রুশ-ইউক্রেন বিরোধ- ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস by মুশফিকুর রহমান
ইউক্রেন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার মধ্যে
ইউরোপজুড়ে অন্যতম আশঙ্কা, রাশিয়ার জ্বালানি গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন
থাকবে কি না। মনে রাখা দরকার, ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জ্বালানি গ্যাসের
সরবরাহ পাইপলাইন দিয়ে আসে রাশিয়া থেকে। পূর্ব ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত
অনেক দেশের প্রায় শতভাগ জ্বালানি গ্যাসের সরবরাহ আসে গাজপ্রমের কাছ থেকে।
জার্মানি (৩৬ শতাংশ), গ্রিস (৭৬ শতাংশ), অস্ট্রিয়া (৪৯ শতাংশ), ইতালি (২৭ শতাংশ), ফিনল্যান্ড (১০০ শতাংশ), সুইজারল্যান্ড (১২ শতাংশ), ফ্রান্সসহ (১৪ শতাংশ) পশ্চিম ইউরোপের নির্ভরতা রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ওপর। পৃথিবীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জ্বালানি গ্যাসের মালিকানা রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি গাজপ্রমের নিয়ন্ত্রণে। রাশিয়ার জাতীয় রাজস্ব আয়ের প্রায় অর্ধেক আসে গাজপ্রম ও তার অধীন কোম্পানির তেল ও গ্যাস বিক্রির অর্থ থেকে।
তা ছাড়া মধ্য এশিয়া, ককেশাস অঞ্চল ও কাস্পিয়ান সাগরের গ্যাস পরিবহনের জন্য ইউরোপ অভিমুখী প্রধান পাইপলাইনগুলোর মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণও রাশিয়ার হাতে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে জ্বালানির জন্য রাশিয়া ও নরওয়ের পাইপ গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হয়।
পশ্চিম ইউরোপের গ্যাস পাওয়ার আরও একটি উৎস উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়া। নরওয়ে ও আলজেরিয়া উভয়ের গ্যাস উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ২০৩০ পর্যন্ত আলজেরিয়া তার চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ অটুট রাখতে পারবে কি না এ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতায় তুলনামূলক সস্তা ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি গ্যাসের ওপর ইউরোপকে নির্ভর করতেই হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থা এলএনজি বা তরলীকৃত আমদানি করা গ্যাস আরও ব্যয়বহুল।
ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত ইউক্রেনকে রাশিয়া ১৫ বিলিয়ন ডলারের যে সহায়তা প্যাকেজ দিতে সম্মত হয়েছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার বিপরীতে ১১ বিলিয়ন ডলার সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তবে এ জন্য যেসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ঝুঁকি ইউক্রেনকে নিতে হবে, সে জন্য দেশটি আদৌ প্রস্তুত নয়।
তা ছাড়া গ্রিসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঋণ নিয়ে যে যন্ত্রণার প্রলম্বিত সংস্কার-প্রক্রিয়া দেখতে হচ্ছে, তাতে সিংহভাগ রুশ-অধ্যুষিত ইউক্রেনকে তা কতটুকু প্রলুব্ধ করবে বলা মুশকিল। গত ডিসেম্বরে ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘বাণিজ্য-সহায়তার’ প্রলোভন থেকে সরে গিয়ে বরং রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকেছিল। একই সঙ্গে ইউক্রেনের জন্য গাজপ্রমের পাইপলাইন থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ৩০ শতাংশ কম মূল্যে পাওয়ার সুবিধা আদায় করেছিল। ইউক্রেনের জ্বালানি গ্যাসের ৬৪ শতাংশ এখনো রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
সাম্প্রতিক সংকটের পটভূমিতে রুশ সরকার জানিয়ে দিয়েছে, আগামী মাস থেকে গ্যাসের মূল্যছাড় ইউক্রেনের জন্য আর বহাল থাকছে না। এখন থেকে ইউক্রেনকে প্রতি এক হাজার ঘনমিটার গ্যাসের জন্য প্রায় ৪০০ মার্কিন ডলার মূল্য পরিশোধ করতে হবে। গাজপ্রম বলছে, তারা ২০১৩ সালে ইউক্রেনকে ১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস সরবরাহ করেছে; ইউক্রেন সে মূল্য পরিশোধ করেনি। এ বকেয়া পরিশোধ না করলে রাশিয়া ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে।
ইউক্রেনের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে গাজপ্রমের ইউরোপে রপ্তানির মাত্র ১৫ শতাংশ গ্যাস এখন সঞ্চালন করা হয়। গাজপ্রম বেলারুশের ভেতর দিয়ে একটি ও বাল্টিক সাগর দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত একটি পৃথক নতুন গ্যাস পাইপলাইন (নর্থ স্ট্রিম) নির্মাণ করায় ইউরোপীয় বাজারমুখী গাজপ্রমের অর্ধেক গ্যাস ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। গাজপ্রমের পরিকল্পিত কৃষ্ণসাগর থেকে ইউরোপকে সংযোগকারী ‘সাউথস্ট্রিম’ নামের নতুন গ্যাস পাইপলাইনের নির্মাণ ২০১৫ নাগাদ সম্পূর্ণ হলে ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপে পৌঁছাবে।
রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক ইউক্রেনসংকটে রুবলের ব্যাপক পতন ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৩ মার্চ ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বিক্রি করতে হয়েছে। মস্কোর শেয়ারবাজারেও ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধের হুমকির প্রভাব পড়েছে। রাশিয়া ‘সমাজতন্ত্রের’ দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন পুঁজিবাদের দেশ। রুশ পুঁজি ও সেখানকার বাজারসংশ্লিষ্ট কেউই বিশ্ববাজার থেকে নিজেদের এখন বিচ্ছিন্ন করতে আগ্রহী নয়। গাজপ্রমও চায় না ইউরোপের বাজারে তার রাজস্ব আয় হ্রাস পাক। সুতরাং পরস্পর নির্ভরতার কারণে সামরিক শক্তির বদলে সংলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেনসংকট কেটে যাবে বলে আস্থা প্রকাশের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী। জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments