জনগণের ইচ্ছাতেই সুপার মেজরিটি?
সংসদীয় ব্যবস্থায় আইনসভার নির্বাচনে কোনো দল বা জোটের দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভের ঘটনার পর সেসব দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে গত চার দশকে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশেই। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ৩৫টি নির্বাচনের ভেতরে যে ১১টিতে বিজয়ী দল বা জোট দুই-তৃতীয়াংশ বা তার বেশি আসন পেয়েছে, সেখানে নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে এবং তাঁদের আচরণে অগণতান্ত্রিক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ভারতে ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধীর শাসনামলে; শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়িয়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সেই পদে আসীন হয়েছেন। কিন্তু এই নির্বাচনগুলোর ফলাফল যেহেতু জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, সেহেতু সুপার মেজরিটিও জনগণের রায়—এই দাবি কেউ কেউ করতে পারেন। কিন্তু এই নির্বাচনগুলোর ফলাফল খতিয়ে দেখলে যে ছবি উঠে আসে, তা এই যুক্তির বিরুদ্ধেই বরং প্রমাণ তৈরি করে দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় গত চার দশকে কোনো সুষ্ঠু, অবাধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে কোনো দল ভোটারদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোট পায়নি। আমরা অবশ্যই এই বিবেচনা থেকে বাংলাদেশের ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাদ রেখেছি। কেননা, এই দুই ক্ষেত্রেই ভোটারদের সামনে কার্যকর কোনো বিকল্প ছিল না। ফলে এই সময়ে সংশ্লিষ্ট বিজয়ী দল যে ৬৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, তাতে নির্বাচনে অসদুপায় ব্যবহারের প্রমাণ মেলে, তাদের প্রতি ভোটারদের সমর্থন নয়। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনকে ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে।
তবে এই নির্বাচনেও ভোট জালিয়াতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। তবু তাকেই আমরা ব্যতিক্রম বলতে পারি, যেখানে ক্ষমতাসীনেরা ১৯৭৩ সালে ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, আসনের দিক থেকে ৯৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছিল ৪৬ দশমিক ৬২ শতাংশ (আসনের ৭০ দশমিক ৬৭ শতাংশ); ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের পাওয়া ভোট ৫৭ শতাংশ। ভারতে ১৯৭১ সালে কংগ্রেস পায় ৪৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ ভোট (আসনের ৬৭ দশমিক ৯৫); ১৯৮৪ সালে কংগ্রেসের বাক্সে পড়ে ৫০ শতাংশের কম ভোট—৪৯ দশমিক ০১ শতাংশ; পায় আসনের ৭৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯৭৭ সালে পেয়েছিল ৬০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট—কিন্তু আসন পেয়েছিল ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পাকিস্তান মুসলিম লীগ যখন দুই-তৃতীয়াংশের জোরে দেশ শাসন করেছে, সেই ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে তার পাওয়া ভোটের হার ছিল ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় ইউএনপি মাত্র ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটের জোরে ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ আসনের অধিকারী হয়েছিল ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে। এসব তথ্য নিঃসন্দেহে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’-ব্যবস্থার ভেতরে লুকানো একটা গভীর দুর্বলতার দিকে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই ব্যবস্থায় একটি দল সুপার মেজরিটির দাবি করতে পারে এবং সেভাবে দেশ শাসন করতে পারে, যখন দেশের ভোটাররা তাঁদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এমন কোনো ম্যান্ডেট দেয়নি। শুধু তা-ই নয়, এসব উদাহরণ থেকে আমরা আরও একটি উপসংহারে পৌঁছতে পারি। ক্রিস অ্যাডক গুয়াতেমালা, কলম্বিয়া ও আলজেরিয়াবিষয়ক আলোচনায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
তিনি বলেছেন, ‘কার্যকর নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকার অর্থ এই নয় যে তা নিজে নিজেই প্রকৃত গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয় বা কর্তৃত্ববাদী (বা অথরিটারিয়ান) আচরণ বা কাঠামোর সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়।’ গত চার দশকের অভিজ্ঞতা আমাদের এ তথ্যও জানাচ্ছে যে চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশিবার দুই-তৃতীয়াংশের শাসনের ঘটনা ঘটেছে; সেটা যেমন সেনাশাসকদের বৈধতা প্রদানের জন্য, তাঁদের হাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রভাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তেমনি তা ঘটেছে বেসামরিক শাসকদের হাতেও। আর কোনো দেশে এত ঘন ঘন এ ধরনের অবস্থার উদ্ভব হয়নি। শুধু তা-ই নয়, সংসদে এ ধরনের উপর্যুপরি সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগ দেশে সেনাশাসনের পথ সুগম করেছে, যার পরিণতি দেশটির জন্য ভালো হয়নি। ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হলো, ১৯ মাসের জরুরি অবস্থা এবং তার আওতায় যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচনে যখন একটি দলের ও তার শরিকদের সব আসনে বিজয়ী হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং ‘নির্বাচনী’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা হতে চলেছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ার গত চার দশকের ইতিহাস স্মরণ করা জরুরি। বাংলাদেশে গত দুই সংসদে ক্ষমতাসীনেরা সুপার মেজরিটির কারণে যে অবস্থার তৈরি হয়েছে, তার পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে দেশের মানুষকে, এখনো তারা তার পরিণাম ভোগ করছে। দুর্নীতি, অস্থিতিশীল রাজনীতি, আইনের শাসনের অভাব ও ক্ষমতাসীনদের আচরণ দেশের ভবিষ্যৎকে বিভিন্নভাবে বিপন্ন করেছে। অন্যান্য দেশে যেমন এই ধরনের শাসনের ফলে সৃষ্ট সমস্যাদি পরবর্তী সময়ে মোকাবিলা করা গেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার সুযোগ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। সে কারণেই এ আলোচনা যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা বিবেচনার ক্ষেত্রে। একে এড়ানোর কোনো উপায় নেই।
No comments