নাগরিক ফোরাম সরকারের প্রতিপক্ষ নয় by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সম্প্রতি কয়েকজন মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতা নাগরিক সমাজের নানা ফোরাম ও নেতার সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা সঠিক তথ্যভিত্তিক না হলে তা সমাজে গ্রাহ্য হয় না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিশেষ একটি শ্রেণী বিরোধী দলের জন্য মায়াকান্না করছে।’ তিনি নতুন নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে এ কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘দেশ আবার উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা কোনো কোনো মহলের পছন্দ না। তাদের কান্না জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির জন্য।’ (প্রথম আলো, ১৯ মার্চ)
প্রধানমন্ত্রী কারও নাম করে এ সমালোচনা করেননি। তবে অনুমান করি, তিনি নাগরিক সমাজকে উদ্দেশ করে এসব কথা বলেছেন। দেশের কোনো নির্দল নাগরিক ফোরাম কোনো বিরোধী দলের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বলেছে, এমন তথ্য জানা নেই। নাগরিক সমাজ বলেছে, ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন করা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দরকার।’ প্রায় এ রকম কথা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের বহু নেতাও বলেছিলেন। নাগরিক সমাজ নতুন কিছু তো বলেনি। তা ছাড়া সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিরোধী দল জিতবে, এমন কথা কে বলেছে? আওয়ামী লীগও তো জিততে পারে। নাগরিক সমাজ শুধু সব দলের অংশগ্রহণে, সব ভোটার যাতে ভোট দিতে পারেন, সে রকম নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এখানে শুধু বিরোধী দলের প্রসঙ্গ আসছে কেন?
প্রধানমন্ত্রী তাঁর এক বক্তৃতায় নির্বাচনের ইস্যুর সঙ্গে ‘জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের’ প্রসঙ্গ এক করে ফেলেছেন। যথাযথ নির্বাচন হলে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসী বা স্বাধীনতাবিরোধীরাই জিতবে—এই আশঙ্কা কেন প্রধানমন্ত্রীর? আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের জনপ্রিয়তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর আস্থা এত কম কেন? প্রধানমন্ত্রী দেখাতে পারবেন জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য নাগরিক সমাজ কোথাও ওকালতি করেছে? ১৪-দলীয় জোট এখন ৩৪৮ জন সাংসদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংসদে এ রকম শতভাগ সমর্থনের সরকার এর আগে কেউ দেখেনি। কাজেই সরকার আইন দিয়ে, প্রশাসন দিয়ে, বিচার দিয়ে যত জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী রয়েছে, তাদের দমন করছে না কেন? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো চলছেই। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমনে সরকারকে কেউ কি বাধা দিচ্ছে? কে বাধা দেবে? বিএনপি বা জামায়াত কি সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী?
সংসদে শতভাগ সমর্থন ও বিরোধী দলবিহীন সরকার যদি জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দমন করতে না পারে, তাহলে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ দেখা দেবে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী জুজু দেখিয়ে সরকার ভারতের সমর্থন ও সহায়তা লাভ করছে। আমরা চাই, সরকার আইনি ও বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত করবে। যদি তা না পারে, তাহলে সরকার যেন এ ব্যর্থতা স্বীকার করে নাগরিক সমাজকে যেন এ জন্য অভিযুক্ত না করে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী পালনে নির্দল নাগরিক সমাজের কোনো ভূমিকা নেই।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ‘জঙ্গিবাদ’ এক নতুন সমস্যা। একদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা, অপরদিকে দারিদ্র্য অনেক ব্যক্তিকে জঙ্গিবাদে উদ্দীপিত করছে। জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করতে হবে দুভাবে। ১. যারা জঙ্গিবাদের নামে নানা সন্ত্রাসী কাজকর্মে লিপ্ত, তাদের ধরে আইনের আশ্রয়ে আনা। এ ব্যাপারে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করতে হবে। ২. দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণে উদ্ভাবনী পন্থা বের করতে হবে। শিক্ষাবঞ্চিত তরুণ ও শিক্ষিত তরুণেরা যাতে বেকার না থাকেন, তার জন্য নানা প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য কোনো আর্থিক প্রলোভনে পড়ে তরুণেরা যেন বিভ্রান্ত হয়ে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে না পড়েন। জঙ্গিবাদ দূরীকরণে বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু অদৃশ্য শক্তির ওপর গদা ঘুরিয়ে জঙ্গিবাদ দূর করা যাবে না; মাঠ গরম করা যাবে মাত্র। জঙ্গিবাদ দূর করার নামে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করলে তাতে বিরোধী দলের আন্দোলন স্তিমিত হতে পারে, প্রকৃত জঙ্গিবাদ দূর হবে না। বর্তমান সরকারকে সংসদ ও সংবিধান সব ক্ষমতা দিয়েছে। তার পরও তারা দেশ থেকে জঙ্গিবাদ দূর করতে না পারলে বুঝতে হবে, সরকারই তার স্বার্থে ‘জঙ্গিবাদ’ টিকিয়ে রাখতে চায়। আগামী দিনের কোনো সরকারকে যেন জঙ্গিবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আন্দোলন করতে না হয়। বর্তমান সরকারের মেয়াদেই তার পরিসমাপ্তি ঘটুক।

দুই
বিগত সংসদ নিয়ে টিআইবি সম্প্রতি যে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাংসদ সমালোচনামুখর। মনে হয়, এসব সাংসদ রিপোর্টটি ঠিকমতো পড়েননি। রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে অনেক কথা রয়েছে। বরং সংসদে অনুপস্থিতি নিয়ে সমালোচনা রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার। এই রিপোর্টে সংসদে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে আইন পাসের প্রস্তাবও রয়েছে। আমাদের সাংসদেরা অধিবেশনের মোট সময়ের মাত্র ৮ দশমিক ২ শতাংশ সময় আইন প্রণয়নে দেন। সংসদে নষ্ট সময়ের আর্থিক মূল্য ১০৪ কোটি টাকা। নবম সংসদে খালেদা জিয়া মাত্র ১০ দিন উপস্থিত ছিলেন। এগুলো কি ভুল তথ্য? সাংসদেরা কি সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন, রিপোর্টে টিআইবি কী কী ভুল তথ্য দিয়েছে?
বিগত সংসদে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি যে সংসদে প্রায় আসেইনি, নাগরিক সমাজ তার বহু সমালোচনা করেছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন ফোরাম গত সরকারের সময় সংসদে অনুপস্থিতি নিরুৎসাহিত করার জন্য নানা বিধি পরিবর্তন এবং প্রয়োজনবোধে এ ব্যাপারে আইন পাস করার জন্যও আবেদন জানিয়েছে। বিগত সংসদে সরকারি দল এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এবারও আওয়ামী লীগের সেই সুযোগ রয়েছে। বাগাড়ম্বর না করে এ ব্যাপারে যথাযথ আইন প্রণয়নে মনোযোগ দিলেই ভালো হবে।
ইদানীং কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতাকে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের চেয়েও ‘সুজন’ ও টিআইবির সমালোচনায় বেশি মুখর। সুজন ও টিআইবি তো আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ নয়। তারা ক্ষমতায় যাবে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তারা বিএনপি সরকারের নানা ভুলভ্রান্তি ধরেছিল। তারা যা করছে, তা প্রধানত দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সুশাসনের পক্ষে। টিআইবি বা সুজন যদি দেশের আইন অমান্য করে কিছু কাজ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিন। অভিযোগ আদালতেই প্রমাণিত হোক। আশা করি, সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ‘গাড়ি পোড়ানো’ বা ‘পুলিশ হত্যায় জড়িত’—এমন অভিযোগে মামলা দেবে না।
আরেকটি বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আজকাল নানা উপলক্ষে জাতীয় সংসদের কতিপয় সদস্য ও মন্ত্রী সংসদে অনুপস্থিত (সাংসদ নন) ব্যক্তির বিরুদ্ধে নাম ধরে সমালোচনা করেন, যা প্রত্যাশিত নয়। এ ক্ষেত্রে সমালোচিত ব্যক্তির লিখিত ‘জবাব’ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পড়ে শোনানো ও কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করার কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া যায়? তা করা না হলে সমালোচিত ব্যক্তির প্রতি খুবই অবিচার হবে। তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত ‘অভিযোগ’ কার্যবিবরণীতে স্থান পেলে তা সংসদীয় দলিল হয়ে যাবে, যা খুবই গুরুতর। কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিলেও ‘অভিযোগটি’ টিভি ও বেতারে লাইভ সম্প্রচারিত হয়ে যায়। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মাননীয় স্পিকার এ ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করি।

তিন
২৬ মার্চ লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সরকারি উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। এর ফলে জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে শিশু, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে একধরনের দেশপ্রেম জাগ্রত হতে পারে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানটি শুধু একটি সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে হলেই ভালো হতো। সরকার এটা ‘আয়োজন’ করায় স্বতঃস্ফূর্ততা অনেকখানি নষ্ট হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের টাকা নিয়ে অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে একটি টাকাও খরচ করার প্রয়োজন ছিল না। সরকার যদি বলত, ২৬ মার্চ বেলা ১১টায় প্রতিটি স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ও দেশের সর্বস্তরের জনগণ যার যার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইবে। বড় বড় মাঠেও জনগণ সমবেত হতে পারত।
গিনেস বুক রেকর্ড বাদ দিলে সমবেতভাবে ২৬ মার্চ জাতীয় সংগীত গাওয়ার ধারণা চমৎকার। এ কর্মসূচি প্রতিবছর হতে পারে। তবে তা হুকুমের আয়োজন না হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজনই শ্রেয়।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.