মাসুদ পথিকের কবিতা সুন্দরের সহজিয়া আবাহন
কবিতার ইতিহাস কেবল টেকনিক ও আঙ্গিকের
ইতিহাস কী? মূর্ত বা দৃশ্যমান বস্তুনিচয়ের মতো উদ্দাম শারীরিকতা বা স্থূল
অঙ্গসর্বস্বতা দিয়ে কী কবিতার বিপুল বিস্ময় কিংবা আকুল-আশ্বাসকে প্রবাহমান
ধারায় সচল রাখা যায়? ইত্যাকার বিবেচনায় জগতের সব কথা বলা হয়ে গেছে বলে
সৃজনশেকড়কে যারা জন্মান্ধ বা সংশয়াপন্ন করতে চান, এখন তাদের প্রতি
চ্যালেঞ্জ ঘোষণার সময় হয়েছে বৈকি। এই চ্যালেঞ্জের সপক্ষে যুতসই উপজীব্য
হিসেবে বাংলা কবিতার তরুণ-কণ্ঠস্বর কবি মাসুদ পথিকের একাকী জমিন
কাব্যগ্রন্থ নিঃসংকোচে হাজির করা যায়।
বাগ্বিস্তারে কবিতা এক উন্মুক্ত রক্তস্বর বা অবারিত হাহাকার। এই হাহাকার, এই আকুতি প্রতিটি জন্মে, প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি ঋতুতে, প্রতিটি অঞ্চলে, প্রতিটি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ত পরিবর্তিত হয়। পথিকের কবিতায় এই বদলে যাওয়ার প্রণালি কী সুন্দর অসামান্য স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত হয়েছে দেখুন : যারা খুব কোলাহল করো, তারা কি জানো প্রতিটি বর্ষের ছায়ায় কী রূপে/বিপুল ইমোশনের জন্ম দিয়ে হারিয়ে যায় কেনো বুনোফুলের পাপড়ি/বুনোফুল বর্ষের দোল... অথবা ...অনাদিকালের চাষবিজ্ঞানে নিজেকেই...আবিষ্কার করে যাই/প্রবহমান ঘটনার ডানায় অচেনা অনেক অনেক উপমা বয়ে আসবেই...।
একাকী জমিন শিরোনামের কবিতাটি স্মরণ করা যেতে পারে। আখ্যানের আবডালে আলুথালু সংলাপের সহজিয়া ঢঙে এতদঞ্চলের দলিত ও কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের বাণী পরম্পরাকে কবি এখানে তুলে ধরেছেন সম্পূর্ণ নতুনরূপে। নতুনত্বের এই রূপশৈলী কিংবা বলা যেতে পারে বুঝশৈলী এখানে যতটা না আঙ্গিকানুগ, তার চাইতে ঢের বেশি হার্দ্য ও প্রাণানুগ- যা কিনা প্রহরের চূড়ান্তে এসে, হয়ে পড়ে মা ও মায়া বা প্রেমিকা অবলম্বনহীন একাকী জমিন বা একাকী জীবন। একাকীত্বের এই কষ্ট-কল্পদ্রুম বড়ই মর্মস্পর্শী, বড়ই অথবা যে কোন ধরনের এবং প্রাণবিদারক।
