চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির রূপকার by রাজীব সরকার
বিদ্রোহী কবি ও জাতীয় কবি বলে যিনি বহুল
পরিচিত সেই কাজী নজরুল ইসলামের উপযুক্ত মূল্যায়ন এখনও আমরা করতে পারিনি
বলেই আমি মনে করি। ব্রিটিশ শাসনামলে যিনি কাফের আখ্যায়িত হয়েছিলেন, মুনশী
রেয়াজুদ্দীন আহমেদ যাকে সন্দেহ করে বলেছিলেন, লোকটি মুসলমান না শয়তান? সেই
নজরুলকে পাকিস্তান আমলের শেষ পর্বে হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ-এর বিপরীতে
মুসলমান কবির তকমা পরিয়ে দেয়া হয় এবং এই তকমাই যে শেষ পর্যন্ত তাকে স্বাধীন
বাংলাদেশের জাতীয় কবির মুকুট (?) প্রাপ্তিতে সহায়ক হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো
সন্দেহ নেই। শুধু দৈহিকভাবে নয়, চৈতন্যের দিক থেকেও যদি নজরুল তখন জীবিত
থাকতেন তবে তাকে নিয়ে এসব তুঘলকি কাণ্ডে তিনি যে ক্ষুব্ধ হতেন তাতেও কোনো
সন্দেহের অবকাশ নেই। বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও লেখক যতীন সরকার দেখিয়েছেন,
সামগ্রিক নয়, খণ্ডিত মূল্যায়নের শিকার হয়েছেন নজরুল। মুসলিম
স্বাতন্ত্র্যবাদী, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী, মার্কসবাদী- এভাবে প্রত্যেকেই
নিজের সুবিধামতো নজরুলকে খণ্ডিত করেছেন। অখণ্ড নজরুল তাদের জন্য বিব্রতকর।
নজরুলের সামগ্রিক তথা প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটন ছাড়া কীর্তিমান এ ব্যক্তিত্বের
প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র।
নজরুলের প্রকৃত পরিচয় অনুধাবন করতে হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তাকে বিবেচনা করতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস হাজার বছরের। এ অঞ্চলের জীবনাচরণে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে, চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে, নাটকে বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল্য প্রতিফলিত। বাঙালি সংস্কৃতির ধারা গত কয়কশ বছরে বিশেষ কোনো ছকে রূপান্তরিত হয়েছে এমন বলা যাবে না। বিভিন্ন মত-পথ-পন্থা, তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও মূলধর্মগুলোর আদর্শগত দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে বিশাল গ্রামীণ জনপদে গ্রহণ বর্জন সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একটি মৌলিক ধারা ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ সংস্কৃতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর সমন্বয়ধর্মী ধারা। শুধু সমন্বয়ধর্মী নয়, মানবতাবাদীও। বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর থেকে ইসলাম ধর্ম এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করে। দেশজ সংস্কৃতি ও ইসলাম পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। পাঠান রাজত্বেও এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি পৃষ্ঠপোষকতা পায়। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসনামলে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য সমাদৃত হয় এবং দেশীয় পণ্ডিত-কবিবৃন্দ ও পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনে সক্ষম হন। এ সময় যথার্থ অর্থেই একটি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির উত্থান ঘটে। একদিকে শ্রীচৈতন্যের ভক্তিবাদ ও ভালোবাসার বাণী এবং অন্যদিকে সুফি সাধকদের মানবতাবাদী মতবাদ- এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এক অসামান্য সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে।
এভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে সব ধর্মের ও নানা লোকচর্চার সমন্বয়ে চিন্তা-চেতনা মানবিক অন্তঃসারযুক্ত হওয়াতে এ ধারাটি প্রাণবন্ত ও গতিশীল হয়ে ওঠে। এ ধারাটির প্রকাশবাহন হয়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বুলি- আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। সমাজজীবন ও ভাষার এ মেলবন্ধনের মধ্যেই বাঙালির স্বকীয় জীবনঘনিষ্ঠ ও গভীরভাবে মানবিক এক সংস্কৃতি বিরাজমান। এ সংস্কৃতি বাঙালি হিন্দুর নয়, বৌদ্ধের নয়, খ্রিস্টানের নয়, মুসলমানের নয়- এ সংস্কৃতি বাঙালির সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির ভিত্তি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।
বাঙালি সংস্কৃতির এ সমন্বয়বাদিতা ও লৌকিক ঐতিহ্য স্বীকৃতি পেয়েছে বহু শাস্ত্র বিশারদ মনীষী ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় সরকারের মূল্যায়নে। বাঙালিরা আদিতে হিন্দু ছিল, পরে সেই হিন্দু বাঙালিদের থেকেই অনেকে বৌদ্ধ, মুসলমান বা খ্রিস্টান হয়েছে- প্রচলিত এ ধারণা তিনি সমর্থন করতেন না। তার মতে বাঙালির আসল ধর্ম হচ্ছে বাঙালি ধর্ম। এ বাঙালি ধর্ম মানে বাঙালি সংস্কৃতির অন্তঃসারের সমন্বয় তথা লৌকিক ঐতিহ্য।
বিনয় সরকারের মতো প্রখর মনীষীর দীপ্তি তথা পঠিত অনেক বুদ্ধিজীবীরই নেই। বাঙালি ধর্মের তাৎপর্যটি বুঝে উঠতে পারেন না বলে ওই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা নজরুলকেও বুঝতে পারেন না। এমনই একজন লেখক-বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদ। আমার অবিশ্বাস বইয়ে তিনি নজরুলকে অভিহিত করেছেন বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান হিসেবে। একাধিক ধর্মের প্রতি নজরুলের প্রীতির নিদর্শন উদ্ধৃত করে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন-
“নজরুলের বিশ্বাসও সন্দেহজনক, মনে হয় তিনি এক বিশ্বাসের সঙ্গে আরেক বিশ্বাসের পার্থক্য বোঝেন না। বিধিবদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো কঠোর, একটি মানলে আরেকটি মানা যায় না, ইসলাম মানলে হিন্দু ধর্ম মানা যায় না, একই সঙ্গে কেউ হতে পারে না মুসলমান ও হিন্দু; কিন্তু নজরুল তার এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আগের বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে। আমি বিস্মিত হই যিনি লেখেন আল্লাহ আমর প্রভু, আমার নাহি ভয়।/আমার নবী মোহাম্মদ, যাহার তারিফ জগৎময়, তিনি কী করে লিখতে পারেন কালী কালী মন্ত্র জপি বসে লোকের ঘোর শ্মশানে; বল রে জবা বল্! কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল... এমন বহু পৌত্তলিক পদ। তিনি কি একই সঙ্গে হতে পারেন খাঁটি মুসলমান আর কালীভক্ত?”
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও নজরুল যে বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী নির্যাসটুকু তার চৈতন্যে ধারণ করেছিলেন তা দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে অনেকেরই আবার জেনেশুনে সেদিকে দৃষ্টি দিতে চাননি অনেকেই। বাল্যকালেই লেটো গানে হাতেখড়ি হয় নজরুলের। বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রকরণ লেটো লোককবিতা সমন্বয়ধর্মী বাঙালি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের ধারক। সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে তিনি লেটোর জন্য যেমন লিখেছেন কারবালার শোকাতুর ঘটনা নিয়ে পালা, তেমনি লিখেছেন রামায়ণভিত্তিক মেঘনাদবধ পালা। ইসলামী ঐতিহ্য ও হিন্দুপুরাণ উভয় উৎস থেকেই নজরুল সৃষ্টির উপকরণ গ্রহণ করেছেন বাল্যকাল থেকেই।
গ্রহণ ও আত্মীয়করণের ক্ষমতা বাঙালি সংস্কৃতির অসামান্য। বিদেশি ভাষার বহুশব্দ ও সাংস্কৃতিক উপকরণ বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে। উত্তর ভারতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণ থেকে রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণের মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গেছে। আরব-পারস্যের কাহিনী ঐতিহ্য ও সমাদৃত হয়েছে দোভাষী পুঁজিতে যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ বাঙালি সংস্কৃতিতে মর্যাদা পেয়েছে ঘরের মানুষের মতো।
বাঙালি সংস্কৃতির এ আত্মীকরণের গুণটি নজরুল সাহিত্যে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, সেভাবে আর কারও সাহিত্যে সম্ভব হয়নি। অপ্রতিম নৈপুণ্যে তিনি আরবি-ফার্সি শব্দের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তার রচনায়। একই সঙ্গে শ্যামা সঙ্গীত, বৈষ্ণবপদ ও হামদ-নাত, ইসলামী সঙ্গীত রচনায় যে পারদর্শিতা নজরুল দেখিয়েছেন তা এক কথায় নজিরবিহীন। নজরুলের এ অদ্বিতীয় প্রতিভার তাৎপর্য হুমায়ুন আজাদ অনুধাবন করতে না পারলেও তার আদর্শিক গুরু বহুমাত্রিক লেখক বুদ্ধদেব বসু কিন্তু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ঠিকই। রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হওয়ার আপ্রাণ প্রয়াসে লিপ্ত তিরিশের আধুনিক কবিদের দলপতি বুদ্ধদেব বসু লক্ষ্য করেছেন- “... সত্যেন্দ্রনাথকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই সংলগ্ন, কিংবা অন্তর্গত, আর নজরুল ইসলামকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবি- ক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই, কিন্তু নতুন।...কবিতার যে আদর্শ নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, নজরুলও তা-ই, কিন্তু নজরুল বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন তার জীবনের পটভূমিকার ভিন্নতায়। মুসলমান তিনি, সেই সঙ্গে হিন্দু মানসও আপন করে নিয়েছিলেন- চেষ্টার দ্বারা নয়, স্বভাবতই। তার বাল্য-কৈশোর কেটেছে শহরে নয়, মফস্বলে; স্কুল-কলেজে ভদ্রলোক হওয়ার চেষ্টায় নয়, যাত্রাগান লেটোগানের আসরে; বাড়ি থেকে পালিয়ে রুটির দোকানে, তারপর সৈনিক হয়ে। এই যেগুলো সামাজিক দিক থেকে তার অসুবিধে ছিল, এগুলোই সুবিধা হয়ে উঠল যখন তিনি কবিতা লেখায় হাত দিলেন। যেহেতু তার পরিবেশ ছিল ভিন্ন এবং একটু বন্য ধরনের আর যেহেতু সেই পরিবেশ তাকে পীড়িত না করে উল্টো আরও সবল করেছিল তার সহজাত বৃত্তিগুলোকে, সেই জন্য, কোনোরকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না- নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে পালাতে পারলেন তিনি, বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত আনতে পারলেন।”
বাংলা কবিতায় নতুন রক্তের ধারা নজরুল বইয়ে দিতে পেরেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি ধর্মের প্রকৃত মর্মটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই। আবহমান বাংলা ছিল তার চৈতন্যে। বাংলার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, বাঙালির বাইরে আদিবাসী সম্প্রদায় যারা যুগ যুগ ধরে এ বাংলারই অধিবাসী তাদের কাছ থেকেও তিনি সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা ও উপকরণ পেয়েছেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির যোগ্যতম রূপকার। বাংলার নবজাগরণের ও সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল রবীন্দ্রনাথ। তিনি শুধু বাঙালির নন, সমগ্র বিশ্বের। সেই বিবেচনায় নজরুলই ধারণ করেছিলেন অখণ্ড বাঙালি সংস্কৃতিকে এর সমন্বয়বাদিতাকে একটুও ক্ষুণ্ন না করে। পরম আবেগে উচ্চারণ করেছিলেন- বাঙলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক! নজরুলের প্রকৃত পরিচয় তাই খাঁটি বাঙালি সংস্কৃতির আঁধারে, বাঙালি সংস্কৃতির অবয়বে।
নজরুলের প্রকৃত পরিচয় অনুধাবন করতে হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তাকে বিবেচনা করতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস হাজার বছরের। এ অঞ্চলের জীবনাচরণে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে, চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে, নাটকে বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল্য প্রতিফলিত। বাঙালি সংস্কৃতির ধারা গত কয়কশ বছরে বিশেষ কোনো ছকে রূপান্তরিত হয়েছে এমন বলা যাবে না। বিভিন্ন মত-পথ-পন্থা, তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও মূলধর্মগুলোর আদর্শগত দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে বিশাল গ্রামীণ জনপদে গ্রহণ বর্জন সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একটি