নারায়ণগঞ্জ-৫ উপনির্বাচন- অজানা আতঙ্কে নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা
আর মাত্র তিন দিন। ২৬শে জুন নারায়ণগঞ্জ-৫
আসনের উপনির্বাচন। সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই আতঙ্ক বাসা বাঁধছে সাধারণ
ভোটারদের মধ্যে। সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও দাবি উঠেছে। যদিও স্থানীয় আইশৃঙ্খলা
বাহিনী ভোটারদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক
থাকবে বলে। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যাতে ভোট দিতে পারেন তার
সর্বাত্মক চেষ্টা তারা করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি ভোটারদের
অনুকূলে না থাকলে নির্বাচনের দিন আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা
দেবে বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।
এদিকে হত্যা, গুম, সন্ত্রাসের প্রতিবাদের পাশাপাশি এ আসনের মানুষের কাছে উন্নয়নও একটি প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা আর প্রতিশ্রুতির বাণী শুনতে চান না। এবার উন্নয়নের বাস্তবতা দেখতে চান। তারা আরও বলেন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি চাই না, কিন্তু এলাকার উন্নয়ন তো চাই। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের নাকের ওপর একটি মুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর সেটা হলো শীতলক্ষ্যা সেতু। এ সেতু বন্দরবাসীর প্রাণের দাবি। বন্দরের সঙ্গে শহরের সেতুবন্ধ না হলে কখনও এ এলাকার (বন্দর) কাঙিক্ষত উন্নয়ন হবে না। কিন্তু সরকার আসে সরকার যায়, সেতু আর হয় না।
শহরের একজন ব্যবসায়ী আলিম উদ্দিন। বন্দরে তার বাড়ি হলেও ব্যবসা ও সন্তানদের লেখাপড়ার সুবিধার্থে শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূলত লড়াই হবে সেলিম ওসমান (লাঙ্গল) ও এস এম আকরাম (আনারস)-এর মধ্যে। আকরাম একজন ভদ্র-নম্র মানুষ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি এমপি থাকা অবস্থায় এলাকায় আশানুরূপ উন্নয়ন করতে না পারলেও সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিকে প্রশ্রয় দেননি। সরকারি কর্মকর্তা থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসেছেন। দীর্ঘদিন এ দলের সঙ্গে থেকে ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা ও গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কাজ করে দুই দু’বার তাকে বিজয়ী করেন। কিন্তু সিটি নির্বাচনের পর হঠাৎ তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করলেন। এরপর তাকে আর এলাকায় তেমন একটা দেখা যায়নি। এখন তিনি নির্বাচনে মাঠে নেমেছেন। ঠিক আছে। কিন্তু তিনি বিজয়ী হলে তো এলাকার উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখতে পারবেন না। এ সরকার তাকে সেই সুযোগ দেবে না। সন্ত্রাস, গুম আর চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলছেন তা ঠিক। কিন্তু তিনি যখন এমপি ছিলেন তখন তো একই ধরনের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ছিল। তিনি কি পেরেছেন তা বন্ধ করতে? পারেননি। আর সেলিম ওসমানের কথা বলতে গেলে তিনি আগাগোড়াই একজন ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসা ভাল বোঝেন। রাজনীতিতে তিনি দক্ষ না। তবে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন- এটা মানুষ বিশ্বাস করেন। নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে তিনি সবাইকে এক টেবিলে বসানোর যে মেসেজ দিচ্ছেন তা মানুষ পজিটিভভাবেই নিয়েছে। সবাই এক টেবিলে বসলে নারায়ণগঞ্জের চিত্র পাল্টে যাবে। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি অনেকটাই কমে যাবে। আলিম উদ্দিন আরও বলেন, নাসিম ওসমান (প্রয়াত) ও শামীম ওসমানের মতো সেলিম ওসমানের বদনাম নাই। কিন্তু তাদের কর্মকা- সেলিম ওসমানের নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। সেলিম ওসমান ওই প্রভাব কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন তা এখন দেখার বিষয়। তিনি বলেন, এবার ভোটাররা ভেবেচিন্তে ভোট দেবে। আলিম উদ্দিনের মতো একই কথা বললেন, চাকরিজীবী এরফান উদ্দিন, ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন।
বন্দর ধামগড় এলাকার ভোটার ঈমাম হোসেন বলেন, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যিনিই বিজয়ী হোন ভোটের ব্যবধান অনেক থাকবে। কিন্তু আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারবো কিনা সেটাই ভাবছি। তিনি বলেন, অনেক ভোটারের মধ্যে আতঙ্ক আছে। পরিবেশ শান্ত থাকলে মানুষ ভোট দিতে যাবে। না হলে যাবে না।
আকরামের শঙ্কা: আগামী ২৬শে জুন অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম আকরামের আশঙ্কা- নির্বাচনের দিন অনেক অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে। কারণ ইতিমধ্যে বন্দরে একটি নির্বাচনী সভায় সেলিম ওসমানের এক সহযোগীর কাছ থেকে বৈধ অস্ত্র খোয়া গেলেও পরে সেটা উদ্ধার করা হয়। এতেই বোঝা যায় সেলিম ওসমানরা অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করবেন। সে জন্য আগামী নির্বাচনের আগে থেকেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান করতে হবে।
গতকাল দুপুরে শহরের সেন্ট্রাল খেয়াঘাটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আকরাম এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি এখন নির্বাচনের সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করে আসছি। সেনাবাহিনী ছাড়া এ নির্বাচন কোনভাবেই সুষ্ঠু হবে না। সেলিম ওসমানের নির্বাচনী প্রচারণার নামে প্রতিনিয়ত আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রশাসনও এখন পক্ষপাতিত্ব শুরু করেছে। সেলিম ওসমান রঙিন পোস্টার সাঁটালেও কোন প্রতিকার হচ্ছে না। আকরাম দুপুরে শহরের কাছারিগল্লিসহ আশপাশের এলাকায় গণসংযোগ করেন।
এস এম আকরামের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন পরিচালনা পরিষদের উপদেষ্টা ও ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোর সদস্য শফিউদ্দিন আহমেদ, পরিষদের আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক ও গণফোরাম জেলা শাখার সভাপতি দেলোয়ার হোসেন চুন্নু, জেলা সিপিবির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিমাংশু সাহা, যুগ্ম সদস্য সচিব ও খেলাঘর আসরের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকম-লীর সদস্য জহিরুল ইসলাম জহির, আওয়ামী লীগ নেতা মামুন, আরমান, জেলা বাসদের সমন্বয়ক নিখিল দাস প্রমুখ।
বন্দর থেকে শুরু করে সোনারগাঁ পর্যন্ত শিল্পায়ন করা হবে -সেলিম ওসমান: বন্দর উপজেলার পুরানবন্দর চৌধুরীবাড়ী এলাকায় নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী সেলিম ওসমানের নির্বাচনী মতবিনিময় সভা সর্বদলীয় মতবিনিময় সভায় পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির পাশাপাশি নির্বাচন বর্জনকারী দল ১৯ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দেয়া বিএনপি ও অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলাম সমর্থন জানিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়েছিল।
এ সময় সেলিম ওসমানের পক্ষে ভোট চেয়ে বক্তব্য রাখেন বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার জামায়াত নেতা খোকা মোল্লাসহ বন্দর থানা ছাত্রদলের হুমায়ুন মোল্লা, বন্দর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরীফ মোল্লা, বিএনপির সমর্থক শহীদ মোল্লা ও আরিফ মোল্লা। এ সময় তারা সেলিম ওসমানকে উন্নয়নের স্বার্থে বিপুল ভোটে বিজয়ী করার আহ্বান জানান। পাশাপশি সেলিম ওসমানের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক এমপি এস এম আকরামকে প্রতিবন্ধী বলে আখ্যা দেন।
