সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির মত ও পথ by আবু সাঈদ খান
বিভক্তির ছুরিতে দেশের রাজনৈতিক দল থেকে
শুরু করে শ্রেণী-পেশার সংগঠন আজ ক্ষত-বিক্ষত। তবে এতে ক্ষমতার
প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তেমন আক্রান্ত হয়নি। সবচেয়ে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাম দলগুলো। বিভক্তির ঘাত-প্রতিঘাতে তারা ক্ষুদ্র থেকে
ক্ষুদ্র হয়ে পড়েছে। এসব বিভাজন যতটা না আদর্শকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি
ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বা কোটারির স্বার্থে সংঘটিত।
সাংবাদিক-শিক্ষক-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-আইনজীবীরাও আজ বিভক্ত। এসব পেশাজীবী
বিভক্ত হয়ে এক দল হয়েছে আওয়ামী লীগপন্থি, অপর দল বিএনপিপন্থি। এ বিভাজনে
লাভবান হচ্ছেন বিভাজিত সংগঠনের নেতারা। দল ক্ষমতায় গেলে সে দলের সমর্থকদের
ভাগ্য খুলে যায়। তাদের পদোন্নতি হয়, বড় বড় দায়িত্ব মিলে, সুযোগ-সুবিধা
বাড়ে, অর্থযোগ ঘটে। আর দলাদলিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মপরিবেশ, নিম্নগামী হয়
সেবার মান।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পেশাজীবীদের কি মতাদর্শ থাকবে না? নিশ্চয়ই থাকবে। এমনকি চাকরিবিধি বাধা নেই_ এমন সব পেশাজীবী প্রত্যক্ষ রাজনীতিও করতে পারেন। কিন্তু পেশার সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক লেজুড়ে পরিণত করা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে তার চেয়ে ভয়াবহ বুদ্ধিবৃত্তিক লেজুড়বৃত্তি। বুদ্ধিজীবীদের বলা হয় জাতির বিবেক। সেই বুদ্ধিজীবীরা যখন হীন স্বার্থে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে বিরত থাকেন কিংবা মিথ্যার বেসাতি করেন, তখন জাতি হয়ে পড়ে দিশাহীন।
বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটির কর্ণধররাও পেশাজীবীদের মতোই দুটি বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। তাদের ভূমিকা পক্ষপাতদুষ্ট। তারাও এখন আওয়ামীপন্থি বা বিএনপিপন্থি। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসের চেয়ে স্বার্থের ব্যাপারটা বেশি ক্রিয়াশীল। বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করার বিরোধী নই আমি। সেক্ষেত্রে কথা হচ্ছে_ রাজনৈতিক দলভুক্ত বুদ্ধিজীবীদেরও হতে হবে দলের যৌক্তিক সমালোচনায় দ্বিধাহীন। বুদ্ধিজীবীদের এই দুই পন্থার বাইরেও আরও একটি পন্থার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এনজিও কর্মকর্তা, এনজিও প্রকল্পের গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক-সামরিক আমলাদের নিয়ে গড়ে ওঠা শক্তি_ যারা সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের লোক বলে অধিক পরিচিত। সিভিল সোসাইটির প্রচলিত বাংলা 'নাগরিক সমাজের' স্থলে 'সুশীল সমাজ' শব্দটি এখন বহুল ব্যবহৃত।
ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিক সমাজের সঙ্গে তাদের ভূমিকা তুলনীয় নয়, এমনকি তুলনীয় নয় ভারতের নাগরিক সমাজের সঙ্গেও। ভারতে নাগরিক সমাজের শিকড় আম আদমি বা আমজনতার মধ্যে প্রোথিত। ফলে সেখানে গড়ে উঠছে শক্তিশালী নাগরিক আন্দোলন। বাংলাদেশেও নাগরিক আন্দোলন হচ্ছে। তবে সিভিল সোসাইটি বলে পরিচিত এলিটরা সে আন্দোলনে শরিক নন। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্বে তাদের অবস্থান। তবে পরিবেশ বা মানবাধিকার রক্ষার কোনো কোনো আন্দোলনে এনজিও কর্মীরা শরিক থাকছেন। এনজিও-আমলাকেন্দ্রিক সিভিল সোসাইটিও দুই পন্থার থাবা থেকে একেবারে মুক্ত নয়। তবে এর বাইরে বড় অংশের অবস্থান। সিভিল সোসাইটির বড় অংশ গণতন্ত্রের প্রশ্নে সোচ্চার। অর্থবহ নির্বাচনের কথা বলছেন তারা, সে কারণে বিএনপি তাদের ওপর সন্তুষ্ট। ক্ষুব্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের ১/১১-এর কুশীলব বলে অভিহিত করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদের প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও। তবে এটি সত্য যে, সিভিল সোসাইটির মূলধারা অর্থবহ নির্বাচনের প্রশ্নে সোচ্চার হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে মৌন। তাদের কণ্ঠ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূখপাত্রদের সঙ্গে একাকার। ১/১১-এর প্রাক্কালে তারা একইভাবে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলেছিলেন বলে তাদের ১/১১-এর অনুঘটক বলে চিহ্নিত হতে হচ্ছে। সে যাই হোক, ১/১১-এর পেছনে রাজনৈতিক দলের সংযত ও ব্যর্থতাই ছিল মূল কারণ। তবে ১/১১-এর পেছনে সিভিল সোসাইটির একাংশের সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলা যাবে না।
এবার আওয়ামী লীগপন্থি ও বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের কথায় আসা যাক। আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, 'দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। আবার বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কাছেও দেশ দু'ভাগে বিভাজিত। সেটি গণতন্ত্রের পক্ষ-বিপক্ষ। তাদের কথা_ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যা করছে আর বিএনপি তা উদ্ধারের চেষ্টা করছে। এ অংশের কাছে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ কোনো বড় সমস্যা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে 'মাতামাতি'ও ঠিক নয়। আসল কাজ হচ্ছে_ অর্থপূর্ণ- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কথা, নির্বাচন কেমন হলো তা বিচারের সময় এখন নয়। আসল কাজ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের দমন।
দুই দলের কথার মধ্যেই সত্যতা আছে। তবে তা অর্ধসত্য। দেশের সামগ্রিক কল্যাণেই জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিচার করতে হবে; একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচারের মধ্য দিয়ে কলঙ্কমোচন করতে হবে_ এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের অবস্থান অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু ইতিবাচক অবস্থানের কারণে একতরফা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনকে জায়েজ করতে পারে না। পক্ষান্তরে অর্থবহ নির্বাচনের জন্য বিএনপির দাবি সমর্থনযোগ্য। এ দাবিতে তাদের আন্দোলন করার অধিকার আছে। কিন্তু আন্দোলনের নামে সহিংসতা কিংবা যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টির অধিকার নেই। আমাদের মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রের সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের দমন_ একই সূত্রে গাঁথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের দমন যেমনি প্রয়োজন, তেমনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও সচল রাখা প্রয়োজন।
জাতির সামনে এখন দুটি বড় এজেন্ডা। একটি অর্থবহ নির্বাচন, অপরটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের অবসান। একটি অন্যটির বিকল্প নয়। দেশের সামগ্রিক কল্যাণে এই দুটি ইস্যুর নিষ্পত্তি করতে হবে।
প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, তা কে করবে_ রাজনৈতিক দল না বুদ্ধিজীবীরা? দেশের পরিবর্তন বা অগ্রগতির চালিকাশক্তি রাজনীতি। বুদ্ধিজীবীরা পথ দেখাতে পারেন, মতামত দিতে পারেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলকে নিতে হবে এবং তাদেরই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটিকে গালি না দিয়ে বরং তাদের মতামত প্রদানের সুযোগ অবারিত রাখাই হচ্ছে রাজনৈতিক কর্তব্য।
মানুষ লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে যৌক্তিক ভূমিকা আশা করে। সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে সুবিধাবাদিতা। স্বার্থের মোহে বুদ্ধিজীবী সমাজ দিকভ্রান্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক সুবিধাবাদ অতীতেও ছিল। তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা লক্ষণীয়। ইসলাম ও পাকিস্তানের ডামাডোলে ড. মুুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাহসী উচ্চারণ, 'আমরা হিন্দু-মুসলমান সত্য। তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। প্রকৃতি মাতা আমাদের এমনভাবে গড়েছেন যে, টুপি-টিকি পরে তা আলাদা করার জোঁ নেই।' আমাদের জাতীয় চেতনা বিকাশে ড. মুুহম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে আহমদ শরীফ পর্যন্ত এক ঝাঁক বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া করেছিলেন সে সময়ের তরুণ লেখক আহমদ ছফা। তার প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি। এমন বুদ্ধিজীবী সমাজ চেয়েছিলেন যারা হবেন যুগের দিশারি। গ্রামসির ভাষায়, 'বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী'। সে আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রচলিত ধারার বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা, 'বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন শুনলে বাংলাদেশে সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না। আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন বিশ্বাসের কারণে নয়_ প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন_ সেও ঠেলায় পড়ে।' স্বাধীনতার ৪২ বছর পর বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতা আরও প্রকট, সুবিধাবাদিতাই আজ বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে এসব কিছুর মাঝে কিছু সাহসী কণ্ঠে সত্য প্রকাশমান।
সুবিধাবাদিতা ও আপসকামিতা রুখে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ, নাগরিক সমাজ কবে, কখন মাথা তুলে দাঁড়াবে_ সেটিই আজ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
সাংবাদিক
প্রশ্ন উঠতে পারে, পেশাজীবীদের কি মতাদর্শ থাকবে না? নিশ্চয়ই থাকবে। এমনকি চাকরিবিধি বাধা নেই_ এমন সব পেশাজীবী প্রত্যক্ষ রাজনীতিও করতে পারেন। কিন্তু পেশার সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক লেজুড়ে পরিণত করা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে তার চেয়ে ভয়াবহ বুদ্ধিবৃত্তিক লেজুড়বৃত্তি। বুদ্ধিজীবীদের বলা হয় জাতির বিবেক। সেই বুদ্ধিজীবীরা যখন হীন স্বার্থে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে বিরত থাকেন কিংবা মিথ্যার বেসাতি করেন, তখন জাতি হয়ে পড়ে দিশাহীন।
বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটির কর্ণধররাও পেশাজীবীদের মতোই দুটি বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। তাদের ভূমিকা পক্ষপাতদুষ্ট। তারাও এখন আওয়ামীপন্থি বা বিএনপিপন্থি। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসের চেয়ে স্বার্থের ব্যাপারটা বেশি ক্রিয়াশীল। বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করার বিরোধী নই আমি। সেক্ষেত্রে কথা হচ্ছে_ রাজনৈতিক দলভুক্ত বুদ্ধিজীবীদেরও হতে হবে দলের যৌক্তিক সমালোচনায় দ্বিধাহীন। বুদ্ধিজীবীদের এই দুই পন্থার বাইরেও আরও একটি পন্থার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এনজিও কর্মকর্তা, এনজিও প্রকল্পের গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক-সামরিক আমলাদের নিয়ে গড়ে ওঠা শক্তি_ যারা সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের লোক বলে অধিক পরিচিত। সিভিল সোসাইটির প্রচলিত বাংলা 'নাগরিক সমাজের' স্থলে 'সুশীল সমাজ' শব্দটি এখন বহুল ব্যবহৃত।
ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিক সমাজের সঙ্গে তাদের ভূমিকা তুলনীয় নয়, এমনকি তুলনীয় নয় ভারতের নাগরিক সমাজের সঙ্গেও। ভারতে নাগরিক সমাজের শিকড় আম আদমি বা আমজনতার মধ্যে প্রোথিত। ফলে সেখানে গড়ে উঠছে শক্তিশালী নাগরিক আন্দোলন। বাংলাদেশেও নাগরিক আন্দোলন হচ্ছে। তবে সিভিল সোসাইটি বলে পরিচিত এলিটরা সে আন্দোলনে শরিক নন। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা আন্দোলন থেকে নিরাপদ দূরত্বে তাদের অবস্থান। তবে পরিবেশ বা মানবাধিকার রক্ষার কোনো কোনো আন্দোলনে এনজিও কর্মীরা শরিক থাকছেন। এনজিও-আমলাকেন্দ্রিক সিভিল সোসাইটিও দুই পন্থার থাবা থেকে একেবারে মুক্ত নয়। তবে এর বাইরে বড় অংশের অবস্থান। সিভিল সোসাইটির বড় অংশ গণতন্ত্রের প্রশ্নে সোচ্চার। অর্থবহ নির্বাচনের কথা বলছেন তারা, সে কারণে বিএনপি তাদের ওপর সন্তুষ্ট। ক্ষুব্ধ হয়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের ১/১১-এর কুশীলব বলে অভিহিত করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদের প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও। তবে এটি সত্য যে, সিভিল সোসাইটির মূলধারা অর্থবহ নির্বাচনের প্রশ্নে সোচ্চার হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে মৌন। তাদের কণ্ঠ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূখপাত্রদের সঙ্গে একাকার। ১/১১-এর প্রাক্কালে তারা একইভাবে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলেছিলেন বলে তাদের ১/১১-এর অনুঘটক বলে চিহ্নিত হতে হচ্ছে। সে যাই হোক, ১/১১-এর পেছনে রাজনৈতিক দলের সংযত ও ব্যর্থতাই ছিল মূল কারণ। তবে ১/১১-এর পেছনে সিভিল সোসাইটির একাংশের সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলা যাবে না।
এবার আওয়ামী লীগপন্থি ও বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের কথায় আসা যাক। আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, 'দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। আবার বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কাছেও দেশ দু'ভাগে বিভাজিত। সেটি গণতন্ত্রের পক্ষ-বিপক্ষ। তাদের কথা_ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যা করছে আর বিএনপি তা উদ্ধারের চেষ্টা করছে। এ অংশের কাছে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ কোনো বড় সমস্যা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে 'মাতামাতি'ও ঠিক নয়। আসল কাজ হচ্ছে_ অর্থপূর্ণ- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কথা, নির্বাচন কেমন হলো তা বিচারের সময় এখন নয়। আসল কাজ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের দমন।