মৌলিক ধারা ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ সংস্কৃতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর সমন্বয়ধর্মী ধারা। শুধু সমন্বয়ধর্মী নয়, মানবতাবাদীও। বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর থেকে ইসলাম ধর্ম এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করে। দেশজ সংস্কৃতি ও ইসলাম পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। পাঠান রাজত্বেও এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি পৃষ্ঠপোষকতা পায়। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসনামলে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য সমাদৃত হয় এবং দেশীয় পণ্ডিত-কবিবৃন্দ ও পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনে সক্ষম হন। এ সময় যথার্থ অর্থেই একটি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির উত্থান ঘটে। একদিকে শ্রীচৈতন্যের ভক্তিবাদ ও ভালোবাসার বাণী এবং অন্যদিকে সুফি সাধকদের মানবতাবাদী মতবাদ- এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এক অসামান্য সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে।
এভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে সব ধর্মের ও নানা লোকচর্চার সমন্বয়ে চিন্তা-চেতনা মানবিক অন্তঃসারযুক্ত হওয়াতে এ ধারাটি প্রাণবন্ত ও গতিশীল হয়ে ওঠে। এ ধারাটির প্রকাশবাহন হয়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বুলি- আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। সমাজজীবন ও ভাষার এ মেলবন্ধনের মধ্যেই বাঙালির স্বকীয় জীবনঘনিষ্ঠ ও গভীরভাবে মানবিক এক সংস্কৃতি বিরাজমান। এ সংস্কৃতি বাঙালি হিন্দুর নয়, বৌদ্ধের নয়, খ্রিস্টানের নয়, মুসলমানের নয়- এ সংস্কৃতি বাঙালির সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির ভিত্তি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।
বাঙালি সংস্কৃতির এ সমন্বয়বাদিতা ও লৌকিক ঐতিহ্য স্বীকৃতি পেয়েছে বহু শাস্ত্র বিশারদ মনীষী ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় সরকারের মূল্যায়নে। বাঙালিরা আদিতে হিন্দু ছিল, পরে সেই হিন্দু বাঙালিদের থেকেই অনেকে বৌদ্ধ, মুসলমান বা খ্রিস্টান হয়েছে- প্রচলিত এ ধারণা তিনি সমর্থন করতেন না। তার মতে বাঙালির আসল ধর্ম হচ্ছে বাঙালি ধর্ম। এ বাঙালি ধর্ম মানে বাঙালি সংস্কৃতির অন্তঃসারের সমন্বয় তথা লৌকিক ঐতিহ্য।
বিনয় সরকারের মতো প্রখর মনীষীর দীপ্তি তথা পঠিত অনেক বুদ্ধিজীবীরই নেই। বাঙালি ধর্মের তাৎপর্যটি বুঝে উঠতে পারেন না বলে ওই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা নজরুলকেও বুঝতে পারেন না। এমনই একজন লেখক-বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদ। আমার অবিশ্বাস বইয়ে তিনি নজরুলকে অভিহিত করেছেন বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান হিসেবে। একাধিক ধর্মের প্রতি নজরুলের প্রীতির নিদর্শন উদ্ধৃত করে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন-
“নজরুলের বিশ্বাসও সন্দেহজনক, মনে হয় তিনি এক বিশ্বাসের সঙ্গে আরেক বিশ্বাসের পার্থক্য বোঝেন না। বিধিবদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো কঠোর, একটি মানলে আরেকটি মানা যায় না, ইসলাম মানলে হিন্দু ধর্ম মানা যায় না, একই সঙ্গে কেউ হতে পারে না মুসলমান ও হিন্দু; কিন্তু নজরুল তার এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আগের বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে। আমি বিস্মিত হই যিনি লেখেন আল্লাহ আমর প্রভু, আমার নাহি ভয়।/আমার নবী মোহাম্মদ, যাহার তারিফ জগৎময়, তিনি কী করে লিখতে পারেন কালী কালী মন্ত্র জপি বসে লোকের ঘোর শ্মশানে; বল রে জবা বল্! কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল... এমন বহু পৌত্তলিক পদ। তিনি কি একই সঙ্গে হতে পারেন খাঁটি মুসলমান আর কালীভক্ত?”
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও নজরুল যে বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী নির্যাসটুকু তার চৈতন্যে ধারণ করেছিলেন তা দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে অনেকেরই আবার জেনেশুনে সেদিকে দৃষ্টি দিতে চাননি অনেকেই। বাল্যকালেই লেটো গানে হাতেখড়ি হয় নজরুলের। বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রকরণ লেটো লোককবিতা সমন্বয়ধর্মী বাঙালি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের ধারক। সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে তিনি লেটোর জন্য যেমন লিখেছেন কারবালার শোকাতুর ঘটনা নিয়ে পালা, তেমনি লিখেছেন রামায়ণভিত্তিক মেঘনাদবধ পালা। ইসলামী ঐতিহ্য ও হিন্দুপুরাণ উভয় উৎস থেকেই নজরুল সৃষ্টির উপকরণ গ্রহণ করেছেন বাল্যকাল থেকেই।
গ্রহণ ও আত্মীয়করণের ক্ষমতা বাঙালি সংস্কৃতির অসামান্য। বিদেশি ভাষার বহুশব্দ ও সাংস্কৃতিক উপকরণ বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে। উত্তর ভারতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণ থেকে রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণের মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গেছে। আরব-পারস্যের কাহিনী ঐতিহ্য ও সমাদৃত হয়েছে দোভাষী পুঁজিতে যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ বাঙালি সংস্কৃতিতে মর্যাদা পেয়েছে ঘরের মানুষের মতো।
বাঙালি সংস্কৃতির এ আত্মীকরণের গুণটি নজরুল সাহিত্যে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, সেভাবে আর কারও সাহিত্যে সম্ভব হয়নি। অপ্রতিম নৈপুণ্যে তিনি আরবি-ফার্সি শব্দের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তার রচনায়। একই সঙ্গে শ্যামা সঙ্গীত, বৈষ্ণবপদ ও হামদ-নাত, ইসলামী সঙ্গীত রচনায় যে পারদর্শিতা নজরুল দেখিয়েছেন তা এক কথায় নজিরবিহীন। নজরুলের এ অদ্বিতীয় প্রতিভার তাৎপর্য হুমায়ুন আজাদ অনুধাবন করতে না পারলেও তার আদর্শিক গুরু বহুমাত্রিক লেখক বুদ্ধদেব বসু কিন্তু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ঠিকই। রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হওয়ার আপ্রাণ প্রয়াসে লিপ্ত তিরিশের আধুনিক কবিদের দলপতি বুদ্ধদেব বসু লক্ষ্য করেছেন- “... সত্যেন্দ্রনাথকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই সংলগ্ন, কিংবা অন্তর্গত, আর নজরুল ইসলামকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবি- ক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই, কিন্তু নতুন।...কবিতার যে আদর্শ নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, নজরুলও তা-ই, কিন্তু নজরুল বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন তার জীবনের পটভূমিকার ভিন্নতায়। মুসলমান তিনি, সেই সঙ্গে হিন্দু মানসও আপন করে নিয়েছিলেন- চেষ্টার দ্বারা নয়, স্বভাবতই। তার বাল্য-কৈশোর কেটেছে শহরে নয়, মফস্বলে; স্কুল-কলেজে ভদ্রলোক হওয়ার চেষ্টায় নয়, যাত্রাগান লেটোগানের আসরে; বাড়ি থেকে পালিয়ে রুটির দোকানে, তারপর সৈনিক হয়ে। এই যেগুলো সামাজিক দিক থেকে তার অসুবিধে ছিল, এগুলোই সুবিধা হয়ে উঠল যখন তিনি কবিতা লেখায় হাত দিলেন। যেহেতু তার পরিবেশ ছিল ভিন্ন এবং একটু বন্য ধরনের আর যেহেতু সেই পরিবেশ তাকে পীড়িত না করে উল্টো আরও সবল করেছিল তার সহজাত বৃত্তিগুলোকে, সেই জন্য, কোনোরকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না- নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে পালাতে পারলেন তিনি, বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত আনতে পারলেন।”
বাংলা কবিতায় নতুন রক্তের ধারা নজরুল বইয়ে দিতে পেরেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি ধর্মের প্রকৃত মর্মটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই। আবহমান বাংলা ছিল তার চৈতন্যে। বাংলার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, বাঙালির বাইরে আদিবাসী সম্প্রদায় যারা যুগ যুগ ধরে এ বাংলারই অধিবাসী তাদের কাছ থেকেও তিনি সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা ও উপকরণ পেয়েছেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির যোগ্যতম রূপকার। বাংলার নবজাগরণের ও সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল রবীন্দ্রনাথ। তিনি শুধু বাঙালির নন, সমগ্র বিশ্বের। সেই বিবেচনায় নজরুলই ধারণ করেছিলেন অখণ্ড বাঙালি সংস্কৃতিকে এর সমন্বয়বাদিতাকে একটুও ক্ষুণ্ন না করে। পরম আবেগে উচ্চারণ করেছিলেন- বাঙলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক! নজরুলের প্রকৃত পরিচয় তাই খাঁটি বাঙালি সংস্কৃতির আঁধারে, বাঙালি সংস্কৃতির অবয়বে।
No comments