বেপরোয়া ছিনতাই
রাজধানী ও এর বাইরে হঠাৎ করেই ছিনতাই বেড়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার না থাকায় রাজধানীতে ছিনতাইকারী চক্রের এখন মহোৎসব চলছে। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতার সুযোগে তারা আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ফলে নগরবাসীর মধ্যে ছিনতাই-আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। খুনখারাবি, চুরি, ডাকাতির পাশাপাশি ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু তা ঠেকাতে দৃশ্যত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ছিনতাই আতঙ্কে ভুগছেন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা। অহরহই তারা ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ায় এ মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে আতঙ্কে বিকাশ-এর এজেন্টরা। বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের আতঙ্ক দূর করা না হলে এজেন্টরা মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে সেবাটি। এজেন্টদের কাছ থেকে ছিনতাই ছাড়াও সাধারণ মানুষের অর্থও ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে গত পরশু। এদিন দুপুরে প্রকাশ্যে কল্যাণপুর বাসডিপোর সামনে ৩ প্রাইভেটকার আরোহীকে গুলি করে ৩০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন মাল্টিন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সুপারভাইজার শামসুর রহমান, গাড়িচালক আকতার হোসেন ও ফ্ল্যাটক্রেতা জাকারিয়া। এদের মধ্যে আহত শামসুর রহমান, আকতার হোসেন ও প্রাইভেটকার আরোহী বিল্লাল হোসেন (আনসার সদস্য)কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল এবং জাকারিয়াকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। শুধু এ ঘটনায়ই নয়, গত এক মাসে রাজধানীতে ১৫টি বড় ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ঘটনায় ব্যবহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। তবে এসব ঘটনায় জড়িত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ সপ্তাহে আরও একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। গত ২২শে জুন রোববার উত্তরায় বিকাশের এক এজেন্টকে গুলি করে ১১ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় আহত মো. শাহিন নামে একজনকে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া, গেল সপ্তাহে খিলগাঁওয়ে ছানাউল্লাহ নামে এক বিকাশ এজেন্টের ৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। একই সপ্তাহে রামপুরায় ইরান মুন্সী নামের একজনকে গুলি করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। ইরান মুন্সী রামপুরা এলাকার স্কাই ইন্টারন্যাশনালের মালিক ও বিকাশ এজেন্ট। রাজধানীর বাইরেও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা। গত ২২শে জুন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় আতোয়ার হোসেন ও আবদুল আলিম নামে বিকাশের দুই এজেন্টকে কুপিয়ে ৩ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ২৭শে এপ্রিল বরিশালের বিকাশ এজেন্ট সাদ এন্টারপ্রাইজের কর্মীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ১২ লাখ টাকা নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। ১১ই মে মাদারীপুরে বিকাশ এজেন্টের ১৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ১০ই জুন ঝালকাঠিতে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই করা হয় ২৮ লাখ টাকা। এভাবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা। অনেক এজেন্টকেই এতে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৬ মাসের মধ্যে গত এক মাসেই রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি বড় অঙ্কের টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। তাও আবার গুলি করে। ছিনতাইকারীরা অধিকাংশ ঘটনা ঘটাচ্ছে মোটরসাইকেলযোগে এসে। আবার পালিয়েও যাচ্ছে মোটরসাইকেলে। কিন্তু কোন ঘটনাতেই ছিনতাইয়ে জড়িতরা ধরা পড়েনি। সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে রামপুরা থানা ও আশপাশ এলাকায়। রাজধানীতে একের এক ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের চরম ব্যর্থতার অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু নগর পুলিশের এতে কোন মাথাব্যথা নেই। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের প্রতিদিন লেনদেনের সীমা বেঁধে দিলেও অনেকেই তা মানছেন না। এ কারণে তাদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ জমা পড়ছে। এ কারণেও অনেক সময় ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন এজেন্টরা। রাজধানীর মিরপুর এলাকার বিকাশ, ডাচ্-বাংলা ও ইউক্যাশের এক এজেন্ট জানালেন, তিনটি প্রতিষ্ঠানের সেবা দিয়ে থাকি। জমার পরিমাণটাও তাই বেশি হয়। কিন্তু জমা হওয়া অর্থ নিয়ে সব সময়ই আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। একবার ছিনতাই হয়ে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। এ কারণে অন্য কোন ব্যবসার কথা ভাবছি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত এক কোটি ৫৪ লাখ গ্রাহক এ সেবায় যুক্ত হয়েছে। আর এজেন্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন লাখ ২৬ হাজার। ২০১২ ও ২০১৩ সালে যে হারে এ সেবার প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, বর্তমানে তা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। চলতি বছরের এপ্রিলে সচল অ্যাকাউন্টের সংখ্যা এর আগের মাসের তুলনায় ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ কমে ৫৭ লাখ ৬৬ হাজারে দাঁড়িয়েছে। ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ- কমিশনার ছানোয়ার হোসেন জানান, সামপ্রতিক সময়ে যেসব গ্রুপ ছিনতাই করছে তাদের অধিকাংশকে গত বছর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারা এখন জামিনে এসে ছিনতাইয়ে নেমেছে। তাদেরকে ধরার জন্য শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
No comments