কবিতা কোনো কিছুর মতো নয়। কবিতা আদপে প্রত্যেক কবির নিজের মতোই। প্রতিটি ভোর যেমন নব নব মহিমায় দিনমান সময়ের ইশারা দিয়ে যায়, তেমনি কবিতা বেলাতেও একজন অতিচেতন-সংবেদন মনের কবি তার জীয়ন-অস্তিত্বের প্রগাঢ়-উপলব্ধির নতুনতরো ব্যঞ্জনা, নতুন সুরের অভিযোজনায় চির অবিনাশী উচ্চারণে উৎকীর্ণ করে যায়। কাব্য তো রসোত্তীর্ণ বাক্যই। তাই বলে প্রতিটি বাক্য কিন্তু কাব্যের উষ্ণকমলটি ধারণ করতে পারে না। এতদ্কালের কাব্যের ইতিহাস কিন্তু আমাদের তা-ই জানান দেয়। পথিকের কবিতা পাঠ পাঠককে সেই রসোত্তীর্ণতার সুবাদে অনন্য এক নতুন সঞ্চারণায় নিয়ে যায় : ...সন্ধান করি শব্দের জন্মভূমি/ বাক্যের দেশের করি ভূমি জরিপ/ ঘুমন্ত কাহিনির খোলা পিঠে লিখে দেই/যে দিনগুলি হারিয়েছি তার হিসাব/বাক্যগর্ভে বাঁধিয়ে গোল ব্যাকরণের ভ্রুণ হত্যা করি/ যে বাক্যে ঢুকেছে দ্বিধার অরণ্যযাপন উপত্যকা/ আর আছে ইতিহাসের বন্ধুর ইতিকথা, ভাবি/ কবে কালো প্রজাতির রক্ত ঢুকেছিল দানববাক্যের গর্ভে...। অথবা ...কতদূর যাবে, যায়! আছি, মুক্ত হবো শব্দগর্ভে ধ্বনিত উপমায়/ বাক্যের পথে মৃত্যু আসুক, আসুক অমোঘ জীবন, পৌঁছাবো ধীরে সমুদ্র মোহনায়/ মিশে যাবে, যাবেই, লক্ষ বাধা দলিত করে যাকে পাই প্রসূতিসদনের ইশারা-ভাষায়...।
পথিকের কবিতায় প্রযুক্তিগত বিশ্বায়নের অতিপ্রচল শব্দসমবায়ের সঙ্গে এ দেশের আদিম শ্রমজীবী সমাজের চিরায়ত কৌম-ভাষারীতির অনায়াস-প্রয়োগ লক্ষ করার মতো। নিত্য নতুন উদ্ভাবিত ও চলিষ্ণু ভাষাভঙ্গি কিংবা প্রাত্যহিকতার গ্রামীণ-মেজাজের স্বরকথনে তিনি যে দ্যোতনা, যে রসবোধ, সৌন্দর্যের যে আনন্দঘন পরিচর্যা দেখিয়েছেন, সমকালীন বাংলা কবিতার চর্চাবলয়ে তা অবশ্যই প্রাগ্রসর আধুনিক ও অভিনব। বোধগম্যতার সহজার্থে এখানে কিছু কিছু কবিতার শিরোনাম অথবা শব্দবন্ধ বা নবযুক্ততার উদাহরণ দেখা যেতে পারে : বিপুল ইমোশন, সুরেলা অব্যয়ভাব, জীবনের হাইফেন, মৃতুর মনতাজ, শূন্যতার ফিল, মৌন বুদ্বুদ, যৌন-তৃণঝুর, বহুজাতিক ইশারা, হাইব্রিড ইশারা, চোরারোদ, শব্দের চুপিচুপি ডুব, গোলার ডামি, আউশ-আমনের ভঙ্গিমা, গুরুবক, বাক্যবিহঙ্গ, ইরি-ইউরিয়ার খামে নবান্ন, রাষ্ট্র কি ভেরো ভাজে, ঢেঁকির শুলুক, কামনিরালা, সৌরগামলা, কসমো-বিতর্ক, র-রিয়ালিজমের ছুরি, সিভিলায়জেশন প্রহর, ধর্ষিত ধান, বর্ণমালার গৃহস্থালি, আবহ স্তনমান, যোনিচিত্র, টোটেম গ্লানি, জবাচিন্তা ঘুঘু, আলবাক্য, শব্দবীথি ও শিল্পপ্রহর ইত্যাদি। শব্দ বা চয়নবিন্যাসে তিনি তার নিজস্ব কাব্যস্বর বা কবিতাপ্রতিমায় শনাক্ত হয়ে উঠেছেন।
