অরণ্যে রোদন- কোনো শর্টকাট নেই by আনিসুল হক
আজ ১৩ ডিসেম্বর। আজকের দিনটা পার হলেই
আসবে সেই রাত, যখন আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি
বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা—আলবদর, আলশামস, রাজাকাররা।
ঘরের
কড়া নেড়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের আতঙ্কভরা চোখের সামনে ধরে নিয়ে যাওয়া
হয়েছিল বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও শিক্ষকদের।
চোখ বাঁধা হয়েছিল। পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়েছিল হাত। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় এল,
কিন্তু তাঁরা আর ফিরে এলেন না, তাঁদের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে রইল
রায়েরবাজার, মিরপুর এলাকার জলা-জংলায়।
১৯৭১ সালে আমাদের সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীকে খুন করা হয়েছে। খুন করা হয়েছে তালিকা তৈরি করে। এই তালিকা কারা প্রস্তুত করেছিল? কারা নির্দেশ দিয়েছিল তাঁদের হত্যা করার? পরিকল্পনা কারা করেছিল? কারা সেটা বাস্তবায়ন করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে ‘স্যার, আমার সঙ্গে চলেন’ বলে যারা ডেকেছিল, তারা ছিল বাঙালি। সেই খুনিদের, তাদের রাজনৈতিক নেতাদের, সেই নীলনকশাকারীদের বিচার সম্পন্ন হবে না? শাস্তি নিশ্চিত হবে না?
এই রকম একটা প্রশ্ন নিয়ে এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আর বিজয় দিবস আমাদের সামনে এসেছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার পঙিক্ত উচ্চারিত হচ্ছে, ‘আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, ধর্ষিতার কাতর আর্তনাদ শুনি আকাশে বাতাসে, এদেশ কি ভুলে গেছে সেই রক্তাক্ত সময়? জাতির পতাকা খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।’
পাশাপাশি এটা নির্বাচনেরও মৌসুম। আমাদের একটা নির্বাচন করতেই হবে, এটা আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই নির্বাচনটা কি একটা বাধ্যবাধকতা পূরণের নির্বাচন হবে, নাকি হবে সত্যিকারের নির্বাচন? যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত প্রতিফলিত হবে? জনগণ যাকে চাইবে, সেই দল বা জোট জয়লাভ করবে?
অন্য একটা বিতর্কও দেখতে পাচ্ছি। তা হলো, গণতন্ত্র বড়, নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বড়? কোনটা আগে। এখানে উত্তরটা আগেভাগেই দিয়ে দেওয়া যাক, গণতন্ত্রের চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে ফারাক নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক নম্বর উপাদান হলো গণতন্ত্র। এটা ১৯৫২ সালেরও শিক্ষা, এটা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও শিক্ষা। ভাষা আন্দোলনের মূলেও ছিল মহান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই সময় বাঙালিরা একমাত্র বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি তোলেনি, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছিল এবং তারাই ছিল সংখ্যাগুরু। পাকিস্তানি শাসকেরা যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মানশীল হতেন, তাহলে তাঁরা এই সহজ যুক্তিটাকে অস্ত্রের ভাষায় উড়িয়ে দিতে চাইতেন না। তেমনিভাবে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কাজেই তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়াটাই হতো গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক আচার ও আচরণ জানা ছিল না পাকিস্তানি শাসকদের, জান্তাদের, কাজেই তাঁরা অস্ত্রের ভাষাকেই একমাত্র ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, নিযুত মানুষের রক্তের বিনিময়ে শেষতক বাংলাদেশ হলো স্বাধীন।
