ফরমালিন থেকে বাঁচার উপায় কী?
বাংলাদেশে কত রকমের খাদ্যদ্রব্যে কত ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়, তার কোনো লেখাজোখা নেই। সে রকম একটা তালিকা পাওয়া গেলে মন্দ হতো না; কিন্তু সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ তেমন তালিকা তৈরি করেছে—এমন খবর পাওয়া যায় না। আমরা শুধু মাঝেমধ্যে হঠাৎ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখি। একটি বা দুটি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু হয়ে যায়। এই মুহূর্তে সে রকম অভিযান চলছে ফরমালিনের বিরুদ্ধে। আম-লিচুর এই ভরা মৌসুমে টনকে টন আম-লিচু ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে এই অভিযোগে যে সেগুলোতে ফরমালিন মেশানো হয়েছে। এ অভিযান এমনই বেপরোয়া আকার ধারণ করেছে যে ফল বিক্রেতারা এর প্রতিবাদে ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা এমন হুমকিও দিচ্ছেন যে অভিযানের নামে হয়রানি বন্ধ করা না হলে তাঁরা এমনকি ফল আমদানি বন্ধ করে দেবেন। উভয় পক্ষেই বাড়াবাড়ি আছে। ফলমূল ফরমালিনমুক্ত করার তথাকথিত অভিযানটি বেপরোয়া। অভিযানের পরিকল্পনাকারী ও পরিচালকেরা সম্ভবত ভাবছেন যে এর মধ্য দিয়ে যে ভীতি সঞ্চারিত হবে, তার ফলে ফলমূলে ফরমালিন মেশানোর প্রবণতা কমে যাবে। কারণ, তাতে ক্ষতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি; ধরা পড়লে সর্বস্বান্ত হওয়ার আশঙ্কা যে অত্যন্ত প্রবল, এই অভিযানের মধ্য দিয়ে তা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এ ধরনের অভিযানের কিছু সুফল ফলতে পারে বটে, কিন্তু তা নিতান্তই সাময়িক হয়ে থাকে। এভাবে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না।
অন্যদিকে ফল বিক্রেতাদের ধর্মঘটে নামাটাও বাড়াবাড়ি। ধর্মঘটের মতো চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাঁদের উচিত ছিল এ ব্যাপারে বক্তব্য পরিষ্কার করা। তাঁরা আসলে কী বলতে চাইছেন? অভিযানের নামে তাঁদের অহেতু হয়রানি করা হচ্ছে? ফল বিক্রেতাদের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ভুল যন্ত্রের সাহায্যে ফরমালিনের মাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এভাবে ফরমালিনের সঠিক উপস্থিতি নিরূপণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার মানে তো এটা নয় যে, ফলে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে না। ফরমালিনযুক্ত ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে মানুষ অসুস্থ হবে, এমন কোনো কথা নেই। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের ওপর, বিশেষ যকৃৎ, কিডনি ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর ফরমালিনসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়া ঘটে দীর্ঘ মেয়াদে। এ দেশে নানা ধরনের ক্যানসার, কিডনি ও যকৃতের রোগীর সংখ্যা বছরে বছরে বেড়ে চলেছে; নিউরোবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। এসবের পেছনে খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো এবং বিশেষত কৃষিকাজে কীটনাশক-বালাইনাশকের ব্যাপক ব্যবহারের ভূমিকা রয়েছে—এমন কথা বিশেষজ্ঞদের কাছে শোনা যায়। সুতরাং ফরমালিনবিরোধী অভিযানের নামে ফল বিক্রেতাদের হয়রানির অভিযোগ ও তার প্রতিবাদে তাঁদের ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে এই সত্য মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে না যে ফলমূলসহ বিভিন্ন পচনশীল খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হচ্ছে এবং তার ফলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কী? প্রথমত, এটা এমন এক গুরুতর জাতীয় সমস্যা, মাঝেমধ্যে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে যার স্থায়ী সমাধান ঘটানো সম্ভব নয়। ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধসহ পচনশীল খাদ্যদ্রব্যের পচন রোধ করার উদ্দেশ্যে ফরমালিন মেশানো হয় কেন—এই গোড়ার প্রশ্নে যেতে হবে সবকিছুর আগে।
কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে, বিপুল পরিমাণ কৃষিপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। রাস্তাঘাট ও যান চলাচলব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত কৃষিপণ্য পরিবহনে অনেক সুবিধাও হয়েছে। ফলে কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পাচ্ছেন, যা আগে পেতেন না। কিন্তু উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পচনশীল পণ্যদ্রব্যের সংরক্ষণব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে পরিবহনের সময় যেন পচে না যায়, এমন ব্যবস্থা তো এ দেশে গড়ে তোলা হয়নি। এটা খুবই স্বাভাবিক যে কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন পচনশীল খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্য পচতে দেবেন না, কারণ তাতে তাঁদের লোকসান। এই লোকসান থেকে তাঁরা বাঁচতে পারতেন যদি দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক হিমাগার নির্মাণ করা হতো এবং হিমাগারযুক্ত পণ্য পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা হতো। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও কৃষিপণ্য মজুত ও পরিবহনের জন্য হিমাগারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি। এ দেশে তো আলু সংরক্ষণের জন্যই পর্যাপ্তসংখ্যক হিমাগার নেই। অথচ এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। সরকারি ও বেসরকারি—উভয় তরফেই হিমাগারব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত; সরকারের দায়িত্ব পর্যাপ্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা। হিমাগারব্যবস্থা ছাড়াও পচনশীল পণ্যদ্রব্যের পচন এড়ানোর অনেক আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। যেমন, মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকর নয় এমন সহনীয় মাত্রার তেজস্ক্রিয় গামারশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে ফল ও অন্যান্য পচনশীল দ্রব্যের পচন সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রযুক্তি ইউরোপ-আমেরিকায় এখন বহুল প্রচলিত। এ ছাড়া অর্গানিক কিছু প্রযুক্তিও উদ্ভাবিত হয়েছে,
যা মানবস্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত নিরাপদ। বাংলাদেশে সেসব প্রযুক্তি আমদানির চেষ্টা করেছেন এমন কিছু ব্যক্তি-উদ্যোক্তার কাছে জানা গেছে, সরকারের তরফে এ ব্যাপারে নানা রকমের বিধিনিষেধ রয়েছে, যেগুলো অনেক পুরোনো। পরিবর্তিত প্রযুক্তিগত বাস্তবতায় এ ব্যাপারে সরকারি বিধিনিষেধগুলো পুনর্বিবেচনা করে দেখা উচিত। দেশজুড়ে পর্যাপ্তসংখ্যক হিমাগার গড়ে তোলা এবং হিমাগারযুক্ত পণ্য পরিবহনব্যবস্থা চালু করা অনেক ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু চূড়ান্ত বিবেচনায় আমাদের সেদিকে যেতেই হবে। তবে তার আগে আশু কতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, ফরমালিন আমদানি ও কেনাবেচা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে। বিজ্ঞান গবেষণাগার, খেলনা, আসবাবশিল্প, ট্যানারি ও মেডিকেল প্রভৃতি খাতে ব্যবহারের জন্য মোট ফরমালিনের চাহিদা ১০০ টন৷ অথচ এ দেশে মোট আমদানি করা হয় ৫০০ টন ফরমালিন৷ বাকি ৪০০ টন ফরমালিন কেন আমদানি করা হয়? সেগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়? এতেই বোঝা যায়, এ দেশে ফরমালিন কেন সুলভ ও সস্তা৷ হিমাগার কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত পচনরোধী প্রযুক্তি—কোনোটাই যখন নেই, তখন ফরমালিন যদি এত সুলভ ও সস্তা হয়, তাহলে ফলমূলসহ পচনশীল খাদ্যদ্রব্যের বিপণনকারী-ব্যবসায়ীদের ফরমালিন ব্যবহার থেকে নিরস্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাঁরা জেল-জরিমানা ও ব্যাপক লোকসানের ঝুঁকি নিয়েই তাঁদের পণ্যে ফরমালিন মেশাবেন, কারণ এভাবেই শুধু তাঁরা তাঁদের পণ্যের পচনজনিত লোকসান থেকে বাঁচতে পারেন। তাই বিজ্ঞান-গবেষণা ও কিছু নির্দিষ্ট শিল্পে ব্যবহারের বাইরে আর কোনো প্রয়োজনে কেউ ফরমালিন আমদানি করতে পারবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের ভেতরে যে কেউ চাইলেই ফরমালিন কিনতে পারবে—এই অবস্থারও অবসান ঘটানো জরুরি। ফরমালিন মেশানোর পর শত শত টন আম জব্দ করে ধ্বংস করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই; আমে কিংবা যেকোনো খাদ্যদ্রব্যে মেশানোর জন্য ফরমালিন যেন কেউ কোনোভাবেই সংগ্রহ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কাজ।
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
No comments