মানুষ আর কত বিপর্যস্ত হবে? by ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
পানির
কতিপয় ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য আছে এবং এ বিষয়ে আমরা কম-বেশি অবগত। যেমন পানিকে
যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রের আকার ধারণ করে, পানির উপরিতল সব সময় সমতল,
পানি সব সময় ওপর থেকে নিচ দিকে প্রবাহিত হয়, পানির কোনো বর্ণ বা গন্ধ নেই
ইত্যাদি। ঠিক তেমনি ক্ষমতারও কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন- একজন
সাধারণ মানুষের হাতেও বন্দুক তথা ক্ষমতা থাকলে তার চোখ থাকে আকাশের
পাখ-পাখালির দিকে, হাতে ক্ষমতা থাকলে তা অপব্যবহার হওয়ার আশংকা থাকে বা
ক্ষমতার অপব্যবহার হয় এবং যদি চরম ক্ষমতা থাকে, তাহলে সেই ক্ষমতার চরম
অপব্যবহারের আশংকা থাকে বা চরম অপব্যবহার হয়। বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য এতই
খারাপ যে, এখানকার জনগণকে প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত হওয়া সুনামিতেও বিপর্যস্ত
হতে হয়, আবার তার চেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হতে হয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক
সুনামিতে। প্রাকৃতিক পর্যায়ের সুনামি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে এ
দেশের সাধারণ মানুষ কিছুদিন পর পর রেহাই পেলেও এ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক
সুনামির হাত থেকে যেন কিছুতেই পরিত্রাণ পাচ্ছেন না তারা। আর এ দেশে
রাজনৈতিক সুনামির জোর এতই প্রবল ও ভয়ংকর যে, তা কয়েক বছর আগে জাপানে
প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত সুনামিকেও যেন হার মানায়।
ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারা, মানুষকে পেট্রল বোমা মেরে হত্যা করা, হরতাল-অবরোধ ডেকে মানুষকে চরম দুর্ভোগ ও হয়রানিতে ফেলা, দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত করা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুুণ্ন করা- এসব কি কখনও কারও কাম্য হতে পারে? নিশ্চয় না। অথচ বাংলাদেশে ক্ষমতার জন্য কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও ক্যাডারদের দ্বারা এগুলোর সবকিছুই এখন প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে। আর দেশের সাধারণ মানুষও যেন অসহায়-অবলা জীবের মতো মুখ বুজে এসব নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন। সম্মিলিতভাবে কোনো প্রতিবাদ করছেন না। প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না। দেশের সব রাজনৈতিক দলই বলে, তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে। দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দল তো এ স্লোগান প্রায়ই প্রচার করে বেড়ায়, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। কিন্তু দেশের চেয়ে যে রাজনীতিকদের নিজেদের পকেট বড় এবং জনগণের চেয়ে তাদের নিজেদের পকেটকেই প্রকৃতপক্ষে বড় করে দেখা হয়, তা জনগণের অজানা নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য রাজনীতি করত, তাহলে ওইসব রাজনৈতিক দলের হাতে এ দেশের জনগণকে বারবার জিম্মি হতে হতো না, জনগণকে বারবার বলির পাঁঠা হতে হতো না। এ দেশে হরতাল-অবরোধ মানেই যে মানুষ পুড়িয়ে মারা, দেশব্যাপী তাণ্ডবলীলা চালানো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশ যেন হরতাল-অবরোধের দেশ হতে চলেছে। হরতালে, অবরোধে শুধু জনগণের প্রাণহানিই ঘটছে না। দেশের অর্থনীতিরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা পড়ছে সেশনজটের কবলে, যা তাদের জীবনে বয়ে আনছে অপূরণীয় ক্ষতি।
রাজনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ সব দিক থেকে এগিয়ে নেয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে এর উল্টোটি। হরতাল-অবরোধের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহেও বিঘ্ন ঘটছে। ফলে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে এখন চলছে বিপর্যয়। এর ফল ভয়াবহ হতে বাধ্য এবং এর খেসারত দিতে হবে গোটা জাতিকে। হরতাল-অবরোধ বন্ধে দেশের ব্যবসায়িক নেতারা, বুদ্ধিজীবী মহল, সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজসহ সব রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজন দাবি আদায়ে হরতাল-অবরোধের বিকল্প কোনো পন্থা খুঁজে বের করা। সবাই মিলে হরতাল আর অবরোধকে ‘না’ বলার ব্যাপারেও দ্রুত সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলেরই ভালোভাবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যে দল হরতাল-অবরোধ আহ্বান করে দেশে অস্থিশীলতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, পরবর্তী সময়ে এর কুপ্রভাব পড়ে ওই দলেরই ওপর। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার এটাও বোঝা উচিত, জনগণ এখন আর বোকা নন। তারা যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তারা ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ ভালোভাবেই দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব দলেরই হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পরিহার করা উচিত। এখন সময় দেশকে এগিয়ে নেয়ার, পিছিয়ে দেয়ার নয়। হরতাল-অবরোধের কারণে এ দেশটি সবদিক থেকে পিছিয়ে যাক, এমনটি কারও কাম্য হতে পারে না। তাই দেশের এহেন মুহূর্তে সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে হবে- যেন এ দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সুনামির হাত থেকে চিরতরে রক্ষা পান, সুখে-শান্তিতে দুই বেলা দুমুঠো ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারা, মানুষকে পেট্রল বোমা মেরে হত্যা করা, হরতাল-অবরোধ ডেকে মানুষকে চরম দুর্ভোগ ও হয়রানিতে ফেলা, দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত করা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুুণ্ন করা- এসব কি কখনও কারও কাম্য হতে পারে? নিশ্চয় না। অথচ বাংলাদেশে ক্ষমতার জন্য কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও ক্যাডারদের দ্বারা এগুলোর সবকিছুই এখন প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে। আর দেশের সাধারণ মানুষও যেন অসহায়-অবলা জীবের মতো মুখ বুজে এসব নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন। সম্মিলিতভাবে কোনো প্রতিবাদ করছেন না। প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না। দেশের সব রাজনৈতিক দলই বলে, তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে। দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দল তো এ স্লোগান প্রায়ই প্রচার করে বেড়ায়, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। কিন্তু দেশের চেয়ে যে রাজনীতিকদের নিজেদের পকেট বড় এবং জনগণের চেয়ে তাদের নিজেদের পকেটকেই প্রকৃতপক্ষে বড় করে দেখা হয়, তা জনগণের অজানা নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য রাজনীতি করত, তাহলে ওইসব রাজনৈতিক দলের হাতে এ দেশের জনগণকে বারবার জিম্মি হতে হতো না, জনগণকে বারবার বলির পাঁঠা হতে হতো না। এ দেশে হরতাল-অবরোধ মানেই যে মানুষ পুড়িয়ে মারা, দেশব্যাপী তাণ্ডবলীলা চালানো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশ যেন হরতাল-অবরোধের দেশ হতে চলেছে। হরতালে, অবরোধে শুধু জনগণের প্রাণহানিই ঘটছে না। দেশের অর্থনীতিরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা পড়ছে সেশনজটের কবলে, যা তাদের জীবনে বয়ে আনছে অপূরণীয় ক্ষতি।
রাজনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ সব দিক থেকে এগিয়ে নেয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে এর উল্টোটি। হরতাল-অবরোধের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহেও বিঘ্ন ঘটছে। ফলে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে এখন চলছে বিপর্যয়। এর ফল ভয়াবহ হতে বাধ্য এবং এর খেসারত দিতে হবে গোটা জাতিকে। হরতাল-অবরোধ বন্ধে দেশের ব্যবসায়িক নেতারা, বুদ্ধিজীবী মহল, সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজসহ সব রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজন দাবি আদায়ে হরতাল-অবরোধের বিকল্প কোনো পন্থা খুঁজে বের করা। সবাই মিলে হরতাল আর অবরোধকে ‘না’ বলার ব্যাপারেও দ্রুত সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলেরই ভালোভাবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যে দল হরতাল-অবরোধ আহ্বান করে দেশে অস্থিশীলতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, পরবর্তী সময়ে এর কুপ্রভাব পড়ে ওই দলেরই ওপর। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার এটাও বোঝা উচিত, জনগণ এখন আর বোকা নন। তারা যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তারা ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ ভালোভাবেই দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব দলেরই হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পরিহার করা উচিত। এখন সময় দেশকে এগিয়ে নেয়ার, পিছিয়ে দেয়ার নয়। হরতাল-অবরোধের কারণে এ দেশটি সবদিক থেকে পিছিয়ে যাক, এমনটি কারও কাম্য হতে পারে না। তাই দেশের এহেন মুহূর্তে সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে হবে- যেন এ দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সুনামির হাত থেকে চিরতরে রক্ষা পান, সুখে-শান্তিতে দুই বেলা দুমুঠো ভালোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারেন।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
No comments