কঠিন ঠিকই, তবে ফেলে রাখার নয়

খবরে প্রকাশ, তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিক কমে গেছে। এতে বৃহত্তর রংপুরের তিস্তার সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থা হুমকির মুখে। জানা যায়, বিষয়টি স্থায়ী সমাধান প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পাশাপাশি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। পত্রিকান্তরের খবর থেকে এটাও জানা যায়, সে বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে তিস্তা চুক্তি খুব কঠিন। আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি।’ সে বৈঠকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে আরও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছে ভারত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এ উদারতা প্রশংসার দাবি রাখে। ভারতে ইতিমধ্যে লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। এটা সামনে রেখে তিস্তা চুক্তিটি এখনই হওয়ার কথা নয়। আর এ-জাতীয় একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন সহজও নয়। কঠিন বটে। তবে কঠিন বলেই ফেলে রাখার নয়। এর সমাধান করতে হবে ন্যায় ও বাস্তবতার নিরিখে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন।
সে সময়েই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। উভয় পক্ষের মধ্যে আগাম আলোচনার মাধ্যমে চুক্তির একটি ভিত্তিও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির মুখে ভারত সরকার তখনকার মতো চুক্তিটি স্বাক্ষরে অপারগ হয়। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক উন্নতি লক্ষণীয় হচ্ছে না। কিন্তু দুটি বন্ধুপ্রতিম দেশের সম্পর্ককে ক্রমবর্ধমানভাবে জোরদার করতে এটার আবশ্যকতা রয়েছে। আর তা দরকার যত দ্রুত সম্ভব। উল্লেখ্য, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে এ ধরনের নদী রয়েছে ৫৪টি। ভারতের সিকিম রাজ্যে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে এর উৎস। ভারতের অংশে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ অংশের নীলফামারী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছে। ৩০৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটি বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১১৫ কিলোমিটার। বৃহত্তর রংপুরের পাঁচটি জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এটা চিলমারী বন্দরের কাছে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। এ পাঁচটি জেলার অনেক আবাদি জমিসহ বহু জনপদ তিস্তার ওপর নির্ভরশীল। ঠিক তেমনিভাবে নির্ভরশীল পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল ও সিকিমের কিছু অংশ। তাই এর ওপর একক অধিকার কারও নেই। ভাটির দেশের সম্মতি ব্যতিরেকে উজানে এর গতিপথ থেকে পানি ভিন্ন পথে সরিয়ে নেওয়াও যথার্থ নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে তা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ন্যূনতম চাহিদা আর ন্যায়নীতির নিরিখে একটি চুক্তি সম্পাদন জরুরি।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময়ে তিস্তা চুক্তি না হলেও স্বাক্ষরিত হয়েছিল স্থলসীমান্ত চুক্তি। এ চুক্তিটি মূলত ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নসংক্রান্ত রূপরেখা। এটা বাস্তবায়িত হলে দুটি দেশের বেশ কিছু মানুষের নিত্য ভোগান্তির অবসান ঘটত। এতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমারেখার মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার একরের ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশ পাওয়ার কথা রয়েছে। ঠিক তেমনি ভারতীয় ভৌগোলিক সীমায় সাত হাজার একরের ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল পাবে ভারত। বস্তুতপক্ষে এটা বর্তমান বাস্তব অবস্থার আইনানুগ স্বীকৃতি। এখন এসব ছিটমহলে বসবাসকারী ব্যক্তিরা কার্যত একরূপ বন্দী জীবন যাপন করছে। ‘নিজ দেশের’ পরিসেবাসহ প্রায় সবকিছু থেকে তারা বঞ্চিত। ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে ‘ভিনদেশের’ সুবিধাদি তাদের নিতে হয়। মনমোহন সিং সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সংবিধান সংশোধনে একটি বিল গত ডিসেম্বরে রাজ্যসভায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের আসন্ন নির্বাচনের ফলাফল অনিশ্চিত। ঠিক তেমনিভাবে অনিশ্চিত এ চুক্তি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা। তা-ও আমরা আশাবাদী থাকতে চাই। সমস্যাগুলোর সমাধান সহজসাধ্য নয়, এটা বলাবাহুল্য। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও দল সময়ে সময়ে স্থানীয় স্বার্থে এসব বিষয়ে অনড় অবস্থান নিয়ে থাকে। আর জোটনির্ভর কেন্দ্রীয় সরকার সে ক্ষেত্রে সবল কার্যক্রম নিতে পারে না। তবে ব্যতিক্রমও আছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেন। তখন দিল্লিতে ক্ষমতাসীন ছিল দেবগৌড়ার নেতৃত্বাধীন একটি সংখ্যালঘু জোট সরকার। গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নদী। তা সত্ত্বেও সে চুক্তি সম্পাদনের জন্য ভারত সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছিল ওই রাজ্য। তেমনি দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে প্রয়োজন ছিল তিন বিঘা আয়তনের একটি করিডর।
সেটার বিধান ১৯৭৪ সালের চুক্তিতে থাকলেও অনেক পরে বাস্তবায়িত হয়েছে। এর ওপর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলেও ছিটমহলবাসী ও বাংলাদেশের প্রয়োজন অনেকটাই মিটছে। এটা নিয়েও সীমান্তের ওপারে বাধাবিঘ্ন অনেক ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দৃঢ়তার সঙ্গে সেগুলো অতিক্রম করে তথাকার সরকার। যৌথ অংশীদারির যেকোনো কিছুতে স্থানীয় জনগণ পুরোটাই চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতি অনুসরণে যার যা প্রাপ্য, তা নিশ্চিত করতে হবে উভয় দেশের সরকারকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু ক্ষেত্রে তা ঘটছে না। ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর দেশ ভারতকে তার রাজ্যগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়। তবে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে মতামত যৌক্তিক হওয়া দরকার। এমনটা করা না হলে উদীয়মান পরাশক্তি ভারতের মর্যাদা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরদার হবে না। কথাটা বলেছেন ভারতের রাজ্যসভার সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মনিশঙ্কর আইয়ার গেল বছরের অক্টোবরে। তাঁর মতে, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ভারতের কোনো ক্ষতিই হবে না। ভারত সরকারের এটা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার বলেও তিনি মত ব্যক্ত করেন। অন্য অমীমাংসিত বিষয়গুলো সম্পর্কেও তিনি এ ধরনের উদার মত ব্যক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে উভয় পক্ষের উদারতার প্রয়োজন রয়েছে। ভারত আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি ভারতবিরোধী মহল আমাদের দেশে বরাবর আছে। যেমনটা ভারতেও এ ধরনের একটি মহল রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর এরা জোরদার হয়। পরিস্থিতি যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে থাকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি গোষ্ঠী। এগুলো সে দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে শীতল করেছে সন্দেহ নেই।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে মহাজোট সরকার অত্যন্ত সফলভাবে এর প্রতিকার করে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আশ্রয়স্থল কিংবা অস্ত্র সরবরাহের রুট হিসেবে যাতে এ দেশের ভূমি ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে সরকার সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্থল, রেল ও নৌপথ ব্যবহার করতে দেওয়ার নীতি নিয়েছে এ সরকার। এটা পরিপূর্ণ রূপ না পেলেও সীমিত আকারে চলছে। পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওভার ডাইমেনশনাল মালামাল আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় নেওয়া হয়েছে। সাময়িকভাবে হলেও তখন তিতাস নদে বাঁধ দিতে হয়েছিল। এগুলো সবই কঠিন সিদ্ধান্ত। তবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে আবশ্যক ছিল। আমরা যৌক্তিক মূল্যে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এখন আরও ১০০ মেগাওয়াট যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা হলো। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসে মহাজোট সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করতে যে ভূমিকা নিয়েছে, ভারতের পক্ষ থেকে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, স্থলসীমান্ত চুক্তিসহ মৌলিক কিছু বিষয়ে গঙ্গা চুক্তির ন্যায় উদারতা আশা করা অমূলক হবে না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ভারতের কিছু কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের আশাহত করে। এগুলো বাংলাদেশে ভারতবিরোধী অংশটিকেই চাঙা হতে সহায়তা করার কথা। তবে ভারত সরকার ও ভারতীয় সিভিল সমাজের উদার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের আশাবাদকে জোরদার করে। তিস্তা চুক্তি করা আর স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের কাজগুলো সহজ না হলেও এগুলোর আবশ্যকতা উপেক্ষা করার মতো নয়। আমাদের ক্ষেত্রবিশেষে কঠিন কাজও করতে হয়। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। ভারত অতীতে আমাদের জন্য অনেক কঠিন কাজ করেছে। এখনো কঠিন বলেই সামনে আসা সমস্যাগুলো ফেলে রাখবে না—এমন আশাবাদী আমরা হতে চাই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.