শান্তি-সম্প্রীতি বনাম রাজনৈতিক অস্থিরতা by ড. সুকোমল বড়ুয়া
লেখাটি
‘সম্প্রীতি’ দিয়েই শুরু করছি, যদিও শিরোনামে প্রথমে আছে ‘শান্তি’ শব্দটি।
আমার মতে, সম্প্রীতির মধ্যেই শান্তি, সমঝোতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক
বোঝাপড়াসহ সব ধরনের আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশের উপাদান থাকে। যদি আমরা অন্যকেও
নিজের মতো করে ভাবি ও দেখি, তাহলেই খুঁজে পাওয়া যায় সত্যিকারের শান্তি;
নতুবা নয়। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এমনকি বিশ্বজনীন শান্তিও এর মধ্যে নিহিত
থাকে। ইদানীং দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা
ঘটছে, যা কারও কাম্য নয়। গত বছর কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও চট্টগ্রামের
পটিয়ার বৌদ্ধদের ওপর যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, এ রকম ঘটনা আমরা আর কখনও দেখিনি
এবং আমাদের পূর্বপুরুষের কাছেও কোনোদিন শুনিনি। সে এক ভয়াল দৃশ্য। মাসখানেক
আগে পাবনার সাঁথিয়ার হিন্দু অধ্যুষিত তিনটি গ্রামে যে হামলা, লুটপাট ও
মন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে তাও অবাক করার মতো। ক’দিন আগে
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও কিশোরগঞ্জসহ দেশের নানা স্থানে সংখ্যালঘু
হিন্দুদের ঘর-বাড়ি ও মূর্তি ভাংচুরের খবরও বেশ দুঃখজনক। ১৩ ডিসেম্বর
ভোররাতে বগুড়ার ধুনট উপজেলার পেঁচিবাড়ী গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের একটি
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সিরাজগঞ্জের
কালীমন্দিরের প্রতিমাও ভাংচুর করেছে একইদিন ভোররাতে। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম,
বরিশাল, নওগাঁ ও পঞ্চগড়ের নানা জায়গায় বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে, যা মিডিয়ায় তেমন
প্রচার পায়নি।
এ রকম কিছু ঘটনা হরহামেশাই সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটে যাচ্ছে, যা আমাদের শংকিত করে তোলে। এদিকে আবার গুজব ছড়ানো হচ্ছে রামু ও উখিয়ার তৈরিকৃত নতুন বিহার ও বুদ্ধমূর্তির ওপর আঘাত হানা হবে, হামলা হবে। এ নিয়ে সেখানকার বৌদ্ধরা বেশ আতংকে আছে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই এ ধরনের কিছু খবর আমাদের চোখে পড়ে, যা দেখে আমরা বিস্মিত হই এবং ভয়ও পাই।
অনেকে বলেন, সংখ্যালঘুদের কী অপরাধ তা আমরা জানি না। তারা কি এ দেশে জন্মগ্রহণ করে ভুল করেছে? আমি কিন্তু এর ঘোর বিরোধী। আমি বলি এ দেশে জন্মগ্রহণ করে আমরা অনেক ধন্য হয়েছি। রামুর ঘটনার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে একটি সংবাদপত্র কয়েকটি গোলটেবিল বৈঠক করেছে। বিশেষত চার প্রধান ধর্ম সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে এ বৈঠক করা হয়। এরপর ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা ও সংঘাত-সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে সংলাপও হয়েছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না এগুলো। এ কাজ কারা করছে, কেন করছে- অনেক প্রশ্ন মনে দোলা দেয়। আরও প্রশ্ন জাগে, সরকারের গোয়েন্দা, প্রশাসন ও আইন রক্ষাকারী বাহিনী যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয় না কেন? তাদের দায়িত্ব তো এগুলো অনুসন্ধান করা, খতিয়ে দেখা এবং ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এসব ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতা ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতা রয়েছে। এ ধরনের মন্তব্যের পর আর কি কিছু বলার থাকে?
