গুলি করে পুড়িয়ে হত্যার ভিডিওচিত্র দেখে চারজনকে শনাক্ত by গোলাম মর্তুজা ও আবু তাহের
ফেনীতে একরামুল হককে হত্যায় সরাসরি
জড়িত—এমন কাউকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা যায়নি৷ তবে
পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, এ ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র দেখে এ খুনে
সরাসরি জড়িত কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এঁরা সবাই ওই এলাকার অপরাধজগতের
সঙ্গে যুক্ত এবং আওয়ামী লীগের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। ফেনী জেলার পুলিশ
সুপার পরিতোষ ঘোষ বলেন, ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা
একরাম হত্যার তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আছে। সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করে
জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁদের দেওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, গত মঙ্গলবার ফেনী শহরের একাডেমি সড়কে একরামকে গুলি করে এবং গাড়িসহ পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র পুলিশ পেয়েছে। ওই ভিডিওচিত্র দেখে হামলায় সরাসরি জড়িত চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রুটি সোহেল, আবিদ, পারভেজ ও হুমায়ুন। এঁরা সবাই ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ওই এলাকার সবাই এঁদের নাম জানে। এঁরা ওই এলাকার একজন পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের নেতার অনুসারী। সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে পরিচিত জয়নাল হাজারীর একসময়ের ক্যাডার ওই কাউন্সিলর এখন স্থানীয় সাংসদ নিজাম হাজারীর সমর্থক।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একরাম হত্যার পর চিহ্নিত ওই চার হামলাকারীর কাউকে এলাকায় দেখা যায়নি। তবে রুটি সোহেলের ভাই ইকবালসহ (২২) দুজনকে পুলিশ আটক করেছে। আটক হওয়া অপর ব্যক্তি হলেন মো. সাখাওয়াত (২৪)। দুজনের বাড়ি শহরের বিরিঞ্চি এলাকায়। তাঁরা এলাকায় যুবলীগের কর্মী বলে পরিচিত।
এর আগে ঘটনার দিন পুলিশ সন্দেহভাজন যে ২১ জনকে আটক করেছিল, জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সবাই নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ ছিলেন।
ফেনী সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার শামসুল আলম সরকার গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, প্রাথমিকভাবে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এখন তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।
নিহত একরামের সঙ্গে গাড়িতে থাকা ও হামলায় আহত সাংবাদিক মহিবুল্লাহ ফরহাদ প্রথম আলোকে বলেন, হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন। সবাই কিশোর ও তরুণ বয়সের।
প্রতিরোধের বিফল চেষ্টা: একরামের প্রাডো গাড়িতে তাঁর লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল। পোড়া গাড়ি থেকে ম্যাগাজিন লোড করা অবস্থায় ওই পিস্তলটি পরে উদ্ধার করেছে পুলিশ। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিরা জানান, ওই পিস্তল দিয়ে তাঁদের একজন কয়েকটি গুলিও ছুড়েছিলেন। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে পাওয়া পাজেরো গাড়ির পেছনে থাকা একরামের এক সহযোগী শটগান দিয়ে গুলি ছুড়েছিলেন। তবে একটি গুলি বের হওয়ার পর শটগানটি জ্যাম হয়ে যায়।
ওই পাজেরো গাড়িতে থাকা ইউসুফ আলী নামের একজন জানান, গাড়িতে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা, একটি শিশুসহ তাঁরা সাতজন ছিলেন। ১০০ গজ দূরত্বে থাকা অবস্থায় একরামের গাড়িটি হামলার মুখে পড়ে। তখন তাঁদের গাড়িতে ইট ছোড়া হয়। ওই অবস্থায় চালক ফিরোজ একরামের গাড়িকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালিয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পর্যন্ত চলে আসেন। সেখানে গাড়ি রেখে তাঁরা সবাই পালিয়ে যান। পরে পুলিশ পলিটেকনিকের সামনে থেকে কাচ ভাঙা গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে।
জয়নাল হাজারীকে দায়ী করলেন নিজাম: এদিকে ফেনী-২ আসনের সাংসদ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম হত্যার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল হাজারীকে দায়ী করেছেন। তাঁর দাবি, জয়নাল হাজারীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ ঘটনার সব তথ্য জানা যাবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ঘটনার আগের দিন জয়নাল হাজারী তাঁর সম্পাদিত হাজারিকা প্রতিদিন-এ ‘নিজাম এখন উভয় সংকটে, প্রতিপক্ষকে খুন ও গুমের পরিকল্পনা হচ্ছে’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছেন। তাতে একরামসহ কয়েকজন খুন হবেন বলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এতে প্রমাণিত হয়, জয়নাল হাজারী জানেন, কারা একরামকে হত্যা করেছে এবং তিনি এ হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত।
একরাম হত্যা নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একে অন্যকে দোষারোপের পর এবার আলোচনায় এসেছেন জয়নাল হাজারীও। এ ব্যাপারে জয়নাল হাজারীর বক্তব্য নেওয়ার জন্য তাঁর মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়। প্রথম আলোর পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
তবে জয়নাল হাজারী এ ঘটনার জন্য সরাসরি নিজাম হাজারীকে দায়ী করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন।
অবশ্য নিজাম হাজারী একই সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকেও দায়ী করেন। তাঁর দাবি, মাহতাবের লোকজন নির্বাচনের সময় একাধিকবার একরামকে হত্যার জন্য হামলা করেছিলেন। তবে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় বিএনপি শুরু থেকেই বলে আসছে যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে একরাম খুন হয়েছেন।
এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে কয়েক দিন ধরে নিজাম হাজারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ করেন নিজাম হাজারী। তিনি দাবি করেন, একরাম হত্যায় তিনি জড়িত নন। ফেনীকে অস্থিতিশীল করতে এবং ফেনীর উন্নয়ন ব্যাহত করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে।
তাহলে আগের দিন বিক্ষোভে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে কেন স্লোগান দেওয়া হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাবে নিজাম বলেন, ‘ওরা সবাই বিএনপির লোক।’ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (নাসিম) এ মামলার যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী চাপমুক্ত থেকে কাজ করছে পুলিশ।
ফুলগাজীতে হরতাল পালিত: একরামকে হত্যার প্রতিবাদে এবং খুনিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে গতকাল ফুলগাজীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় ফুলগাজী উপজেলা সদরে মানববন্ধন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।
ফুলগাজী উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক গোলাম রাব্বানী মজুমদার বলেন, খুনিরা যে দলের বা যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও শাস্তি দিতে হবে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল আলীম বলেন, সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে।
No comments