বাংলাদেশ সরকার বিরোধী দলকে পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টা করছে by টবি ক্যাডমান
২০১৪’র ৪ঠা ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক
অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটরের কাছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের
পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রাথমিক তদন্ত শুরু করার আবেদন দাখিল করা হয়।
বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ ধরনের
পিটিশন দাখিল করার কোন আইনি সুযোগ নেই। ২০শে ফেব্রুয়ারি আইসিসি প্রসিকিউটর
আনুষ্ঠানিকভাবে ওই আবেদনপত্র নিবন্ধিত করে এর জবাব দিয়েছেন। এখন তারা
প্রাথমিক তদন্ত শুরু করা হবে কিনা তা নিরূপণের জন্য বিস্তারিত
সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিল করার বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
বাংলাদেশ
পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপ ভিত্তিক স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা
ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন ফর ফ্রিডম অ্যান্ড রাইটস যে আবেদন দাখিল করেছে,
সেখানে বিচারবহির্ভূত গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতার বিষয়ে তদন্তের আহ্বান
জানানো হয়েছে। সংস্থাটির আবেদন যে একটি গুরুতর আইনি পদক্ষেপ সে বিষয়ে
সন্দেহ নেই। বিশ্বের সম্মানিত আইনজ্ঞরা এতে সমর্থন দিয়েছেন। এর মধ্যে
রয়েছেন বৃটিশ সরকারের সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিষয়ক উপদেষ্টা লর্ড কার্লাইল
কিউসি, স্যার ডেসমন্ড ডি সিলভা কিউসি, সিয়েরা লিওনের বিশেষ আদালতের সাবেক
চিফ প্রসিকিউটর এবং সাবেক আইসিটিওয়াই প্রসিকিউটর স্যার জিওফ্রি নাইস কিউসি।
আইসিসি প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা তাদের সমর্থনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই
নেবেন বলে ধারণা করা যায়। বাংলাদেশী নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সংঘটিত
মানবতাবিরোধী অপরাধের যে প্রমাণ রয়েছে তা সত্যিই অত্যন্ত মর্মান্তিক।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষ্য, ছবি আর ভিডিও ফুটেজে- বিরোধী
দলগুলোর সমর্থক ও বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর বিপরীতে ভিন্ন মতপোষণকারীদের ওপর
সুপরিকল্পিত দমন-পীড়ন, নির্যাতন, হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের বিস্তারিত ও
চরম উদ্বেগজনক প্রমাণ রয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা ও তার সরকার আইনি ও শারীরিক শক্তির সমন্বিত প্রয়োগের মধ্য দিয়ে
বিরোধী দলকে পঙ্গু করে দেয়ার চেষ্টা করেছে। ২০১৩ সালে ঘটনাপ্রবাহ
মর্মান্তিক মোড় নেয় যখন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কয়েক শ’ মৃত্যুর
বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ সামনে আসে। ওই বছরে সুনির্দিষ্টভাবে ৩টি ভয়ঙ্কর সময়
গেছে যখন কয়েক ডজন সরকারবিরোধী প্রতিবাদকারী নিহত হয়েছেন। আইসিসিতে
দাখিলকৃত আবেদনে প্রথম যে ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তার সময়কাল শুরু হয়েছে
২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে
যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত বিরোধী এক রাজনীতিবিদের মৃত্যুদ- দেয়ার পর ঘটনার
সূত্রপাত হয়। এরপর ২০১৩ সালের মে মাসের শুরুতে অতিরক্ষণশীল ইসলামী দলের
সমর্থনে প্রতিবাদ কর্মসূচি রাজধানী থেকে জোরপূর্বক ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়।
এতে কয়েক শ’ মানুষ নিহত হয় বলে ব্যাপক পরিসরে বিশ্বাস করা হয়। আন্তর্জাতিক
গণমাধ্যমের অনেক ক্ষেত্রে ওই ঘটনাকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করা
হয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ গণমাধ্যমে ঘটনার
সাক্ষ্যপ্রদানের প্রস্তাব দেয়ায় সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার
করা হয়। সর্বশেষ ৫ই জানুয়ারির অতিমাত্রায় বিতর্কিত নির্বাচনে বিরোধী
সমর্থকদের ওপর সংঘটিত সহিংসতা নতুন মাত্রা ধারণ করে। বিরোধী দল ওই নির্বাচন
বর্জন করে। বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। আটক অবস্থায় মৃত্যু হয়
অনেকের। এর একটি ঘটনায় দেখা যায়, বিরোধী দলের এক সদস্যকে রাতে তার বাসা
থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে তারই বাসার ছাদে নিরাপত্তা কর্মীরা গুলি
চালিয়ে হত্যা করে। সরকার, বিরোধী দলের অনেক সমর্থকের মৃত্যুর ব্যাখ্যা
দেয়ার চেষ্টা করেছে ক্রসফায়ার আখ্যা দিয়ে। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে দাবি করা
হয়েছে সন্ত্রাসী সংগঠন সন্দেহে পরিচালিত অভিযানের অনিচ্ছাকৃত ঘটনা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকদের অনেকে নিরাপত্তা বাহিনীর
হেফাজতে এসব মৃত্যুকে সরকারি বাহিনীর দ্বারা পরিকল্পিত হত্যাকা- বলে অভিহিত
করেছে। এইচআরডব্লিউ সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাপ্রবাহকে নিরাপত্তা বাহিনীর
হেফাজতে হত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি বলে অভিহিত করে মন্তব্য করেছে, বাংলাদেশ
মানবাধিকার সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করায়
সরকার এইচআরডব্লিউ’র বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনেছে। বিষয়টি
বিবেচনায় পরিচিত এক ধারা লক্ষ্য করা যায়। অসংখ্য অনুরোধ সত্ত্বেও বাংলাদেশে
সরকার এসব অপরাধের জন্য দায়ী কোন ব্যক্তিবর্গকে তদন্ত বা বিচারের আওতায়
আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে, তারা এটা করতে সম্মত নয়।
একারণেই আদালত হিসেবে সর্বশেষ গন্তব্য হওয়ায় এটা আইসিসি’র জন্য অত্যাবশ্যক
যে তারা অভিযোগগুলোর তদন্ত করবে; যখন কিনা একটি দেশ তাদের সরকারের ওপর
তদন্ত করতে অনিচ্ছুক। আইসিসি প্রসিকিউটর কাকে বিচারের আওতায় আনবে এটা
নিঃসন্দেহে তার নিজের বিবেচনা। দাখিলকৃত অভিযোগ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতির দায় মন্ত্রিপরিষদের আর পুলিশ কমিশনার, র্যাবের পরিচালক এবং
বিজিবি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ও পুলিশি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে,
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিজের অধীনে রেখে যেভাবে তিনি দেশ
পরিচালনা করছেন, তাতে সরকারি কর্মকা-ে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে অধিকতর বেশি
দ-যোগ্য বিবেচনা করার মতো কেউ নেই। এমনকি সরকারের উপদেষ্টাদেরও হয়তো অনেক
কিছুর উত্তর দেয়ার আছে। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব আহমেদ
ওয়াজেদও রয়েছেন। সরকারি উপদেষ্টা হিসেবে ডিসেম্বর মাসে তিনি একটি বিবৃতি
প্রকাশ করেন যেখানে তিনি বিরোধী ইসলামপন্থি দলের সদস্যদের নিশ্চিহ্ন করার
আহ্বান জানিয়েছেন। ওই বিবৃতি প্রকাশের পরের কয়েক দিনে বিরোধীদের কয়েক ডজন
সদস্য নিহত হয়েছেন। শুধু ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারিতেই কমপক্ষে ২১ জন বেসামরিক
লোক নিহত হয়। এখন রাজনৈতিক একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সজীব আহমেদের
আহ্বান আর পরের কয়েকদিনের মৃত্যুগুলোর সঙ্গে যথেষ্ট যোগসূত্র আছে কিনা এবং
তার বিরুদ্ধে অপরাধ অভিযোগ আনা হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত আইসিসি প্রসিকিউটরের।
এই সহিংসতা আর আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকার এ
পরিস্থিতিকে উদারমনা সেক্যুলারিজম আর কট্টর ইসলামিজমের দ্বন্দ্ব হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে।
No comments