দুই দলের কথার মধ্যেই সত্যতা আছে। তবে তা অর্ধসত্য। দেশের সামগ্রিক কল্যাণেই জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিচার করতে হবে; একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচারের মধ্য দিয়ে কলঙ্কমোচন করতে হবে_ এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের অবস্থান অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু ইতিবাচক অবস্থানের কারণে একতরফা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনকে জায়েজ করতে পারে না। পক্ষান্তরে অর্থবহ নির্বাচনের জন্য বিএনপির দাবি সমর্থনযোগ্য। এ দাবিতে তাদের আন্দোলন করার অধিকার আছে। কিন্তু আন্দোলনের নামে সহিংসতা কিংবা যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টির অধিকার নেই। আমাদের মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রের সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের দমন_ একই সূত্রে গাঁথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের দমন যেমনি প্রয়োজন, তেমনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও সচল রাখা প্রয়োজন।
জাতির সামনে এখন দুটি বড় এজেন্ডা। একটি অর্থবহ নির্বাচন, অপরটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের অবসান। একটি অন্যটির বিকল্প নয়। দেশের সামগ্রিক কল্যাণে এই দুটি ইস্যুর নিষ্পত্তি করতে হবে।
প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, তা কে করবে_ রাজনৈতিক দল না বুদ্ধিজীবীরা? দেশের পরিবর্তন বা অগ্রগতির চালিকাশক্তি রাজনীতি। বুদ্ধিজীবীরা পথ দেখাতে পারেন, মতামত দিতে পারেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলকে নিতে হবে এবং তাদেরই তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটিকে গালি না দিয়ে বরং তাদের মতামত প্রদানের সুযোগ অবারিত রাখাই হচ্ছে রাজনৈতিক কর্তব্য।
মানুষ লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে যৌক্তিক ভূমিকা আশা করে। সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে সুবিধাবাদিতা। স্বার্থের মোহে বুদ্ধিজীবী সমাজ দিকভ্রান্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক সুবিধাবাদ অতীতেও ছিল। তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা লক্ষণীয়। ইসলাম ও পাকিস্তানের ডামাডোলে ড. মুুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাহসী উচ্চারণ, 'আমরা হিন্দু-মুসলমান সত্য। তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। প্রকৃতি মাতা আমাদের এমনভাবে গড়েছেন যে, টুপি-টিকি পরে তা আলাদা করার জোঁ নেই।' আমাদের জাতীয় চেতনা বিকাশে ড. মুুহম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে আহমদ শরীফ পর্যন্ত এক ঝাঁক বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া করেছিলেন সে সময়ের তরুণ লেখক আহমদ ছফা। তার প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি। এমন বুদ্ধিজীবী সমাজ চেয়েছিলেন যারা হবেন যুগের দিশারি। গ্রামসির ভাষায়, 'বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী'। সে আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রচলিত ধারার বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা, 'বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন শুনলে বাংলাদেশে সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না। আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন বিশ্বাসের কারণে নয়_ প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন_ সেও ঠেলায় পড়ে।' স্বাধীনতার ৪২ বছর পর বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতা আরও প্রকট, সুবিধাবাদিতাই আজ বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে এসব কিছুর মাঝে কিছু সাহসী কণ্ঠে সত্য প্রকাশমান।
সুবিধাবাদিতা ও আপসকামিতা রুখে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ, নাগরিক সমাজ কবে, কখন মাথা তুলে দাঁড়াবে_ সেটিই আজ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
সাংবাদিক
No comments