জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ধৈর্য ধরতে বললেন পরিবারকে
ধৈর্য ধারণ এবং সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত
থাকতে স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের সদস্যদের আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতের সহকারী
সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। একই সঙ্গে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত
বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কাদের মোল্লার
সঙ্গে দেখা করেছেন তার স্বজনরা।
সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে
তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছান। কারাগারের ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন
সোয়া সাতটার দিকে। কাদের মোল্লার বড় ছেলে হাসান জামিল পিতার বরাত দিয়ে
মানবজমিনকে জানান, আব্বা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। তবে শেষবারের মতো তিনি
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি বলেছেন, ‘আমার মরণ তো মঙ্গলবার রাতেই
হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ এতক্ষণ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন। অতএব
মৃত্যুকে আমার কোন ভয় নেই। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।’ তবে শেষবারের মতো
আইনজীবীদের সাক্ষাৎ চান তিনি। হাসান জামিল বলেন, সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ
আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর মার্সি পিটিশনের জন্য সাত দিন সময় আছে। সাত
দিনের মধ্যে আব্বা তার আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করে মার্সি পিটিশন করবেন কিনা
এ ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন। কাদের
মোল্লার স্ত্রী সানোয়ারা জাহান, বড় ছেলে হাসান জামিল, ছোট ছেলে হাসান
মওদুদসহ পরিবারের মোট ১০ সদস্য গতকাল কারাগারে যান। সন্ধ্যা ছয়টা ২০ মিনিটে
তারা কারাগারে পৌঁছান। প্রায় এক ঘণ্টা তারা কাদের মোল্লার সামনে অবস্থান
করেন। হাসান জামিল বলেন, গতকালও আব্বাকে বেশ স্বাভাবিক দেখা গেছে। কোন
ধরনের ভয় বা উদ্বেগ ছিল না তার মাঝে। ছিল না আবেগ বা নমনীয়তা। আমাদেরকেও
তিনি দৃঢ় মনোবল বজায় রাখতে বলেছেন। যে ইসলামী আন্দোলনের জন্য তিনি জীবন
দিচ্ছেন, সেই ইসলামকে বিজয়ী করে তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে বলেছেন। কাদের
মোল্লা বলেছেন, তোমরা বিশ্বাস করো, ইসলামী আন্দোলন না করলে কখনও আমি
যুদ্ধাপরাধী হতাম না। কখনও সরকার আমাকে হত্যা করার জন্য এত কলঙ্কজনক
অধ্যায়ের সৃষ্টি করতো না। তিনি বলেছেন, জেলে থাকা অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে
ভর্তি, আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, বিভিন্ন কাগজপত্র সরবরাহ, ডিভিশন প্রদান
সব কিছুই জেলকোড মেনে করা হয়েছে। এজন্য ট্রাইব্যুনাল জেল কর্তৃপক্ষকে বেশ
কয়েকবার লিখিত আদেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও এসব ক্ষেত্রে তখন
জেলকোড প্রয়োগের বিরোধিতা করেননি। অথচ এখন বলা হচ্ছে জেলকোড আমার ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য নয়। কাদের মোল্লা বলেন, ২০১০ সালের ১৩ই জুলাই আমাকে গ্রেপ্তার এবং
পরে জেলখানায় থাকা অবস্থায় সব কিছুই জেলকোড মেনেই করা হয়েছে। কিন্তু রায়
পরবর্তী কার্যক্রম জেলকোড অনুযায়ী মেনে নিতে চাইছে না সরকার পক্ষ। তাই এটা
পরিষ্কার সরকার আমার বিরুদ্ধে দেয়া রায় দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যই জেলকোড
মানতে চাইছে না। যাই হোক তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ, তোমরা ধৈর্য হারাবে
না। সর্ব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রেখো। নিশ্চয় আল্লাহ এর প্রতিদান
দেবেন। দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, আমার শাহাদাতের পর যেন
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে আমার রক্তকে
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজে লাগায়। কোন ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে যেন
জনশক্তি নিয়োজিত না হয়। যারা আমার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছে আমি
তাদের শাহাদাত কবুলিয়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি এবং তাদের পরিবারের
প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করি। আল্লাহ তাদেরকে সর্বোত্তম পুরস্কার দান করুন।”
তিনি আরও বলেন, “আমি পূর্বেই বলেছি, সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এ সরকার আমাকে
হত্যা করতে চাইছে। আমি মজলুম। আমার অপরাধ আমি ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব
দিয়েছি। শুধুমাত্র এ কারণেই এ সরকার আমাকে হত্যা করছে। আমি আল্লাহ্,
রাসূল, কোরআন ও সুন্নাহ্তে নিশ্বাসী। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমার এ
মৃত্যু হবে শহীদি মৃত্যু। আর শহীদের স্থান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ
আমাকে শাহাদাতের মৃত্যু দিলে এটা হবে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া। এর
জন্য আমি গর্বিত। কাদের মোল্লা বলেন, আমি বিশ্বাস করি, জীবন-মৃত্যুর মালিক
আল্লাহ। আমাকে ১০ই ডিসেম্বর রাতেই সরকার হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু
আল্লাহ্ তায়ালা সেদিন আমার মৃত্যু নির্ধারণ করেননি। যেদিন আল্লাহর ফায়সালা
হবে সেদিনই আমার মৃত্যু হবে। প্রত্যেক প্রাণীরই মৃত্যু আছে। আমাকেও মরতে
হবে। শহীদি মৃত্যুর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কিছু নয়। আজীবন আমি সে মৃত্যু কামনা
করেছি, আজও করছি। তবে আমার অনুরোধ, আমার শাহাদাতের পর ইসলামী আন্দোলনের
কর্মীরা যেন ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। তারা যেন কোন ধরনের ধ্বংসাত্মক
বা প্রতিহিংসা পরায়ণ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হয়। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের
কাছে এটাই আমার আহ্বান। আমি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলছি,
শাহাদাতের রক্তপিচ্ছিল পথ ধরে অবশ্যই ইসলামের বিজয় আসবে। আল্লাহ যাদেরকে
সাহায্য করেন তাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। ওরা আব্দুল কাদের মোল্লাকে
হত্যা করে ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে চায়। আমি বিশ্বাস করি,
আমার প্রতি ফোঁটা রক্ত ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে তীব্র থেকে তীব্রতর
করবে এবং জালেম সরকারের পতন ডেকে আনবে। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে
যেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা আমার রক্তের বদলা নেয়।” সব শেষে তিনি তার
স্ত্রী সানোয়ারা জাহানোর উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি পরিবারের অভিভাবক ছিলাম।
আমার পরে আল্লাহ্ আমার পরিবারের অভিভাবক হবেন। তুমি পরিবারকে দেখাশোনা
করবে মাত্র। আল্লাহর কাছে আমি দোয়া করি, তোমার এই দায়িত্ব পালন শেষ হওয়ার
পরই যেন আল্লাহ্ তায়ালা তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসেন।” আব্দুল কাদের মোল্লা
ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি সালাম জানান। তিনি বলেন, “খবরে
দেখেছি ১০ বছরের শিশুদেরকে হত্যা করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের
রক্তে ভাসছে দেশ। এই রক্তের বদলা অবশ্যই আল্লাহ দেবেন। আমি মোটেই বিচলিত
নই। আমি দেশবাসীর দোয়া চাই। আমার জীবনের বিনিময়ে যেন ইসলামী আন্দোলন, দেশের
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে আল্লাহ হেফাজত করেন। মহান আল্লাহর কাছে এটাই
আমার কামনা।”
No comments