সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার খোঁজে

পৃথিবীর সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত ও রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ অঞ্চলের নাম দক্ষিণ এশিয়া। এখানে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ আছে। আছে মেধাবী ও কর্মক্ষম এক বিশাল তরুণসমাজ। কিন্তু সেই তরুণদের কাজে লাগানোর জন্য যে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা, পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার, রাষ্ট্রনেতাদের চিন্তা ও কর্মে তার লক্ষণ দেখা যায় না। বরং তাঁরা ঐতিহাসিক ভ্রান্তির বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর থেকে জাতিগত ও ধর্মগত অভ্যন্তরীণ বিরোধে এ অঞ্চলের দেশগুলো যেমন ন্যুব্জ ও দুর্বল হয়েছে, তেমনি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও ক্রমাগত শক্তি ক্ষয় করে চলেছে (ব্যতিক্রম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ)। খাল কেটে কুমির আনার মতো প্রতিবেশী দেশের বিদ্রোহীদের উসকে দিলে তার পরিণতি যে কী ভয়ংকর হতে পারে, বর্তমান পাকিস্তানই তার প্রমাণ।
১৩ মার্চ মিয়ানমারের বন্দরনগর ইয়াঙ্গুনে ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টার আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সংলাপে এই অঞ্চলের সরকারগুলোর নানা দুর্বলতা ও হঠকারিতার পাশাপাশি গণবিরোধী ভূমিকার কথা উঠে আসে। উঠে আসে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সম্পর্ক, আন্তরাষ্ট্রীয় ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ, পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, আন্তসীমান্ত বিরোধ ও সন্ত্রাসবাদের ভেতর-বাইর। আলোচিত হয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের দ্বন্দ্বময় সম্পর্কের বিষয়টি। আলোচনায় অংশ নেন নাজিবা আইউবি (আফগানিস্তান); সাইফুল্লাহ গুল, ওমর চিমা (পাকিস্তান); কুণ্ডা দীক্ষিত (নেপাল); দিলনাজ বোগা, ত্রিদিবেশ মাইনি, সৈয়দ নাজাকাত, জয়দেব মিশ্র ও রামকৃষ্ণ শ্রীনাথারান (ভারত); আমন্ত পেরেরা (শ্রীলঙ্কা), শ্যামল দত্ত ও সোহরাব হাসান (বাংলাদেশ)। এ ছাড়া ইস্টওয়েস্ট সেন্টারের পক্ষে ছিলেন ড. সাব্বির চিমা ও সুজান ক্রিফেলস।
পৃথিবীর সব অঞ্চলেই রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও আন্তরাষ্ট্রীয় বিরোধ আছে। কিন্তু সেই বিরোধ জিইয়ে রেখে কেউ অমঙ্গলকে আলিঙ্গন করেননি, যেমনটি করেছেন দক্ষিণ এশীয় নেতারা। বিভিন্ন অঞ্চলের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিরোধ মেটাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো যে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়; তারই সফল পরিণতি আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তারা একটি কার্যকর অর্থনৈতিক জোটই করেনি, অভিন্ন মুদ্রা ও ভিসাও চালু করেছে। এ ছাড়া কার্যকর আঞ্চলিক জোট গঠিত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (আসিয়ান), আফ্রিকায় (আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা), ল্যাটিন আমেরিকায় (ল্যাটিন আমেরিকান ইকোনমিক কো-অপারেশন)। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা সে রকম কার্যকর আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা মুখে ঐক্যের কথা বললেও কাজ করেন ঐক্যের বিপক্ষে। তিন দশক আগে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) এখন একটি প্রায় ভঙ্গুর ও অকার্যকর জোটে পরিণত হয়েছে। সার্ক কার্যকর না হওয়ার কারণ কী? অনেকে বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধ। খানিকটা সত্য। আরও সত্য আছে। এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কও সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। যে প্রতিদান তারা প্রতিবেশীর কাছে আশা করে, সেই প্রতিদান দিতে প্রস্তুত নয়।
স্মরণ করতে পারি যে, সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি না করেই আসিয়ান দেশগুলো চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ সার্বিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে। আমরা পারিনি। এখনো বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে ঘুরেফিরে পুরোনো বিষয়গুলোই স্থান পাচ্ছে। সড়কের গতিবিধি কী হবে, পানিবণ্টন চুক্তি হবে কি না, সীমান্ত বিরোধ মিটবে কবে, ভিসাব্যবস্থা আরও সহজ করা যাবে কি না ইত্যাদি। এসব সমস্যা জিইয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুব বেশি এগিয়ে নেওয়া যায় না। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ২৬ শতাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য হলেও সার্ক দেশগুলোর মধ্যে হচ্ছে মাত্র ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এটি মৈত্রী নয়, বৈরিতার লক্ষণ।
সম্ভবত দুটি কারণে দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা সংকটের সমাধান না করে জিইয়ে রাখেন। প্রথমত, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের মধ্যে একধরনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব জাগিয়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশীর কাছ থেকে হুমকি আসতে পারে—এই অজুহাতে জনগণকে মৌলিক ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তবে অনেক দেশের সেই ক্ষমতাও নেই। ১৯৪৭ সালে এই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান নেতারা সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বপন করেছিলেন, সেটাই এখন বিষবৃক্ষে রূপ নিয়েছে। সমূলে এই বিষবৃক্ষের উৎপাটন ছাড়া এ অঞ্চলে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি আনা যাবে না। তখন আমাদের নেতারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন যে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করা গেলেও কোনো দেশ থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষকে একেবারে উচ্ছেদ করা যায় না। সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত ও উৎপীড়িত রেখে দেশকেও খুব বেশি এগিয়ে নেওয়া যায় না। পূর্ব ও পশ্চিমের যেসব দেশ এসব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে সচেষ্ট হয়েছে, তারা কিছুটা হলেও এগিয়ে গেছে। আর যেসব দেশ গায়ের জোরে ভিন্ন মতকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে, সেসব দেশে ঘোষিত-অঘোষিত গৃহযুদ্ধ চলছে।
আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যই হলো সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ। দুর্ভাগ্য, দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ রাষ্ট্রের অধিপতিরা সেটি বুঝতে চান না। তাঁদের কাছে রাষ্ট্র মানে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ। তাঁদের কাছে রাষ্ট্রীয় বিরোধ জিইয়ে রাখা। তাঁরা প্রতিবেশীকে শত্রুজ্ঞান করে নিজের নীতি ও কৌশল ঠিক করেন। সবকিছু দেখেন সংকীর্ণ জাতীয়তা কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁরা সীমান্তের ওপার দূরে থাক, নিজ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাও বুঝতে চান না।
এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা সাংবাদিকদের ভূমিকা কী হবে? তাঁরা কি রাষ্ট্রের চালকদের নীতিকে সমর্থন করবেন? তাঁরা কি অন্য দেশের মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকবেন, আর নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি উপেক্ষা করবেন? তাঁরা কি সরকারের ভাষায় কথা বলবেন, নাকি উৎপীড়িত ও দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়াবেন? তাঁদের লেখার ও বলার কেন্দ্রে কী থাকবে—সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, না মানুষ? কার কণ্ঠস্বর হবেন তাঁরা—ক্ষমতান্ধ রাজনীতি, নাকি মানুষের কল্যাণে পরিচালিত অর্থনীতি? দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিক প্রতিনিধিরা জোর দিয়ে বললেন, পীড়িত ও বঞ্চিত মানুষই হবে গণমাধ্যমের কেন্দ্র। সীমান্তের এপারের মতো ওপারের সমস্যাটিও তাঁরা দেখবেন নির্মোহ দৃষ্টিতে। কীভাবে? সেটি সম্ভব পরস্পরকে জানা, শোনা ও বোঝার মাধ্যমে। সেটি সম্ভব পেশাগত সততা ও একাগ্রতার মাধ্যমে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা যেভাবে ভিন্ন রাষ্ট্রকে দেখতে চান, সাংবাদিকেরা নিশ্চয়ই সেভাবে দেখবেন না। তাঁরা দেখবেন তাঁদের নিজেদের সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে। তাই দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে হবে; নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবেশী দেশের খবর সংগ্রহের জন্য যতটা সম্ভব পশ্চিমা তথ্যমাধ্যমের নির্ভরতা কমাতে হবে। দিনভর এই আলোচনায় আফগানিস্তানে তালেবান হানার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, পাকিস্তানে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার প্রাণঘাতী লড়াইসহ তালেবানের সঙ্গে সরকারের আলোচনা-প্রক্রিয়া, শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহী দমন থেকে মানবাধিকার হরণ, ভারতে সমরাস্ত্র তৈরির সাফল্য থেকে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাত, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা ও নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা গুরুত্ব পায়। ভুটান এই অঞ্চলের সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত।
সব বিষয়ে যে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা একমত হয়েছেন, তা নয়, বরং তালেবান উত্থান, কাশ্মীর সমস্যা, আফগানিস্তানে মাদক ব্যবসার উৎস ইত্যাদি নিয়ে প্রবল মতভেদ লক্ষ করা গেছে। কিন্তু একটি বিষয়ে প্রায় সব দেশের সাংবাদিক প্রতিনিধিরাই একমত হন যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আন্তরাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ বিরোধই উন্নয়নের প্রধান বাধা। এই বাধা অবশ্যই দূর করতে হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে, মানবাধিকারের স্বার্থে এই যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটিয়ে পরস্পরকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সব দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ এশীয় নেতারা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবেন? তাঁরা কি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য কাজ করবেন, নাকি এই অঞ্চলকে চিরতরে গরিব করে রাখবেন? তাঁরা কি এ অঞ্চলের পৌনে দুই শ কোটি মানুষকে নিজেদের ভাগ্য গড়ার সুযোগ দেবেন, নাকি তাঁদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.