শনিবার রাত ১১টায় বন্দর ইউনিয়নের পুরানবন্দর চৌধুরীবাড়ী এলাকায় নির্বাচনী মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ও উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী সেলিম ওসমানের নির্বাচনী মতবিনিময় সভা সর্বদলীয় সভায় পরিণত হয়। সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রয়াত নাসিম ওসমানের সহধর্মিণী পারভিন ওসমান।
প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বন্দর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রবের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার জামায়াত নেতা খোকা মোল্লা, থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নাজমুল ইসলাম আরিফ, জাতীয় পার্টির নেতা রশিদ কনট্রাক্টর, মাঈনউদ্দিন মানুু, খোকা মেম্বার, শাহাবুদ্দিন সাবা, ইবনে সাইদ, আলী হোসেন মোল্লা, নজরুল ইসলাম টিটু, সালাউদ্দিন মিলন, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবুল জাহের চেয়ারম্যান, নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক খালেদ হায়দার খান কাজল, বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লিটন সাহা প্রমুখ।
সভায় সেলিম ওসমান বলেছেন, শ্রমিকরাই বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কোন মালিক বা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা নেই দেশ বাঁচিয়ে রাখার। আমি একজন শ্রমিক। আমার অনেক মালিক ভাইসহ অনেকে অনেক বড় বড় কথা বলেন। আমি তাদের বলতে চাই, যত টাকাই নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন না কেন শ্রমিক না থাকলে আপনার ব্যবসার কোন উন্নতি হবে না, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন না হলে দেশের উন্নয়ন হবে না। তাই দেশের উন্নয়ন করতে হলে শিল্পায়ন প্রয়োজন। বন্দরে শীতলক্ষ্যা সেতু হলে বন্দর থেকে শুরু করে সোনারগাঁ পর্যন্ত শিল্পায়ন করা হবে। তখন বন্দরের শ্রমিকরা বাড়ির ভাত খেয়েই কাজ করতে পারবেন। বন্দরের মানুষ নারায়ণগঞ্জে যাবে না। বিশ্ব বাজার থেকে উদ্যোক্তারা এসে বন্দরে শিল্পায়ন হবে।
গামছার পক্ষে কাদের সিদ্দিকীর প্রচারণা: এদিকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার (গামছা) হত্যা, গুম, রাহাজানি বন্ধে মানুষের জান-মাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গামছা প্রতীকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, বর্তমান সরকার আফ্রিকান মাগুরে পরিণত হয়েছে। আফ্রিকান মাগুর যেমন সব কিছু খাওয়া শেষ হলে নিজেরাই নিজেদের খায়, তেমনি বর্তমান সরকার দেশের সব কিছু খাওয়া শেষ করে এখন নিজেরাই নিজেদের খাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন সেটারই আলামত।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে শনিবার বিকালে বন্দর উপজেলায় আয়োজিত বিভিন্ন নির্বাচনী পথসভায় শনিবার বিকালে তিনি এসব কথা বলেন।ড়বর্তমান জনসমর্থনহীন সরকারকে লাল কার্ড দেখাতে তিনি গামছা মার্কায় ভোট প্রার্থনা করেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেন, এ সংসদ বেশি দিন থাকবে না, ভারতে কংগ্রেসের পরাজয়ে বর্তমান সরকারের প্রাণভ্রমরা মরে গেছে। বন্দর উপজেলার উত্তর লক্ষণখোলা, ইস্পাহানি বাজার, বক্তারকান্দি নবীগঞ্জ ও বন্দরে আয়োজিত নির্বাচনী সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দলের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী, প্রার্থী শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার, হাবিবুননবী সোহেল, বিল্লাল হোসেন প্রমুখ।
সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে মামুনের স্লোগান: এদিকে বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগকালে স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল মজিদ মামুন (চিংড়ি মাছ) ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচিত হলে সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করতে চাই। তরুণ প্রজন্মের কথা সংসদে বলতে চাই। আমি আপনাদের পাশে থেকে এলাকার উন্নয়ন করবো।
No comments