হলফনামা- কেন এই স্ববিরোধিতা? by বদিউল আলম মজুমদার
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয়
সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্প্রতি মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদের
হলফনামা দেওয়ার বিধানের সমালোচনা করে বলেন, ‘এই হলফনামা এখন রাজনীতিবিদদের
চরিত্র হনননামায় পরিণত হয়েছে।’ নির্বাচন কমিশনে হলফনামা জমা দেওয়ার আইন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথাও তিনি বক্তব্যে উল্লেখ করেন। (প্রথম আলো, ৪
মার্চ ২০১৪)। জনাব ইসলামের বক্তব্য পড়ে আমরা হতবাক হয়েছি, কারণ এ ধরনের
বক্তব্য দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণেরই সমতুল্য।
স্মরণ করা যেতে পারে যে ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া বনাম অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফর্মস [(২০০২)৫ এসসিসি ২৯৪] ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ২০০২ সালে দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে: ভারতীয় ‘সংবিধানের ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদে (বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে) বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোট প্রদান ভোটারের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ ভোটার মত প্রকাশ বা বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করেন ভোট প্রদানের মাধ্যমে। তাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি। গণতন্ত্র টিকে থাকার জন্য এমপি ও এমএলএ পদে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অতীত তাঁদের অপরাধসংক্রান্ত অতীতসহ ভোটারদের জানা অতি প্রয়োজন ও জরুরি। ফলে ক্ষুদ্র ব্যক্তিটিও একজন আইন ভঙ্গকারীকে আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত করবেন কি না, তা আগেই বিবেচনায় আনতে পারেন।’ প্রসঙ্গত, বাক্স্বাধীনতা তথা মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্য হলো যে এ স্বাধীনতা সাধারণত আইন করেও রহিত করা যায় না।
পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া [(২০০৩)৪ এসসিসি] মামলার রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেন, ‘এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তবে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে, যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানেন। তাঁদের “এ” কিংবা “বি”-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুও হবে না, নিরপেক্ষও না।’ এ ছাড়া আদালত বলেন, ‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্র ও উপহাসে বা প্রহসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি।’ অর্থাৎ নির্বাচনকে কলুষমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার লক্ষ্যেই প্রার্থীদের তথ্য প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আমাদের উচ্চ আদালতও আবদুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ মামলার (রিট পিটিশন নম্বর ২৫৬১/২০০৫) রায়ে প্রায় একই ধরনের যুক্তি উত্থাপন করা হয়। রায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, মামলার বিবরণী এবং নিজেদের ও নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আয়-ব্যয়, সম্পদ এবং দায়দেনার তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ছাড়া আদালত হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন, যাতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। (বিস্তারিত জানতে দেখুন ভূমিকা, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮: অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি, প্রথমা প্রকাশন, ২০১০)।
ক্ষমতাসীনেরা ভুলে গেছেন যে সম্পদের হিসাব দেওয়ার দাবি ছিল আওয়ামী লীগেরই এবং তারা একাধিকবার সম্পদের হিসাব প্রদানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকারও করেছিল, যদিও সেই অঙ্গীকার রক্ষায় তারা ব্যর্থ হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই তাঁর নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণ, কোনো রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের স্বার্থ জড়িত আছেন কি না, সে সম্পর্কে বিবরণ দিতে হবে... নির্বাচন কমিশনে আয়-ব্যয় ও সম্পদের মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ, ১১ দল, জাসদ ও ন্যাপের পক্ষ থেকে ২২ নভেম্বর, ২০০৫ তারিখে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ থেকে প্রকাশিত ‘অভিন্ন ঘোষণা’য় অঙ্গীকার করা হয় যে ‘রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে দুর্নীতি উচ্ছেদ করতে মন্ত্রী, এমপিসহ সব দলের রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের সম্পত্তির প্রকাশ্য হিসাব ও তার নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা হবে।’
এরপর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দু-দুবার সম্পদের হিসাব প্রদানের অঙ্গীকার করে। ‘দুর্নীতি নির্মূল’ শিরোনামে প্রথমে বলা হয়, ‘ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে।’ পরবর্তী সময়ে ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে অঙ্গীকার করা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’ অর্থাৎ সম্পদের হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশ করার অঙ্গীকারের ভিত্তিতেই ক্ষমতাসীনেরা ২০০৮ সালে জনগণের ভোট নেন। নির্বাচনের পরও অর্থমন্ত্রী নির্বাচনী ইশতেহার মোতাবেক সম্পদের হিসাব প্রদানের একাধিকবার অঙ্গীকার করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসব অঙ্গীকার রক্ষা করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী অবশ্য নিজের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করে ব্যক্তিগতভাবে দায়মুক্ত হয়েছেন।
ক্ষমতাসীনেরা নিশ্চয়ই জানেন যে দুর্নীতি ঘটে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আর দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নই জাতি হিসেবে আমাদের পেছনে টেনে রাখছে। রাজনীতির ‘দুর্নীতিকীকরণ’ এবং দুর্নীতির ‘রাজনীতিকীকরণ’ করা হয়। আর হলফনামার মাধ্যমে সম্পদের হিসাব প্রদান ও প্রকাশের বিধান বাতিল হবে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সুরক্ষা প্রদানেরই শামিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কেন হঠাৎ করে হলফনামার বিধান বাতিলের পক্ষে অবস্থান নিলেন? এটা কি স্ববিরোিধতা নয়?
আমরা মনে করি যে আমাদের নির্বাচনী অঙ্গন তথা রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হলে হলফনামা প্রদানের বিধান একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। এর জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে হলফনামার ছকটিতে কিছু পরিবর্তন আনা। যেমন, প্রার্থীর ‘প্রাইভেট ইন্টারেস্ট’ বা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সস্পৃক্ততার তথ্য এবং সম্পদের মূল্য প্রকাশের বিধান ছকে অন্তর্ভুক্ত করা। এর ফলে প্রার্থীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কে ভোটাররা জানতে পারবেন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব উপেক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হবে।
হলফনামার বিধানটি সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে যদি নির্বাচন কমিশন এগুলোকে খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়; এবং সে ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে। এটি করা হলে হলফনামা সত্যিকারার্থে ‘আমলনামায়’ পরিণত হবে।
আমাদের দেশে বেশ কিছুদিন থেকেই অনেক অরাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশেষত ব্যবসায়ীকে রাজনৈতিক অঙ্গনে উড়ে এসে জুড়ে বসতে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের কেউ কেউ প্রচুর অর্থকড়ি ব্যয় করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেন এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে আরও বিত্তশালী হন। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের রাজনীতি আজ একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
যেহেতু হলফনামায় তথ্য গোপন করলে সাংসদ হওয়া যায় না এবং থাকাও যায় না, তাই নির্বাচন কমিশন হলফনামার তথ্য খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলে অনেক বসন্তের কোকিল ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকেই নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা যাবে। ফলে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া কলুষমুক্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের জবাবে আমাদের প্রশ্ন: আসলেই কে কার চরিত্র হনন করছে? অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে রাজনীতিবিদেরাই মূলত নিজেরাই নিজেদের চরিত্র হনন করেন। তাঁরাই প্রতিনিয়ত একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসের অভিযোগ উত্থাপন করেন। তাঁরাই একে অন্যকে রুচিবহির্ভূত ভাষায় গালাগাল করেন। এমনকি তাঁরা নাগরিকদের হুমকি দিতেও দ্বিধা করেন না।
অনেকেরই মনে আছে যে ২০০৫ সালে হলফনামা প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টিকারী হাইকোর্টের রায়ের পর চারদলীয় জোট সরকারের প্রতি কিছু অনুগত ব্যক্তি জালিয়াতির মাধ্যমে আবু সাফা নামের এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পক্ষে আপিল দায়ের করে হাইকোর্টের রায়টি খারিজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা আইন করেও এ ধরনের আদালতের রায় ভন্ডুল করতে গিয়ে অসফল হন। তাই আশা করি, আমাদের ক্ষমতাসীন দল এমন অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments