‘ওয়ার্নিং শট’ হাদিসের বুকে by জাবেদ রহিম বিজন
তারাগন গ্রাম থেকে মাইল খানেক দূরত্ব হবে
ভারত সীমান্তের। সীমান্ত এলাকা বলে প্রতিনিয়তই এখানকার মানুষের সঙ্গে
ওঠাবসা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। সহজ সম্পর্ক। কিন্তু সেই বাহিনী (বিজিবি) কেন
এমন অ্যাকশনে গেল তার কোন হিসেব মেলাতে পারছেন না এ গ্রামের মানুষ।
বাড়িঘরের টিনের বেড়া, মাটির দেয়াল জুড়ে গুলির চিহ্ন। ঘটনার ভয়াবহতা আর
গুলির শব্দে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকেই।
বিজিবি’র
দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন তারা ‘ওয়ার্নিং শট’ করেছেন। ওয়ার্নিং শট
কিভাবে মানুষের জীবন কেড়ে নেয় তার হিসাব মেলাতে পারছেন না এ গ্রামের
মানুষ। সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে গ্রামের মানুষের মধ্যে তা হচ্ছে
গুলি চালানোর মতো কোন বাস্তবতা না থাকলেও সেদিন বিজিবি কেন গুলি চালালো। গত
২৩শে মার্চ আখাউড়া উপজেলা পরিষদের ভোট চলাকালে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে
তারাগন কেন্দ্রের ভেতরে সরকার সমর্থক প্রার্থীর লোকজন জাল ভোট দিচ্ছে খবরে
কেন্দ্রের আশপাশে অবস্থানরত বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
তারা এর প্রতিবাদ করলে গুলি চালায় বিজিবি। এতে গুলিবিদ্ধ হন উপজেলা যুবদলের
সহ-সভাপতি হাদিস মিয়া। তাকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু
হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হাদিস তার বড় ভাই আখাউড়া পৌর বিএনপি’র সভাপতি
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাহার মিয়াকে বিজিবি সদস্যরা মারধর করতে থাকলে
তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যান। তখনই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিজিবি। নিহত
হাদিসের স্ত্রী আছিয়া খাতুন পাখি বলেন, জাল ভোট দেয়ার প্রতিবাদ করায় তার
স্বামীকে গুলি করে মেরেছে বিজিবি। তার কথা, ‘এরা আমার স্বামীর পায়ে গুলি
করলেও তো সে বাইচ্চা যাইতো। সরকার কি এমন নতুন বাহিনী পাঠাইছে যারা মানুষ
মারতে আইছে?’ এদিকে হাদিস মিয়ার পরিবারে শোকের মধ্যে ভর করেছে আতঙ্ক। ঘটনার
পর পুলিশ ও বিজিবি’র দেয়া দু’টি মামলায় এই পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার
করা হতে পারে সেই আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এখন তাদের। ঘটনার দিন রাতেই আখাউড়া
থানার সাব ইন্সপেক্টর মৃণাল দেবনাথ বাদী হয়ে হাদিস হত্যা ঘটনায় অজ্ঞাত
২/৩শ’ জনকে আসামি করে একটি এবং বিজিবি’র নায়েক সুবেদার আলী আরশাদ বাদী হয়ে
ঘটনার সময় বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন। এতেও
অজ্ঞাত ২/৩শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। মর্গে ভাইয়ের লাশ রেখে বাড়ি ফেরার পথে
পুলিশ হাদিসের ছোট ভাই মিজানকে আটক করে। পরে অবশ্য ছেড়ে দেয়া হয় তাকে।
তারাগন গ্রামের মৃত আফতাব মিয়ার ৪ ছেলের মধ্যে হাদিস তৃতীয়। সৌদি আরব ও
সিংগাপুর প্রবাসে কাটিয়েছেন প্রায় ১৭ বছর। বছর দুয়েক আগে দেশে ফিরে আসেন।
তার বড় ভাই বাহার মিয়া আখাউড়া পৌর বিএনপি’র সভাপতি ও স্থানীয় ৯ নম্বর
ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাকে কেন্দ্র করেই বিএনপি’র সংগঠন সেখানে চাঙ্গা।
তারাগন গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় বাহারদের বাড়ি। হাদিস আলাদা বাড়িতে থাকতেন।
নতুন রঙে ঝকঝকে বাড়িটি এখন ফাঁকা, তালাবদ্ধ। তার স্ত্রী পাখি রয়েছেন ভাশুর
বাহার মিয়ার বাড়িতে। হাদিসের তিন কন্যা সন্তান। এর মধ্যে বড় মেয়েটি
প্রতিবন্ধী। ঘটনার পর থেকেই শয্যাশায়ী হাদিসের মা আর স্ত্রী। মঙ্গলবার
দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে শোকাতুর পরিবেশ। গ্রামের অনেকের সঙ্গেই
কথা হয় সেদিনের ঘটনা নিয়ে। তারা সবাই বলছেন বাহারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা
করাই ছিল উদ্দেশ্য। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেছেন। সেদিনের ঘটনার বিষয়ে
বাহার মিয়া জানান, বিজিবি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর এরশাদুল হক
কেন্দ্রে এসে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষের নেতৃস্থানীয় লোকজনের
সঙ্গে প্রথমে কথা বলেন। এরপর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ৫-৭ জন
কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে আমাদের সবাইকে বের করে দিয়ে ব্যালটে সিল মারতে থাকে।
তাদের কয়েকজন হচ্ছে জুয়েল মিয়া, মহসীন মিয়া, নাছির মিয়া, ছাত্রলীগ সভাপতি
তৎসন। আমি তখন এগিয়ে গিয়ে মেজরকে বলি, আর ১০ মিনিট পর ভোট শেষ হয়ে যাবে।
কেন্দ্রের ভেতর থেকে ওদেরকে বের করে দিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার
ব্যবস্থা করেন। স্যার আপনি বললে তারা (আওয়ামী লীগ সমর্থক) সব বন্ধ করে
দেবে। তখন তিনি বলেন, আমি দেখছি। এই কথা বলে চলে আসার সময় হয়তো আওয়ামী
লীগের লোকজনের কোন কথায় বা ইশারায় মেজর নিজে এসে আমাকে আক্রমণ করেন। তিনি
লাঠি দিয়ে পেছন থেকে প্রথমে গুঁতো মারেন আমাকে। এরপর মারতে শুরু করেন। এই
অবস্থায় আমার ভাই এগিয়ে এসে আমাকে মারধর করার কারণ জানতে চাইলে তাকে লক্ষ্য
করে গুলি করা হয়। বাড়িঘরে ঢুকেও বিজিবি সদস্যরা অ্যাকশন চালায়। কেন্দ্রের
আশপাশের বাড়ির মেয়ে ছেলেরা তখন দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন। গ্রামবাসী
জানান, ভোট সারা দিনই উৎসবমুখর পরিবেশে, শান্তিপূর্ণ ভাবে চলছিল। গুলি
চালানো দূরে থাক কোন অ্যাকশনে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়ে ওঠেনি। তারপরও
বিজিবি গুলি চালিয়েছে কেন ? এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না ওই
গ্রামের মানুষ। তারাগন পশ্চিম পাড়ার সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা সব সময়
এখানে ঈদ-উৎসবের আনন্দ নিয়েই ভোট দিয়েছি। জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি। আরেকজন
হাজী হেবজু মিয়া বলেন, বাঁশির আওয়াজ আর হট্টগোল শুনে বাসার গেইট খুলে দেখি
বিজিবি একদলকে উত্তর দিকে আরেক দলকে দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নিচ্ছে। কাউন্সিলর
বাহার মিয়া সেখানেই ছিল। তিনি সরে যাননি। তখনই তাকে মারধর করতে শুরু করে। এ
সময় কিছু লোক কেন্দ্রের পেছনের রাস্তা দিয়ে ধরধর করে এগিয়ে আসে। তখনই
ফায়ার শুরু হয়ে যায়। বিজিবির গুলির চিহ্ন তারাগন সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের বাড়িঘরে। অনেক বাড়ির মাটির দেয়াল ভেদ করে পেড়িয়ে
গেছে গুলি। ভয়ে-আতঙ্কে বাড়ির বউ-ঝিদের সবাই দরজা বন্ধ করে বসে ছিলেন ওই
সময়। শামসুন্নাহার নামের একজন জানান, বিজিবি অনেক অত্যাচার করেছে। মহিলাদের
ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। হেপি আক্তার। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষা করছেন
রেজাল্টের। বিজিবি’র অ্যাকশনে তার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বড় ঝড়। ঘটনার
পর থেকেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ তার। অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে
যেতে হয় তাকে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য তার চোখের পর্দায় জ্বলজ্বল করছে এখনও। এ নিয়ে
কথা বলার পুরো সময় নীরবে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে তার দু’চোখ দিয়ে। বিজিবি’র ১২
ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এরশাদুল হক সাংবাদিকদের জানান, কিছু
লোক ভোট কেন্দ্র দখলের চেষ্টায় চারদিক থেকে তাদের বাহিনীর ওপর ইট-পাটকেল
ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এসে কেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালায়।
আক্রমণকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে বিজিবি চারটি গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় এক ব্যক্তি
গুলিবিদ্ধ হন। তবে নিহত হাদিস মিয়ার স্ত্রী আছিয়া খাতুন পাখি বলেন, আমার
স্বামী জাল ভোট দেয়ার প্রতিবাদ করার কারণেই তাকে গুলি করে মারা হয়েছে।
হাদিসের মৃত্যুর পর থেকেই শয্যাশায়ী তিনি। থামছে না চোখের জল। তিনি এবং তার
ভাশুর বাহার মিয়া দু’জনই এই হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন সরকারের
কাছে।
No comments