জিতবে আওয়ামী লীগ, হারবে দেশ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টাকে ‘পর্যায়ক্রমিক অভ্যুত্থান’ বলে অভিহিত করেছেন একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক। প্রধান বিরোধী দল ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করতে যাচ্ছে। কাজেই শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত। এখানে বৈধতার প্রশ্নটি অন্য। ভোট নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় এ পর্যন্ত শতাধিক লোক নিহত হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করার পর সাম্প্রতিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের রক্তাক্ত পরাজয়ের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে তিনি একটি ত্রুটিপূর্ণ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত হন। যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। কিন্তু আরও রক্ত না ঝরিয়ে সংঘাতপূর্ণ জন্ম বাংলাদেশ মেনে নেবে বলে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, তা বিলীন হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার অজনপ্রিয় সরকার দেশের বেশির ভাগ অংশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
রাজপথে তার রাজনীতি পরিচালনা করছে। একের পর এক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে তারা পরিবহনব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তাদের দোসর জামায়াত নিছক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়ছে। তাদের গুন্ডা-মাস্তান, যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দিতে গিয়ে রগ কাটে বলে কুখ্যাতি রয়েছে, তারা এখন সরাসরি হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। গুলি ছুড়ে এর পাল্টা জবাব দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর তারা জামায়াতের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ভারতের সীমান্তসংলগ্ন সাতক্ষীরা জেলায় পাঁচজন জামায়াত-সমর্থককে হত্যা করে। উত্তরাঞ্চলে জামায়াতের তরুণ কর্মীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়িয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা রাজধানী ঢাকার আশপাশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, দণ্ডিত সব জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়া দেখতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার বিষয়ে আস্থা রয়েছে সামান্যই। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শেখ হাসিনাকে এসব দণ্ডাদেশ কার্যকর না করতে বলেছিলেন। কিন্তু আপস করা তাঁর রীতি নয়। পাঁচ বছর আগে শেখ হাসিনা বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করেন।
২০১১ সালে একটি অনুচ্ছেদ বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করা হয়। নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার এই অনুচ্ছেদ সংবিধানভুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। দুটি বড় দলের পারস্পরিক অবিশ্বাসের দীর্ঘ জের ধরে এর বিলুপ্তি ঘটে। এই সংশোধনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা যে স্বেচ্ছায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছেন, তা নয়। তবে ওই সংশোধনীর পরিণামে হয়তো এটাই হতে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখছেন। এখানে সবচেয়ে বড় বেকায়দার বিষয়টি হচ্ছে, নির্বাচন হবে সুস্পষ্ট একটা প্রহসন। ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৪ জন নির্বাচিত হবেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিএনপি ও তাদের মিত্র ১৭টি ছোট দল নির্বাচন বর্জন করছে। এই বর্জনে তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি যোগ দেওয়ায় দলের নেতা সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে হাসপাতালে আটক রাখা হয়েছে এবং তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। পরবর্তী বড় দল জামায়াত ধর্মকে পুঁজি করে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান লঙ্ঘন করেছে, এই কারণ দেখিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে আওয়ামী লীগ অন্তত জয়ী হচ্ছে। ৫ জানুয়ারি যা-ই ঘটুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার শপথ নেওয়ার মতো যথেষ্ট সাংসদ সংসদে থাকবেন। দেশে-বিদেশে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। নির্বাচনের দিক পরিবর্তনে বিদেশি শক্তি হিসেবে বাংলাদেশকে কেবল প্রভাবিত করতে পারে প্রতিবেশী দেশ ভারত। কিন্তু হস্তক্ষেপ করছে না তারা। ভারত যদি ‘ফল নির্ধারণপূর্বক আয়োজিত নির্বাচনের’
(রাষ্ট্রপতি এরশাদ আশির দশকে এ ধরনের নির্বাচনের প্রচলন করেন) প্রতি পরোক্ষ সমর্থনও দেয়, তবে তা দেশটির জন্য অদূরদর্শিতা বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব ফেঁপে উঠেছে। সংঘাতময় পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, ভারতের মিত্র আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী হিসেবে দেখানোর আশঙ্কাও তত বাড়ছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগত করাকে সমর্থন করলে তা ভারতের জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। তা হবে ‘আরও উগ্র ও দুর্বল ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ’। এ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীও আগ বাড়াতে রাজি নয়। গতবার খালেদা জিয়া যখন নির্বাচনের ফল ছিনতাইয়ের ফন্দি করছিলেন, তখন একটি অনির্বাচিত ‘টেকনোক্রেটিক’ প্রশাসন ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে দুই বছর দেশ শাসন করেছিল। এই অভ্যুত্থানের প্রতি বিদেশি ক্ষমতাধর দেশগুলোর মৌন সমর্থন থাকলেও এবার তা করবে না। এতে সংঘাতময় পরিস্থিতি মাসের পর মাস ধরে চলতে পারে। কাজেই যথাযথ নির্বাচন হতে হবে। আওয়ামী লীগের কিছু রাজনীতিকও তা স্বীকার করেন। জনমত জরিপ বলছে, মাত্র ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি চায়, জেনারেলরা ক্ষমতায় আসুন। তা করে তাঁরা যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনও করেন, তবু মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ‘যুদ্ধংদেহী বেগমদ্বয়ের’ রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পক্ষে। তবে দেশ তাঁরা যত খারাপভাবেই চালান না কেন, মনে হচ্ছে তাঁদের ছাড়া চলবে না।
সূত্র: দি ইকোনমিস্ট, ২০ ডিসেম্বর ২০১৩
সূত্র: দি ইকোনমিস্ট, ২০ ডিসেম্বর ২০১৩
No comments