নির্বাচনী ট্র্যাপে আমলাদের কাছে ধরাশায়ী দুদক by আলমগীর স্বপন
‘ক্ষমতার
অপব্যবহার মানে যদি দুর্নীতি হয়’ তাহলে প্রশ্ন আসে ক্ষমতাবান কারা? এর
উত্তরে নিশ্চয়ই নিমিষেই আমাদের মাথায় চলে আসে সরকারের কথা। কেননা সরকারই
ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্রে থাকে। আর এর চালিকাশক্তি সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বা নির্বাচনের
মাধ্যমে যারা সরকার কাঠামোয় যুক্ত হয়, সাদা চোখে তাদের ক্ষমতাই বেশি
দৃশ্যমান। কিন্তু আখেরে আমলা মানে সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা ক্ষমতার
পালাবদলেও থেকে যান ক্ষমতার কেন্দ্রে, বলা যায় তারাই প্রকৃত ক্ষমতাবান। এর
প্রমাণ দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধন নিয়ে আমলাদের ক্ষমতার চর্চা এবং
রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে টেক্কা দিয়ে এক্ষেত্রে বিজয়ী হওয়া। গত ১০ নভেম্বর
সংসদে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল-২০১৩ পাস হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- জজ,
ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে। ফৌজদারি
কার্যবিধির এ ধারায় বলা আছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো ফৌজদারি আদালত কোনো
সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না। এর অর্থ
সংশোধিত বিল অনুযায়ী সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর
বিরুদ্ধে দুদক আর মামলা করতে পারবে না। এছাড়া সংশোধিত আরও একটি ধারা
দুদকের ক্ষমতা খর্ব করবে। দুদক আইনের ১৬(১) অনুযায়ী সচিব নিযুক্ত হন
কমিশনের মাধ্যমে। কিন্তু সংশোধিত বিলে এ ক্ষেত্রে সচিব নিযুক্ত হবেন সরকার
কর্তৃক। এতে আগের আইনে দুদক চেয়ারম্যান, প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্টিং অফিসার
বা প্রধান নির্বাহী হলেও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর বিলটির গেজেট প্রকাশিত
হলে সচিবই হবেন দুদকের সর্বসেবা। এর ফলে দুদকের ওপর সরকারি প্রভাব যেমন
বাড়বে, তেমনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও কমিশনারের পদ এক অর্থে আলঙ্কারিক
হয়ে যাবে। এছাড়া দুদকের নিজস্ব বিধিতে শাস্তির বিধান থাকলেও সংশোধিত বিলে
কিছু ধারা যুক্ত করে দুদকের তদন্ত ও অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের স্বাধীনভাবে
কাজ করার ক্ষেত্রও সংকুচিত করা হয়েছে। এ জন্য সংসদে বিল পাসের পরের দিন
সারাদেশে দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্মবিরতিও পালন
করেছেন। তারা এখন এই ভেবে হতবিহ্বল যে, দাতা দেশ ও সংস্থার শক্ত অবস্থান,
সংসদীয় কমিটির সুপারিশ, অর্থমন্ত্রীর চিঠি ও প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও
আমলারা কীভাবে কৌশলে তাদের পক্ষে দুদক আইনের সংশোধনী বিল পাস করিয়ে
নিয়েছেন।
তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ। এর মধ্যে সবাই ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত এমনটা বলা অন্যায্য। কেননা এমনও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন যারা চাকরির বাইরে টিউশনি করেও সংসার চালান। কিন্তু মোটা দাগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা কী? একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন পুলিশ বিভাগের কথা কিংবা ভূমি অফিসের কথাই একটু চিন্তা করা যাক, টাকা ছাড়া এসব অফিসে কারও কোনো ফাইল নড়েছে কি? এরকম সরকারি যত সেবা খাত আছে- সব জায়গায়, সব ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি যে কম-বেশি হয় তা কি কেউ অস্বীকার করবে? বিগত এক দশকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির গবেষণা রিপোর্ট তো এ ধরনের চিত্রই তুলে ধরে। তাই দুদক আইনের সংশোধনীর ফলে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষের রেট আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়?
অথচ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে দুর্নীতিতে লাগাতার পাঁচবার চ্যাম্পিয়নের (!) কলংকতিলক বাংলাদেশের ললাটে লাগার পরই বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার বাধ্য হয়ে তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করেছিল। ২০০৪ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে গঠিত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ব্যুরোর আমলে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হতো। এতে তখনকার ব্যুরো অনেক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আবার দুদক যাদের প্রকৃত আসামি ভেবেছে, তাদের বাদ দিয়েই অনেক ক্ষেত্রে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে- এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে বলে জানিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা। তাই নতুন সংশোধনী এনে দুদককে আবার পূর্বতন ব্যুরোতে পরিণত করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা। আর এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, ২০০৪-এর আইন অনুযায়ী দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন যদি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে মামলার জন্য সরকারের অনুমোদন নিতে হয় তাহলে তো আর এর স্বাধীনতা থাকবে না। আবার সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৩ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কেন পৃথক হবেন? দেশের পৌনে ষোল কোটি মানুষের জন্য এক আইন আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি করলে তাদের জন্য আইন ভিন্ন হবে কেন?
এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। হলমার্কসহ ৬টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা, তারা সরকারি কর্মকর্তাও বটে। এ অর্থ কেলেংকারির ঘটনায় তারা নিজেরা লাভবান হয়েছেন। কিন্তু নতুন সংশোধনী অনুযায়ী দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হতো। এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই অনেকের নাম থাকত না আসামির তালিকায়? কেননা হলমার্ক অর্থ কেলেংকারির মামলায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির ও সাবেক ডিএমডি মাঈনুল হকের বিরুদ্ধে যেন মামলা না হয় এজন্য দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের অনেক ধকল-চাপ সহ্য করতে হয়েছিল। আর এই চাপ এ কারণে ছিল, হুমায়ুন কবির সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নতুন পাওয়া ব্যাংকের প্রধান হিসেবে সব কাজ গোছানোর দায়িত্বে ছিলেন। আর মাঈনুল হক এক সাবেক প্রধান বিচারপতির ভাই। তাই ১৯৭ ধারা যদি হলমার্ক অর্থ কেলেংকারির মামলার সময় কার্যকর থাকত, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন কি আদৌ সহজ হতো? পরিস্থিতি যখন এমন সে ক্ষেত্রে সংশোধিত বিল আইন হিসেবে কার্যকর হলে ভবিষ্যতে এ রকম বড় মামলার কী পরিণতি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে শোনা তথ্য অনুযায়ী ২৮ অক্টোবর দুদক আইনের সংশোধনী বিলটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু বিলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের বিষয়টি দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হন। তিনি সে সময় সংশ্লিষ্টদের বলেন, দুদকের চেয়ারম্যান-কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এ নিয়ে আলোচনা করতে পরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের অফিসে যান দুদকের চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান, কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন ও নাসির উদ্দিন আহমেদ। মন্ত্রীর রুমে আগে থেকেই ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম শহীদ খান। বৈঠকে দুদকের কর্তাব্যক্তিরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের বিরোধিতা করেন। দুদকের পক্ষ থেকে উপস্থিত আমলাদের বলা হয়, তিন বছর আগে এ ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা যুক্ত করলে দুদক আর স্বাধীন থাকবে না। সে কারণে দাতা দেশ ও সংস্থা এর বিরোধিতা করেছিল। পরে অন্যান্য দেশের আইনে এ ক্ষেত্রে কী আছে তা দেখতে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াও সফর করেছেন। এরপর সংসদীয় কমিটি তাদের সুপারিশে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের প্রস্তাব বাদ দিয়ে দেয়। তাহলে সবকিছু সুরাহার পরও কেন আবার সেই ধারা যুক্ত করা হচ্ছে? এ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সেই বৈঠকে দু’পক্ষই যুক্তি পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেন। শেষে আইনমন্ত্রীর সামনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের বিষয়টি কেটে দেয়া হয়। বিষয়টি সেখানেই সুরাহা হয়ে যায় বলেও জানান দুদকের কর্মকর্তারা। কিন্তু বিলটি সংসদে উত্থাপনের আগে প্রভাবশালী আমলা গ্র“প শেষবারের মতো সক্রিয় হয়। তারা কৌশলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মাধ্যমে তাদের সেই শেষ চেষ্টায় সফল হন। মতিয়া চৌধুরী সংসদে বিলটি উত্থাপন করলে সংশোধনী আনেন সাবেক আমলা এবং বর্তমানে এমপি র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির। আর তা কণ্ঠভোটে পাস করে দেন উপস্থিত সংসদ সদস্যরা। কেন এমন হল এ নিয়ে পরের দিন দুদকের একজন কমিশনার ২০ থেকে ২৫ জন সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথাও বলেছেন, কীভাবে তারা এমন একটি বিল পাস করলেন। যেখানে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশও উপেক্ষিত হল। এর ফলে দুদক কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হবে। এর জবাবে নাকি সংসদ সদস্যরা তাকে জানিয়েছেন, যেহেতু সরকারের একজন মন্ত্রী বিল উত্থাপন করেছেন, তাই বিলটি ক্ষতিকর কিনা সে বিষয়টি তারা বিবেচনা করেননি। অথচ যে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, মন্ত্রীর হাত দিয়ে বিলটি সংসদে পাস হল, ক্ষমতার পালাবদলে তার বিরুদ্ধে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই মামলা করতে পারবে দুদক। মামলা করতে পারবে তাদের বিরুদ্ধে যারা সংসদে ‘হ্যাঁ’ বলে কণ্ঠভোটে পাস করেছেন দুদকের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা খর্বকারী বিলটি। দুদক আইনে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারার সংযুক্তি নিয়ে আমলাদের যে তৎপরতার কথা জানলাম দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে, বিষয়টি যদি সত্যি হয় তা সুশাসনের জন্যও বড় হুমকি। সেই সঙ্গে সংসদে আইন পাসের প্রক্রিয়া এবং এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের ভূমিকার বিষয়টিকেও তা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সেই সঙ্গে আরও একটি ভয়াবহ প্রবণতা দুদক আইনের সংশোধনী পাসের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। বিলটি পাসে আমলারা এমন একটা সময় বেছে নিয়েছেন যখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে চাপে রয়েছে বর্তমান সরকার। সরকারের এ দুর্বলতার সুযোগ হাতছাড়া করেননি আমলারা। কেননা একতরফা নির্বাচন করতে হলে বা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সরকারকে আমলাদের পক্ষ নিতেই হবে। আর শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে আমলাদের কৌশলই জয়ী হয়েছে তা তো স্পষ্ট।
তবে আমলাদের ইচ্ছায় দুদক আইনের সংশোধনী যেভাবে পাস হল, তাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান এখন বিরাট প্রশ্নের মুখে। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি ও রেলওয়ের অর্থ কেলেংকারির ঘটনায় সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এমনিতে সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব ছিল। আর এবার ষোলকলা পূর্ণ করা হল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধা দিতে গিয়ে দুদক আইনের সংশোধিত বিলটি পাস করে। তাই মহাজোট সরকারের ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে মিঠা মিঠা বুলি ছিল, তা এখন শুধুই কথার কথা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল-২০১৩ পুনর্বিবেচনার সুযোগ এখনও রয়েছে, যদি রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বাক্ষর না করে পুনর্বিবেচনার জন্য আবারও সংসদে পাঠান। এরই মধ্যে শেষ চেষ্টা হিসেবে দুদক চেয়ারম্যান ও দুজন কমিশনার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও দুদকের ঊর্ধ্বতনদের এ ক্ষেত্রে সমবেদনা জানিয়েছেন বলেই জেনেছি। কিন্তু দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়াতে হলে, প্রতিরোধ করতে হলে এখন সমবেদনার চেয়ে জরুরি দুদক আইনের সংশোধনী পুনর্বিবেচনা করা।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ। এর মধ্যে সবাই ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত এমনটা বলা অন্যায্য। কেননা এমনও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন যারা চাকরির বাইরে টিউশনি করেও সংসার চালান। কিন্তু মোটা দাগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা কী? একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন পুলিশ বিভাগের কথা কিংবা ভূমি অফিসের কথাই একটু চিন্তা করা যাক, টাকা ছাড়া এসব অফিসে কারও কোনো ফাইল নড়েছে কি? এরকম সরকারি যত সেবা খাত আছে- সব জায়গায়, সব ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি যে কম-বেশি হয় তা কি কেউ অস্বীকার করবে? বিগত এক দশকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির গবেষণা রিপোর্ট তো এ ধরনের চিত্রই তুলে ধরে। তাই দুদক আইনের সংশোধনীর ফলে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষের রেট আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়?
অথচ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে দুর্নীতিতে লাগাতার পাঁচবার চ্যাম্পিয়নের (!) কলংকতিলক বাংলাদেশের ললাটে লাগার পরই বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার বাধ্য হয়ে তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করেছিল। ২০০৪ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে গঠিত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ব্যুরোর আমলে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হতো। এতে তখনকার ব্যুরো অনেক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আবার দুদক যাদের প্রকৃত আসামি ভেবেছে, তাদের বাদ দিয়েই অনেক ক্ষেত্রে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে- এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে বলে জানিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা। তাই নতুন সংশোধনী এনে দুদককে আবার পূর্বতন ব্যুরোতে পরিণত করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা। আর এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, ২০০৪-এর আইন অনুযায়ী দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন যদি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে মামলার জন্য সরকারের অনুমোদন নিতে হয় তাহলে তো আর এর স্বাধীনতা থাকবে না। আবার সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৩ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কেন পৃথক হবেন? দেশের পৌনে ষোল কোটি মানুষের জন্য এক আইন আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি করলে তাদের জন্য আইন ভিন্ন হবে কেন?
এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। হলমার্কসহ ৬টি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা, তারা সরকারি কর্মকর্তাও বটে। এ অর্থ কেলেংকারির ঘটনায় তারা নিজেরা লাভবান হয়েছেন। কিন্তু নতুন সংশোধনী অনুযায়ী দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হতো। এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই অনেকের নাম থাকত না আসামির তালিকায়? কেননা হলমার্ক অর্থ কেলেংকারির মামলায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির ও সাবেক ডিএমডি মাঈনুল হকের বিরুদ্ধে যেন মামলা না হয় এজন্য দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের অনেক ধকল-চাপ সহ্য করতে হয়েছিল। আর এই চাপ এ কারণে ছিল, হুমায়ুন কবির সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নতুন পাওয়া ব্যাংকের প্রধান হিসেবে সব কাজ গোছানোর দায়িত্বে ছিলেন। আর মাঈনুল হক এক সাবেক প্রধান বিচারপতির ভাই। তাই ১৯৭ ধারা যদি হলমার্ক অর্থ কেলেংকারির মামলার সময় কার্যকর থাকত, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন কি আদৌ সহজ হতো? পরিস্থিতি যখন এমন সে ক্ষেত্রে সংশোধিত বিল আইন হিসেবে কার্যকর হলে ভবিষ্যতে এ রকম বড় মামলার কী পরিণতি হবে তা সহজেই অনুমেয়।
দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে শোনা তথ্য অনুযায়ী ২৮ অক্টোবর দুদক আইনের সংশোধনী বিলটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু বিলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের বিষয়টি দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হন। তিনি সে সময় সংশ্লিষ্টদের বলেন, দুদকের চেয়ারম্যান-কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এ নিয়ে আলোচনা করতে পরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের অফিসে যান দুদকের চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান, কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন ও নাসির উদ্দিন আহমেদ। মন্ত্রীর রুমে আগে থেকেই ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম শহীদ খান। বৈঠকে দুদকের কর্তাব্যক্তিরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের বিরোধিতা করেন। দুদকের পক্ষ থেকে উপস্থিত আমলাদের বলা হয়, তিন বছর আগে এ ধারা যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা যুক্ত করলে দুদক আর স্বাধীন থাকবে না। সে কারণে দাতা দেশ ও সংস্থা এর বিরোধিতা করেছিল। পরে অন্যান্য দেশের আইনে এ ক্ষেত্রে কী আছে তা দেখতে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াও সফর করেছেন। এরপর সংসদীয় কমিটি তাদের সুপারিশে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের প্রস্তাব বাদ দিয়ে দেয়। তাহলে সবকিছু সুরাহার পরও কেন আবার সেই ধারা যুক্ত করা হচ্ছে? এ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সেই বৈঠকে দু’পক্ষই যুক্তি পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেন। শেষে আইনমন্ত্রীর সামনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলার আগে সরকারের অনুমোদনের বিষয়টি কেটে দেয়া হয়। বিষয়টি সেখানেই সুরাহা হয়ে যায় বলেও জানান দুদকের কর্মকর্তারা। কিন্তু বিলটি সংসদে উত্থাপনের আগে প্রভাবশালী আমলা গ্র“প শেষবারের মতো সক্রিয় হয়। তারা কৌশলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মাধ্যমে তাদের সেই শেষ চেষ্টায় সফল হন। মতিয়া চৌধুরী সংসদে বিলটি উত্থাপন করলে সংশোধনী আনেন সাবেক আমলা এবং বর্তমানে এমপি র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির। আর তা কণ্ঠভোটে পাস করে দেন উপস্থিত সংসদ সদস্যরা। কেন এমন হল এ নিয়ে পরের দিন দুদকের একজন কমিশনার ২০ থেকে ২৫ জন সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথাও বলেছেন, কীভাবে তারা এমন একটি বিল পাস করলেন। যেখানে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশও উপেক্ষিত হল। এর ফলে দুদক কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হবে। এর জবাবে নাকি সংসদ সদস্যরা তাকে জানিয়েছেন, যেহেতু সরকারের একজন মন্ত্রী বিল উত্থাপন করেছেন, তাই বিলটি ক্ষতিকর কিনা সে বিষয়টি তারা বিবেচনা করেননি। অথচ যে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, মন্ত্রীর হাত দিয়ে বিলটি সংসদে পাস হল, ক্ষমতার পালাবদলে তার বিরুদ্ধে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই মামলা করতে পারবে দুদক। মামলা করতে পারবে তাদের বিরুদ্ধে যারা সংসদে ‘হ্যাঁ’ বলে কণ্ঠভোটে পাস করেছেন দুদকের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা খর্বকারী বিলটি। দুদক আইনে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারার সংযুক্তি নিয়ে আমলাদের যে তৎপরতার কথা জানলাম দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে, বিষয়টি যদি সত্যি হয় তা সুশাসনের জন্যও বড় হুমকি। সেই সঙ্গে সংসদে আইন পাসের প্রক্রিয়া এবং এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের ভূমিকার বিষয়টিকেও তা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সেই সঙ্গে আরও একটি ভয়াবহ প্রবণতা দুদক আইনের সংশোধনী পাসের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই অনেকেই লক্ষ্য করেছেন। বিলটি পাসে আমলারা এমন একটা সময় বেছে নিয়েছেন যখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে চাপে রয়েছে বর্তমান সরকার। সরকারের এ দুর্বলতার সুযোগ হাতছাড়া করেননি আমলারা। কেননা একতরফা নির্বাচন করতে হলে বা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সরকারকে আমলাদের পক্ষ নিতেই হবে। আর শেষ পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে আমলাদের কৌশলই জয়ী হয়েছে তা তো স্পষ্ট।
তবে আমলাদের ইচ্ছায় দুদক আইনের সংশোধনী যেভাবে পাস হল, তাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান এখন বিরাট প্রশ্নের মুখে। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি ও রেলওয়ের অর্থ কেলেংকারির ঘটনায় সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এমনিতে সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব ছিল। আর এবার ষোলকলা পূর্ণ করা হল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধা দিতে গিয়ে দুদক আইনের সংশোধিত বিলটি পাস করে। তাই মহাজোট সরকারের ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে মিঠা মিঠা বুলি ছিল, তা এখন শুধুই কথার কথা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল-২০১৩ পুনর্বিবেচনার সুযোগ এখনও রয়েছে, যদি রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বাক্ষর না করে পুনর্বিবেচনার জন্য আবারও সংসদে পাঠান। এরই মধ্যে শেষ চেষ্টা হিসেবে দুদক চেয়ারম্যান ও দুজন কমিশনার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও দুদকের ঊর্ধ্বতনদের এ ক্ষেত্রে সমবেদনা জানিয়েছেন বলেই জেনেছি। কিন্তু দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়াতে হলে, প্রতিরোধ করতে হলে এখন সমবেদনার চেয়ে জরুরি দুদক আইনের সংশোধনী পুনর্বিবেচনা করা।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক
No comments