কবিতারাষ্ট্রে সিদ্ধি ও প্রসিদ্ধি বলে একটা কথার চল্ আছে। কবি মাসুদ পথিকের কাব্য-প্রাণসত্তার শৈল্পিক অভিযাত্রা কোন্ মহাসত্যের সৌন্দর্যের সন্ধানে, সময়-ই তার রায় দেবে। আমরা সেই সহজিয়া আবাহন-পানে নিরন্তর তাকিয়ে রইলাম।
কুতুব হিলালী
বাগ্বিস্তারে কবিতা এক উন্মুক্ত রক্তস্বর বা অবারিত হাহাকার। এই হাহাকার, এই আকুতি প্রতিটি জন্মে, প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি ঋতুতে, প্রতিটি অঞ্চলে, প্রতিটি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ত পরিবর্তিত হয়। পথিকের কবিতায় এই বদলে যাওয়ার প্রণালি কী সুন্দর অসামান্য স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত হয়েছে দেখুন : যারা খুব কোলাহল করো, তারা কি জানো প্রতিটি বর্ষের ছায়ায় কী রূপে/বিপুল ইমোশনের জন্ম দিয়ে হারিয়ে যায় কেনো বুনোফুলের পাপড়ি/বুনোফুল বর্ষের দোল... অথবা ...অনাদিকালের চাষবিজ্ঞানে নিজেকেই...আবিষ্কার করে যাই/প্রবহমান ঘটনার ডানায় অচেনা অনেক অনেক উপমা বয়ে আসবেই...।
একাকী জমিন শিরোনামের কবিতাটি স্মরণ করা যেতে পারে। আখ্যানের আবডালে আলুথালু সংলাপের সহজিয়া ঢঙে এতদঞ্চলের দলিত ও কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের বাণী পরম্পরাকে কবি এখানে তুলে ধরেছেন সম্পূর্ণ নতুনরূপে। নতুনত্বের এই রূপশৈলী কিংবা বলা যেতে পারে বুঝশৈলী এখানে যতটা না আঙ্গিকানুগ, তার চাইতে ঢের বেশি হার্দ্য ও প্রাণানুগ- যা কিনা প্রহরের চূড়ান্তে এসে, হয়ে পড়ে মা ও মায়া বা প্রেমিকা অবলম্বনহীন একাকী জমিন বা একাকী জীবন। একাকীত্বের এই কষ্ট-কল্পদ্রুম বড়ই মর্মস্পর্শী, বড়ই অথবা যে কোন ধরনের এবং প্রাণবিদারক।
কবিতা কোনো কিছুর মতো নয়। কবিতা আদপে প্রত্যেক কবির নিজের মতোই। প্রতিটি ভোর যেমন নব নব মহিমায় দিনমান সময়ের ইশারা দিয়ে যায়, তেমনি কবিতা বেলাতেও একজন অতিচেতন-সংবেদন মনের কবি তার জীয়ন-অস্তিত্বের প্রগাঢ়-উপলব্ধির নতুনতরো ব্যঞ্জনা, নতুন সুরের অভিযোজনায় চির অবিনাশী উচ্চারণে উৎকীর্ণ করে যায়। কাব্য তো রসোত্তীর্ণ বাক্যই। তাই বলে প্রতিটি বাক্য কিন্তু কাব্যের উষ্ণকমলটি ধারণ করতে পারে না। এতদ্কালের কাব্যের ইতিহাস কিন্তু আমাদের তা-ই জানান দেয়। পথিকের কবিতা পাঠ পাঠককে সেই রসোত্তীর্ণতার সুবাদে অনন্য এক নতুন সঞ্চারণায় নিয়ে যায় : ...সন্ধান করি শব্দের জন্মভূমি/ বাক্যের দেশের করি ভূমি জরিপ/ ঘুমন্ত কাহিনির খোলা পিঠে লিখে দেই/যে দিনগুলি হারিয়েছি তার হিসাব/বাক্যগর্ভে বাঁধিয়ে গোল ব্যাকরণের ভ্রুণ হত্যা করি/ যে বাক্যে ঢুকেছে দ্বিধার অরণ্যযাপন উপত্যকা/ আর আছে ইতিহাসের বন্ধুর ইতিকথা, ভাবি/ কবে কালো প্রজাতির রক্ত ঢুকেছিল দানববাক্যের গর্ভে...। অথবা ...কতদূর যাবে, যায়! আছি, মুক্ত হবো শব্দগর্ভে ধ্বনিত উপমায়/ বাক্যের পথে মৃত্যু আসুক, আসুক অমোঘ জীবন, পৌঁছাবো ধীরে সমুদ্র মোহনায়/ মিশে যাবে, যাবেই, লক্ষ বাধা দলিত করে যাকে পাই প্রসূতিসদনের ইশারা-ভাষায়...।
পথিকের কবিতায় প্রযুক্তিগত বিশ্বায়নের অতিপ্রচল শব্দসমবায়ের সঙ্গে এ দেশের আদিম শ্রমজীবী সমাজের চিরায়ত কৌম-ভাষারীতির অনায়াস-প্রয়োগ লক্ষ করার মতো। নিত্য নতুন উদ্ভাবিত ও চলিষ্ণু ভাষাভঙ্গি কিংবা প্রাত্যহিকতার গ্রামীণ-মেজাজের স্বরকথনে তিনি যে দ্যোতনা, যে রসবোধ, সৌন্দর্যের যে আনন্দঘন পরিচর্যা দেখিয়েছেন, সমকালীন বাংলা কবিতার চর্চাবলয়ে তা অবশ্যই প্রাগ্রসর আধুনিক ও অভিনব। বোধগম্যতার সহজার্থে এখানে কিছু কিছু কবিতার শিরোনাম অথবা শব্দবন্ধ বা নবযুক্ততার উদাহরণ দেখা যেতে পারে : বিপুল ইমোশন, সুরেলা অব্যয়ভাব, জীবনের হাইফেন, মৃতুর মনতাজ, শূন্যতার ফিল, মৌন বুদ্বুদ, যৌন-তৃণঝুর, বহুজাতিক ইশারা, হাইব্রিড ইশারা, চোরারোদ, শব্দের চুপিচুপি ডুব, গোলার ডামি, আউশ-আমনের ভঙ্গিমা, গুরুবক, বাক্যবিহঙ্গ, ইরি-ইউরিয়ার খামে নবান্ন, রাষ্ট্র কি ভেরো ভাজে, ঢেঁকির শুলুক, কামনিরালা, সৌরগামলা, কসমো-বিতর্ক, র-রিয়ালিজমের ছুরি, সিভিলায়জেশন প্রহর, ধর্ষিত ধান, বর্ণমালার গৃহস্থালি, আবহ স্তনমান, যোনিচিত্র, টোটেম গ্লানি, জবাচিন্তা ঘুঘু, আলবাক্য, শব্দবীথি ও শিল্পপ্রহর ইত্যাদি। শব্দ বা চয়নবিন্যাসে তিনি তার নিজস্ব কাব্যস্বর বা কবিতাপ্রতিমায় শনাক্ত হয়ে উঠেছেন।
কবিতারাষ্ট্রে সিদ্ধি ও প্রসিদ্ধি বলে একটা কথার চল্ আছে। কবি মাসুদ পথিকের কাব্য-প্রাণসত্তার শৈল্পিক অভিযাত্রা কোন্ মহাসত্যের সৌন্দর্যের সন্ধানে, সময়-ই তার রায় দেবে। আমরা সেই সহজিয়া আবাহন-পানে নিরন্তর তাকিয়ে রইলাম।
কুতুব হিলালী
No comments