ভারতের নির্বাচন- সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকা by কাজী আলিম-উজ-জামান
এপ্রিল ও মে মাসজুড়ে কয়েক দফায় ভারতের লোকসভা নির্বাচন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এখন নির্বাচনী প্রচারণায় উত্তাল। এবারের নির্বাচন বিশেষত দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই নির্বাচন সামনে রেখে কয়েক মাস ধরে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে মূলত এ কারণে যে, এই দলটির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি। দলকে ছাপিয়ে গেছেন তিনি। ২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নেপথ্যের এই হোতা আবির্ভূত হয়েছেন দক্ষ প্রশাসক ও উন্নয়নকামী নেতা হিসেবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ আগাম বলে দিচ্ছেন, এবার ক্ষমতায় মোদিই আসছেন।
অন্যদিকে কংগ্রেস আছে একটু ঢিমেতালে। প্রচারণায়ও খানিকটা ম্রিয়মাণ। কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে দলটিতে আছে গুমোট অস্বস্তি। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে দলটি প্রচার চালাচ্ছে বটে, তবে তেজি ভাব কম। ১০ বছর শাসনের পর তৃতীয় মেয়াদে কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।দ্বিতীয় যে কারণকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে, তা হলো এই নির্বাচনে ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রভাব। শুধু বিজেপি-কংগ্রেস নয়, নতুন দল আম আদমি পার্টিসহ (এএপি) বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলো সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, এই মাধ্যমে প্রচার চালাতেও নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নেওয়া এবং যা যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তার সিডি নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার বিধান আছে।
কোন দল কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছে? বারাক ওবামা ২০০৮ ও ২০১২ সালের নির্বাচনে এই মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে সফল হয়েছেন, বিজেপি সেখান থেকে ধারণা নিয়ে সফল হওয়ার চেষ্টা করছে। নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বেশি পছন্দ ইউটিউবকে; এটি তিনি ব্যবহার করছেন ২০০৭ সাল থেকে। তাঁর প্রতিদিনের সভা-সমাবেশ-বক্তৃতার ভিডিও নিমেষেই চলে আসছে ইউটিউবে। দলের কর্মী-স্বেচ্ছাসেবী-সমর্থকেরা তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করছেন। মোদি টুইটারে আসেন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে, আর ফেসবুকে ওই বছরের মে মাসে। দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, টুইটারে তাঁর ‘ফলোয়ার’ ৩০ লাখের ওপরে, ফেসবুকে এ পর্যন্ত ‘লাইক’ পেয়েছেন ৭৫ লাখের কাছাকাছি।
মোদি ব্লগিং শুরু করেন ওই বছরের এপ্রিলে, বাবাসাহেব আম্বেদকরের ১১৮তম জন্মদিনে। তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটও আছে। এসব মাধ্যমে মোদির জীবনের সংগ্রাম, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তিনি দরিদ্র মানুষের কল্যাণই জীবনের ধ্যান-জ্ঞান মনে করেন। সামান্য একজন চা বিক্রেতা থেকে আজ তিনি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। শৈশব থেকেই প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠা তাঁর অভ্যাস। দিনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিছানায় যান না।
এ ধরনের বার্তার মাধ্যমে সাধারণ ভারতীয়রা যেন নিজেদের মধ্যেই মোদিকে খুঁজে পাচ্ছেন। একই সঙ্গে তরুণেরা ভাবতে পারছেন, চেষ্টা-পরিশ্রম করলে একদিন মোদির মতো হওয়া অসম্ভব নয়। তবে যাঁরা মোদির বিপক্ষে, তাঁরা আবার তাঁকে একজন ভয়ংকর, সাম্প্রদায়িক, ‘ফেকু’ নেতা হিসেবে চিত্রিত করতে ছাড়ছেন না।
তবে সত্যিকার অর্থে সামাজিক গণমাধ্যমের সৃষ্টি রাজনৈতিক দল আম আদমি পার্টি (এএপি)। এই মাধ্যমে বিজেপি যদি হয় ‘ক্ষমতাসীন দল’, তবে বিরোধী দল বলতে হবে এএপিকে। ফেসবুক, টুইটার, গুগলপ্লাস, লিঙ্কডইন—সব মাধ্যম জোরেশোরে ব্যবহার করছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ভোট দিতে এবং দলীয় তহবিলে চাঁদা দিতে এই মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণদের উৎসাহিত করছেন তিনি। কেবল দেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যেও। কেজরিওয়ালের ভালো ভালো কথা শুনে শিশুরা মা-বাবাকে বলছে এএপিকে ভোট দিতে। সে তুলনায় কংগ্রেসকে সামাজিক গণমাধ্যমের ব্যাপারে ততটা উৎসাহী মনে হচ্ছে না। স্বয়ং রাহুল গান্ধীর কথাই ধরা যাক। দেশ-বিদেশে পড়াশোনা
করা প্রখর মেধাবী এই তরুণ টুইটারেও নেই, ফেসবুকেও নেই। তবে দলের অন্যান্য নেতা এই মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন।
ভারতের জনসংখ্যা ১২৫ কোটি; ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২ কোটির কাছাকাছি। ক্রমাগত এ সংখ্যা বাড়ছে। একটি জরিপ বলছে, লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে অন্তত ১৬০টিতে সামাজিক গণমাধ্যম প্রভাব রাখতে পারে। আবার মুদ্রার উল্টোপিঠে আছে বিবর্ণ চিত্র। সরকারি হিসাবেই সে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে ২৭ কোটি মানুষ। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৫০ কোটির কাছাকাছি। বয়স্ক নিরক্ষরের সংখ্যাও ভারতে বেশি, প্রায় ২৯ কোটি।
ভারতে ২৯টি রাজ্য। জাত-পাতসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যু ভোটের মাঠ গরম করে। তাই সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারণা ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত কতটা প্রভাব রাখতে পারবে, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। তা ছাড়া এই মাধ্যমে মোদি বা কেজরিওয়ালের ভক্ত-অনুসারীর সংখ্যা যত বলা হচ্ছে, তার সত্যতাও প্রশ্নাতীত নয়। এত ভক্ত-অনুসারী, যাঁরা অনবরত লাইক দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের কতজন ব্যালটে সিল দেবেন, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। তারপরও বিজেপি, এএপি ও কংগ্রেসের নেতৃত্ব আশাবাদী, কিছুটা হলেও প্রভাব রাখবে ইন্টারভিত্তিক সামাজিক গণমাধ্যম। তাঁদের কাছে ফলাফলের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে এটুকুই অনেক।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
alim_zaman@yahoo.com
No comments