আজও এই প্রশ্নটা আসছে বটে। প্রশ্ন উঠছে কী হবে, আজ যদি নির্বাচনের মাধ্যমে এমন গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে, যারা মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাকেই ধূলিসাৎ করে দেবে? আমাদের উত্তর হলো, গণতন্ত্রে কোনো শর্টকাট নেই। গণতন্ত্রে চালাকি, ফন্দি, অপকৌশলের স্থান নেই। গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র। আজ আমাদের দেশে যে চরম সংকট দেখা দিয়েছে, যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রতিদিন হত্যা করছে মানুষকে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে নিরপরাধ মানুষ ও তাদের সম্পদকে, স্রেফ সন্ত্রাসবাদী কায়দায় আগুন দেওয়া হচ্ছে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে; উপড়ে ফেলা হচ্ছে রেললাইন, হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে—সেটা মোটেও গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উপাদান নিশ্চয়ই সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাই, কিন্তু গণতন্ত্র মানে জবাবদিহি, গণতন্ত্র মানে একজন মানুষেরও ভিন্নমত পোষণ ও প্রকাশের অধিকার। গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগুরুর শাসন নয়; সংখ্যালঘু মানুষ, ভিন্নমতাবলম্বীরা সেখানে কীভাবে আছে, কত ভালো আছে—সেটাও গণতন্ত্রের পরীক্ষা। গণতন্ত্র মানে সমাজে, পরিবারে, দলে, রাষ্ট্রে—সর্বত্র গণতন্ত্র। আজকের যে সংকট, সেই সংকট থেকে উত্তরণের পথও আসলে গণতন্ত্রই।
তবে দুঃখের কথা হলো, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে চলে নিপীড়নতন্ত্র, এখানে চলে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র। আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি দল ও তাদের নেতৃত্ব এবং আমাদের সরকারের রুলস অব বিজনেস আসলে একনায়কতন্ত্রকেই পোষণ করে এসেছে। আজ বহু সমস্যার মূলে এই স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাই। এবং আছে এই মানসিকতা, যদি তুমি আমার কথা না শোনো, তাহলে তোমাকে উড়িয়ে দেওয়ার-পুড়িয়ে দেওয়ার অধিকার আমার আছে—এটা মোটেও গণতন্ত্রের ভাষা নয়।
তবু এ থেকে উত্তরণের জন্যও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। অ্যাবরশন করে আমাদের গণতন্ত্রের পথের জটিলতা নিরসন করা যাবে না। দুই বড় দলের অংশগ্রহণে একটা সত্যিকারের অর্থবহ নির্বাচন হতেই হবে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জোটকে ক্ষমতায় বসতে দেওয়া যাবে না, তাতে দেশের ক্ষতি হবে; কিংবা কেবল আমরাই দেশপ্রেমিক, আমাদের প্রতিপক্ষ মোটেও দেশপ্রেমিক নয়, তাদের দেশের ভালো করার ক্ষমতাই নেই—এই মানসিকতাটাই অগণতান্ত্রিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করার জন্য একটা দলকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে, তা যদি
হয় পূর্বশর্ত, এ কথা যদি আমি ভাবি, তাহলে বুঝতে হবে, আমার নিজের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই দুর্বল।
ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়াতেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা যায়, তা যদি ভাবা হয়, তাহলে ভুল ভাবা হবে। বরং যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশই রাখতে পারতে হবে। এবং সেটা বিরোধী দলে থেকে আরও ভালোভাবে সম্ভব। সেটা হতে হবে সমাজের ভেতর থেকে। সেটা হতে হবে অবিরাম উজান স্রোতে সাঁতার কেটে, সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।
আমাদের দুঃখ হলো, এই দেশে ক্ষমতাধরেরা দুর্নীতি করে, লুটপাট করে, অনৈতিক কাজকর্ম করে, আর আমাদের জুজুর ভয় দেখায়, ওই যে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এল, ওই যে ধর্মবিরোধী শক্তি এল। তবে আশার কথা হলো, দেশের মানুষ এই জুজুর ভয়ে ভিত নয়। অমুক দল ক্ষমতায় এলে বিসমিল্লাহ
উঠে যাবে, মসজিদে উলুধ্বনি দেওয়া হবে বলেও কোনো লাভ হয় না, মানুষ বানের স্রোতের মতো সেই দলকেই ভোট দেয়। আবার অমুক দল ক্ষমতায় এলে দেশ আর মুক্তিযুদ্ধের দেশ থাকবে না বলেও কোনো লাভ হয়নি, মানুষ ভোট দেওয়ার সময় সাদা মন নিয়ে ভোট দিয়েছে।
সত্যি সত্যি দেশের মানুষ বারবার দই ভেবে চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়েছে। ফলে এখন সাদা কিছু দেখলেই ভয় পায়। এবং বর্তমানে দেশে নৈরাজ্য চলছে, যেভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অচলাবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এবং অবশ্যই যারা যারা বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও ভবনে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ মেরেছে, তাদের সত্যিকারের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।
অন্যদিকে, গণতন্ত্র ও সংবিধানের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় এসে কেউ যেন গণতন্ত্র ও সংবিধান তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল প্রত্যয়গুলো রদ করতে না পারে, তা নিশ্চিত রাখতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের সায়েন্স ফিকশনে একটা রোবটকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বলো তো, একটা সাপ তার লেজ থেকে খেতে শুরু করেছে, খেয়েই চলেছে, কী হবে। মুখ নিজেকে কি খেয়ে ফেলবে? এই ধাঁধার হিসাব করতে গিয়ে রোবট হ্যাঙ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে যে শক্তি গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, তেমন শক্তিকে আমরা গণতন্ত্রের নামে শক্তি সংহত করতে দিতে পারি না। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য দেশেই ফ্যাসিবাদকে চলতে দেওয়া হয় না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে চলতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর গণতন্ত্রের চেতনা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হলো গণতন্ত্রের চেতনা। এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে শোষণহীন সমাজ। এবং তা সব ধর্মের মানুষকে স্বাধীনভাবে নিরাপদে ধর্মকর্ম করার নিশ্চয়তাও দেয়। একাত্তর সালে যেমন বলা হতো, মুক্তিযোদ্ধারা কাফের, এখন তেমনিভাবে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা বা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা নাস্তিক—সেটাও খুব অন্যায় কথা, মিথ্যা কথা এবং অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কথা।
বিজয় দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সামনে রেখে আবারও বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশই থাকবে। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার মাধ্যমে সৃষ্ট শূন্যতা দেশে আজও পূরণ হয়নি—শহীদুল্লা কায়সার কিংবা আনোয়ার পাশার মতো কথাসাহিত্যিক আর আমরা পেলাম না, জহির রায়হানের মতো চলচ্চিত্রকার কোথায় পাব? সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো সাংবাদিক, ফজলে রাব্বির মতো চিকিৎসক আর কি আসবেন? আমরা সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত দল ও মানুষগুলোকে ক্ষমা করিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা চাইবই, এবং বাংলার মাটিতে সেই বিচার সুসম্পন্ন হতেই হবে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকেও আমরা একচুলও যেন না নড়ি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
১৯৭১ সালে আমাদের সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীকে খুন করা হয়েছে। খুন করা হয়েছে তালিকা তৈরি করে। এই তালিকা কারা প্রস্তুত করেছিল? কারা নির্দেশ দিয়েছিল তাঁদের হত্যা করার? পরিকল্পনা কারা করেছিল? কারা সেটা বাস্তবায়ন করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে ‘স্যার, আমার সঙ্গে চলেন’ বলে যারা ডেকেছিল, তারা ছিল বাঙালি। সেই খুনিদের, তাদের রাজনৈতিক নেতাদের, সেই নীলনকশাকারীদের বিচার সম্পন্ন হবে না? শাস্তি নিশ্চিত হবে না?
এই রকম একটা প্রশ্ন নিয়ে এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আর বিজয় দিবস আমাদের সামনে এসেছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার পঙিক্ত উচ্চারিত হচ্ছে, ‘আজও আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই, ধর্ষিতার কাতর আর্তনাদ শুনি আকাশে বাতাসে, এদেশ কি ভুলে গেছে সেই রক্তাক্ত সময়? জাতির পতাকা খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।’
পাশাপাশি এটা নির্বাচনেরও মৌসুম। আমাদের একটা নির্বাচন করতেই হবে, এটা আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই নির্বাচনটা কি একটা বাধ্যবাধকতা পূরণের নির্বাচন হবে, নাকি হবে সত্যিকারের নির্বাচন? যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত প্রতিফলিত হবে? জনগণ যাকে চাইবে, সেই দল বা জোট জয়লাভ করবে?
অন্য একটা বিতর্কও দেখতে পাচ্ছি। তা হলো, গণতন্ত্র বড়, নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বড়? কোনটা আগে। এখানে উত্তরটা আগেভাগেই দিয়ে দেওয়া যাক, গণতন্ত্রের চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে ফারাক নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক নম্বর উপাদান হলো গণতন্ত্র। এটা ১৯৫২ সালেরও শিক্ষা, এটা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও শিক্ষা। ভাষা আন্দোলনের মূলেও ছিল মহান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই সময় বাঙালিরা একমাত্র বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি তোলেনি, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছিল এবং তারাই ছিল সংখ্যাগুরু। পাকিস্তানি শাসকেরা যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মানশীল হতেন, তাহলে তাঁরা এই সহজ যুক্তিটাকে অস্ত্রের ভাষায় উড়িয়ে দিতে চাইতেন না। তেমনিভাবে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কাজেই তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়াটাই হতো গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক আচার ও আচরণ জানা ছিল না পাকিস্তানি শাসকদের, জান্তাদের, কাজেই তাঁরা অস্ত্রের ভাষাকেই একমাত্র ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, নিযুত মানুষের রক্তের বিনিময়ে শেষতক বাংলাদেশ হলো স্বাধীন।
আজও এই প্রশ্নটা আসছে বটে। প্রশ্ন উঠছে কী হবে, আজ যদি নির্বাচনের মাধ্যমে এমন গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে, যারা মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাকেই ধূলিসাৎ করে দেবে? আমাদের উত্তর হলো, গণতন্ত্রে কোনো শর্টকাট নেই। গণতন্ত্রে চালাকি, ফন্দি, অপকৌশলের স্থান নেই। গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র। আজ আমাদের দেশে যে চরম সংকট দেখা দিয়েছে, যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রতিদিন হত্যা করছে মানুষকে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে নিরপরাধ মানুষ ও তাদের সম্পদকে, স্রেফ সন্ত্রাসবাদী কায়দায় আগুন দেওয়া হচ্ছে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে; উপড়ে ফেলা হচ্ছে রেললাইন, হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে—সেটা মোটেও গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উপাদান নিশ্চয়ই সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাই, কিন্তু গণতন্ত্র মানে জবাবদিহি, গণতন্ত্র মানে একজন মানুষেরও ভিন্নমত পোষণ ও প্রকাশের অধিকার। গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগুরুর শাসন নয়; সংখ্যালঘু মানুষ, ভিন্নমতাবলম্বীরা সেখানে কীভাবে আছে, কত ভালো আছে—সেটাও গণতন্ত্রের পরীক্ষা। গণতন্ত্র মানে সমাজে, পরিবারে, দলে, রাষ্ট্রে—সর্বত্র গণতন্ত্র। আজকের যে সংকট, সেই সংকট থেকে উত্তরণের পথও আসলে গণতন্ত্রই।
তবে দুঃখের কথা হলো, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে চলে নিপীড়নতন্ত্র, এখানে চলে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র। আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি দল ও তাদের নেতৃত্ব এবং আমাদের সরকারের রুলস অব বিজনেস আসলে একনায়কতন্ত্রকেই পোষণ করে এসেছে। আজ বহু সমস্যার মূলে এই স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাই। এবং আছে এই মানসিকতা, যদি তুমি আমার কথা না শোনো, তাহলে তোমাকে উড়িয়ে দেওয়ার-পুড়িয়ে দেওয়ার অধিকার আমার আছে—এটা মোটেও গণতন্ত্রের ভাষা নয়।
তবু এ থেকে উত্তরণের জন্যও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। অ্যাবরশন করে আমাদের গণতন্ত্রের পথের জটিলতা নিরসন করা যাবে না। দুই বড় দলের অংশগ্রহণে একটা সত্যিকারের অর্থবহ নির্বাচন হতেই হবে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জোটকে ক্ষমতায় বসতে দেওয়া যাবে না, তাতে দেশের ক্ষতি হবে; কিংবা কেবল আমরাই দেশপ্রেমিক, আমাদের প্রতিপক্ষ মোটেও দেশপ্রেমিক নয়, তাদের দেশের ভালো করার ক্ষমতাই নেই—এই মানসিকতাটাই অগণতান্ত্রিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করার জন্য একটা দলকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে, তা যদি
হয় পূর্বশর্ত, এ কথা যদি আমি ভাবি, তাহলে বুঝতে হবে, আমার নিজের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই দুর্বল।
ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়াতেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা যায়, তা যদি ভাবা হয়, তাহলে ভুল ভাবা হবে। বরং যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশই রাখতে পারতে হবে। এবং সেটা বিরোধী দলে থেকে আরও ভালোভাবে সম্ভব। সেটা হতে হবে সমাজের ভেতর থেকে। সেটা হতে হবে অবিরাম উজান স্রোতে সাঁতার কেটে, সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।
আমাদের দুঃখ হলো, এই দেশে ক্ষমতাধরেরা দুর্নীতি করে, লুটপাট করে, অনৈতিক কাজকর্ম করে, আর আমাদের জুজুর ভয় দেখায়, ওই যে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এল, ওই যে ধর্মবিরোধী শক্তি এল। তবে আশার কথা হলো, দেশের মানুষ এই জুজুর ভয়ে ভিত নয়। অমুক দল ক্ষমতায় এলে বিসমিল্লাহ
উঠে যাবে, মসজিদে উলুধ্বনি দেওয়া হবে বলেও কোনো লাভ হয় না, মানুষ বানের স্রোতের মতো সেই দলকেই ভোট দেয়। আবার অমুক দল ক্ষমতায় এলে দেশ আর মুক্তিযুদ্ধের দেশ থাকবে না বলেও কোনো লাভ হয়নি, মানুষ ভোট দেওয়ার সময় সাদা মন নিয়ে ভোট দিয়েছে।
সত্যি সত্যি দেশের মানুষ বারবার দই ভেবে চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়েছে। ফলে এখন সাদা কিছু দেখলেই ভয় পায়। এবং বর্তমানে দেশে নৈরাজ্য চলছে, যেভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অচলাবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এবং অবশ্যই যারা যারা বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও ভবনে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ মেরেছে, তাদের সত্যিকারের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।
অন্যদিকে, গণতন্ত্র ও সংবিধানের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় এসে কেউ যেন গণতন্ত্র ও সংবিধান তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল প্রত্যয়গুলো রদ করতে না পারে, তা নিশ্চিত রাখতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের সায়েন্স ফিকশনে একটা রোবটকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বলো তো, একটা সাপ তার লেজ থেকে খেতে শুরু করেছে, খেয়েই চলেছে, কী হবে। মুখ নিজেকে কি খেয়ে ফেলবে? এই ধাঁধার হিসাব করতে গিয়ে রোবট হ্যাঙ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে যে শক্তি গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, তেমন শক্তিকে আমরা গণতন্ত্রের নামে শক্তি সংহত করতে দিতে পারি না। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য দেশেই ফ্যাসিবাদকে চলতে দেওয়া হয় না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে চলতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর গণতন্ত্রের চেতনা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হলো গণতন্ত্রের চেতনা। এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে শোষণহীন সমাজ। এবং তা সব ধর্মের মানুষকে স্বাধীনভাবে নিরাপদে ধর্মকর্ম করার নিশ্চয়তাও দেয়। একাত্তর সালে যেমন বলা হতো, মুক্তিযোদ্ধারা কাফের, এখন তেমনিভাবে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা বা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা নাস্তিক—সেটাও খুব অন্যায় কথা, মিথ্যা কথা এবং অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কথা।
বিজয় দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সামনে রেখে আবারও বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশই থাকবে। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার মাধ্যমে সৃষ্ট শূন্যতা দেশে আজও পূরণ হয়নি—শহীদুল্লা কায়সার কিংবা আনোয়ার পাশার মতো কথাসাহিত্যিক আর আমরা পেলাম না, জহির রায়হানের মতো চলচ্চিত্রকার কোথায় পাব? সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো সাংবাদিক, ফজলে রাব্বির মতো চিকিৎসক আর কি আসবেন? আমরা সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত দল ও মানুষগুলোকে ক্ষমা করিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা চাইবই, এবং বাংলার মাটিতে সেই বিচার সুসম্পন্ন হতেই হবে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকেও আমরা একচুলও যেন না নড়ি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments