নজরুলের সমসাময়িকতা by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সমসাময়িকতা ও আধুনিকতা এক বস্তু নয়।
আধুনিকতার ভেতর সমসাময়িকতা থাকে, কিন্তু সমসাময়িক হলেই আধুনিক হওয়া যায় না।
সমসাময়িকতা অনেকটা রুচির ব্যাপার আর আধুনিকতা হল মূলত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর
নির্ভরশীল। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমসাময়িকতার বৃত্তটাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে
চায় এবং এই এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই আধুনিকতা থাকে। সমসাময়িকতাই সাংবাদিকতার,
আধুনিক সৃষ্টিশীল সাহিত্যের। নজরুল একই সঙ্গে সমসাময়িক এবং আধুনিক ছিলেন,
কেবল যদি সমসাময়িক হতেন তাহলে অনেক আগেই হারিয়ে যেতেন। আধুনিক ছিলেন বলেই
যুগের হাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার আবেদন ও প্রাসঙ্গিকতা নিঃশেষ হয়ে
যায়নি বরং প্রত্যেক যুগেই তিনি প্রাসঙ্গিক থেকেছেন। আজকেও আছেন এবং আজকের
দিনেও মনে হবে তিনি আমাদের সমসা-... তিনি সম... প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন।
সদর্পে ঘোষণা দিয়েছিলেন- বর্তমানের কবি আমি ভাই ভবিষ্যতের নবী, পরোয়া করি
না বাঁচি নাবাঁচি যুগের হাওয়া কেটে গেলে। এখনকার বর্তমানকে তিনি
পরিপূর্ণভাবে জানতেন এবং সে বিষয়ে লিখেছেন। সমঃ প্রসঙ্গগুলো ছিল,
সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতার দৌরাত্ম্য নারীর অবমাননা। এই
বিষয়গুলোর ওপর তিনি লিখেছেন কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল আধুনিক- যে জন্য তিনি
সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করে সমস্যাগুলোকে একটা বৈশ্বিক পরিভাষাতে দেখতে
পেয়েছেন। এবং সমস্যার যে সমাধান তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেটা কেবল
সেকালের নয়, অনেককালের বটে।
ধরা যাক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ব্যাপারটা। ব্রিটিশের পরাধীনতার সেকালে স্বাধীনতার জন্য অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু নজরুল যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন সেটা পূর্ণ স্বাধীনতা। তার মন্তব্য ছিল এই রকম যে সরাজ-টরাজের আপসকামিতা ও ধোঁকাবাজিতে কাজ হবে না। তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা, যার অর্থ ভারতবর্ষের এক কণাও ব্রিটিশের অধীনে থাকবে না। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের অনেকেই এরকম কথা বলতেন না। তবে সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত বিপ্লবীরা পূর্ণ স্বাধীণতাই চাইতেন এবং সে জন্যই সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এদের অবস্থানের পরিষ্কার ছবি পাই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবি উপন্যাসে। সেখানে বিপ্লবী সব্যসাচি বলছেন যে তিনি বিপ্লব চান। এই বিপ্লবের অর্থ পূর্ণ স্বাধীনতা, কিন্তু সব্যসাচি সামাজিক বিপ্লব চান না। তার বিপ্লব ভদ্রলোকের বিপ্লব। সশস্ত্র বিপ্লবীরাও ওইরকম স্বাধীনতারই স্বপ্ন দেখতেন। তারা বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন ঠিকই কিন্তু ওই বিপ্লব ছিল রাজনৈতিক প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা, যার অর্থ ক্ষমতা হস্তান্তর। তারা সামাজিক বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন। যে বিরোধিতার কথাটা সব্যসাচি বেশ সুন্দরভাবেই বলেছেন। তার মতো পরাধীন ভারতের শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণীই ছিল সবচেয়ে লাঞ্ছিত ও অপমানিত। এই বিপ্লবে তিনি কৃষককে সঙ্গে নিতে চাননি কারণ কৃষক অগ্রগামী নয়, অথচ কৃষকের তুলনায় শোষিত শ্রেণী ভারতবর্ষে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। করুণ সত্য এটাও, কৃষক শোষিত হতো ভদ্রলোক শ্রেণীর দ্বারা। পথের দাবিতে শোষী নামে যে চরিত্রটি আছে সে কবি। সব্যসাচি তাকেই নিজের দলে আনতে চাচ্ছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে শষী আসতে প্রস্তুত নয়। এই শষীর ভেতর নজরুল আছেন।
