প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনটি খারাপ দৃষ্টান্তই তৈরি করবে by তারেক শামসুর রেহমান
আবারও
লাগাতার ৮৩ ঘণ্টার অবরোধ আর ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’
সংসদ সদস্যের খবর যখন সংবাদপত্রগুলো আমাদের দিচ্ছে, ঠিক তখন মনে পড়ে গেল
২০০৮ সালের একটা লেখার কথা। লেখক ছিলেন ই জে সি দুরু এবং ও ও জর্জ।
প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘দ্য প্যারাডক্স অব ডেমোক্রেটাইজেশন ডার্জ’। বাংলা
করলে দাঁড়ায় ‘মৃত গণতন্ত্রের স্মরণগীত’। অন্ত্যেষ্টিকালে যে শোকস্তবক
উচ্চারণ করা হয়, তাকে ইংরেজিতে বলে ‘উরৎমব’। এটা পশ্চিমা সমাজের ঐতিহ্য
হলেও আমরাও কিন্তু তা অনুসরণ করি। একজন মানুষ মারা গেলে জানাজায় তার
সম্পর্কে কিছু ভালো ভালো কথা বলা হয় এবং তার বিগত জীবনের ভুল-ত্র“টির জন্য
ক্ষমা চাওয়া হয়। এটা আমাদের মুসলমান সমাজেরও ঐতিহ্য। আফ্রিকার ওই দুই লেখক
উল্লিখিত প্রবন্ধে আফ্রিকার গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে ওই শব্দটি ব্যবহার
করেছিলেন। যারা আফ্রিকার রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, বিশেষ করে
২০০৮ সালের দিকে জিম্বাবুয়ে কিংবা কেনিয়ার ঘটনাবলী সম্পর্কে যাদের কিছুটা
ধারণা আছে, তারা জানেন আফ্রিকায় গণতন্ত্র চর্চা কীভাবে তখন বাধাগ্রস্ত
হয়েছিল। তাই ওই দুই লেখক অনেকটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে গণতন্ত্রের ‘মৃত্যু’ হয়েছে
মনে করে তার জন্য শোকবাণী উচ্চারণ করেছিলেন!
বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে কিংবা কেনিয়া নয়। আমাদের গণতন্ত্র চর্চার আলাদা একটা ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু লাগাতার অবরোধ আর একতরফা নির্বাচন এই গণতন্ত্রকে এখন একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। একটা বাজে দৃষ্টান্ত আরেকটা বাজে দৃষ্টান্তকে টেনে আনবে ভবিষ্যতে। ইতিমধ্যে একটা বাজে দৃষ্টান্ত আমরা তৈরি করেছি তারানকোকে মধ্যস্থতা করার সুযোগ দিয়ে। বিষয়টি একান্তভাবেই আমাদের। এখানে নির্বাচন ব্যবস্থা কীভাবে হবে, সংসদ কীভাবে চলবে- এ বিষয়গুলো একান্তভাবেই আমাদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েছে ‘তৃতীয় পক্ষ’ অর্থাৎ বিদেশীরা। জাতিসংঘের দূত যখন বাংলাদেশে আসেন তখন আমরা বলেছি, এটা অশনি সংকেত! এভাবে আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাতিসংঘের মতো সংস্থা আসতে পারে না। এটা জাতিসংঘের কাজও নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতিকরা এ সুযোগটি করে দিয়েছেন। দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল ‘সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু সেটা হল না। এখন একটা নির্বাচন হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন! নির্বাচন হচ্ছে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নেই, সেটা কেমন নির্বাচন? এটা তো সংবিধানে বর্ণিত ১১নং অনুচ্ছেদের বরখেলাপের শামিল। ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখন জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হল কোথায়? আরও একটা কথা। কোথাও কোথাও এখন দু’জন সংসদ সদস্যের (যেমন পিরোজপুর-২) অবস্থান হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ ভেঙে না দেয়ায় সেখানে এখনও একজন এমপি ‘আইনগতভাবে’ বহাল রয়েছেন। কিন্তু ওই আসনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ আরেকজন এমপি এসে গেছেন, যিনি নবম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে এমপি হননি। বাংলাদেশে আমরা এখন এ কোন গণতন্ত্র দেখছি! জাতীয় পার্টি একটি বড় দল। সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তার দলের প্রার্থীদের নাম প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিলেও কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়ে গেছেন। অর্থাৎ সেসব আসনে নির্বাচন হচ্ছে! খোদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়ে আছেন! তার প্রত্যাহারের চিঠি গ্রহণ করা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তার দলের ৬ জন সদস্য থাকলেও (একজন উপদেষ্টাসহ) তিনি তাদের পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র পাঠালেও তা এখন অবধি গ্রহণ করা হয়নি! আমরা এ কোন গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ করছি এ দেশে!
যখন এ নিবন্ধ তৈরি করেছি, তখন একের পর এক খারাপ খবর আসছে। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসউইম্যান গ্রেস মেংয়ের একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি না বদলালে মার্কিন কংগ্রেসে ফের বাংলাদেশ নিয়ে শুনানি হবে। গেল নভেম্বরে একবার শুনানিতে কংগ্রেস সদস্যরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর কংগ্রেসের ফরেন রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডওয়ার্ড রয়েস ও কংগ্রেসনাল বাংলাদেশ ককাসের চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে চিঠি দিয়ে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধি তারানকোর বাংলাদেশে পাঁচ দিনের সফরও কার্যত ‘ব্যর্থ’ হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী কেরি প্রধানমন্ত্রীকে সরে গিয়ে নির্বাচন আয়োজন করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যদিও সংবাদটির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিজয় দিবসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা সাভারে স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেননি। প্রতিটি ঘটনা কতগুলো মেসেজ আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে : ক. বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দাতারা অসন্তুষ্ট; খ. তারা নিশ্চিত নির্বাচনটা প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখেই একতরফাভাবে হচ্ছে; গ. ‘একটি সিদ্ধান্তে’ আসতে পারে(?) মার্কিন কংগ্রেস। প্রতিটি ঘটনা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। স্পষ্টতই বিদেশীদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
শুধু বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হচ্ছে তা নয়। বরং অর্থনীতির ‘বারোটা’ বেজে গেছে। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংস্থা বিজিএমইএ’র হিসাব মতে, হরতাল ও অবরোধজনিত কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে গত দেড় মাসে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একটা দেশের জন্য এই বিপুল ‘ক্ষতি’ কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রেশ আগামীতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়! আর একটা জিনিস আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না যে, অবরোধ যদি এভাবে চলতেই থাকে, তাহলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি সচল না হলে ভ্যাট আদায় হবে না। আর ভ্যাট আদায় না হলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে। সেক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বলতে পারে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি গেল বছর ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে তা কমে ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এনবিআর আমাদের জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। যুগান্তর আমাদের জানাচ্ছে (১৭ ডিসেম্বর), বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখন দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশগুলো এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে। একটি উদ্বেগজনক সংবাদও দিয়েছেন প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শংকিত আমদানিকারক দেশগুলো। তাদের এ শংকার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে ৩৫টি দেশের বায়ার্স প্রতিষ্ঠান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তারা ব্যবসার পরিবেশ না পেলে ভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। বেশ ক’টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আমি জানি না, কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটা আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে আগামী ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে বলে আমার ধারণা। কেননা নির্বাচন বাতিল করার আর কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
৫ জানুয়ারির আগে আর দুপক্ষের মধ্যে কোনো সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংলাপ কার্যত এখন ব্যর্থ। আমরা বারবার বলছি, আমাদের রাজনীতিকদের ‘মাইন্ড সেটআপে’ যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে এ ধরনের ‘সংলাপ’ হবে লোক দেখানো। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্যার নিনিয়ানের ব্যর্থ চেষ্টার পর আরেক ডিসেম্বরে তারানকোর উদ্যোগও কার্যত ব্যর্থ হল! এতে আগামীতে আর কেউ আসবেন না আমাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধানকল্পে। এখন বিএনপিকে বাদ রেখেই দশম জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সংসদ কতদিন টিকবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু বাংলাদেশ যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের জন্য আদৌ উপযুক্ত নয়, সে প্রশ্ন উঠবে বিভিন্ন মহলে। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- প্রথম সংসদ (১৯৭৩) ৩০ মাস, দ্বিতীয় সংসদ (১৯৭৯) ৩৫ মাস, তৃতীয় সংসদ (১৯৮৬) ১৭ মাস, চতুর্থ সংসদ (১৯৮৮) ৩১ মাস, পঞ্চম সংসদ (১৯৯১) ৫৬ মাস, ষষ্ঠ সংসদ (১৯৯৬) ১৩ দিন, সপ্তম সংসদ (১৯৯৬) ৬০ মাস, অষ্টম সংসদ (২০০১) ৬০ মাস, নবম সংসদ (২০০৮) ধারণা করছি ৬০ মাস টিকে ছিল। রাজনীতির স্ট্র্যাটেজিস্টরা ‘রাজনীতির অংক’ কষতেই পারেন। লাভ-ক্ষতির হিসাবও কষতে পারেন কেউ কেউ। তাতে পরিস্থিতি বদলে যাবে না। নির্বাচন হবেই। এ ক্ষেত্রে আমরা কেউ স্বীকৃতি দিই আর না দিই, দশম জাতীয় সংসদে আমরা একটা ‘বিরোধী দল’ও পাব!
পঞ্চম দফা অবরোধ আন্দোলন অনেক ‘বিষয়’ সামনে নিয়ে এলো। এক. নির্বাচন কমিশনকে ‘স্বাধীন’ করেও ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ কমিশন নিশ্চিত করতে পারে না। প্রশাসনের প্রভাবের বাইরে গিয়ে ইসি কাজ করতে পারে না। সুতরাং ‘স্বাধীন’ ও ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার জন্য যথেষ্ট নয়। সিইসি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেন। অতীতের অনেক ব্যর্থ কমিশনের মতো ‘রকিব কমিশন’ও ব্যর্থতার খাতায় নাম লেখাল! দুই. এবার আমাদের একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো’ গড়ে তুলতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকার একটি কমিশন গঠন করে বুদ্ধিজীবীদের মতামতও নিতে পারে। তিন. সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত সব মামলা প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এতে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পথ প্রশস্ত হতে পার। চার. পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলার যে আহ্বান সরকারি নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, তা প্রত্যাহার করতে হবে। এতে উত্তেজনা, সংঘাত বাড়বে বৈ কমবে না।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাই সব কথা নয়। গণতন্ত্র সহনশীলতা ও আস্থার কথা বলে। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, সহনশীলতা ও আস্থার সম্পর্ক এ মুহূর্তে নেই। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগটা তাই বাঞ্ছনীয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে কিংবা কেনিয়া নয়। আমাদের গণতন্ত্র চর্চার আলাদা একটা ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু লাগাতার অবরোধ আর একতরফা নির্বাচন এই গণতন্ত্রকে এখন একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিল। একটা বাজে দৃষ্টান্ত আরেকটা বাজে দৃষ্টান্তকে টেনে আনবে ভবিষ্যতে। ইতিমধ্যে একটা বাজে দৃষ্টান্ত আমরা তৈরি করেছি তারানকোকে মধ্যস্থতা করার সুযোগ দিয়ে। বিষয়টি একান্তভাবেই আমাদের। এখানে নির্বাচন ব্যবস্থা কীভাবে হবে, সংসদ কীভাবে চলবে- এ বিষয়গুলো একান্তভাবেই আমাদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েছে ‘তৃতীয় পক্ষ’ অর্থাৎ বিদেশীরা। জাতিসংঘের দূত যখন বাংলাদেশে আসেন তখন আমরা বলেছি, এটা অশনি সংকেত! এভাবে আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জাতিসংঘের মতো সংস্থা আসতে পারে না। এটা জাতিসংঘের কাজও নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতিকরা এ সুযোগটি করে দিয়েছেন। দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল ‘সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু সেটা হল না। এখন একটা নির্বাচন হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন! নির্বাচন হচ্ছে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নেই, সেটা কেমন নির্বাচন? এটা তো সংবিধানে বর্ণিত ১১নং অনুচ্ছেদের বরখেলাপের শামিল। ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখন জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হল কোথায়? আরও একটা কথা। কোথাও কোথাও এখন দু’জন সংসদ সদস্যের (যেমন পিরোজপুর-২) অবস্থান হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ ভেঙে না দেয়ায় সেখানে এখনও একজন এমপি ‘আইনগতভাবে’ বহাল রয়েছেন। কিন্তু ওই আসনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ আরেকজন এমপি এসে গেছেন, যিনি নবম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে এমপি হননি। বাংলাদেশে আমরা এখন এ কোন গণতন্ত্র দেখছি! জাতীয় পার্টি একটি বড় দল। সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তার দলের প্রার্থীদের নাম প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিলেও কোথাও কোথাও জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়ে গেছেন। অর্থাৎ সেসব আসনে নির্বাচন হচ্ছে! খোদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়ে আছেন! তার প্রত্যাহারের চিঠি গ্রহণ করা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তার দলের ৬ জন সদস্য থাকলেও (একজন উপদেষ্টাসহ) তিনি তাদের পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র পাঠালেও তা এখন অবধি গ্রহণ করা হয়নি! আমরা এ কোন গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ করছি এ দেশে!
যখন এ নিবন্ধ তৈরি করেছি, তখন একের পর এক খারাপ খবর আসছে। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসউইম্যান গ্রেস মেংয়ের একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি না বদলালে মার্কিন কংগ্রেসে ফের বাংলাদেশ নিয়ে শুনানি হবে। গেল নভেম্বরে একবার শুনানিতে কংগ্রেস সদস্যরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর কংগ্রেসের ফরেন রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডওয়ার্ড রয়েস ও কংগ্রেসনাল বাংলাদেশ ককাসের চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে চিঠি দিয়ে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধি তারানকোর বাংলাদেশে পাঁচ দিনের সফরও কার্যত ‘ব্যর্থ’ হয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী কেরি প্রধানমন্ত্রীকে সরে গিয়ে নির্বাচন আয়োজন করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যদিও সংবাদটির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিজয় দিবসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা সাভারে স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেননি। প্রতিটি ঘটনা কতগুলো মেসেজ আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে : ক. বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দাতারা অসন্তুষ্ট; খ. তারা নিশ্চিত নির্বাচনটা প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখেই একতরফাভাবে হচ্ছে; গ. ‘একটি সিদ্ধান্তে’ আসতে পারে(?) মার্কিন কংগ্রেস। প্রতিটি ঘটনা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। স্পষ্টতই বিদেশীদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
শুধু বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হচ্ছে তা নয়। বরং অর্থনীতির ‘বারোটা’ বেজে গেছে। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংস্থা বিজিএমইএ’র হিসাব মতে, হরতাল ও অবরোধজনিত কারণে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে গত দেড় মাসে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একটা দেশের জন্য এই বিপুল ‘ক্ষতি’ কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর রেশ আগামীতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়! আর একটা জিনিস আমরা অনেকেই চিন্তা করছি না যে, অবরোধ যদি এভাবে চলতেই থাকে, তাহলে দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি সচল না হলে ভ্যাট আদায় হবে না। আর ভ্যাট আদায় না হলে রাষ্ট্রের আয় কমে যাবে। সেক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে একটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে বলতে পারে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি গেল বছর ছিল ৬ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে তা কমে ৫ দশমিক ২ ভাগে নেমে আসবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এনবিআর আমাদের জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। যুগান্তর আমাদের জানাচ্ছে (১৭ ডিসেম্বর), বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখন দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশগুলো এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে। একটি উদ্বেগজনক সংবাদও দিয়েছেন প্রতিবেদক। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শংকিত আমদানিকারক দেশগুলো। তাদের এ শংকার কথা জানিয়ে এরই মধ্যে ৩৫টি দেশের বায়ার্স প্রতিষ্ঠান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তারা ব্যবসার পরিবেশ না পেলে ভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছেন। বেশ ক’টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আমি জানি না, কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার একটা আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে আগামী ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে বলে আমার ধারণা। কেননা নির্বাচন বাতিল করার আর কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।
৫ জানুয়ারির আগে আর দুপক্ষের মধ্যে কোনো সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংলাপ কার্যত এখন ব্যর্থ। আমরা বারবার বলছি, আমাদের রাজনীতিকদের ‘মাইন্ড সেটআপে’ যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে এ ধরনের ‘সংলাপ’ হবে লোক দেখানো। ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর স্যার নিনিয়ানের ব্যর্থ চেষ্টার পর আরেক ডিসেম্বরে তারানকোর উদ্যোগও কার্যত ব্যর্থ হল! এতে আগামীতে আর কেউ আসবেন না আমাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধানকল্পে। এখন বিএনপিকে বাদ রেখেই দশম জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সংসদ কতদিন টিকবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু বাংলাদেশ যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের জন্য আদৌ উপযুক্ত নয়, সে প্রশ্ন উঠবে বিভিন্ন মহলে। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- প্রথম সংসদ (১৯৭৩) ৩০ মাস, দ্বিতীয় সংসদ (১৯৭৯) ৩৫ মাস, তৃতীয় সংসদ (১৯৮৬) ১৭ মাস, চতুর্থ সংসদ (১৯৮৮) ৩১ মাস, পঞ্চম সংসদ (১৯৯১) ৫৬ মাস, ষষ্ঠ সংসদ (১৯৯৬) ১৩ দিন, সপ্তম সংসদ (১৯৯৬) ৬০ মাস, অষ্টম সংসদ (২০০১) ৬০ মাস, নবম সংসদ (২০০৮) ধারণা করছি ৬০ মাস টিকে ছিল। রাজনীতির স্ট্র্যাটেজিস্টরা ‘রাজনীতির অংক’ কষতেই পারেন। লাভ-ক্ষতির হিসাবও কষতে পারেন কেউ কেউ। তাতে পরিস্থিতি বদলে যাবে না। নির্বাচন হবেই। এ ক্ষেত্রে আমরা কেউ স্বীকৃতি দিই আর না দিই, দশম জাতীয় সংসদে আমরা একটা ‘বিরোধী দল’ও পাব!
পঞ্চম দফা অবরোধ আন্দোলন অনেক ‘বিষয়’ সামনে নিয়ে এলো। এক. নির্বাচন কমিশনকে ‘স্বাধীন’ করেও ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ কমিশন নিশ্চিত করতে পারে না। প্রশাসনের প্রভাবের বাইরে গিয়ে ইসি কাজ করতে পারে না। সুতরাং ‘স্বাধীন’ ও ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার জন্য যথেষ্ট নয়। সিইসি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলেন। অতীতের অনেক ব্যর্থ কমিশনের মতো ‘রকিব কমিশন’ও ব্যর্থতার খাতায় নাম লেখাল! দুই. এবার আমাদের একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো’ গড়ে তুলতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকার একটি কমিশন গঠন করে বুদ্ধিজীবীদের মতামতও নিতে পারে। তিন. সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত সব মামলা প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এতে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পথ প্রশস্ত হতে পার। চার. পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলার যে আহ্বান সরকারি নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, তা প্রত্যাহার করতে হবে। এতে উত্তেজনা, সংঘাত বাড়বে বৈ কমবে না।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাই সব কথা নয়। গণতন্ত্র সহনশীলতা ও আস্থার কথা বলে। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, সহনশীলতা ও আস্থার সম্পর্ক এ মুহূর্তে নেই। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগটা তাই বাঞ্ছনীয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments