একটি শটগান আর ভিআইপিকুলের দাপট by কুর্রাতুল-আইন-তাহমিনা
ভদ্রলোকটি ঘুমের মধ্যে ডান কাত হলেন।
তারপর উসখুস করে উঠে বসলেন। প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন
তিন-চারটি হৃষ্টপুষ্ট বড়সড় তরতাজা গুলি। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সেগুলো তাঁর
১১-১২ বছর বয়সী মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে জরির ফুলতোলা কুশনে মাথা রেখে
ভদ্রলোকটি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। মেয়েটি গুলিগুলো তার মায়ের হাতে দিল। মা
সেগুলো তাঁর হাতব্যাগে পুরলেন।
পদ্মার পানি কেটে আমাদের ‘রো রো’ অর্থাৎ টানা-ফেরিটি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে এগিয়ে চলল মাদারীপুরের দিকে। আমরা বসেছি ফেরিটানা জাহাজের ইঞ্জিনের গহ্বরের ওপরকার তক্তা বিছানো উঁচু পাটাতনে। আমার সঙ্গে আমার সাত বছর বয়সী মেয়ে আর দুজন প্রবীণ সুহৃদ। আমাদের বঁা পাশে সফেদ-দাড়ি এক বৃদ্ধ আর তাঁর স্ত্রী একরাশ লিচু খাওয়া শেষে ঢুলছিলেন। ডান পাশে ওই ভদ্রলোক, তাঁর ছোট পরিবার, এবং তাঁর খোলামেলা বন্দুক।
বয়ানটা গোড়া থেকে শুরু করি। ১৯ মে, সোমবার সকালে মাওয়াঘাটে পৌঁছে ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করার পর মাদারীপুরের ফেরি পেয়েছি। ওপারে পৌঁছাতে টানা-ফেরির দুই ঘণ্টা লাগবে। আমরা পাটাতনে বসার অল্প পরেই আমার ডান পাশে ঝপ করে একটা চাদর পড়ল, আর পড়ল জরিদার দুই কুশন। তারপর ঝুপ করে পড়ল সিসা-রঙের ফুট দেড়েক লম্বা এক বন্দুক। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি, বন্দুকটি সামনে প্রতিষ্ঠা করার পর ৩৫-৪০ বছর বয়সী গাট্টাগোট্টা এক ভদ্রলোক শোয়ার উদ্যোগ করছেন। তাঁর পরনে খাকি কাপড়ের বুশশার্ট গোছের একটি শার্ট। শার্টের বুকপকেটের ওপর লেবেলে লেখা ‘স্পেশাল ফোর্স’।
ততক্ষণে চাদরের ওপর এসে বসেছে হাসিখুশি ছোট মেয়েটি ও তার ঈষৎ চঞ্চল ছোট ভাই। একপ্রান্তে বসেছেন ওড়নার ঘোমটা-টানা তাদের মা। আমার নিজের ভাই কাছেপিঠে হাঁটাহাঁটি করছিল। ফেরিভর্তি মানুষের সামনে বন্দুকের খোলামেলা সদম্ভ অবতরণ তারও চোখে পড়েছে। পরে সে-ই আমাকে বলেছে, সেটা একটা শটগান। ঘরে ফিরে গুগ্ল করে শটগানের ছবি দেখেছি। ভদ্রলোকের বন্দুকটি অবিকল তেমনই দেখতে বটে।
সে কথা যাক। ফেরিতে ফেরত যাই। আমরা আত্মীয়-সুহৃদদের একটি বড় দল মাদারীপুরের শিবচরের এক গ্রামে যাচ্ছিলাম অত্যন্ত কাছের এক আত্মীয়র মৃত্যু-পরবর্তী অনুষ্ঠানে। তবে অস্ত্রের এমন খোলামেলা প্রদর্শন বিক্ষিপ্ত ও ভারাক্রান্ত মনেও দাগ কাটল। এদিকে মেয়ের হাতে গুলি চালান দেওয়ার বেশ খানিকক্ষণ পরে ভদ্রলোকটির ঘুম ভাঙে। তিনি উঠে বসেন এবং আমার মেয়ের সঙ্গে সস্নেহ কৌতুকে মাতেন। তাঁর চমৎকার মেয়েটির সঙ্গেও আমার মেয়ের কিছুটা ভাব হয়। ভদ্রলোকটির কাছে জানতে চাই, তিনি কী করেন। বললেন, ব্যবসা। বন্দুকটি দেখিয়ে বলি, ‘এটা’? তিনি বলেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত লাইসেন্স করা অস্ত্র। তাঁর স্ত্রী বলেন, তাঁরা ঢাকায় থাকেন। শিবচরে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছেন। তিনিই অস্ফুটে বলেন, স্বামী সরকারি দলের রাজনীতি করেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন কি? কথাটা স্পষ্ট হলো না। ফিরে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। নাম-পরিচয়ও বিনিময় করা হয়নি। ফেরি শিবচরের কূলে ভিড়লে যে যার পথে চলে যাই।
শেষ বিকেলে আমরা আবার ফেরিঘাটে। একটি ঘাটে ঢোকার মুখে শুনি, ‘ভিআইপি’ ঢাকায় ফিরবেন বলে ফেরি অপেক্ষা করছে। স্থান পাওয়া অনিশ্চিত। অন্য ঘাটের দিকে যাই। ঘাটের পথের মুখেই নীল উর্দি পরা এক ব্যক্তি সব গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। আমরা তাঁর চোখ এড়িয়ে ঘাটের কাছে যেতে পারি বটে কিন্তু সেখানেও ফেরি ভিআইপির আগমনের অপেক্ষায়। তাঁদের বহর উঠলে তবে স্থান পাওয়ার প্রশ্ন। হেঁটে আমরা আবার আগের ঘাটের সামনে ফিরি। আমাদের গাড়ি লম্বা লাইন ধরে আসতে থাকে। সেই লাইনে একটি অ্যাম্বুলেন্সকেও দেখি।
এ ঘাটের ফেরি তখনো ‘ভিআইপি’র জন্য বাঁধা। আমাদের জন্য একই অনিশ্চয়তা। ফেরির লোকজন মহাব্যস্ত। মোবাইলে ব্যবস্থাপনা নিয়ে উৎকণ্ঠিত আলাপের টুকরো টুকরো কথা কানে আসে। কারা ভিআইপি? নৌমন্ত্রীর নাম শুনি। ‘এমপি’ আর সরকারি কর্মকর্তাদের কথাও শুনি। এ ঘাট থেকে ও ঘাটে ঠেলাধাক্কা খেতে খেতে ততক্ষণে প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। ‘ভিআইপি’দের উপদ্রব আর পাবলিকের হেনস্তা নিয়ে আমার গজগজও ততক্ষণে সবার কানে যাওয়ার মতো সরব হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে একটি বিশাল ঝাঁ চকচকে ঘননীল জিপজাতীয় গাড়ি ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়।
গাড়িটির পেছনে গণ্যমান্যদের এক কাফেলা। সে কাফেলায় সকালের শটগান-প্রদর্শক ভদ্রলোকটিকেও দেখি। এখন তাঁর পরনে ধোপদুরস্ত ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবি। তিনি চিনতে পারার হাসি মুখে নিয়ে এগিয়ে এসে মাদারীপুর-৩ আসনের সরকারদলীয় সাংসদের আগমনবার্তা দিলেন। হঠাৎ নীল গাড়ির জানালার অস্বচ্ছ কাচ নেমে যায়। সাংসদ বাহাউদ্দিন নাছিম মুখ বাড়িয়ে জানতে চান, আমার সমস্যা কী। সওয়াল-জবাবের উত্তাপে কিছুক্ষণ যায়। তারপর একসময় এমপির গাড়ি ফেরিতে ওঠে। আমরা তখনো ঘাটে দাঁড়িয়ে। এমপি নেমে এসে বলেন, তিনি ফেরি দাঁড় করাতে বলেননি। আমাদের গাড়ির নম্বরও তিনি জানতে চান, ফেরিতে ওঠানোর ব্যবস্থা করে দেবেন বলে। সবিনয়ে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বলি, তার দরকার নেই। আমরা লাইন ধরেই উঠব। তিনি ফিরে যান। তাঁর পারিষদেরা জোরাজুরি করতে থাকেন আমাদের গাড়িকে ফেরিতে ওঠাবেনই ওঠাবেন।
এই নাটক চলতে চলতে দেখি অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরিতে উঠতে পারল। ক্রমে আমাদের গাড়িটিও উঠল। ফেরির এক কর্মচারী আমাদের বললেন, এই ফেরিতে অনেক ভিআইপির চাপ থাকে। তদুপরি দিনটি ছিল, ফরিদপুর-মাদারীপুরের দুই সহোদর দঁুদে এমপির পিতার মৃত্যুবার্ষিকী। সুতরাং ফেরি সেদিন তারকাপিষ্ট, ভিআইপি-কবলিত। আগে একদিন জনৈক মন্ত্রীর ভাইয়ের স্ত্রীর ‘ভিআইপি’ হওয়ার কথাও শুনলাম।
অবশেষে ফেরি যখন ছাড়ল, তখন সন্ধ্যার ছায়া নেমেছে৷ আমরা ছাদে উঠে বেঞ্চিতে বসলাম। মাগরিবের নামাজের সময় হলে আমার মামা অন্য পাশে জামাতে শামিল হলেন। পশ্চিমের আকাশে মেঘের স্তরে স্তরে তখন গোলাপি আলোর রেখা। আরও পরে ফেরির বড় বাতির আলো ঘিরে আগুনের ফুলকির মতো পোকাদের ওড়াওড়ি দেখিয়ে আমার মেয়ে বলল, ‘মা, জোনাকিরা আসলে হচ্ছে তারা। তারারা পড়ে গিয়ে জোনাকি হয়।’ একটু পরে আকাশভরা তারার মধ্যে সে পরিবারের সদ্য চলে যাওয়া প্রিয় সদস্যকে খঁুজে পাওয়ার ঘোষণা দিল।
গুম, নিখোঁজ আর লাশ উদ্ধারের অরাজক এই সময়ে ব্যক্তিগত শোক, শটগানের বেআইনি ও সদম্ভ প্রদর্শন আর দাপুটে ভিআইপিদের কথা খুব বড় কিছু হয়তো নয়। কিন্তু সবকিছু কেমন মিলেমিশে গেছে। ভদ্রলোকটির শটগান আমাকে খুবই বিচলিত করছে।
কুর্রাতুল-আইন-তাহমিনা: সাংবাদিক৷
No comments