সে প্রশ্নের জবাব লিখছেন মওদুদ by সাজেদুল হক
প্রশ্নটি আগেও ছিল। সাংবাদিক নূরুল কবীর তা আবার নতুন করে তুলেছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা নতুন বই ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দি আফটারম্যাথ: ২০০৭-০৮’-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানেই তিনি এ প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের জন্য অনেকে সংবিধানের একটি সংশোধনীকে দায়ী করেন। ওই সংশোধনীতে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়েছিল। মওদুদ আহমদ তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন। কি উদ্দেশ্যে সংবিধানের সে সংশোধনী আনা হয়েছিল মওদুদ আহমদের উচিত ছিল এ ব্যাপারে বইতে ব্যাখ্যা করা।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গতকাল মানবজমিনকে বলেছেন, সে প্রশ্নের জবাব তিনি দেবেন। তিনি বলেন, আমি তখন আইনমন্ত্রী ছিলাম। এ কারণে আমাকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে। কিন্তু কোন ব্যাকগ্রাউন্ডে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা আমি এরই মধ্যে লিখে শেষ করেছি। আরও কিছু কাজ শেষে সে বই প্রকাশিত হবে। ওই বইতে আমি এ ব্যাপারে খোলাখুলিভাবেই বলবো। আমার আরও কিছু ব্যর্থতা ছিল। যেমন সে সময় বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হয়নি, মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। কেন এসব ক্ষেত্রে আমি ব্যর্থ হয়েছি তা-ও বলবো। রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমদ লেখক হিসেবেও বিপুল আলোচিত। তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দি আফটারম্যাথ: ২০০৭-০৮’ নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ১/১১-এর পর কারাবন্দি মওদুদ আহমদ এ গ্রন্থে বয়ান করেছেন সে সময়কার ঘটনাপ্রবাহ। তিনি লিখেছেন, রাজনীতিবিদ, বিএনপি চেয়ারপারসন অথবা লাখ লাখ মানুষের নেত্রীর চেয়েও একজন মা হিসেবে খালেদা জিয়া তার নিজের ভাগ্য অপেক্ষা তার ছেলেদের মুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি তাদের মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন। তার এ দুর্বলতার কথা জানা থাকায় সামরিক মধ্যস্থতাকারীরা কঠোর দর কষাকষিতে লিপ্ত হন। ছায়া সামরিক সরকারের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সমঝোতা প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ লিখেছেন, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খালেদা জিয়া তার মাথা উঁচু করে রেখেছিলেন। হাঁটুতে তার গুরুতর সমস্যা থাকলেও তিনি দেশ ছাড়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি দেশেই চিকিৎসা নিতে চেয়েছিলেন। যে কোন ধরনের প্যারোলেও অনিচ্ছুক ছিলেন তিনি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চারটি দুর্নীতির মামলা ছিল। কিন্তু তার কোনটিতেই বিচারকাজ শুরু হয়নি। সে কারণে খালেদা জিয়া আশা করেছিলেন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়াতেই তিনি মুক্তি পাবেন। শেখ হাসিনার মতো সরকার থেকে কোন ধরনের সুবিধা নেয়ার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। খালেদা জিয়া যখন কারাগারে বন্দি তখন সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য তাকে নানা প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল- (১) দেশত্যাগ না হয় বিচারের মুখোমুখি হওয়া; (২) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না তবে তাকে সব সুযোগ-সুবিধাসহ জাতীয় নেতার মর্যাদা দেয়া; (৩) প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা কাঠামোর ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের সংশোধন। অন্য কথায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা এমনভাবে করা যাতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে। (৪) নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে দু’টি তালিকা ছিল। কাদের মনোনয়ন দিয়ে পুরস্কৃত করতে হবে আর কাদের মনোনয়ন দেয়া যাবে না। আলোচনার ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর তারেক রহমান মুক্তি পান। এর আগে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকেও বিদেশ পাঠানো হয়। তারেক রহমানকে বিদেশ পাঠানোর ব্যাপারে খালেদা জিয়া ও মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত ছিল। শেষ পর্যন্ত তারেক রহমানকেও বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। সরকার ও খালেদা জিয়ার মধ্যে ঠিক কি কি বিষয়ে সমঝোতা হয়েছিল তা বলা কঠিন। কারণ হাসিনার মতো খালেদা কখনও এসব আলোচনার বিষয় প্রকাশ করেননি। তবে ধারণা করা হয় খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশ নেয়ার শর্তটি মেনে নিয়েছিলেন। ওই সময়ের পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জন করাই খালেদা জিয়ার জন্য যৌক্তিক ছিল। জনগণকে বোঝানোর মতো যথার্থ কারণও তার কাছে ছিল। কিন্তু আরও কিছু বিষয় খালেদা জিয়াকে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছিল। ১. বিএনপির নির্বাচন বর্জন দেশকে আবারও বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারতো। যাতে দেশে ২০০৭-এর আগের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির সুযোগ ছিল। যাতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সামরিক বাহিনী আবারও প্রশাসনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেতে পারে এবং দেশকে আবারও তাদের পরিকল্পিত পথে নিয়ে যেতে পারতো। যার জন্য ইতিহাস খালেদা জিয়াকে দায়ী করতে পারতো। ২. এ অবস্থায় তার দলের নেতাকর্মীরা আবার নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হতে পারতেন। তারেক রহমান ও কোকোকেও কোন ছাড় না দেয়ার আশঙ্কা ছিল। ৩. নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে জামায়াতে ইসলামী শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। দলটি খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। খালেদা জিয়ার আশঙ্কা ছিল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের অনুপস্থিতিতে জামায়াত বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এতে চারদলীয় জোট শুধু অকার্যকরই হবে না, বিএনপি মূলধারার ইসলামপন্থি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। ৪. ধারণা ছিল যদি বিএনপি নির্বাচনে না-ও জেতে- অন্তত ১০০ আসনে জয়ী হবে। এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। নির্বাচনে ভরাডুবির কারণও নিজের মতো করে চিহ্নিত করেছেন মওদুদ আহমদ। তিনি লিখেছেন, বিএনপি সরকারের অপশাসন, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গে মিত্রতা, বিএনপি সরকারের কিছু মন্ত্রীর সম্পৃক্ততায় জঙ্গিবাদের উত্থান, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে হাওয়া ভবনের ক্ষমতা, প্রভাব ও দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন ভোটাররা।
No comments