বৈরী সময়ের আমি by রফিকুন নবী

৭০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বেঙ্গল গ্যালারিতে শুরু হয়েছে রফিকুন নবীর নির্বাচিত কাজের প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনীকে ঘিরে তাঁর শিল্পবৃত্তান্ত...

‘রেট্রোস্পেকটিভ’ প্রদর্শনী মানেই দীর্ঘকালের চিত্রচর্চায় পূর্বাপর চেহারার প্রমাণ দেওয়া বা একটা আদল তুলে ধরা। অন্তত আমি তা-ই মনে করি। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর। অতএব প্রদর্শনী আয়োজন করার ব্যাপারে আমার পক্ষে সম্মত হওয়া কঠিনই ছিল। নিজের চিত্রকলার অতীত কেমন ছিল, কী কাজ করতাম বা করেছি, সেসবকে বর্তমানের শিল্পকলাজগতের সবচেয়ে ব্যস্ততম এবং প্রাণবন্ত সময়টিতে সর্বসমক্ষে উপস্থিত করানোর পক্ষপাতী আমি নই। আমার জন্য তা মোটেই আনন্দের নয়। এটা তাঁদের খাটে, যাঁদের কাজের পরিধি ও গুণাবলিতে উচ্চমান থাকে। আমি সেই রকমের বিশাল মাপের শিল্পীদের গোত্রীয় নই। এ কারণেই বেঙ্গল শিল্পালয় কর্তৃপক্ষ যখন আমার চিত্রকলার ধারাবাহিক কাজ এবং বিভিন্ন সময়ের ধাপসংক্রান্ত পরম্পরাকে প্রদর্শনীতে উপস্থিত করার জন্য ‘রেট্রোস্পেকটিভ’ আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন বিচলিত বোধ করেছি। অনীহা তো বটেই। কিন্তু কী করে যেন শেষ পর্যন্ত তারা সম্মতি আদায় করেই ছাড়ল।
ব্যাপারটিতে বিব্রত হওয়ার বিস্তর কারণ রয়েছে। তবে প্রধানতম দুটি কারণকে উল্লেখ না করলেই নয়। প্রথমত, নানা কারণে অঢেল কাজ করা হয়ে ওঠেনি। যদি কিছু ভালো করেও থাকি, তা নানা কারণে হাতছাড়া হয়েছে অনেক আগেই। সেসব যে কার কাছে আছে তারও তালিকা রাখা হয়নি। দ্বিতীয়ত, নিজের কাজের গুণগত মান সম্পর্কে সন্দিহান ছিলাম বলে মূল্যায়নের চেষ্টা করিনি কখনো। ফলে যত্ন-আত্তির অভাবে বহু ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। এই অভ্যাসকে ঔদাসীন্য নয়, বরং নিশ্চেতন কাণ্ডও বলা যায়।
এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর জন্য কোনোকালে ডাক পড়বে বা প্রস্তাব আসতে পারে, তা ভাবা হয়নি হেতু ছবি হাতে জমিয়ে রাখা হয়নি। নিজ কাজের ব্যাপারে আস্থাহীনতাও প্রচ্ছন্নে দায়ী হতে পারে হয়তো। এখন এসব ভাবতে গিয়ে মন খারাপ হচ্ছে। নিজেকে অপরিণামদর্শী শিল্পী ভাবতে ইচ্ছে করছে। সেই সঙ্গে অনুতাপ হচ্ছে ও অদূরদর্শিতার জন্য ভেতরে ভেতরে এক কষ্টও দানা বাঁধছে। তবে কিছু ছবি আমার সহধর্মিণী গচ্ছিত রেখেছেন বলে খানিকটা স্বস্তি। সেসব যেমনই হোক, পুরোনো তো বটে।
কিছুটা নিশ্চিন্তির আরেকটি দিক হলো বেঙ্গলের পক্ষ থেকে সংগ্রাহকদের অনুরোধ করে কিছু ছবি সংগ্রহ করে আনার পরিকল্পনা। সেটি সফল হলে পনেরো-বিশ বছরের কাজ পাওয়া যাবে। পুরোটা না হলেও অন্তত কিছু ছবি এই সময়ের চর্চার নমুনা হিসেবে উপস্থিত করানোর সুযোগ হবে।
সত্যি বলতে কি, শুধু চিত্রকলাচর্চায় যতটা সময় দিলে নিবেদিতপ্রাণ বলা যায়, তেমনটা বোধ হয় আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এর জন্য কারণহীন কারণই দায়ী। ব্যাপারটি ঘটে ওঠেনি। আঁকার জগতেই আছি, এন্তার আঁকাআঁকিও হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে শুধুই নিখাদ চিত্রকলায় একনাগাড়ে মনোযোগী থেকেছি তেমনটা দাবি আমি করব না। শুভানুধ্যায়ীরাও তা-ই বলেন। আঁকার ব্যাপারটিকে নানা দিকে প্রসারিত করার কারণে অভিজ্ঞতা শুধু একদিকে ঠেকে থাকেনি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে সেসব অভিজ্ঞতা থেকে চিরকালই আলো আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি। তাতে কখনো সাফল্য এসেছে, কখনো বা কোনোই প্রাপ্তি ঘটেনি।
এই নানা দিকে মন দেওয়ার ব্যাপারটি ঘটতে শুরু করেছিল শিল্পকলা শিক্ষা নিতে যাওয়ার প্রথম থেকেই। অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে আর্ট কলেজে লেখাপড়ায় নাম লেখার বছরেই। কলেজটিতে ভর্তির আগে জানা ছিল না কিছুই। শুধু ধারণা ছিল যে ছবি আঁকার কিছু ব্যাকরণ আছে, আর আছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কিন্তু জগৎটিতে যুক্ত হয়ে আবিষ্কার করি যে বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিয়োজিত হয়েছি। সেখানে নিজ শিল্পকর্মের সহায়তায় আয়ের কপাট খুলতে পারে তেমনভাবে তৈরি হওয়া, সেই সঙ্গে সর্বক্ষেত্রের মানুষদের শিল্পকলার প্রতি আগ্রহী করে তোলা, নিজের রুচি তৈরি করার পাশাপাশি অন্যদেরও রুচিমান করা, দেশের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলা, দেশকে চেনা এবং বিশ্বকে জানান দেওয়ার মতো হাজার দিক নিয়ে ভাবার ব্যাপারে বৃহৎ ভুবনে ঢুকে পড়েছি। চিন্তায়-চেতনায়, শিল্পকর্মে সজ্ঞানে সবকিছুকে ধারণ না করতে পারলে শিল্পী হওয়ার ব্যাপারটি পূর্ণতা পায় না, বিশেষ করে আমাদের দেশে, এসব উপলব্ধি করেছি ও জেনেছি।
এসব ধারণা ঠিক কি বেঠিক তা নিয়ে ভাবার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম যে লেখাপড়ার বাইরে বহু কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেছি অজান্তেই। পূর্বসূরিদের ভাব-ভাবনা কী করে যেন সঞ্চারিত হয়ে গেছে আমার কর্মকাণ্ডে। তখন ষাটের দশক। সময়টি মোটেও শুধুই চিত্রকলাতে মনোযোগী বা অন্তঃপ্রাণ থাকার উপায় ছিল না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো তেমন হতে পারেনি। মানসিকভাবে আসলে ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে আজ অবধি বৈরী অবস্থার মধ্যে দিনকাল কাটল। জীবনের প্রতিটি দশক ও দিবারাত্রি ছিল সংকটে আচ্ছন্ন। বলা যায়, অ্যান্টি-আর্ট পরিবেশে সময় অতিবাহিত হলো, যদিও এখনকার প্রজন্মের শিল্পীরা অনেক কিছু তৈরি পেয়েছে, যা পূর্বসূরিরা প্রতিষ্ঠা করে রেখেছেন। তবু দেশের সামগ্রিক অশান্ত পরিবেশ ছবি আঁকিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্য সুখকর সময় নয়। আমি তেমনটাই ভাবি।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছাত্র ছিলাম। এই সময়ে নানা দাবি-দাওয়াসংবলিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাতে আঁকা পোস্টার লেখালেখি করতে হতো। ওই সবের কারণে ইলাস্ট্রেশন, ব্যঙ্গচিত্রের দিকে মোহ জন্মে। হাত পাকুক না পাকুক জমা পাওয়া যেত। তবে বড় দিক ছিল আনন্দের। আনন্দিত হতাম আন্দোলনে শিল্পকলার ছাত্র হিসেবে কিছু করতে পারছি ভেবে। দেশ চেতনা উদ্দীপক হয়ে গেঁথে গিয়েছিল।
এই যে ইলাস্ট্রেশন আর ব্যঙ্গচিত্রের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হলো, তা বইপত্র এবং পত্রপত্রিকায় গিয়ে পৌঁছাল ছাত্রাবস্থায়ই। বইপত্রের ছবি আঁকার প্রতি লোভ ছিল স্কুলে পাঠ গ্রহণের সময় থেকেই। সে জন্য ক্রমাগত সুযোগ ঘটতে থাকায় সেদিকে ঝুঁকেছিলাম। লেখাপড়া করার আর্থিক আশ্রয়ও যেমন হতো, তেমনি আনন্দও। তবে লেখাপড়ার নির্ধারিত পাঠ থেকে দূরে থাকার উপায় ছিল না শিক্ষকদের কড়াকড়ির কারণে। শিক্ষকেরা সবাই বিখ্যাত শিল্পী। পাকিস্তানজুড়ে নামী ব্যক্তিত্ব প্রায় সবাই। তাঁরা ড্রয়িং এবং জলরঙের চর্চা বজায় রেখেছিলেন নিজস্ব স্টাইলের আঁকাআঁকির পাশাপাশি। ছাত্রদেরও সেদিকে ঝুঁকতে বলতেন। কারণ ছিল দুরকমের। এক হলো যে ড্রয়িং ভালো হলে আর্থিক দিকের কিছুটা সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন দিকে তখন ছুটছাট কাজ করার প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছিল আর এসবকে ব্যবহারের শিল্পিত রুচি বাড়ছিল। বলা যায়, রুচি বাড়ানো হচ্ছিল।
দ্বিতীয় কারণ হলো, বিশেষ করে ড্রয়িংয়ের অ্যাকাডেমিক চর্চা থাকলে নিজের চিত্রকলাও ভালো বাঁধুনি পায়, তা সে যে স্টাইলের দিকেই যাওয়া হোক না কেন। এই বিশ্বাসটা আমারও রয়েছে। যেহেতু বিষয়ভিত্তিক ছবিতেই রয়ে গেছি চিরকাল, সে কারণে পেইন্টিং অথবা ছাপচিত্র যা-ই করি, ড্রয়িংকে প্রশ্রয় না দিয়ে পারি না। বরং ড্রয়িংই সহায়। কার্টুনের দিকটাও এভাবে এসেছে। কাঠখোদাই ছবিতেও তা-ই। আসলে ড্রয়িংকে বাদ দিয়ে কিছু ভাবার জো নেই। অ্যাকাডেমিকতার খুঁটিনাটি হয়তো একসময় আর প্রয়োজন হয় না। সরলীকরণ ঘটে যায়। তাতেও আলাদা রস তৈরি হতে পারে। এই ভাবনা থেকে নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আঁকার চেষ্টা করি।
১৯৭৩-এ গ্রিক সরকারের বৃত্তি পেলাম অপ্রত্যাশিতভাবেই। অধ্যাপক গ্রামাতোপুলসের অধীনে কাঠখোদাই চিত্রের দীক্ষা পেয়ে মাধ্যমটিতে কাজ শুরু করলাম। বলতে দ্বিধা নেই, যেহেতু ছাত্রাবস্থায় প্রিন্টমেকিং বিভাগের কাঠখোদাই পর্বটিকে কঠিন বলে এড়িয়ে চলতাম, অতএব এথেন্সে প্রায় নবিশ মতন হয়েই কাজ শুরু করি। পরবর্তীকালে নতুন কিছু পদ্ধতিগত দিক যুক্ত করি। মাধ্যমটির প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। তবে আনন্দিত হই দেখে যে পরবর্তী প্রজন্ম তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে চমৎকার মাত্রা তৈরি করেছে। নিজের কাজ যেমনই হোক সবার কাঠখোদাই মাধ্যমটিতে আগ্রহ দেখে ভালো লাগে। প্রচুর কাজ হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার উৎসাহ বেড়েছে। এসব দেখলে উজ্জীবিতই বোধ করি। তবে এ মুহূর্তে আমার আর তা করা হচ্ছে না। আসলে পেইন্টিংয়ে মন বসালে অন্যান্য মাধ্যমে সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন কার্টুন এবং ইলাস্ট্রেশনের ব্যস্ততা থেকেও দূরে সরিয়ে নিয়েছি নিজেকে। বলা যায়, হরেক দিকে যে মনকে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, তা এখন গুটিয়ে নিয়ে পেইন্টিংয়ের জগতে থিতু হওয়ার চেষ্টায় আছি।
বহুদূর হাঁটা হলো। শিল্পকলার জগতে এই হাঁটা সব সময় সাবলীল নয়। উঠতি-পড়তি সঙ্গী না হলে চলা দায়। হোঁচট খেয়ে খেয়ে এই এগিয়ে চলাতেও লাভ আছে। জেদ বাড়ে, তোয়াক্কাহীন হলে নিজ কাজের প্রতি আস্থাও বাড়ে।
হিসাব কষে দেখলাম, ছবি আঁকার জগতে আনুষ্ঠানিক যুক্ততার সময়কাল চুয়ান্ন বছর পেরিয়েছে। দীর্ঘকাল বৈকি! এত দিনে কলাকৈবল্যের যেকোনো দিকে অনবরত চর্চায় যে কারও মোক্ষ লাভ অবধারিত। অবশ্য যদি আর্থিক-জাগতিক-মানসিক মায় সমাজ-সংসারের সর্বদিকে আনুকূল্য লাভ ঘটে। শিল্পীদের ক্ষেত্রে সচরাচর তা ঘটে ওঠে না। সবদিক না হলেও কোনো না কোনো দিকে খামতিটা না পোষানোর মতোই সঙ্গী হয়ে থাকে। অগ্রগামিতা ব্যাহত হয়। দারুণ কিছু করার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয় না। চর্চা দিয়ে যেটুকু প্রাপ্তি ঘটে, তা নিতান্তই গৌণ। কোনো শিল্পীই তৃপ্ত হন না নিজের সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ নিয়ে। বিশেষ করে শেষ জীবনে এসে ভালো কিছু না করতে পারার আক্ষেপটা বড় হয়ে দেখা দেয়। অনুতাপ হয় আরও ভালো কিছু না করতে পারার কথা ভেবে।
পাবলো পিকাসো বলি অথবা আমাদের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, বয়সের এবং খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছেও তাঁদের সৃষ্ট চিত্রকলা নিয়ে অতৃপ্তির কথা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তা-ই বলেছেন। আসলে আঁকাজোকার ক্ষেত্রটিই অমন। শেষ বলে কোনো কথা নেই। সফল বলেও কোনো ধাপ নেই।
শিল্পীদের চর্চার ক্ষেত্রে এটা অর্ঘ্য মতন। নতুন করে আরও কিছু করার দিকে মোহাবিষ্ট করে। কাজের স্পৃহা বাড়ায়। আর তা করে বলেই হয়তো অনবরত নিত্যনতুন আঁকার ঝোঁকটি টিকে থাকে। ব্যাপারটি ভালো-মন্দের ধার ধারে না। তবুও যে কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় তা হলো এই যে আঁকাজোকার ক্ষেত্রটিতে দীর্ঘকালের মনোনিবেশে কী অর্জিত হলো না হলো সে গণনার চেয়ে বাকি স্বল্প সময়টি যদি নিশ্চিন্ত-নির্ভেজাল থাকে তবে হয়তো কিছু কাজ করা যাবে। ইচ্ছেটা অবশ্যই ভালো কিছু করার। এই ইচ্ছেটুকু পূর্ণতা পেলেই আমি খুশি থাকতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
লেখাটি বেঙ্গল গ্যালারি প্রকাশিত বই রফিকুন নবী থেকে নেওয়া হয়েছে।
সংক্ষেপিত

No comments

Powered by Blogger.