এ রকম বছর যেন আর না আসে
২০১৩ সালটা যত তাড়াতাড়ি আমরা ভুলে যেতে পারব, ততই মঙ্গল। না, এ বছরের ভালো দিকগুলো ভুলে যাওয়ার কথা আমি বলছি না, বলছি বছরজুড়ে চলা নৃশংসতা, বীভৎসতা আর মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা। রাজনৈতিক হানাহানিতে মানুষ মরেছে, পুলিশ মরেছে; মরেছেন রাজনৈতিক কর্মীরা, নিরীহ বাসযাত্রীরা, অটোরিকশার চালকেরা। গবাদিপশুও মরেছে। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের তাণ্ডবে বিদ্যুৎকেন্দ্র পুড়েছে, বাস ও ট্রেন পুড়েছে, ট্রেনের লাইন উড়ে গেছে, প্রতিপক্ষের বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়েছে, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, দোকানপাট, মন্দির-প্যাগোডা ধ্বংস হয়েছে, এক লাখের মতো গাছ কাটা পড়েছে। এক বছরের নিরবচ্ছিন্ন তাণ্ডবে ব্যবসা-বাণিজ্য রসাতলে গেছে, পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে, যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। কৃষকের ফসল মাঠে শুকিয়েছে, সবজি পচেছে খেতে। দুধ উৎপাদকেরা বিক্রি করতে না পেরে দুধ ফেলেছেন নালায়। কর্মহীন মানুষ কপাল চাপড়ে কেঁদেছেন। সবই হয়েছে এবং হচ্ছে যাকে কেন্দ্র করে, তার নাম ক্ষমতার লড়াই এবং আরও অবিশ্বাস্য যা, কিছু যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর প্রাণপণ প্রয়াস।
এবং এই প্রয়াসে যুক্ত হয়েছে হাজার হাজার তরুণ, যাঁদের কাছে দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং স্বজাতি হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধও অপরাধ মনে হচ্ছে না। তাঁরা বরং বিশ্বাস করছেন, এসব অপরাধ ছিল ইসলাম রক্ষার লড়াই। তাঁদের রাত-দিন সে রকমই শেখানো হচ্ছে। একদিকে যেকোনো মূল্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করার সরকারি সংকল্প, অন্যদিকে বিরোধী দলের যেকোনো মূল্যে এই নির্বাচন প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞা। সরকার বলছে, যথাসময়ে নির্বাচন করাটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা; অন্যদিকে বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয় সরকার ছাড়া যেকোনো নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতার কথা। দুই পক্ষই অনড় অবস্থানে এবং এই প্রত্যয়ে স্থির নিশ্চিত যে সত্য তাদের পক্ষে। যদি দুই পক্ষের রাজনীতিবিদেরাই শুধু এ রকম একটা বিশ্বাস-যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন, তাতেও নাহয় একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেত, যেহেতু পৃথিবীর সব দেশেই দুই বা তার বেশি দলে বিভক্ত রাজনীতিবিদেরা একে অন্যের বিরুদ্ধে অবস্থানে দাঁড়িয়ে বাগ্যুদ্ধ (মাঝেমধ্যে মুষ্টিযুদ্ধও) করেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুই পক্ষে শুধু রাজনীতিবিদ নেই, আছেন শিক্ষাবিদেরাও, চিকিৎসক-প্রকৌশলী-আইনজীবী-ব্যবসায়ীরাও। আছেন মুদি দোকানদারেরাও। এমন বিভাজিত দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কি না, সন্দেহ। কোনো টিভি চ্যানেলের টক শোয় যদি দুজন উপাচার্য (সাবেক অথবা বর্তমান), দুজন সাংবাদিক এবং দুজন পেশাজীবী উপস্থিত হন, প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে, দুই দলে বিভক্ত হয়ে তাঁরা নিজেদের দলকে পূত-পবিত্র এবং বিরুদ্ধ দলকে শয়তানের সহযাত্রী ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। বাংলাদেশের আম আদমিরা রাজনীতির এই আদমশুমারির বাইরেই থেকে যাবে চিরকাল।
২০১৩ সাল ছিল আম আদমির জন্য নীরবে যন্ত্রণা সওয়ার বছর এবং দলবাজদের গলা চড়িয়ে চিৎকার করার বছর। এই নীরবে সহা এবং উচ্চকিত দল-চিৎকারের ছবিটা আর কোনো বছর এত প্রকট ছিল না। আমি মানুষের বিবেক ও শ্রেয়বোধে চিরকালই বিশ্বাসী। তাই ঢাকার কয়েকটি দৈনিকে যেদিন গাজীপুরে কাভার্ড ভ্যানে পুড়ে অঙ্গার হওয়া মনিরের ছবিটি বেরিয়েছিল—মনির রাস্তার পাশে বসে তার পুড়তে থাকা আয়ুর শেষ আর কয়েকটি ঘণ্টা প্রত্যক্ষ করছিল এক ভয়ানক অবিশ্বাস ও অসম্ভবতার যন্ত্রণায় এবং তার বাবাও চোখের সামনে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশকে প্রত্যক্ষ করছিলেন এক ভয়ানক নির্বাক কষ্টে—আমার মনে হয়েছিল, হয়তো মনিরের চোখ দিয়ে অন্তত একবার আমাদের নেতা-নেত্রীরা বাংলাদেশটাকে দেখবেন এবং বলবেন, অন্তত মনিরের জন্য আমরা শান্তির একটা শপথ নেব। কিন্তু সেটি ঘটেনি। নেতা-নেত্রীরা চলেছেন তাঁদের রাজনীতির ‘আদর্শে’। শিশু মনিরের পর আরও অনেক লাশ পড়েছে। ৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের ব্যাপক তাণ্ডব হলো। সে রাতে পুলিশি অভিযানে হাজার হাজার আলেম ও এতিম মারা পড়েছেন বলে দাবি জানানো হলো (এই দাবি ৩০ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া আবারও করলেন), গণহত্যার তথ্যও হাজির করা হলো। এক এনজিও দাবি করল, হাজার হাজার না হোক, ৬১টি লাশ পড়েছে, যদিও যাদের লাশ গোনা হলো, তাদের কেউ কেউ সশরীরে হাজির হয়ে জানালেন, না, এ যাত্রায় তাঁরা মারা পড়েননি। অথচ মাদ্রাসা-মক্তব থেকে হাজির করানো অসংখ্য শিশু-কিশোরকে ২৪ ঘণ্টা কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই না যেতে হলো। এই শিশু-কিশোরের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিটা কি কারও চোখে পড়েছে? তাদের কথা কেউ কি একবার ভেবেছে? ২০১৩ সালটি শিশুরা ভুলে যেতে চাইবে। এই বছর তারা নিয়মমতো স্কুলে যেতে পারেনি অথবা গিয়েছে বোমা-ককটেল-সহিংসতার মাঝখান দিয়ে; তাদের ক্লাস-পরীক্ষা পিছিয়েছে, মাঠের খেলাধুলা তারা ভুলেছে। এই শিশুরা আগামী দিনের নাগরিক, এ কথা বলেন নেতা-নেত্রীরা।
আগামী দিনের নাগরিকদের জিম্মি করে যাঁরা ক্ষমতায় যেতে চান, তাঁদের কী বলা যায়? আগামী দিনের রাজনীতিবিদ? বাংলাদেশে আর কোনো বছর শিশুরা রাজনীতির কাছে এভাবে জিম্মি হয়নি। এক যুদ্ধাপরাধী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেলে মহানন্দে দুই আঙুলে বিজয়চিহ্ন দেখিয়েছিল। এই বিজয় চিহ্নকে বিজয়ী করতে এরপর তার দলটি নেমে গেল ধ্বংসযজ্ঞে। এবং আশ্চর্য, তাদের সঙ্গে তাল দিতে শুরু করল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। বছরজুড়ে চলা সহিংসতার বড় কারণ ছিল দুই দলের এই যুগ্ম আন্দোলন। আন্দোলনটি এতটা পরিব্যাপ্ত ও সহিংস হতো না, যদি না শাসক দল নির্বাচনের প্রশ্নে একলা চলার নীতি গ্রহণ করত। যদি নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতো এবং সমঝোতা হতো, তাহলে এই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়তো ঠেকানো যেত। কিন্তু শাসক দল থাকল অনমনীয়। সংবিধানের প্রশ্ন তুলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে এগোল দলটি। ফলে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন আর বিএনপির নির্বাচনী আন্দোলন এক হয়ে গেল এবং একসময় বিএনপির আন্দোলন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর আন্দোলন। অথচ এই সহিংস সংঘাতে মারা পড়তে বসেছে দেশটাই। দেখেশুনে মনে হয়, গণতন্ত্রে বুঝি শুধু নির্বাচনটাই প্রধান। দলগুলোয় গণতন্ত্র নেই, তৃণমূলে গণতন্ত্র নেই, কোনো দলের আচরণে গণতন্ত্র নেই; নির্বাচনে হেরে গেলে সংসদ থেকে শত মাইল দূরে থাকা চাই, ক্ষমতায় থাকলে অর্থ-সম্পদ বাড়ানো চাই, বিদেশের ব্যাংকে টাকা পাচার করা চাই—অথচ সব সংগ্রাম ওই নির্বাচন নিয়ে। দেশ লাটে উঠুক, মানুষ পুড়ে মরুক, শিক্ষা গোল্লায় যাক, ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ুক—নির্বাচনটাই হলো মুখ্য। নির্বাচন মানে ক্ষমতায় থাকা অথবা যাওয়া। ক্ষমতা মানেই শক্তি-প্রতিপত্তি, অগাধ সম্পদ, বিদেশভ্রমণ, মাখনের মধ্য দিয়ে গরম ছুরি চালানোর মতো সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আখের গুছিয়ে নেওয়া।
২০১৩ সাল আমাদের দেখিয়ে দিল, গণতন্ত্রের নামে আমরা কত বীভৎস আচরণকে বৈধতা দিয়েছি। দলবাজেরা অবশ্য এই বীভৎসতাকেও যুক্তিযুক্ত করেন নানা উপায়ে। ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বরের ‘সরকারি অবরোধে’ এক বৃদ্ধা হাসপাতালে মারা গেলে তাঁর মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে বলে এক টক শোয় দাবি জানালেন এক দলীয় বুদ্ধিজীবী। অথচ শাহবাগে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মারা পড়া অনেক মানুষের মৃত্যুর দায় কে নেবে, সে কথাটি তিনি এড়িয়ে গেলেন। এই অকারণে, অসময়ে চলে যাওয়াদের মধ্যে আমার ছাত্রী মাসুমাও ছিল। মাসুমার জন্য কোনো নেতা-নেত্রী এক ফোঁটা সমবেদনা দেখাননি। তার চলে যাওয়ার কষ্ট তা তার নিকটজন ও আমরাই শুধু অনুভব করেছি। আর শিশু মনিরকে তো আমরা ভুলেই গেছি। বছর শেষ হলো সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার কিছু সহকর্মীর ওপর সরকার-সমর্থকদের আক্রমণের ঘটনা দিয়ে। এটিকেও দলের চশমা চোখে লাগিয়ে দেখছেন অনেকেই। অথচ এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা মানে এদের ব্যাপকতা বাড়া। বিএনপি আমলে এ রকম ঘটেছে, তখন ওই দলের বুদ্ধিজীবীরা সেসব ঘটনা এড়িয়ে গেছেন। শুরু থেকেই সবাই মিলে এসব অন্যায় রুখে দিলে আজ হয়তো আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতাম। আমার দুঃখ হয়, ২০১৩ সালটা আমরা কাজে লাগিয়েছি অসংখ্য তরুণকে বিধ্বংসী কাজে নামিয়ে—দলের নামে, গণতন্ত্রের নামে, ধর্মের নামে। এরা কি কখনো আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে? রেললাইন ধ্বংস হলে দেশের ক্ষতি হয়, কিন্তু সেটি পুষিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু বিশালসংখ্যক তরুণকে সহিংসতার শিক্ষা দিয়ে মাঠে নামালে যে ক্ষতি তারা দেশ ও নিজেদের করে, তা কি কখনো সামাল দেওয়া যায়? এত চড়া মূল্যে কেনা ক্ষমতা কি দেশের কোনো মঙ্গল করতে পারে? কোনো দিন? এ বছর রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে অসংখ্য তরুণ পোশাককর্মী মারা গেলেন
এই ক্ষতি অপূরণীয়। সেখানে যারা আটকা পড়লেন, তাদের উদ্ধারে ছুটে এসেছে অসংখ্য মানুষ। উদ্ধারকাজে প্রাণও দিয়েছেন দু-তিনজন। এনাম মেডিকেলে মানুষ দেখেছে সেবার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ২০১৩ সালের এসব ছবিকেই আমি মনে রাখব। হরতাল-বোমা-সন্ত্রাস উপেক্ষা করে শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে—তাদের প্রত্যয়ী মুখ আমি মনে রাখব। নীলফামারীতে আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলায় পাঁচজন মানুষ খুন হলে এলাকার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মীরা একসঙ্গে এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন—এই ঐক্যের ছবিটি মনে রাখব। ২০১৩-এর নৃশংস চেহারাটি বাংলাদেশের প্রকৃত চেহারা নয়—প্রকৃত চেহারা ধারণ করেছেন অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে। প্রকৃত চেহারাটি যেমন রাজশাহীতে এক পুলিশকে বাঁচাতে নামা সাহসী ঝরনা বেগমের, উপড়ে ফেলা ট্রেনলাইন ধরে ধেয়ে আসা ট্রেনের যাত্রীদের বাঁচাতে নামা সেই কৃষকের, প্রাইমারি ও জেএসসি পরীক্ষায় পাস করা প্রত্যয়ী ও হাস্যোজ্জ্বল সেই শিশুদের। বাংলাদেশ ক্ষমতার রাজনীতির কাছে, ধর্মান্ধতার কাছে, সন্ত্রাসের কাছে, দুর্নীতি-দুরাচারের কাছে হারতে পারে না। এই মুহূর্তে মনে হতে পারে হয়তো আমরা পিছিয়ে পড়েছি, কিন্তু একটা লড়াইয়ে হারা মানে যুদ্ধে হারা নয়। যে জাতি একাত্তরে যুদ্ধ করে জিতেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা সে জানে। জেএসসি-প্রাইমারি পরীক্ষায় পাস করা শিশুদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে আমার মনে হয়েছে, একটা অন্ধ সময় আমরা পার করছি বটে, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টাও ক্রমেই এগিয়ে আসছে।সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments