পরিবেশ- গাছ কাটা আন্দোলন by পাভেল পার্থ
পৃথিবীর মূল সম্পদগুলো হলো ভূমি, জল ও
প্রতিবেশগত বৈচিত্র্য। গরিব নিম্নবর্গের প্রাকৃতিক মূলধনও তাই।
প্রতিবেশবৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য শ্রেণীকরণে
বৃক্ষ, বিরুৎ, গুল্ম ও তৃণর ভেতর বৃক্ষরূপটি চারধারের বাস্তুসংস্থানের
সঙ্গে অভিযোজনের প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়েছে,
যা সমান্তরাল বিবর্তনের এক
গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। দুনিয়ার মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতর প্রায় ২৫ ভাগই
বৃক্ষ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ প্রজাতির সপুষ্পক
উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৯৫২ প্রজাতির
উদ্ভিদ রয়েছে।
গাছবিহীন একমুহূর্তও আমরা কল্পনা করতে পারি না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি, শাস্ত্র-পুরাণ, নীতিকথা, প্রথা, বাণিজ্য, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, উৎসব, পার্বণ, শিল্প-সংস্কৃতি, আশ্রয়, প্রশান্তি যাপিত জীবনের সবকিছুই গাছকে ঘিরে, গাছ নিয়ে। এমনকি এ জনপদের রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতার সঙ্গেও গাছ জড়িত আছে ওতপ্রোতভাবে। গাছ নিয়ে, গাছ ঘিরে রাজনৈতিক দরবার ও সংগ্রামেরও কমতি নেই। ব্রিটিশ জুলুমের বিরুদ্ধে সংগঠিত নীল বিদ্রোহ জড়িয়ে আছে নীলগাছের স্মৃতি নিয়ে। তেভাগা, নানকা, টঙ্কসহ ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনগুলো মূলত ধানগাছকে ঘিরেই। উন্নয়ন বলপ্রয়োগ আর বিনাশী তাণ্ডব থেকে এ দেশের নিম্নবর্গ গাছদের জান বাঁচাতে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার।
দক্ষিণ এশিয়ায় গাছ রাজনীতি ও সংগ্রামের অংশ হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রশ্নহীনভাবে ‘রাজনৈতিক সহিংসতায়’ নিহত হয়েছে অগণিত বৃক্ষ-প্রাণ। ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপিসহ ১৮ দলের হরতাল-অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে নৃশংস কায়দায় খুন হয়েছে দেশের অগণিত পাবলিক বৃক্ষ। মূলত হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির মাধ্যমে ‘নির্বিচার গাছ কাটা’ এক ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ হিসেবে রূপ নিয়েছে। এ খুনখারাবির বিরোধিতা না করে ১৮ দলও একে ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ হিসেবে মেনে নিয়েছে। বট, আম, শিশু, অর্জুন, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, কড়ই, বৃষ্টিগাছ কাটা পড়েছে সবচেয়ে বেশি। মূলত সড়কের পাশের এসব গাছের মালিক বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ। বন বিভাগসহ কোনো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষই বৃক্ষগুলোর নিরাপত্তা দিতে পারেনি।
গাছ নিহত হলে গাছ শুধু একাই মরে না, মানুষসহ সব প্রাণসত্তার জন্যই তা ঝুঁকি ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গাছ তাই সব সমাজে, সব ধর্মে ও সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীয় আরাধনার বিষয়। সুন্দরবন অঞ্চলে বাগদীদের ভেতর প্রচলিত ‘নাপিতের ছেলে-রাজার ছেলে ও রাজকন্যা’ কাহিনিতে দেখা যায়, বিষফল নামের এক গাছের ফল ফিরিয়ে দেয় মৃতের জীবন।
একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়। ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদানকে আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার (সূত্র: ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিউম-১১, সংখ্যা ১-২)। টি এম দাসের হিসাবে, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষ বছরে প্রায় ২১ লাখ টাকার অক্সিজেন সরবরাহ করে। বছরে প্রাণীসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার, মাটি ক্ষয়রোধ ও মাটির উর্বরতা বাড়ায় ২১ লাখ টাকার, পানি পরিশোধন ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে ২১ লাখ টাকার এবং বায়ুদূষণ রোধ করে প্রায় ৪২ লাখ টাকার। রাজনৈতিক সহিংসতার ভেতর দিয়ে গাছ হত্যার মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে, বিশৃঙ্খল হয়েছে স্থানীয় খাদ্যচক্র। কেবল মানুষই খাদ্য-জ্বালানি-বিশ্রামস্থল হারায়নি, অগণিত পাখি-সরীসৃপ-পতঙ্গ-পরগাছা-পরাশ্রয়ী লতাগুল্ম হারিয়েছে জীবনধারণের উৎস ও আশ্রয়স্থল। নিহত বৃক্ষগুলো অক্সিজেন সরবরাহ ও কার্বন শোষণ করে বায়ুচক্রে যে বিন্যাস তৈরি করেছিল, তা-ও ধ্বংস হয়েছে। এর করুণ পরিণতি আবহাওয়াচক্র এবং সর্বোপরি জলবায়ু পঞ্জিকার ওপর পড়বে। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে এভাবে বৃক্ষনিধন চলতে থাকলে বাংলাদেশকেও একসময় ‘বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের’ দায় কিছুটা হলেও ঘাড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট আয়তনের একটি দেশ হয়েও প্রাণবৈচিত্র্য এবং রকমভিন্ন প্রতিবেশ ও জটিল বাস্তুসংস্থানে ভরপুর এক অনন্য পরিসর। কিন্তু দিনে দিনে দেশের এই বৈচিত্র্যময় প্রাণ ও পরিসর নিশ্চিহ্ন হয়ে এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করছে। একটি গাছ নিশ্চিহ্ন হলে তা প্রভাবিত করে আমাদের ভাষাকাঠামোর বিন্যাসকেও। ১৯৯৭ সালে করপোরেট অক্সিডেন্টালের মাধ্যমে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ও মাগুরছড়া বনভূমি ঝলসে গেলে সেখানকার আদিবাসী ত্রিপুরি, খাসি ও চা-বাগানিদের ভাষা থেকে হারিয়ে যেতে থাকে অনেক গাছের নাম। কিন্তু শত বলপ্রয়োগ আর বাহাদুরি ঠেলে এখনো এ জনপদ গাছকে বিশ্বাস করে, আগলে রাখে, মানত করে, গাছের সঙ্গেই বন্ধক রাখে জীবনের বিজ্ঞান। এখনো আদিবাসী ওঁরাও গ্রামে কারাম পরবের জন্য সংরক্ষিত হয় কারাম বৃক্ষ। সোহরাই পরবে লাগবে বলে সুন্দরবনের মুন্ডারা বাদাবনের সুন্দরীগাছকে সুরক্ষা দেন। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তুলসী, বেল, ফণীমনসা, দূর্বা ঘাস পবিত্র উদ্ভিদ হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে পূজিত। বাঙালি মুসলিম সমাজে খেজুর ও বরইগাছের এক লোকায়ত পবিত্র মাত্রা আছে। এখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের সুড়লা মৌজায় তেভাগা আন্দোলনের সাক্ষী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রবীণতম তেঁতুল বৃক্ষ। পলাশীর আম্রকানন, মেহেরপুর আমবাগান, খুলনার প্রেমকানন, রমনার বটমূল বৃক্ষময়তার ভেতর দিয়েই তুলে ধরেছে আমাদের সভ্যতা ও ইতিহাসের নির্যাস। হাইকোর্ট ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে শ্রীমঙ্গলের নাহার পুঞ্জির চার হাজার গাছ কাটার অনুমোদন দিলে এর বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন শুরু করেন খাসি আদিবাসীরা। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের এক পবিত্র বটবৃক্ষ ‘কালাচাঁদ ঠাকুরের গাছ’ কাটার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ সংগঠিত করেন আন্দোলন (সূত্র: প্রথম আলো, ২৮ মার্চ ২০১২)। কেবল নিম্নবর্গ নয়, বৃক্ষের জীবন বাঁচাতে বন বিভাগও নানা সময় রুখে দাঁড়ানোর সাহস করেছে। কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন টেকনাফ উপজেলার জাহাজপুরা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৩৬টি প্রবীণ গর্জন বৃক্ষের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিল স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। এলজিইডিকে বনের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণ না করার অনুরোধ জানিয়েছিল বন বিভাগ (সূত্র: প্রথম আলো, ২৫-২-২০১০)।
যে জনপদ বৃক্ষের আহাজারি বুকে নিয়ে বিকশিত করে চলেছে এক টগবগে সভ্যতার বনিয়াদ, সে জনপদ কোনোভাবেই বৃক্ষ হত্যাকারী হিসেবে উদ্যত হতে পারে না। আমরা এটি বিশ্বাস করতে চাই না। গাছ হত্যা কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না। বিদ্যমান ঔপনিবেশিক বন আইন, বন্য প্রাণী আইন ও পরিবেশ আইনের মাধ্যমে এ অন্যায়ের সুরাহা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে বৃক্ষনিধন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সব ঘটনাকে দৃষ্টান্তমূলক অপরাধ ও বিচারের আওতায় আনা জরুরি। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত গাছের রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান, সুষ্ঠু তদন্ত প্রকাশ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এখনই কার্যকর রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ আশা করি। আসুন, বৃক্ষ-মানুষসহ প্রাণসত্তার সংসারকে অবিরত রাখার ঐতিহাসিক জনদর্শনকে বিকশিত করি। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর সব অন্যায় আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
পাভেল পার্থ। গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbnagla@gmail.com
No comments