অবমুক্ত থাকুক জাতীয় সংসদ ভবন
জাতীয় সংসদ ভবন ঘিরে নির্মিত হচ্ছে সাড়ে আট ফুট উঁচু লোহার বেষ্টনী। সংসদ সচিবালয়ের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করছে পূর্ত মন্ত্রণালয়। লুই আই কানের মূল নকশার বাইরে গিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের চারদিকে এই বেষ্টনী নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, এখন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়নি। লুই কানের নকশায় সংসদ ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম দিকের লন ও দক্ষিণ প্লাজা সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। মূল ভবনের সঙ্গে উন্মুক্ত স্থান রাখার তাৎপর্য এই যে সংসদে যাঁরা বসবেন, তাঁদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের নৈকট্য প্রকাশ পাবে স্থাপত্যশৈলীর ভেতর দিয়ে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে এই নৈকট্য ও একই তলে অবস্থান গণতন্ত্রের তাৎপর্যকেও ধারণ করে। লুই আই কান এ দেশের মাটি, গাছপালা, আলো-জল-হাওয়ার সঙ্গে একটি সুর বজায় রেখে গোটা স্থাপত্যের নকশাটি করেছিলেন। ফলে এই স্থাপত্যের চারদিকে নকশাবহির্ভূত লোহার বেষ্টনী স্থাপত্য নির্মাণের পেছনে থাকা তাৎপর্যকে নস্যাৎ করবে; মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ততার প্রতীকী যোগাযোগকে ছিন্ন করে এর নান্দনিক দিক ও স্থাপত্যমান বিনষ্ট করবে।
সংসদ ভবনের চারদিকে লোহার শিক দিয়ে বেষ্টনী নির্মাণে সংসদ সচিবালয়ের সিদ্ধান্তে ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’র বিষয়টিই অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। লোহার বেষ্টনী কি সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে? নকশা অমান্য করে লোহার খাঁচা না বানিয়ে অন্য কোনো উপায়ে কি এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত না? ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি বাড়ানোসহ উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কি করা যেত না এই নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান? এটা স্পষ্ট যে সংসদ সচিবালয় নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। কিন্তু একটি স্থাপত্য, যা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের গণতন্ত্রের তাৎপর্যকে ধারণ করে, তার স্থাপত্যমানকে দেখভাল করার কি কেউ নেই? দেশে নিরাপত্তাঝুঁকি যদি বেড়ে গিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে খাঁচাই কি সমাধান? নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়লে সরকারের তো প্রধান দায়িত্ব সেই ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা। নয়তো মানুষ এবং স্থাপত্য রক্ষায় লাখ লাখ খাঁচাই কেবল বানাতে হবে। লুই কানের নকশা অক্ষুণ্ন রেখে অন্য সব উপায়েই সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো যেত। সেসব উপায়ের ক্ষেত্রে তো কোনো বাধা ছিল না।
বিশ শতকে নির্মিত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যগুলোর একটি আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন। এটিকে জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই দেখে মানুষ। এই স্থাপত্য যাতে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পায়, সে ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নানা উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সংসদ ভবনের স্থাপত্যমান রক্ষায় কোনো সরকারেরই সুদৃষ্টি নেই। আশির দশকে এরশাদ যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন প্রথমবারের মতো বেষ্টনী নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। কিন্তু প্রতিরোধের মুখে বাতিল হয় সেই সিদ্ধান্ত। বিগত সংসদও সংসদ ভবন এলাকার চারপাশে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণের চেষ্টা করেছিল। পরিবেশ ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের আপত্তির মুখে বাতিল হয়েছিল সেই পরিকল্পনা। তবে নতুন করে যে এই লোহার বেষ্টনী নির্মিত হচ্ছে, পরিবেশ ও স্থাপত্য অধিদপ্তর তাতে কী করে অনুমতি প্রদান করল? নাকি এবার স্থাপত্য অধিদপ্তরের পরামর্শ ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে এই স্থাপনা?
সংসদ ভবনের ভেতর ও বাইরে লুই কানের মূল নকশাবহির্ভূত অনেক স্থাপনাই নির্মাণ করা হয়েছে। আর এসবই এই স্থাপত্যের স্থাপত্যমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গণপূর্ত বিভাগের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে সংসদ ভবনের ভেতরে কক্ষের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, অথচ লুই কানের নকশা অনুযায়ী মোট কক্ষ ছিল ৪০০। ভবনের ভেতর অনেক কক্ষ বানানো হয়েছে কাচ ও কাঠের বেড়া দিয়ে। লুই কান ভবনের ভেতর আলো-বাতাস প্রবেশের এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক আলো ছাড়াই কাজ করা সম্ভব হয়। কিন্তু নতুন নতুন স্থাপনা সেসব আলো-হাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। নকশা অমান্য করে সংসদ ভবন এলাকায় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাড়ি বানানো হয়েছে। এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছিল এবং স্থাপনা নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি বাড়ি নির্মাণ হয়েছে। হাইকোর্ট সে সময়ে, ২০০৪ সালে, সংসদ ভবন এলাকায় লুই আই কানের নকশার বাইরে যেকোনো রকম স্থাপনা নির্মাণকেই বে-আইনি ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। এ সময় হাইকোর্ট জাতীয় সংসদ ভবনকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণারও নির্দেশনা দেন। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৩)
আমরা স্মরণ করতে পারি, সংসদ ভবনের উত্তর ফটক বন্ধ করে যখন একটি টেলিভিশন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয় তখন নকশাবহির্ভূত এই স্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল। তখন সংসদ সচিবালয়ের কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, লুই আই কানের নকশাবহির্ভূত কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়ে থাকলে তা ভেঙে ফেলা হবে। সে সময়ে, ২ জুন ২০১৩ ওই কমিশনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জাতীয় সংসদ ভবন বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শন। এর স্থাপত্যমান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। লুই কানের মূল নকশার বাইরে কোনো ধরনের পরিবর্তন করা যাবে না। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৩) কিন্তু আমরা এখন লুই কানের নকশার বিপরীতে লোহার বেষ্টনী নির্মিত হতে দেখছি।
প্রধানমন্ত্রী গত সংসদে বলেছিলেন, লুই কানের নকশা বদলানো যাবে না। এর স্থাপত্যমান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। তিনিই বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী। আমরা আশা করছি, অবিলম্বে সংসদ ভবন এলাকার চারপাশে লোহার বেষ্টনী নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তিনি তাঁর নিজের বক্তব্যের সত্যতা রক্ষা করবেন। একই সঙ্গে সংসদ ভবনের স্থাপত্যমান রক্ষার অনুকূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করবেন। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত এই স্থাপত্যের শিল্পমান অক্ষুণ্ন থাকুক।
লেখকেরা: শিক্ষক, শিল্পী ও স্থপতি।
সংসদ ভবনের চারদিকে লোহার শিক দিয়ে বেষ্টনী নির্মাণে সংসদ সচিবালয়ের সিদ্ধান্তে ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’র বিষয়টিই অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। লোহার বেষ্টনী কি সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে? নকশা অমান্য করে লোহার খাঁচা না বানিয়ে অন্য কোনো উপায়ে কি এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত না? ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি বাড়ানোসহ উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কি করা যেত না এই নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান? এটা স্পষ্ট যে সংসদ সচিবালয় নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। কিন্তু একটি স্থাপত্য, যা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের গণতন্ত্রের তাৎপর্যকে ধারণ করে, তার স্থাপত্যমানকে দেখভাল করার কি কেউ নেই? দেশে নিরাপত্তাঝুঁকি যদি বেড়ে গিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে খাঁচাই কি সমাধান? নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়লে সরকারের তো প্রধান দায়িত্ব সেই ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা। নয়তো মানুষ এবং স্থাপত্য রক্ষায় লাখ লাখ খাঁচাই কেবল বানাতে হবে। লুই কানের নকশা অক্ষুণ্ন রেখে অন্য সব উপায়েই সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো যেত। সেসব উপায়ের ক্ষেত্রে তো কোনো বাধা ছিল না।
বিশ শতকে নির্মিত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যগুলোর একটি আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন। এটিকে জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই দেখে মানুষ। এই স্থাপত্য যাতে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পায়, সে ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নানা উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সংসদ ভবনের স্থাপত্যমান রক্ষায় কোনো সরকারেরই সুদৃষ্টি নেই। আশির দশকে এরশাদ যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন প্রথমবারের মতো বেষ্টনী নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। কিন্তু প্রতিরোধের মুখে বাতিল হয় সেই সিদ্ধান্ত। বিগত সংসদও সংসদ ভবন এলাকার চারপাশে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণের চেষ্টা করেছিল। পরিবেশ ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের আপত্তির মুখে বাতিল হয়েছিল সেই পরিকল্পনা। তবে নতুন করে যে এই লোহার বেষ্টনী নির্মিত হচ্ছে, পরিবেশ ও স্থাপত্য অধিদপ্তর তাতে কী করে অনুমতি প্রদান করল? নাকি এবার স্থাপত্য অধিদপ্তরের পরামর্শ ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে এই স্থাপনা?
সংসদ ভবনের ভেতর ও বাইরে লুই কানের মূল নকশাবহির্ভূত অনেক স্থাপনাই নির্মাণ করা হয়েছে। আর এসবই এই স্থাপত্যের স্থাপত্যমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গণপূর্ত বিভাগের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে সংসদ ভবনের ভেতরে কক্ষের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, অথচ লুই কানের নকশা অনুযায়ী মোট কক্ষ ছিল ৪০০। ভবনের ভেতর অনেক কক্ষ বানানো হয়েছে কাচ ও কাঠের বেড়া দিয়ে। লুই কান ভবনের ভেতর আলো-বাতাস প্রবেশের এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক আলো ছাড়াই কাজ করা সম্ভব হয়। কিন্তু নতুন নতুন স্থাপনা সেসব আলো-হাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। নকশা অমান্য করে সংসদ ভবন এলাকায় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাড়ি বানানো হয়েছে। এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছিল এবং স্থাপনা নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি বাড়ি নির্মাণ হয়েছে। হাইকোর্ট সে সময়ে, ২০০৪ সালে, সংসদ ভবন এলাকায় লুই আই কানের নকশার বাইরে যেকোনো রকম স্থাপনা নির্মাণকেই বে-আইনি ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। এ সময় হাইকোর্ট জাতীয় সংসদ ভবনকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণারও নির্দেশনা দেন। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৩)
আমরা স্মরণ করতে পারি, সংসদ ভবনের উত্তর ফটক বন্ধ করে যখন একটি টেলিভিশন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয় তখন নকশাবহির্ভূত এই স্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল। তখন সংসদ সচিবালয়ের কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, লুই আই কানের নকশাবহির্ভূত কোনো স্থাপনা নির্মিত হয়ে থাকলে তা ভেঙে ফেলা হবে। সে সময়ে, ২ জুন ২০১৩ ওই কমিশনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জাতীয় সংসদ ভবন বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শন। এর স্থাপত্যমান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। লুই কানের মূল নকশার বাইরে কোনো ধরনের পরিবর্তন করা যাবে না। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৩) কিন্তু আমরা এখন লুই কানের নকশার বিপরীতে লোহার বেষ্টনী নির্মিত হতে দেখছি।
প্রধানমন্ত্রী গত সংসদে বলেছিলেন, লুই কানের নকশা বদলানো যাবে না। এর স্থাপত্যমান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। তিনিই বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী। আমরা আশা করছি, অবিলম্বে সংসদ ভবন এলাকার চারপাশে লোহার বেষ্টনী নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তিনি তাঁর নিজের বক্তব্যের সত্যতা রক্ষা করবেন। একই সঙ্গে সংসদ ভবনের স্থাপত্যমান রক্ষার অনুকূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করবেন। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত এই স্থাপত্যের শিল্পমান অক্ষুণ্ন থাকুক।
লেখকেরা: শিক্ষক, শিল্পী ও স্থপতি।
No comments