নজরুল যে স্বাধীনতার কথা বলতেন সেটা কেবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধীই নয়, সামন্তবাদবিরোধীও বটে। সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরে কার্যকর থাকে পুঁজিবাদ। অল্প বয়সেই নজরুল সেটা বুঝে ফেলেছেন। তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ছিল পুঁজিবাদবিরোধিতা, একই সঙ্গে তিনি সামন্তবাদবিরোধীও ছিলেন। কৃষকের ওপরে জমিদার ও ভদ্রলোকের যে শোষণ তার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে শরৎচন্দ্র ছিলেন একেবারেই আপসহীন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেছেন কিন্তু সামন্তবাদের সমালোচনা করে তার নিপীড়নমূলক চরিত্র নিজের লেখার মধ্যে উন্মোচিত করা সত্ত্বেও সামন্তবাদী সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল একটা গোপন ভালোবাসার টান। কিন্তু সব্যসাচির সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় তিনি শ্রেণীর যে সীমা সেটা অতিক্রম করতে পারেন নাই। সেকালে শ্রেণী এবং সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছিল। কৃষক শ্রেণীর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। আর জমিদার ও শিক্ষিত বা অধিকাংশ ছিল হিন্দু।
স্বাধীনতা বলতে নজরুল কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা বুঝতেন না, তার স্বাধীনতা ছিল জনগণের মুক্তির ধারণা পর্যন্ত প্রসারিত। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সমাজ বিপ্লবী, তার অবস্থানটা দাঁড়িয়েছিল সমাজতান্ত্রিক। সেদিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরাও ছিলেন, সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। সমাজতন্ত্রীরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজ বিপ্লবী। জাতীয়তাবাদীরা সাম্প্রদায়িকতাকে এড়াতে পারেননি, যার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হয়েছিল। আবার এই সাম্প্রদায়িক বিরোধের কারণে ৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে আমরা যা পেয়েছি তা ক্ষমতা হস্তান্তর আর দেশ ভাগের চেয়ে বেশি কিছু নয়। ক্ষমতা হস্তান্তর জনগণের মুক্তি আনেনি, দেশ ভাগ সাম্প্রদায়িকতার অবসানও ঘটায়নি। উপরন্তু প্রাণহানি ও জন্মভূমি থেকে উৎপাটন এবং অর্থনীতি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিপদ ডেকে এনেছে, যা থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি। সাম্প্রদায়িকতারও অবসান ঘটেনি। পুঁজিবাদীদের নিষ্পেষণ ও আনুকূল্যে ধর্মীয় মৌলবাদ বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ধর্মীয় মৌলবাদ একটি সমস্যা বটে, কিন্তু ভারতের জন্য এই সমস্যা যে আরও গভীর ও প্রকট তার প্রমাণ সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির অবিশ্বাস্য বিজয়। এই পার্টি ধর্মীয় পুনর্জ্জীবনবাদী। কেবল তা-ই নয়, এর কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।
নজরুল মূল সত্যকে জানতেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার যে অবস্থান সেটা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মকে তিনি রাজনীতিতে আনার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। এবং এই সাম্প্রদায়িকতা যে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দ্বারা তুষ্ট এটা তিনি স্বচ্ছভাবে দেখতে পেয়েছেন। যে জন্য তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল সাম্রাজ্যবাদ। সাম্প্রদায়িকতাকে এভাবে শনাক্ত করা তার কালে কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। তিনি জানতেন যে পুঁজিবাদের দুঃশাসন কায়েম থাকলে সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটবে না এবং শ্রেণী শোষণ অব্যাহত থাকবে। সে অবস্থায় স্বাধীনতা এলে সে স্বাধীনতা মানুষের মুক্তি আনবে না।
৪৭-এ নজরুল সুস্থ ছিলেন না। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। নইলে দেশভাগ তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হতো। কিন্তু কেবল দেশভাগ নয়, সাম্প্রদায়িকতার নৃশংসতা এবং মৌলবাদের অব্যাহত বিকাশ তাকে সহ্য করতে হতো। নজরুল নিজেকে ভবিষ্যতের নবী বলেননি, কিন্তু ভবিষ্যৎকে তিনি পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল যে, পুঁজিবাদকে যদি পরাভূত করতে না পারা যায় তা হলে মানুষের মুক্তি আসবে না। সাম্প্রদায়িকতা টিকে থাকবে এবং শ্রেণী শোষণ নির্মম আকার ধারণ করবে। তার এই আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। নজরুলের কালে যারা আধুনিক বলে পরিচিত ছিলেন সেই মানুষেরা রুচিতে আধুনিক হলেও দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিক ছিলেন না। তারা ছিলেন সমসাময়িক। যদিও সাম্রাজবাদটা ছিল আধুনিকতার। তার কালে প্রবীণ কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বলে পরিচিত। তার সেই আধুনিকতা ছিল সমসায়িকতার নামান্তর। তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিকাশের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন, সেই বিকাশের সঙ্গে সংহতি রেখে সাহিত্যে চর্চা করেছেন। ওই সমসাময়িকতার সাতিত্যিক উপাদানগুলো ছিল নিঃসঙ্গতা, আÍকেন্দ্রিকতা, ক্ষোভ ও যৌনতা। বুদ্ধদেবসহ তিরিশের অধিকাংশ কবিই সমসাময়িকতার এই উপাদান দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। নজরুল ছিলেন ব্যতিক্রম। তার কাছে কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নয় রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও ছিল সমসাময়িক। কিন্তু তিনি সমসাময়িক থাকতে সম্মত হননি, যে জন্য বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী হতাশা নির্বেদ ও আত্মকেন্দ্রিকতা তাকে আক্রমণ করতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যে ভবিষ্যৎ যাত্রা তার আধুনিকতাকে তিনি নিজের সৃষ্টির মধ্যে নিয়ে এসেছেন। নজরুল সাম্যের গান গাইতেন। তার কাছে শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের বিভাজন এবং অসাম্য ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। সেই সঙ্গে তিনি নারী-পুরুষের ভেতর যে সামাজিক বৈষম্য তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তিনি যে বলেছেন তার চোখে পুরুষ ও নারীতে ভেদাভেদ নেই, সেটা কোনো তাৎক্ষণিক উক্তি নয়, এটা তার মনোজগতে গভীরভাবে প্রথিত। সে কালের আধুনিকেরা অনেকেই নারীকে কেবল প্রেমিকা হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। নজরুল নারীকে দেখেছেন মানুষ হিসেবে। এই পার্থক্যটা সামান্য নয়।
পুঁজিবাদ নারীকে মর্যাদাদানের কথা বলে কিন্তু তাকে নানাভাব বৈষম্যের বেষ্টনীতে আবদ্ধ রাখে, এমনকি পণ্যেও পরিণত করে। নজরুল এই ব্যবস্থাটাকে ভাঙতে পেরেছেন। আজকের দিনে এই বাংলাদেশেও দেখছি যে মেয়েরা অনেক এগিয়েছে কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়নি। এর কারণ পুঁজিবাদ। নজরুল উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু উচ্চশিক্ষিত মানুষরা যা বোঝেনি নজরুল তা হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিয়েছেন, সে জন্য তিনি ছিলেন সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে। নজরুল গানের কবি ছিলেন, তার কবিতায় গান আছে, গানে কবিতা রয়েছে কিন্তু এ গায়ক যে গান গেয়েছেন সেটা মূলত সাম্যের। মানুষের ব্যক্তিগত বেদনা ও আনন্দের কথা তার কবিতা ও গানে রয়েছে। বেদনা ব্যক্তিগত কারণে ঘটে- শোকে বিচ্ছেদে বিপদে মানুষ বেদনার্থ হয়। কিন্তু বেদনায় সামাজিক কারণও রয়েছে। আনন্দও ব্যক্তিগত কিন্তু ব্যক্তির আনন্দ বিঘ্নিত এবং সীমাবদ্ধ হয়ে যায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে। নজরুল ব্যক্তিগত বেদনা ও আনন্দের পেছনে যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে তাকে ভাঙতে চেয়েছেন। এখানেও তিনি একাধারে আধুনিক, সমসাময়িক ও চিরকালীন।
নজরুল তাই আমাদের সমসাময়িক হয়েই থাকবেন। যে সমস্যা ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন সেগুলো এখনও বিদ্যমান। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি আধুনিক। কেননা ওই ব্যবস্থার কাছে তিনি আÍসমর্পণ করেননি, ভাঙতে চেয়েছেন।
ধরা যাক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ব্যাপারটা। ব্রিটিশের পরাধীনতার সেকালে স্বাধীনতার জন্য অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু নজরুল যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন সেটা পূর্ণ স্বাধীনতা। তার মন্তব্য ছিল এই রকম যে সরাজ-টরাজের আপসকামিতা ও ধোঁকাবাজিতে কাজ হবে না। তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা, যার অর্থ ভারতবর্ষের এক কণাও ব্রিটিশের অধীনে থাকবে না। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের অনেকেই এরকম কথা বলতেন না। তবে সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত বিপ্লবীরা পূর্ণ স্বাধীণতাই চাইতেন এবং সে জন্যই সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এদের অবস্থানের পরিষ্কার ছবি পাই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবি উপন্যাসে। সেখানে বিপ্লবী সব্যসাচি বলছেন যে তিনি বিপ্লব চান। এই বিপ্লবের অর্থ পূর্ণ স্বাধীনতা, কিন্তু সব্যসাচি সামাজিক বিপ্লব চান না। তার বিপ্লব ভদ্রলোকের বিপ্লব। সশস্ত্র বিপ্লবীরাও ওইরকম স্বাধীনতারই স্বপ্ন দেখতেন। তারা বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন ঠিকই কিন্তু ওই বিপ্লব ছিল রাজনৈতিক প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা, যার অর্থ ক্ষমতা হস্তান্তর। তারা সামাজিক বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন। যে বিরোধিতার কথাটা সব্যসাচি বেশ সুন্দরভাবেই বলেছেন। তার মতো পরাধীন ভারতের শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণীই ছিল সবচেয়ে লাঞ্ছিত ও অপমানিত। এই বিপ্লবে তিনি কৃষককে সঙ্গে নিতে চাননি কারণ কৃষক অগ্রগামী নয়, অথচ কৃষকের তুলনায় শোষিত শ্রেণী ভারতবর্ষে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। করুণ সত্য এটাও, কৃষক শোষিত হতো ভদ্রলোক শ্রেণীর দ্বারা। পথের দাবিতে শোষী নামে যে চরিত্রটি আছে সে কবি। সব্যসাচি তাকেই নিজের দলে আনতে চাচ্ছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে শষী আসতে প্রস্তুত নয়। এই শষীর ভেতর নজরুল আছেন।
নজরুল যে স্বাধীনতার কথা বলতেন সেটা কেবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধীই নয়, সামন্তবাদবিরোধীও বটে। সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরে কার্যকর থাকে পুঁজিবাদ। অল্প বয়সেই নজরুল সেটা বুঝে ফেলেছেন। তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ছিল পুঁজিবাদবিরোধিতা, একই সঙ্গে তিনি সামন্তবাদবিরোধীও ছিলেন। কৃষকের ওপরে জমিদার ও ভদ্রলোকের যে শোষণ তার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে শরৎচন্দ্র ছিলেন একেবারেই আপসহীন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেছেন কিন্তু সামন্তবাদের সমালোচনা করে তার নিপীড়নমূলক চরিত্র নিজের লেখার মধ্যে উন্মোচিত করা সত্ত্বেও সামন্তবাদী সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল একটা গোপন ভালোবাসার টান। কিন্তু সব্যসাচির সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় তিনি শ্রেণীর যে সীমা সেটা অতিক্রম করতে পারেন নাই। সেকালে শ্রেণী এবং সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছিল। কৃষক শ্রেণীর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। আর জমিদার ও শিক্ষিত বা অধিকাংশ ছিল হিন্দু।
স্বাধীনতা বলতে নজরুল কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা বুঝতেন না, তার স্বাধীনতা ছিল জনগণের মুক্তির ধারণা পর্যন্ত প্রসারিত। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সমাজ বিপ্লবী, তার অবস্থানটা দাঁড়িয়েছিল সমাজতান্ত্রিক। সেদিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরাও ছিলেন, সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। সমাজতন্ত্রীরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজ বিপ্লবী। জাতীয়তাবাদীরা সাম্প্রদায়িকতাকে এড়াতে পারেননি, যার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হয়েছিল। আবার এই সাম্প্রদায়িক বিরোধের কারণে ৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে আমরা যা পেয়েছি তা ক্ষমতা হস্তান্তর আর দেশ ভাগের চেয়ে বেশি কিছু নয়। ক্ষমতা হস্তান্তর জনগণের মুক্তি আনেনি, দেশ ভাগ সাম্প্রদায়িকতার অবসানও ঘটায়নি। উপরন্তু প্রাণহানি ও জন্মভূমি থেকে উৎপাটন এবং অর্থনীতি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিপদ ডেকে এনেছে, যা থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি। সাম্প্রদায়িকতারও অবসান ঘটেনি। পুঁজিবাদীদের নিষ্পেষণ ও আনুকূল্যে ধর্মীয় মৌলবাদ বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ধর্মীয় মৌলবাদ একটি সমস্যা বটে, কিন্তু ভারতের জন্য এই সমস্যা যে আরও গভীর ও প্রকট তার প্রমাণ সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির অবিশ্বাস্য বিজয়। এই পার্টি ধর্মীয় পুনর্জ্জীবনবাদী। কেবল তা-ই নয়, এর কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।
নজরুল মূল সত্যকে জানতেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার যে অবস্থান সেটা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মকে তিনি রাজনীতিতে আনার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। এবং এই সাম্প্রদায়িকতা যে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দ্বারা তুষ্ট এটা তিনি স্বচ্ছভাবে দেখতে পেয়েছেন। যে জন্য তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল সাম্রাজ্যবাদ। সাম্প্রদায়িকতাকে এভাবে শনাক্ত করা তার কালে কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। তিনি জানতেন যে পুঁজিবাদের দুঃশাসন কায়েম থাকলে সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটবে না এবং শ্রেণী শোষণ অব্যাহত থাকবে। সে অবস্থায় স্বাধীনতা এলে সে স্বাধীনতা মানুষের মুক্তি আনবে না।
৪৭-এ নজরুল সুস্থ ছিলেন না। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। নইলে দেশভাগ তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হতো। কিন্তু কেবল দেশভাগ নয়, সাম্প্রদায়িকতার নৃশংসতা এবং মৌলবাদের অব্যাহত বিকাশ তাকে সহ্য করতে হতো। নজরুল নিজেকে ভবিষ্যতের নবী বলেননি, কিন্তু ভবিষ্যৎকে তিনি পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল যে, পুঁজিবাদকে যদি পরাভূত করতে না পারা যায় তা হলে মানুষের মুক্তি আসবে না। সাম্প্রদায়িকতা টিকে থাকবে এবং শ্রেণী শোষণ নির্মম আকার ধারণ করবে। তার এই আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। নজরুলের কালে যারা আধুনিক বলে পরিচিত ছিলেন সেই মানুষেরা রুচিতে আধুনিক হলেও দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিক ছিলেন না। তারা ছিলেন সমসাময়িক। যদিও সাম্রাজবাদটা ছিল আধুনিকতার। তার কালে প্রবীণ কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বলে পরিচিত। তার সেই আধুনিকতা ছিল সমসায়িকতার নামান্তর। তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিকাশের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন, সেই বিকাশের সঙ্গে সংহতি রেখে সাহিত্যে চর্চা করেছেন। ওই সমসাময়িকতার সাতিত্যিক উপাদানগুলো ছিল নিঃসঙ্গতা, আÍকেন্দ্রিকতা, ক্ষোভ ও যৌনতা। বুদ্ধদেবসহ তিরিশের অধিকাংশ কবিই সমসাময়িকতার এই উপাদান দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। নজরুল ছিলেন ব্যতিক্রম। তার কাছে কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নয় রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও ছিল সমসাময়িক। কিন্তু তিনি সমসাময়িক থাকতে সম্মত হননি, যে জন্য বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী হতাশা নির্বেদ ও আত্মকেন্দ্রিকতা তাকে আক্রমণ করতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যে ভবিষ্যৎ যাত্রা তার আধুনিকতাকে তিনি নিজের সৃষ্টির মধ্যে নিয়ে এসেছেন। নজরুল সাম্যের গান গাইতেন। তার কাছে শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের বিভাজন এবং অসাম্য ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। সেই সঙ্গে তিনি নারী-পুরুষের ভেতর যে সামাজিক বৈষম্য তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তিনি যে বলেছেন তার চোখে পুরুষ ও নারীতে ভেদাভেদ নেই, সেটা কোনো তাৎক্ষণিক উক্তি নয়, এটা তার মনোজগতে গভীরভাবে প্রথিত। সে কালের আধুনিকেরা অনেকেই নারীকে কেবল প্রেমিকা হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। নজরুল নারীকে দেখেছেন মানুষ হিসেবে। এই পার্থক্যটা সামান্য নয়।
পুঁজিবাদ নারীকে মর্যাদাদানের কথা বলে কিন্তু তাকে নানাভাব বৈষম্যের বেষ্টনীতে আবদ্ধ রাখে, এমনকি পণ্যেও পরিণত করে। নজরুল এই ব্যবস্থাটাকে ভাঙতে পেরেছেন। আজকের দিনে এই বাংলাদেশেও দেখছি যে মেয়েরা অনেক এগিয়েছে কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়নি। এর কারণ পুঁজিবাদ। নজরুল উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু উচ্চশিক্ষিত মানুষরা যা বোঝেনি নজরুল তা হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিয়েছেন, সে জন্য তিনি ছিলেন সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে। নজরুল গানের কবি ছিলেন, তার কবিতায় গান আছে, গানে কবিতা রয়েছে কিন্তু এ গায়ক যে গান গেয়েছেন সেটা মূলত সাম্যের। মানুষের ব্যক্তিগত বেদনা ও আনন্দের কথা তার কবিতা ও গানে রয়েছে। বেদনা ব্যক্তিগত কারণে ঘটে- শোকে বিচ্ছেদে বিপদে মানুষ বেদনার্থ হয়। কিন্তু বেদনায় সামাজিক কারণও রয়েছে। আনন্দও ব্যক্তিগত কিন্তু ব্যক্তির আনন্দ বিঘ্নিত এবং সীমাবদ্ধ হয়ে যায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে। নজরুল ব্যক্তিগত বেদনা ও আনন্দের পেছনে যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে তাকে ভাঙতে চেয়েছেন। এখানেও তিনি একাধারে আধুনিক, সমসাময়িক ও চিরকালীন।
নজরুল তাই আমাদের সমসাময়িক হয়েই থাকবেন। যে সমস্যা ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন সেগুলো এখনও বিদ্যমান। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি আধুনিক। কেননা ওই ব্যবস্থার কাছে তিনি আÍসমর্পণ করেননি, ভাঙতে চেয়েছেন।
No comments