আমাদের প্রশ্ন, সরকারের এসব সংস্থা আগে থেকে সজাগ থাকলে এ ধরনের নাশকতা সহজে হতে পারত না। ফেসবুকের মিথ্যা প্রচারণা থেকে এসব জঘন্য ও নৃশংস ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে বলে সরকারি-বেসরকারি নানা পর্যবেক্ষণে এসেছে।
একই ভূখণ্ডে আমরা বসবাস করি। পরিচয় অভিন্ন, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। তারপরও কেন এত আক্রমণ ভাবতে কষ্ট হয়। এ রকম বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। এজন্য তো স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সোনার বাংলাদেশ, যেখানে সব ধর্ম-বর্ণ মানুষের সমান অধিকার থাকবে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। কোনো রকমের ভেদাভেদ, বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু কার্যত সে দৃশ্য দেখা যায় না। এজন্য আমাদের মনে অনেক কষ্ট। এও ঠিক যে, কোনো জাতি বা সম্প্রদায়কে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বিচার করা যায় না। বিচার করতে হয় তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দিয়ে। মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার মানদণ্ডেও তাদের বিচার করা উচিত। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দুটি শব্দই আমাদের ব্যথিত করে। আমাদের অনেকেই বলেন, ‘সংখ্যালঘু’ বললেই নাকি মন দুর্বল হয়ে যায়। মনে হয় এ দেশে আমরা এতিম, অসহায়। তাই আজ বলতে চাই, এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার সমান। পবিত্র সংবিধানেও বলা আছে ‘একই ভূখণ্ডে যে কোনো স্থানে বসবাসকারী বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণের যে কোনো নাগরিক সমান সুযোগ-সুুবিধা ভোগ করবে। কোনো রকম বৈষম্য করা যাবে না।’ আমরাও যেন বলতে পারি ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।’
২.
বর্তমানে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। দেশের সামগ্রিক অবস্থা খুবই নাজুক। চারদিকে অস্থিরতা শুধু একটি ইস্যু নিয়ে। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এটা কি সমাধানের কোনো পথ নেই? বারবার দোহাই দেয়া হচ্ছে পবিত্র সংবিধানের। সংবিধান তো ধর্মীয় কিতাব নয় যে সংশোধন করা যাবে না। সুশীল সমাজ বলছে, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনও বলছেন, এমনকি দেশের বরেণ্য আইনজীবী এবং এলিট শ্রেণীর মানুষরাও বলছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থেই সংবিধান। নয়তো এতবার সংশোধন করা হল কেন? ১৯৭২-এর প্রণীত সংবিধানের ধারাই তো নিখুঁত ও অনড় থেকে যেত। দেশে যখনই যে পরিস্থিতি হয়-জনগণের স্বার্থে কিংবা সে সময়কার ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে- তখনই সংবিধানের ওপর ছুরি বসানো হয়। নইলে পঞ্চদশ সংশোধনী এলো কীভাবে?
এ সময়ে আমাদের দলগুলোর একত্রে বসা উচিত। আবারও সংলাপ শুরু করা উচিত। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো উভয় দলকে সংলাপে বসিয়ে গেছেন। এটা অব্যাহত রাখা উচিত। ক্ষমতায় থাকলে যে কোনো দলকে উদার মনোভাব দেখাতে হয়। মাঠে বিরোধী দল সব সময় উত্তপ্ত থাকে। এটা শুধু আমাদের বেলায় নয়, সব রাষ্ট্রের বেলায় প্রযোজ্য।
ক’দিন আগে আমরা থাইল্যান্ডে বিরোধী দলের আন্দোলন দেখেছি। বিক্ষোভকারীদের নেতা সুথেপ থাকসুবান সরকারকে হটাতে চূড়ান্ত সীমাও বেঁধে দিয়েছেন। বিরোধী দলের এক আন্দোলনেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনওয়াত্রা আগামী ফেব্র“য়ারির প্রথম সপ্তাহে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি তিনি গণভোটের ধারণাও ব্যক্ত করেছেন। রাজনীতিতে তারা কত সজাগ এবং গণআন্দোলনের প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল- এগুলো অবশ্যই আমাদের জন্য অনুকরণীয়।
গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের আন্দোলন থাকবে, এটা একটি বাস্তবতা। সেক্ষেত্রে সরকারি দলকে মারমুখী হলে চলবে না। সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কারণ সমাধানের সব অস্ত্র সরকারের হাতেই থাকে। এজন্য সরকারি দলকে ছাড়ও দিতে হয় বেশি। এতে সরকারেরই লাভ হয়। কারণ তারা শান্তিতে প্রশাসন চালাতে পারে, সরকারের স্থিতিশীলতাও বজায় থাকে।
৩.
প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষক দলও এ ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। নির্বাচন জোর করে করলেও সেই সরকার বেশিদিন টেকে না। অনর্থক কয়েকশ’ কোটি টাকা অপচয় করে লাভ কী? দেশে সংঘাত, নৈরাজ্য, সহিংসতা আরও অনেক বেড়ে যাবে। এতে দেশের ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। আমাদের দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি স্বীকৃত। তাহলে এর অধীনে নির্বাচন করতে অসুবিধা কোথায়? জাতীয় স্বার্থে এটা অবশ্যই করা উচিত। সবাই বলছে, সংঘাত ও সহিংসতা নিরসনের এটাই একমাত্র পথ। বর্তমান ঘোষিত তফসিল বাতিল করে সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলে এ সংকটের সমাধান হবে।
দেশ এক অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। আমরা কি ভেবেছি দেশের আর্থিক খাতগুলো আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? শিল্প-বাণিজ্যসহ ছোট ছোট শিল্প আজ ধ্বংসের পথে। দেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট শিল্প তো এরই মধ্যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বাকি যেসব কলকারখানা ও শিল্প সংস্থা আছে তাও বন্ধ হওয়ার পথে। শেয়ারবাজার প্রায় ধসে পড়েছে। এ অবস্থা আর কিছুদিন চললে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়াও অসম্ভব নয়। তখন মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। এ ভাবনা কি কারও আছে?
জিঘাংসা জিঘাংসার জন্ম দেয়। একটি সংঘাত আরেকটি সংঘাত সৃষ্টি করে। এটি বৌদ্ধ যুক্তিবাদের কথা। এসব বিষয় চিন্তা করে আমি প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাব আরেকটু নমনীয়তা প্রদর্শনের জন্য। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই বর্তমান সংঘাত বন্ধ হবে। আমি শান্তির পক্ষের মানুষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যেভাবেই হোক সংকট উত্তরণের একটি পথ বের করুন। জাতিকে বাঁচান। নতুবা দেশ অগ্নিগর্ভে নিমজ্জিত হবে।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান. পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
এ রকম কিছু ঘটনা হরহামেশাই সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটে যাচ্ছে, যা আমাদের শংকিত করে তোলে। এদিকে আবার গুজব ছড়ানো হচ্ছে রামু ও উখিয়ার তৈরিকৃত নতুন বিহার ও বুদ্ধমূর্তির ওপর আঘাত হানা হবে, হামলা হবে। এ নিয়ে সেখানকার বৌদ্ধরা বেশ আতংকে আছে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই এ ধরনের কিছু খবর আমাদের চোখে পড়ে, যা দেখে আমরা বিস্মিত হই এবং ভয়ও পাই।
অনেকে বলেন, সংখ্যালঘুদের কী অপরাধ তা আমরা জানি না। তারা কি এ দেশে জন্মগ্রহণ করে ভুল করেছে? আমি কিন্তু এর ঘোর বিরোধী। আমি বলি এ দেশে জন্মগ্রহণ করে আমরা অনেক ধন্য হয়েছি। রামুর ঘটনার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে একটি সংবাদপত্র কয়েকটি গোলটেবিল বৈঠক করেছে। বিশেষত চার প্রধান ধর্ম সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে এ বৈঠক করা হয়। এরপর ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা ও সংঘাত-সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে সংলাপও হয়েছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না এগুলো। এ কাজ কারা করছে, কেন করছে- অনেক প্রশ্ন মনে দোলা দেয়। আরও প্রশ্ন জাগে, সরকারের গোয়েন্দা, প্রশাসন ও আইন রক্ষাকারী বাহিনী যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয় না কেন? তাদের দায়িত্ব তো এগুলো অনুসন্ধান করা, খতিয়ে দেখা এবং ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এসব ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতা ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতা রয়েছে। এ ধরনের মন্তব্যের পর আর কি কিছু বলার থাকে?
আমাদের প্রশ্ন, সরকারের এসব সংস্থা আগে থেকে সজাগ থাকলে এ ধরনের নাশকতা সহজে হতে পারত না। ফেসবুকের মিথ্যা প্রচারণা থেকে এসব জঘন্য ও নৃশংস ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে বলে সরকারি-বেসরকারি নানা পর্যবেক্ষণে এসেছে।
একই ভূখণ্ডে আমরা বসবাস করি। পরিচয় অভিন্ন, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। তারপরও কেন এত আক্রমণ ভাবতে কষ্ট হয়। এ রকম বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। এজন্য তো স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সোনার বাংলাদেশ, যেখানে সব ধর্ম-বর্ণ মানুষের সমান অধিকার থাকবে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। কোনো রকমের ভেদাভেদ, বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু কার্যত সে দৃশ্য দেখা যায় না। এজন্য আমাদের মনে অনেক কষ্ট। এও ঠিক যে, কোনো জাতি বা সম্প্রদায়কে সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বিচার করা যায় না। বিচার করতে হয় তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দিয়ে। মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার মানদণ্ডেও তাদের বিচার করা উচিত। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দুটি শব্দই আমাদের ব্যথিত করে। আমাদের অনেকেই বলেন, ‘সংখ্যালঘু’ বললেই নাকি মন দুর্বল হয়ে যায়। মনে হয় এ দেশে আমরা এতিম, অসহায়। তাই আজ বলতে চাই, এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার সমান। পবিত্র সংবিধানেও বলা আছে ‘একই ভূখণ্ডে যে কোনো স্থানে বসবাসকারী বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণের যে কোনো নাগরিক সমান সুযোগ-সুুবিধা ভোগ করবে। কোনো রকম বৈষম্য করা যাবে না।’ আমরাও যেন বলতে পারি ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার।’
২.
বর্তমানে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। দেশের সামগ্রিক অবস্থা খুবই নাজুক। চারদিকে অস্থিরতা শুধু একটি ইস্যু নিয়ে। নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এটা কি সমাধানের কোনো পথ নেই? বারবার দোহাই দেয়া হচ্ছে পবিত্র সংবিধানের। সংবিধান তো ধর্মীয় কিতাব নয় যে সংশোধন করা যাবে না। সুশীল সমাজ বলছে, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনও বলছেন, এমনকি দেশের বরেণ্য আইনজীবী এবং এলিট শ্রেণীর মানুষরাও বলছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থেই সংবিধান। নয়তো এতবার সংশোধন করা হল কেন? ১৯৭২-এর প্রণীত সংবিধানের ধারাই তো নিখুঁত ও অনড় থেকে যেত। দেশে যখনই যে পরিস্থিতি হয়-জনগণের স্বার্থে কিংবা সে সময়কার ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে- তখনই সংবিধানের ওপর ছুরি বসানো হয়। নইলে পঞ্চদশ সংশোধনী এলো কীভাবে?
এ সময়ে আমাদের দলগুলোর একত্রে বসা উচিত। আবারও সংলাপ শুরু করা উচিত। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো উভয় দলকে সংলাপে বসিয়ে গেছেন। এটা অব্যাহত রাখা উচিত। ক্ষমতায় থাকলে যে কোনো দলকে উদার মনোভাব দেখাতে হয়। মাঠে বিরোধী দল সব সময় উত্তপ্ত থাকে। এটা শুধু আমাদের বেলায় নয়, সব রাষ্ট্রের বেলায় প্রযোজ্য।
ক’দিন আগে আমরা থাইল্যান্ডে বিরোধী দলের আন্দোলন দেখেছি। বিক্ষোভকারীদের নেতা সুথেপ থাকসুবান সরকারকে হটাতে চূড়ান্ত সীমাও বেঁধে দিয়েছেন। বিরোধী দলের এক আন্দোলনেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনওয়াত্রা আগামী ফেব্র“য়ারির প্রথম সপ্তাহে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি তিনি গণভোটের ধারণাও ব্যক্ত করেছেন। রাজনীতিতে তারা কত সজাগ এবং গণআন্দোলনের প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল- এগুলো অবশ্যই আমাদের জন্য অনুকরণীয়।
গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের আন্দোলন থাকবে, এটা একটি বাস্তবতা। সেক্ষেত্রে সরকারি দলকে মারমুখী হলে চলবে না। সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কারণ সমাধানের সব অস্ত্র সরকারের হাতেই থাকে। এজন্য সরকারি দলকে ছাড়ও দিতে হয় বেশি। এতে সরকারেরই লাভ হয়। কারণ তারা শান্তিতে প্রশাসন চালাতে পারে, সরকারের স্থিতিশীলতাও বজায় থাকে।
৩.
প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষক দলও এ ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। নির্বাচন জোর করে করলেও সেই সরকার বেশিদিন টেকে না। অনর্থক কয়েকশ’ কোটি টাকা অপচয় করে লাভ কী? দেশে সংঘাত, নৈরাজ্য, সহিংসতা আরও অনেক বেড়ে যাবে। এতে দেশের ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। আমাদের দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি স্বীকৃত। তাহলে এর অধীনে নির্বাচন করতে অসুবিধা কোথায়? জাতীয় স্বার্থে এটা অবশ্যই করা উচিত। সবাই বলছে, সংঘাত ও সহিংসতা নিরসনের এটাই একমাত্র পথ। বর্তমান ঘোষিত তফসিল বাতিল করে সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হলে এ সংকটের সমাধান হবে।
দেশ এক অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। আমরা কি ভেবেছি দেশের আর্থিক খাতগুলো আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? শিল্প-বাণিজ্যসহ ছোট ছোট শিল্প আজ ধ্বংসের পথে। দেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট শিল্প তো এরই মধ্যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বাকি যেসব কলকারখানা ও শিল্প সংস্থা আছে তাও বন্ধ হওয়ার পথে। শেয়ারবাজার প্রায় ধসে পড়েছে। এ অবস্থা আর কিছুদিন চললে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়াও অসম্ভব নয়। তখন মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। এ ভাবনা কি কারও আছে?
জিঘাংসা জিঘাংসার জন্ম দেয়। একটি সংঘাত আরেকটি সংঘাত সৃষ্টি করে। এটি বৌদ্ধ যুক্তিবাদের কথা। এসব বিষয় চিন্তা করে আমি প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাব আরেকটু নমনীয়তা প্রদর্শনের জন্য। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই বর্তমান সংঘাত বন্ধ হবে। আমি শান্তির পক্ষের মানুষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যেভাবেই হোক সংকট উত্তরণের একটি পথ বের করুন। জাতিকে বাঁচান। নতুবা দেশ অগ্নিগর্ভে নিমজ্জিত হবে।
প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান. পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
No comments