বিগ ব্রাদারদের এত মাথাব্যথা কেন? by সুভাষ সাহা

বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিগ ব্রাদারদের কখনও শীতল আবার কখনও উষ্ণ কথার লড়াই দেখে অনেক বিদগ্ধজনই শঙ্কিত ছিলেন। তাদের কারও কারও মধ্যে এখনও স্বস্তি ফেরেনি। সবার শঙ্কা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কোনো স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ এবং প্রতিযোগিতা কি বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মঞ্চায়িত হচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশনের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্য নয়াদিলি্ল সফর করে ঢাকায় ফিরে আসার পর থেকে ভারতীয় কর্মকর্তাদের কথাবার্তা, এমনকি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় নয়াদিলি্ল ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার মতদ্বৈধতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিএনপির পক্ষে ওকালতি করে গেছেন_ এমন একটা ধারণাও ভারতের পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। ভারত যেখানে জামায়াতকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ব্রিডিং লিডার মনে করে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে সম্পর্কছেদে নারাজ। ভারত মনে করে, বিএনপির সঙ্গে ইসলামপন্থিরা আবার জোট বেঁধে ক্ষমতায় এলে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো এখানেও জঙ্গিবাদ দ্রুত বিস্তার লাভ করবে। জামায়াত ছাড়াও হেফাজতের উত্থান নয়াদিলি্লর শঙ্কাটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে থাকতে পারে।
অন্যদিক থেকে বলতে গেলে তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা ও আপস করা এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অতি উৎসাহ ভারতকে ভাবিয়ে তুলে থাকতে পারে। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে তার শক্তিবলয় সৃষ্টির চেষ্টা করছে? এখানে কি অদূর ভবিষ্যতে মার্কিন সামরিক বা রাজনৈতিক অ্যাসেট নিয়োজিত হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র যতই তার এসব অভিসন্ধি নেই বলে প্রকাশ্যে প্রচার করুক না কেন, নয়াদিলি্ল খুব কমই এটা বিশ্বাস করে। নয়াদিলি্ল মনে করে থাকতে পারে যে, এ ধরনের একটি পরিস্থিতি যদি আদৌ উদ্ভব হয় তাহলে তার পূর্বাঞ্চলে স্থায়ীভাবে অশান্তি বাসা বাঁধবে। তখন তার বিরাট শক্তি উত্তরাঞ্চলের শান্তি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ রুখতে ব্যয় করতে হবে। সে কারণে ভারত বরাবরই বলে আসছিল, নির্বাচন কীভাবে বাংলাদেশে হবে সেটা তারা নিজেরাই ঠিক করবে। এ ব্যাপারে বাইরের কারও হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওয়াশিংটন এরপরও তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে নয়াদিলি্ল তখন রাশিয়া, চীনসহ অপরাপর দেশের সঙ্গে নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার করে থাকতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা, এমনকি জাতিসংঘে বিষয়টি উঠতে পারে এবং বাংলাদেশ সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে_ এ ধরনের একটা আশঙ্কাজনক খবর নির্বাচনের পরপরই চাউর হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের দেশীয় অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং সাবেক কূটনীতিকরা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারির বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এ ব্যাপারে টেলিভিশনের একটি টক শোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের একজন অধ্যাপক এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশে এক সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী একজনের বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তারা দু'জনই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন, অতি শিগগিরই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন দিতে না পারলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে পড়তে পারে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই পথ ধরতে পারে। বাংলাদেশের গার্মেন্টের অধিকাংশ রফতানিই যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউতে যায়, তাই এ অবরোধের পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। আবার মধ্যপ্রাচ্যেও বাংলাদেশের মানবসম্পদ পাঠানো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলতেও তারা ভুললেন না। তাদের প্রশ্ন, এ ব্যাপারে সরকারকে ভারত বা রাশিয়া কতটুকুই-বা সাহায্য করতে পারবে? আলোচকদ্বয় হয়তো মনে করেছিলেন, উলি্লখিত দুটি দেশের বাইরে আর কেউ হাসিনার নতুন সরকারকে সমর্থন করতে যাবে না, সরকারের সঙ্গে কাজও করবে না। কিন্তু এখন চীনসহ বিশ্বের দেশগুলোর অব্যাহত সমর্থন দেখে তারা নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হয়েছেন