জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ আমোদ-আনন্দ ও বেদনার কিছু স্মৃতি by মহিউদ্দিন আহমদ

গত ১৮ অক্টোবর শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ চেম্বারে ‘Women, peace and securit’ বিষয়টির ওপর আলোচনা আমি শুনতে থাকি, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত আসনগুলোর একটিতে বসে। আমার পাশে আরও দুই বাংলাদেশী কূটনীতিবিদ- জাতিসংঘের জেনেভা অফিসে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত হান্নান এবং নিউইয়র্কে আমাদের স্থায়ী মিশনের উপস্থায়ী প্রতিনিধি- ডেপুটি পারমান্যান্ট রিপ্রেজেনটেটিভ (ডিপিআর) মুস্তাফিজ। নিউইয়র্কে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন এখানে আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু পাশের অন্য এক কামরায় অন্য একটি মিটিংয়ে চলে গিয়েছেন। বছরের এই সময়টাতে নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দফতরে একই সময় কয়েক ডজন সভা চলতে থাকে কখনও কখনও।
ড. মোমেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রায় শুরু থেকেই জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি। ছিলেন বোস্টনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সেই আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই। বোস্টনে থাকাকালেও বলতে গেলে, সার্বক্ষণিক ‘একটিভিস্ট’ ছিলেন। সেই এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যাচেষ্টা, কিবরিয়া হত্যাসহ বাংলাদেশের সবগুলো জাতীয় ইস্যুতে তিনি সংশ্লিষ্ট থেকেছেন গভীরভাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী এবং মার্কিনিদের মধ্যে মূলত গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনমত এবং সমর্থন সৃষ্টিতে সচেষ্ট থেকেছেন তিনি। শেখ হাসিনা ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ড. মোমেনকে যখন ডাকলেন, ড. মোমেন প্রধানমন্ত্রীর সেই আহ্বানে সাড়া দিতে বাধ্য হলেন, যেমন বাধ্য থাকেন যে কোন দেশপ্রেমিক নাগরিক।
জাতিসংঘে তার প্রায় এই সাড়ে চার বছর অবস্থানকালে, তার নেতৃত্বে আমাদের নিউইয়র্কে মিশনের বেশ কতগুলো সাফল্য আছে। এই সিরিজের সর্বশেষ সাফল্য হল, গত ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৮১টি ভোট পেয়ে ‘ইকোসক’,Ñ ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক ভোট বেশি পেয়েছে চীন; ৫৪ সদস্যবিশিষ্ট এই ইকোসকের সদস্য পদ তিন বছরের জন্য, টার্ম শুরু হবে আগামী ১ জানুয়ারিতে।
বলতেই হবে এসব সাফল্যের পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির আগ্রহ-উৎসাহ এবং নির্দেশনা অবশ্যই প্রবল ভূমিকা রেখেছে।
রাষ্ট্রদূত হান্নান জেনেভা থেকে নিউইয়র্ক এসেছেন সরকারি কাজে। তার স্ত্রী সেলিনা এখন আমাদের মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের সচিব। আমাদের বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং হান্নান দম্পতি একই ব্যাচের কর্মকর্তা। সেলিনার অভিযোগ, হান্নান জেনেভাতে বছরের কোনো কোনো সময় এত ব্যস্ত থাকে যে তার সঙ্গে কথা বলতে হলে সেলিনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। ফরেন সেক্রেটারি শহীদুল হককে জেনেভা থেকে ডেকে এনে ফরেন সেক্রেটারি করা হয়েছে বছরের শুরুতে। আইএমও ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন দীর্ঘদিন কাজ করেছে শহীদ, প্রথমে ঢাকায় তারপর ব্যাংককে, তারপর জেনেভাতে, সদর দফতরে। ইরাক, লিবিয়া, এমন সব দেশে যুদ্ধের সময় আমাদের হাজার হাজার বাংলাদেশীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এই সংস্থাটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এখানে শহীদুল হকের প্রশংসনীয় ভূমিকাও ছিল। মুস্তাফিজ নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে কলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিল, ডেপুটি হাইকমিশন হলেও এটি আমাদের বৃহত্তম মিশন। কাজের প্রচণ্ড চাপ এখানে।
আর আমি? ২৩ বছর আগে আমিও এখানে উপস্থায়ী প্রতিনিধি ছিলাম। বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমেদের সরকার আমাকে এখানে পাঠিয়েছিল; কিন্তু টিকতে পারিনি বেশি দিন, ১০ মাসের মাথায় আমাকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। টেনেটুনে দেড় বছর ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে গুরুতর ‘অভিযোগ’, নিউইয়র্ক মিশনে আমার অফিসে আমি প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার একটি ছবি রেখেছিলাম। ছবিটি ছিল বঙ্গভবনের, ১৯৯৩-এর ৬ ডিসেম্বরের, সাহাবুদ্দীন সাহেব অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর তিনজন একই ফ্রেমে, অসাধারণ একটি ছবি, দুই নেত্রী মাথায় ঘোমটা দিচ্ছিলেন। কয়েকশ’ টাকা দিয়ে একটি প্রদর্শনী থেকে ছবিটি কিনে পরে আরও কয়েকশ’ টাকা দিয়ে সিলভার ফ্রেমে ছবিটি বাঁধাই করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ছিল জিয়াউল হক জিয়া, খালেদা জিয়ার তখনকার এক ‘মিলিট্যান্ট’ সংসদ সদস্য।
১৯৯১-তে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে একজন সদস্য হিসেবে যোগ দিতে গিয়েছিল সেই বছর সদস্য হিসেবে আরও গিয়েছিল নাসিরউদ্দিন পিন্টুও। তখন ছাত্রনেতা এবং বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় সদ্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী। এই দুই ব্যক্তি একজনও একদিনের জন্যও জাতিসংঘ ভবনে যাননি, তবে দৈনন্দিন ভাতা ঠিকই নিয়েছেন।
‘অভিযোগ’ আরও গুরুতর রূপ নিল যখন এই জিয়াউল হক জিয়া প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে অভিযোগ করেন, নিউইয়র্কে আমার অফিসে আমি বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়েছি। জিয়াউল হক জিয়ার অভিযোগকে বাতাস দিতে থাকল নিউইয়র্কের ইনকিলাব নামে পরিচিত বাংলা সাপ্তাহিক ঠিকানা এবং তার মালিক এমএম শাহীন। পরে কুলাউড়া থেকে বিএনপির সংসদ সদস্য এবং আরও পরে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। জিয়াউল হক জিয়াও বহিষ্কৃত, ওখানকার বিএনপি নেতা নাজিমুদ্দীন আলমের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষে লিপ্ত। দুজনই ফেরদৌস কোরেশীর দলে যোগ দিয়েছিল, এখন আবার তওবা পড়ে ফিরে আসতে চেষ্টা করছে। তবে এমএম শাহীনের জন্য প্রবল হুমকি- মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি সভাপতি এবং মরহুম সাইফুর রহমান পুত্র নাসের রহমান এবং লক্ষ্মীপুরে জিয়াউল হক জিয়াকে বিএনপিতে ঢুকতে দেবে না নাজিমুদ্দীন আলম। দুজনই সন্ত্রাসী চরিত্রের, এই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকাতেই ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শাহীনের ওপর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর ছিল- ‘সংসদে শাহীনের অভব্য আচরণ।’
দুই.
প্রায় ২২ বছর পর আমার নিউইয়র্ক আসা, সরকারি প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিসেবে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চলমান বিতর্ক আমি দেখি এবং শুনি। পেছনের দুটো পর্দায় দেখতে পাই নাভি পিল্লাইকেও জেনেভা থেকে তাকে ভিডিওর মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাভি পিল্লাই দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক, একজন বিচারপতি ছিলেন ওই দেশের; এখন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার। জেনেভাতে তার অফিস।
নিরাপত্তা পরিষদের বিবেচ্য বিষয়টি গরম কিছু নয়। তাই আমি ভাবতে থাকি, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে আমাদের বাংলাদেশ ইস্যুতে কত সব গরম গরম বক্তৃতা, উত্তেজনা, তৎপরতা। ভারতীয় সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট থেকে এগিয়ে আসছে- আকাশে বাতাসে যুদ্ধ। একই সময় নিউইয়র্কের এই ৩৮ তলা জাতিসংঘ ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি কাউন্সিল চেম্বারেও চলছে অন্য রকমের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ- কূটনৈতিক যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন চাইছে যুদ্ধবিরতি। ভারতকে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে তখন সমর্থন করছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধবিরতি হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাও তখন থেমে যায়। আমরা তা কিছুতেই তা হতে দিতে পারি না। হতে দিতে পারে না ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের তখনকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। আমাদের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ যত না ভারত পাকিস্তানের মধ্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। চীন প্রবলভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করছে, আর প্রবলভাবে সমর্থন দিচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমাদের সমর্থনে সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন মাত্র ১০ দিনের মধ্যে তিন-তিনটি ভেটো দেয় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন পাল্টা প্রস্তাব দিচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নেতৃত্বে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাও থাকতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবে। কিন্তু এমন কিছু একেবারেই মানছিল না পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়ে তার হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর, ইয়াহিয়া খান এবং তার অন্যসব জেনারেল জন্য ছিল চরম অবমাননাকর।
সুতরাং ১৯৭১-এর ৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত প্রস্তাবে প্রথম সোভিয়েত ভেটো, পর দিন ৫ ডিসেম্বর আবার সোভিয়েত ভেটো। এবার প্রস্তাব উত্থাপনকারী ছিল আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরালিওন এবং সোমালিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৃতীয় ভেটোটি দেয়া হয় ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্থাপিত আরেকটি প্রস্তাবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এই সোভিয়েত ভেটোগুলোই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়কে নিশ্চিত করেছিল তখন। নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করাতে ব্যর্থ পাকিস্তানপ্রেমিক দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আরব দেশগুলো তখন ছুটে গেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। ১৩১টি সদস্য রাষ্ট্র তখন জাতিসংঘের এবং এই ১৩১টি সদস্য রাষ্ট্রের ১০৪টিই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সমর্থন করে প্রথমবার। যুদ্ধবিরতি এবং ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের পক্ষে বিপুল জনসমর্থন জাতিসংঘে। কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব মানাটা বাধ্যতামূলক নয়, যেমন বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব। চলমান সিরিয়া সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যান্য পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশ, সৌদি আরব, কাতার এবং তুরস্ক সিরিয়াকে গুঁড়িয়ে দিতে পারছে না; কারণ নিরাপত্তা পরিষদে এমন কোনো প্রস্তাব পাস হবে না। চীন এবং রাশিয়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান যুদ্ধে সিকিউরিটি কাউন্সিলে গৃহীত প্রস্তাবে কেউ ভেটো দেয়নি। কিন্তু ইরাকে যে আক্রমণ চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা দোস্তরা, সেখানে কোনো প্রস্তাব নেই নিরাপত্তা পরিষদের। তাই এটি একটি অবৈধ যুদ্ধ ছিল। তবে বাস্তব কথা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন সব প্রস্তাবের তোয়াক্কা করে না সব সময়। তাদের শক্তি আছে, দুনিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই দেশটি যা ইচ্ছা, বলতে গেলে, তাই করতে পারে। এখন তো আর সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করবে। তাই এই জামানায় প্রায় উন্নয়নশীল দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেজাজ-মর্জি বুঝে কাজ করে চলে। এই দেশটিকে চ্যালেঞ্জ করলে বিপদে পড়তে হতে পারে।
তিন.
নিরাপত্তা পরিষদের এসব বিতর্কে পাকিস্তানের কূটনৈতিক অবস্থান জোরদার করতে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে নিউইয়র্কে পাঠানো হয়। কিন্তু ’৭১-এর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে নিরাপত্তা পরিষদে একটি বক্তৃতা দিয়ে তার হাতে যে কাগজগুলো ছিল, সেগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে তিনি ঝড়ের বেগে পরিষদ চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসেন। বক্তৃতায় তিনি এই নিরাপত্তা পরিষদকে ‘দি ফ্যাশন হাউস হয়ার দি আগলিনেস অব দি ওয়ার্ল্ড ইজ ড্রেসড আপ ইন প্রেটি ওয়ার্ডস’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে তখন জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী পরে পাকিস্তানের ফরেন সেক্রেটারি, তার এক সহকর্মী পেশাদার কূটনীতিবিদ রাষ্ট্রদূত ইকবাল আখুন্দকে (ড. কামাল হোসেনের স্ত্রী ড. হামিদা হোসেনের বড় ভাই) বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম সিউর হি হ্যাড রিহার্সড ইট অল ইন ফ্রন্ট অব অ্যা মিরর বিফোর কামিং টু দি মিটিং’। ইউটিউবে আগ্রহীরা ভুট্টোর এমন অমার্জনীয় আচরণ এখনও দেখতে পাবেন।
জাতিসংঘেও পাকিস্তানের এমন বিপর্যয় এবং পরাজয়ের পর ভুট্টো নিউইয়র্কে তার হোটেলে একটি লাঞ্চ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে যেসব দেশ সমর্থন জানিয়েছিল, তাদের ধন্যবাদ জানাতে। এই লাঞ্চে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের এক বাঙালি সদস্য জুলমত আলী খান পাকিস্তানের এমন পরাজয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন, লিখেছিলেন লাঞ্চে উপস্থিত ইকবাল আখন্দ তার মেমোয়ার্স অর অ্যা বাইস্ট্যান্ডার, অ্যা লাইফ ইন ডিপ্লোম্যাসি বইটিতে। বেগম খালেদা জিয়া তার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম টার্মে এই জুলমত আলী খানকে প্রথমে ভুটান এবং পরে থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত করেছিলেন।
আর যে চীন এমন প্রবলভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করল, সেই চীন এখন জামায়াত ও জাতীয়তাবাদীদের ‘পরীক্ষিত বন্ধু’!!।
জাতিসংঘের এই নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্যের মধ্যে ৫টি দেশ- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া স্থায়ী সদস্য, তাদের কোনো নির্বাচনে খাড়া হতে হয় না, ১৯৪৬-এ জাতিসংঘের জন্ম থেকেই তারা স্থায়ী সদস্য, ভেটো ক্ষমতার অধিকারী। মানে, এই ৫টি দেশের যে কোনো একটিও যদি আপত্তি তোলে সেই প্রস্তাব পাস হবে না, যেমন হয়নি ৭১ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া এখন উত্তরাধিকারী হিসেবে স্থায়ী সদস্য। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই দাপট বা ক্ষমতা কোনোটাই রশিয়ার নেই।
চার.
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট এই গুরুত্বপূর্ণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে দুইবার, দুই বছর মেয়াদি অস্থায়ী সদস্য হিসেবে; প্রথমবার ৭৯ ও ৮০, বছর দুটির জন্য। আবার নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম টার্মে, ২০০০ ও ২০০১ বছর দুটির জন্য। বাংলাদেশ আবার প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে ২০১৬ ও ২০১৭ বছর দুটির জন্যও। আমাদের ঘোষণার পর জাপানও প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে আমাদের প্রতিযোগী হিসেবে। গত ১৮ অক্টোবর খুব আমোদজনক একটি ঘটনা ঘটেছে জাতিসংঘের এই নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচনে। সৌদি আরব এই প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হল, ১ জানুয়ারিতে আসন গ্রহণ করার কথা। নির্বাচিত হওয়ার পর নিউইয়র্কে সৌদি মিশনে যখন উৎসব চলছে, তখন রাজধানী রিয়াদ থেকে ঘোষণা এলো, তারা এই আসন গ্রহণ করবে না। সিরিয়া এবং ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্ত ব্যবস্থা নেয়নি বলে প্রতিবাদে এই বর্জন। সৌদিরা শেষ পর্যন্ত কি করে তা জানা যাবে আরও কয়েক দিন পর। জাতিসংঘে বছরের পর বছর কূটনৈতিক তৎপরতা, তারপর নির্বাচন, তারপর সাফল্য। সৌদি আরবের মতো সাফল্য এবং বর্জনের এমন কোনো অতীত উদাহরণ জাতিসংঘে নেই। সৌদি আরব জাতিসংঘ সচিবালয়কে তাদের এই বর্জনের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে এখনও জানায়নি। নিউইয়র্কে কোনো কোনো কূটনীতিবিদকে বলতে শুনেছি মার্কিনিরা এবং ৭৭ জাতি গ্র“প যদি একটু সাধাসাধি করে, তাহলে ‘তাহারা খাইবে’।
মহিউদ্দিন আহমদ : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব

No comments

Powered by Blogger.