যে, সরকার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েনি। সরকার এভাবে দাঁড়িয়ে গেল কী করে? আমাদের দেশে তো অফুরন্ত খনিজসম্পদ বা মহামূল্যবান ধাতু নেই যে, বিগ ব্রাদারদের মধ্যে টনাটানি শুরু হয়ে যেতে পারে! কিন্তু ভবিষ্যৎ পরাশক্তি চীন এবং উদীয়মান শক্তি ভারতের মধ্যখানে বাংলাদেশের অবস্থান আবার বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে চমৎকার সংযোগ একে অনেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। অন্যদিকে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার ছুঁয়ে চীনের চিয়াংমাই এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ (উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার লক্ষ্য) প্রতিষ্ঠা করা গেলে বিশাল জনগোষ্ঠীর বাজারকে ধরা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ চীন ও ভারতকে শঙ্কিত করে থাকবে। কয়েক মাস আগে চীনের সঙ্গে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে দু'দিনে ৩৭টি চুক্তি সম্পাদন নজিরবিহীন। এতেই বোঝা যায়, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে থাকলেও নিজের স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নে সে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে। তদুপরি ওয়াশিংটন ও নয়াদিলি্লর মধ্যে ২০১০ সালের পর থেকে সম্পর্কে তলে তলে টানাপড়েন চলছে। এটা আমার এক বন্ধুরও দৃষ্টি এড়ায়নি এবং এ নিয়ে আমাদের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে কিনা সে জন্য তিনি শঙ্কিত ছিলেন। বিশেষত মার্কিন অস্ত্র ক্রয়, প্রপার্টি রাইট, ভারতীয় পেশাজীবীদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাজ করার সময় সোস্যাল সিকিউরিটির নামে প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি ট্যাক্স কর্তনসহ আরও বিষয়ে বিরোধ চলে আসছিল। ভরতীয় কূটনীতিক দেবযানীকে গ্রেফতার করার মাধ্যমে আমেরিকা ভারতকে শাসানির চেষ্টা করে। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারতের প্রতিক্রিয়াটা হয়েছিল মারাত্মক। তারা দেবযানীকে দেশে ফিরিয়ে এনেই ক্ষান্ত হয়নি, পাল্টা দিলি্লতে নিযুক্ত দুই মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কার করে এর প্রতিশোধ নেয় এবং এখন দেবযানীর ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহারে চাপ অব্যাহত রেখেছে। এভাবে ভারত কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিল, আমি তোমার ক্লায়ান্ট স্টেট নই, সম্পর্ক রাখতে হলে সমঅংশীদারি বা পার্টনারের মর্যাদা থাকতে হবে।
আমাদের আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এবারের নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর তৎপরতাকে অনেক হালকাভাবে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে কিন্তু শঙ্কাটা ষোলআনা ছিল। কী জানি কী হয় এমন একটা ভাব ছিল। তাই নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সারাদেশ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বিরোধী দল বিএনপি কিন্তু নির্বাচন হবে না ধরে নিয়েই এগিয়েছিল। তারা নিজেদের স্ট্র্যাটেজিতে এতটাই আস্থাবান ছিল যে, চরম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অনুমোদন করতেও তাদের বাধেনি। নির্বাচন না হলে যে দেশ এক অশুভ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে, সে বোধটুকুও তাদের নেতৃত্বের ছিল না।
এ ক্ষেত্রে বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের প্রধান মাতবর হলেও অচিরেই যে তার জায়গাটি আর ঠিক থাকছে না, সে বিষয়টিও অনুধাবন করা প্রয়োজন। বিশ্ব পরিস্থিতি সত্যি সত্যিই বহুমেরুর দিকে ধাবিত হয়েছে এবং এ রূপটি দ্রুতই বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হতে থাকবে। সিরিয়ায় এক সময়ের যুদ্ধংদেহী আমেরিকাকে রাশিয়ার সঙ্গে মিলে আপস-রফার বৈঠক ডাকতে হচ্ছে, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, আফগানিস্তানের বশংবদ কারজাই সরকার ওবামা প্রশাসনের ডিকটেশন অনুযায়ী মার্কিন সামরিক উপস্থিতি সীমিত রাখার ব্যাপারে চুক্তি সম্পাদনের এখনও রাজি হয়নি। চীন-ভারত আর মার্কিন আদেশ-নির্দেশে চলছে না। চীন তো বহু পূর্বেই সেটা পরিষ্কার করেছে। আর ভারতের অবস্থান তো বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা দেখলাম। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে যারা মোক্ষ লাভ করতে চান, তাদের ভবিষ্যতে আরও হতাশ হতে হবে। তাই বলে এখানে কি যুক্তরাষ্ট্র প্রাসঙ্গিক নয়। অবশ্যই তাদের প্রাসঙ্গিকতা আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তারা আমাদের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। তাদেরও যে সমঝে চলতে হবে, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যেনতেন একটি নির্বাচন হলেও হাসিনার করে ফেলা এবং সেই সরকারের পক্ষে বিশ্বের শক্তিধরদের অব্যাহত সমর্থন সেটাই প্রমাণ করে।
সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.