রাজনৈতিক মারেফাত এই নেই এই আছে by বেগম জাহান আরা
মিছিল,
হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গুলি, টিয়ার গ্যাস, রাবার
বুলেট, মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি, দুই নেত্রীর বক্তৃতা,
আতিনেতা-পাতিনেতা-নাতিনেতা-ছাতিনেতাদের রকমারি কথার উচ্চকিত জিকির-আসকারে
দিনগুলো বয়ে যাচ্ছিল। টিভি তো দেখতেই হয়। সময়ের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। নাটকের
সিরিয়াল না দেখার কারণে খবর-টকশো দেখা-শোনাটা একটু বেশি হয়। হঠাৎ দেখি,
সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার
বৈঠকের শুরুতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা তাদের পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর
হাতে তুলে দিচ্ছেন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, দফতরবিহীন মন্ত্রীদের পদত্যাগের
কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল ক’দিন থেকেই। এটা নাকি নির্বাচনকালীন সর্বদলীয়
সরকার গঠনের প্রস্তুতি প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু জানা গেল, পদত্যাগপত্রে কেউ
তারিখই লেখেননি। টিভির সামনে বসে একা একাই হাসলাম। ভাবলাম এমন ঘটনার অর্থ
কী? প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন বলেই তো সবাই একযোগে, মানে পুরো ক্যাবিনেট
পদত্যাগ করেছে। সংবিধান মতে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেয়ার সঙ্গে
সঙ্গেই সব মন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে গেল। আরও দুই-এক মন্ত্রী তো এ পদ্ধতিতেই
পদত্যাগ করেছেন। মন্ত্রীশূন্য ক্যাবিনেটে রইলেন শুধু প্রধানমন্ত্রী। কী হল
ঘটনাটা? ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। ক্যাবিনেট আছে, মন্ত্রীরা নেই। ক্যাবিনেট
তো আর ভাঙা হয়নি! তাহলে পরদিন থেকে দেশের কাজকর্ম চলবে কেমন করে? এক
প্রধানমন্ত্রী ‘দশভুজা’ হয়ে কাজ করলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব নয়। সব
আমলা এগিয়ে এলেও লাভ নেই। তারা চাইলেও আসতে পারবেন না। এই শূন্যতার
বাস্তবতা অনুধাবন করে মন্ত্রিপরিষদের সচিব ওহি নাজেলের মতো ঘোষণা করলেন,
মন্ত্রিসভা ভাঙা হচ্ছে না বরং পুনর্গঠিত হচ্ছে। আর সরকারের তরফ থেকে বলা
হচ্ছে, পদত্যাগী মন্ত্রীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাবেন, অফিস করবেন এবং যথারীতি
ফাইলপত্রে সইও করবেন। প্রশ্নটা উঠেছে এই দুটি ব্যাপারে। পদত্যাগপত্র জমা
নেয়ার পর বলা হচ্ছে, সবই ঠিক আছে। কাজ চালিয়ে যাবেন মন্ত্রীরা।
সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সই-সাবুদ দিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করতেও পারবেন। মন্ত্রিসভা
পুনর্গঠনের এমন অভিনব প্রক্রিয়ার ঘটনা আর তো ঘটেনি কখনও। তাই এভাবে
ক্যাবিনেট শূন্য করার পর পদবিহীন মন্ত্রীদের বহাল মনে করা (কারণ সবই তারা
পাবেন এবং করবেন আগের মতোই) এবং সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটা (মানে
হঠাৎ করে মন্ত্রীশূন্য করে দেয়া দেশের প্রশাসন কাজকর্মকে) সাংবিধানিক কিনা-
এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন কেউ কেউ। তুলছেনও।
আমরা আমজনতা। কিছু তেমন জানিও না, বুঝিও না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা যখন ঘটনা বিশ্লেষণ করেন, তখন শুনি মন দিয়ে। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘মন্ত্রীরা কেউ পদত্যাগ করেননি। তারা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তারা তারিখবিহীন যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তা সংবিধান অনুযায়ী নেয়া হয়নি’ (যুগান্তর, ১৩.১১.১৩)। প্রশ্ন হল, রীতিমতো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পূর্বশর্ত নাকি এই অভিপ্রায়পত্র জমা দেয়া? সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কি এটাই? অথবা তারিখবিহীন পদত্যাগপত্রকে এখন থেকে অভিপ্রায়পত্রই বলা হবে? সংবিধানের আকুল ভক্তদের কাছে প্রশ্ন, সংবিধান কী বলে এক্ষেত্রে? যদি জানা থাকে, তাহলে বলুন। আর যদি জানা না থাকে, তাহলেও বলুন। মারেফাতের রহস্য সৃষ্টি করবেন না।
অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলছেন, সংবিধানের বিধান অনুযায়ী মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র প্রদান করলেই মন্ত্রীপদ শূন্য হয়ে যাবে। সাংবিধানিক পদধারীদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা বা না করার কোনো বিধান সংবিধানে নেই। তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের ৫৮(১) অনুচ্ছেদটিতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, এ বিধান অনুযায়ী পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যাবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’ পদত্যাগপত্রে তারিখ না থাকা প্রসঙ্গে ড. শাহদীন বলেন, তাতে কিছু আসে যায় না। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার তারিখই থাকবে পত্রে। অর্থাৎ সত্যিকার পদত্যাগ হয়ে গেছে। মন্ত্রীরা আর মন্ত্রী নন।
অবস্থাটা কী দাঁড়াল? কেউ বলছেন মন্ত্রিত্ব নেই, কেউ বলছেন আছে। এই নেই, এই আছে। এখানে কথার মায়াজাল বিস্তার করা হচ্ছে। বস্তুগত সত্যকে সামনে রেখেও বলা হচ্ছে, এটা সে বস্তু নয়। কিন্তু এই মারেফতি আপেক্ষিক তত্ত্বের মতো খোলা খোলা কথা অনেকেই মানতে চাইছেন না। যুক্তিমতে পদত্যাগ করলেই যদি সেই পদ শূন্য হয়, তাহলে মন্ত্রিত্ব থাকে কীভাবে? খুব সরল প্রশ্ন। যতক্ষণ না পুনর্বহাল হচ্ছেন মন্ত্রী, ততদিন তিনি মন্ত্রী নন। পদত্যাগপত্র গ্রহণের যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, সেখানেও ক্রান্তিকালীন ফাঁক থেকে যাচ্ছে। ধরা যাক, পত্র গৃহীত হল ক’দিন পরে। সেই ক’দিন তো পদত্যাগী মন্ত্রী ক্যাবিনেটের কেউ নন। এ যুক্তির ওপর যারা জোর দিচ্ছেন, তাদেরই সমর্থন করি আমি। আর যারা বলতে চান যে, পদত্যাগপত্রগুলো আসলে পদত্যাগের অভিপ্রায়পত্র, তাদের কথায় মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিংবা আইনমন্ত্রী যখন বলেন, ‘এটা কোনো পদত্যাগপত্রই না। সর্বদলীয় সরকার গঠনে প্রধানমন্ত্রীকে সবার সাপোর্ট হিসেবে একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এটা এক ধরনের প্রশাসনিক সাপোর্টের অংশ মাত্র’, তখন অধিক শোকে পাথর হয়ে যাই। পদত্যাগপত্র, মন্ত্রীর শূন্য পদ এবং মন্ত্রিত্ব লুপ্ত, অসাংবিধানিকভাবে মন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতাদি নেয়ার অধিকার, ফাইলে সই করার ক্ষমতা, দাখিল করা পদত্যাগপত্রকে পদত্যাগের অভিপ্রায়পত্র নাম দেয়া, একযোগে ক্যাবিনেট সদস্যদের পদত্যাগপত্র প্রদানের ব্যাপারকে প্রশাসনিক সাপোর্ট বলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে দেশে। সমাধানের কথা এখনও বলতে পারছেন না কেউ। মানে এই ঝড় থামবে কখন ও কী উপায়ে, তার দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। একটা বাজে উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়েছি আমরা।
সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সর্বদলীয় সরকারের সদস্য হবেন যারা, তাদের পত্রই শুধু পদত্যাগপত্র হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, যারা সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন না, তাদের আবার পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে কি? এই অকাট্য যুক্তিসই প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন করে পদত্যাগপত্র দিতে হবে না। মৌখিকভাবে জানালেই হবে। মানেটা কী দাঁড়াল, বুঝতে সময় নিলাম। অর্থাৎ মুখের কথায় অভিপ্রায়পত্রগুলো, যা সংবিধান অনুযায়ী হয়নি, তা পদত্যাগপত্রে রূপান্তরিত হয়ে যাবে? এ কেমন মারেফাত?
আলোচনায় বসলে আমরা, অকর্মা বয়সী মানুষেরাও বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কারণ খুঁজি। বক্তৃতার সময় জনদরদের চোটে চোখে প্রায় পানি এসে যায় নেতাদের। আমজনতাকে সেবা দেয়ার জন্য প্রতিশ্র“তির ঝড় বয়ে যায়। আবেগের বাহুল্যে প্রধানমন্ত্রী বলেই বসলেন যে, তিনি মানুষের সেবা করতে চান। দেশের সুখ-সমৃদ্ধি চান। প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ে দেশবাসীর কল্যাণই তার কাছে বড়। চান না তিনি এমন প্রধানমন্ত্রিত্ব। কথাটা শুনতে ভালো লাগছিল। বর্তমানের দমবন্ধ করা অবস্থায় দেশের শান্তিকে যারা বড় করে ভেবেছেন, তারা দেখেছিলেন আশার আলো। আমরাও। কিন্তু কী অর্বাচীন আমরা! ওসব যে মাঠ গরম করার কথা, তা জেনেও ভালো কিছু আশা করি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান অস্থির অবস্থার জন্য দুই নেতাই দায়ী। আমজনতার জন্য যতই অশ্র“ ঝরান তারা, তাদের আসল উদ্দেশ্য ক্ষমতা। সার্বিক ক্ষমতা। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সাংবিধানিকভাবে বাতিল করার পেছনেও ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্যই প্রধান। অথচ প্রধানমন্ত্রী একদা এ ব্যবস্থা কায়েমের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। সেটা ভুলে গেলেন কীভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং তা বাতিল করার মধ্যে নিপাট রাজনীতির খেলা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কী আছে? হ্যাঁ, আছে। এবার সংবিধানের কর্মটা প্রধানমন্ত্রীর মুঠোর মধ্যে। জনগণের কোন স্বার্থের বিবেচনায় এই খেলা? কথায় কথায় সংবিধানের ডুগডুগি বাজানো কেন? সংবিধান কি কোনো দলের বা কোনো নেতার একার সম্পদ? চিরকাল কেউ কি ক্ষমতায় থেকেছেন? আইয়ুব খান ও এরশাদকেও ক্ষমতা ছেড়ে যেতে হয়েছে। আর চিরকাল কেউ কি ক্ষমতায় থেকেছেন? লিবিয়া, মিসর তো হালের কথা। এত পরাক্রম যে ব্রিটিশ রাজা, তাদেরও ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যেতে হয়েছে। আমজনতার কথা কতটা কে ভাবে, সেটা লেখা আছে ইতিহাসে। অথচ এই আমজনতাই প্রাণ দেয় রাজনৈতিক সংকটে, মুক্তিযুদ্ধে এবং ক্ষমতার লড়াইয়ে। একই কথা বিরোধীদলীয় নেতার জন্য। আবেগ নয়, ফাঁকি নয়, সত্যি সত্যি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসুন আপনারা। আমাদের দেশটা সোনার দেশ। কী নেই আমাদের? খেলতে গেলে খেলার নিয়ম মানতে হয়। নইলে পণ্ড হয় খেলা। তেমনি রাজনীতিরও নিয়ম আছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির। সেটা তো মানতেই হবে। আজকাল তো নেতাদের ভাষিক শালীনতারও স্খলন দেখা যায় মাঝে মাঝে। এটা একেবারেই মানা যায় না। শেষ কথা, একটা সমঝোতায় আসুন আপনারা। সদিচ্ছা থাকলে পথও খুলে যায়।
গত দুই-তিন সপ্তাহে তড়িঘড়ি কয়েকটা বিল পাস হয়েছে সংসদে। সময়ের সীমা লংঘন করে বর্ধিত সংসদে ‘দলে নাম লেখালেই সংসদ সদস্যের প্রার্থিতা’ এবং ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ সংক্রান্ত বিল পাস হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সংসদে কিছু পাস করিয়ে নেয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়। তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বন্ধীয় গঠনমূলক ও সমঝোতামূলক কোনো প্রস্তাব পাস করানো তো কঠিন কিছু নয়। সংবিধান তো সংশোধন, পরিমার্জন হতেই পারে। সংশোধনীর মাধ্যমেই সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সংশোধনীর মাধ্যমেই তারও পরিবর্তন আনা সম্ভব। কথাটা এখন হাবাগোবা আমজনতাও বোঝে। কারণ জীবন সংগ্রামের ঝুঁকিতে নিতান্ত এতিমের মতো কাল কাটাচ্ছেন তো তারাই! মারেফাতের চিন্তা করলে সাধারণ মানুষের পেট চলে না। সহিংস হরতালে মানুষ মারা যাচ্ছে। এর দায় কিন্তু নেতাদেরই।
ড. বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
আমরা আমজনতা। কিছু তেমন জানিও না, বুঝিও না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা যখন ঘটনা বিশ্লেষণ করেন, তখন শুনি মন দিয়ে। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘মন্ত্রীরা কেউ পদত্যাগ করেননি। তারা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। তারা তারিখবিহীন যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তা সংবিধান অনুযায়ী নেয়া হয়নি’ (যুগান্তর, ১৩.১১.১৩)। প্রশ্ন হল, রীতিমতো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পূর্বশর্ত নাকি এই অভিপ্রায়পত্র জমা দেয়া? সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কি এটাই? অথবা তারিখবিহীন পদত্যাগপত্রকে এখন থেকে অভিপ্রায়পত্রই বলা হবে? সংবিধানের আকুল ভক্তদের কাছে প্রশ্ন, সংবিধান কী বলে এক্ষেত্রে? যদি জানা থাকে, তাহলে বলুন। আর যদি জানা না থাকে, তাহলেও বলুন। মারেফাতের রহস্য সৃষ্টি করবেন না।
অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলছেন, সংবিধানের বিধান অনুযায়ী মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র প্রদান করলেই মন্ত্রীপদ শূন্য হয়ে যাবে। সাংবিধানিক পদধারীদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা বা না করার কোনো বিধান সংবিধানে নেই। তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের ৫৮(১) অনুচ্ছেদটিতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, এ বিধান অনুযায়ী পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যাবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’ পদত্যাগপত্রে তারিখ না থাকা প্রসঙ্গে ড. শাহদীন বলেন, তাতে কিছু আসে যায় না। পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার তারিখই থাকবে পত্রে। অর্থাৎ সত্যিকার পদত্যাগ হয়ে গেছে। মন্ত্রীরা আর মন্ত্রী নন।
অবস্থাটা কী দাঁড়াল? কেউ বলছেন মন্ত্রিত্ব নেই, কেউ বলছেন আছে। এই নেই, এই আছে। এখানে কথার মায়াজাল বিস্তার করা হচ্ছে। বস্তুগত সত্যকে সামনে রেখেও বলা হচ্ছে, এটা সে বস্তু নয়। কিন্তু এই মারেফতি আপেক্ষিক তত্ত্বের মতো খোলা খোলা কথা অনেকেই মানতে চাইছেন না। যুক্তিমতে পদত্যাগ করলেই যদি সেই পদ শূন্য হয়, তাহলে মন্ত্রিত্ব থাকে কীভাবে? খুব সরল প্রশ্ন। যতক্ষণ না পুনর্বহাল হচ্ছেন মন্ত্রী, ততদিন তিনি মন্ত্রী নন। পদত্যাগপত্র গ্রহণের যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, সেখানেও ক্রান্তিকালীন ফাঁক থেকে যাচ্ছে। ধরা যাক, পত্র গৃহীত হল ক’দিন পরে। সেই ক’দিন তো পদত্যাগী মন্ত্রী ক্যাবিনেটের কেউ নন। এ যুক্তির ওপর যারা জোর দিচ্ছেন, তাদেরই সমর্থন করি আমি। আর যারা বলতে চান যে, পদত্যাগপত্রগুলো আসলে পদত্যাগের অভিপ্রায়পত্র, তাদের কথায় মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিংবা আইনমন্ত্রী যখন বলেন, ‘এটা কোনো পদত্যাগপত্রই না। সর্বদলীয় সরকার গঠনে প্রধানমন্ত্রীকে সবার সাপোর্ট হিসেবে একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এটা এক ধরনের প্রশাসনিক সাপোর্টের অংশ মাত্র’, তখন অধিক শোকে পাথর হয়ে যাই। পদত্যাগপত্র, মন্ত্রীর শূন্য পদ এবং মন্ত্রিত্ব লুপ্ত, অসাংবিধানিকভাবে মন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতাদি নেয়ার অধিকার, ফাইলে সই করার ক্ষমতা, দাখিল করা পদত্যাগপত্রকে পদত্যাগের অভিপ্রায়পত্র নাম দেয়া, একযোগে ক্যাবিনেট সদস্যদের পদত্যাগপত্র প্রদানের ব্যাপারকে প্রশাসনিক সাপোর্ট বলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে দেশে। সমাধানের কথা এখনও বলতে পারছেন না কেউ। মানে এই ঝড় থামবে কখন ও কী উপায়ে, তার দিশা পাওয়া যাচ্ছে না। একটা বাজে উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়েছি আমরা।
সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সর্বদলীয় সরকারের সদস্য হবেন যারা, তাদের পত্রই শুধু পদত্যাগপত্র হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, যারা সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন না, তাদের আবার পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে কি? এই অকাট্য যুক্তিসই প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন করে পদত্যাগপত্র দিতে হবে না। মৌখিকভাবে জানালেই হবে। মানেটা কী দাঁড়াল, বুঝতে সময় নিলাম। অর্থাৎ মুখের কথায় অভিপ্রায়পত্রগুলো, যা সংবিধান অনুযায়ী হয়নি, তা পদত্যাগপত্রে রূপান্তরিত হয়ে যাবে? এ কেমন মারেফাত?
আলোচনায় বসলে আমরা, অকর্মা বয়সী মানুষেরাও বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কারণ খুঁজি। বক্তৃতার সময় জনদরদের চোটে চোখে প্রায় পানি এসে যায় নেতাদের। আমজনতাকে সেবা দেয়ার জন্য প্রতিশ্র“তির ঝড় বয়ে যায়। আবেগের বাহুল্যে প্রধানমন্ত্রী বলেই বসলেন যে, তিনি মানুষের সেবা করতে চান। দেশের সুখ-সমৃদ্ধি চান। প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ে দেশবাসীর কল্যাণই তার কাছে বড়। চান না তিনি এমন প্রধানমন্ত্রিত্ব। কথাটা শুনতে ভালো লাগছিল। বর্তমানের দমবন্ধ করা অবস্থায় দেশের শান্তিকে যারা বড় করে ভেবেছেন, তারা দেখেছিলেন আশার আলো। আমরাও। কিন্তু কী অর্বাচীন আমরা! ওসব যে মাঠ গরম করার কথা, তা জেনেও ভালো কিছু আশা করি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান অস্থির অবস্থার জন্য দুই নেতাই দায়ী। আমজনতার জন্য যতই অশ্র“ ঝরান তারা, তাদের আসল উদ্দেশ্য ক্ষমতা। সার্বিক ক্ষমতা। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সাংবিধানিকভাবে বাতিল করার পেছনেও ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্যই প্রধান। অথচ প্রধানমন্ত্রী একদা এ ব্যবস্থা কায়েমের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। সেটা ভুলে গেলেন কীভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং তা বাতিল করার মধ্যে নিপাট রাজনীতির খেলা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কী আছে? হ্যাঁ, আছে। এবার সংবিধানের কর্মটা প্রধানমন্ত্রীর মুঠোর মধ্যে। জনগণের কোন স্বার্থের বিবেচনায় এই খেলা? কথায় কথায় সংবিধানের ডুগডুগি বাজানো কেন? সংবিধান কি কোনো দলের বা কোনো নেতার একার সম্পদ? চিরকাল কেউ কি ক্ষমতায় থেকেছেন? আইয়ুব খান ও এরশাদকেও ক্ষমতা ছেড়ে যেতে হয়েছে। আর চিরকাল কেউ কি ক্ষমতায় থেকেছেন? লিবিয়া, মিসর তো হালের কথা। এত পরাক্রম যে ব্রিটিশ রাজা, তাদেরও ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যেতে হয়েছে। আমজনতার কথা কতটা কে ভাবে, সেটা লেখা আছে ইতিহাসে। অথচ এই আমজনতাই প্রাণ দেয় রাজনৈতিক সংকটে, মুক্তিযুদ্ধে এবং ক্ষমতার লড়াইয়ে। একই কথা বিরোধীদলীয় নেতার জন্য। আবেগ নয়, ফাঁকি নয়, সত্যি সত্যি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসুন আপনারা। আমাদের দেশটা সোনার দেশ। কী নেই আমাদের? খেলতে গেলে খেলার নিয়ম মানতে হয়। নইলে পণ্ড হয় খেলা। তেমনি রাজনীতিরও নিয়ম আছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির। সেটা তো মানতেই হবে। আজকাল তো নেতাদের ভাষিক শালীনতারও স্খলন দেখা যায় মাঝে মাঝে। এটা একেবারেই মানা যায় না। শেষ কথা, একটা সমঝোতায় আসুন আপনারা। সদিচ্ছা থাকলে পথও খুলে যায়।
গত দুই-তিন সপ্তাহে তড়িঘড়ি কয়েকটা বিল পাস হয়েছে সংসদে। সময়ের সীমা লংঘন করে বর্ধিত সংসদে ‘দলে নাম লেখালেই সংসদ সদস্যের প্রার্থিতা’ এবং ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ সংক্রান্ত বিল পাস হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সংসদে কিছু পাস করিয়ে নেয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়। তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বন্ধীয় গঠনমূলক ও সমঝোতামূলক কোনো প্রস্তাব পাস করানো তো কঠিন কিছু নয়। সংবিধান তো সংশোধন, পরিমার্জন হতেই পারে। সংশোধনীর মাধ্যমেই সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সংশোধনীর মাধ্যমেই তারও পরিবর্তন আনা সম্ভব। কথাটা এখন হাবাগোবা আমজনতাও বোঝে। কারণ জীবন সংগ্রামের ঝুঁকিতে নিতান্ত এতিমের মতো কাল কাটাচ্ছেন তো তারাই! মারেফাতের চিন্তা করলে সাধারণ মানুষের পেট চলে না। সহিংস হরতালে মানুষ মারা যাচ্ছে। এর দায় কিন্তু নেতাদেরই।
ড. বেগম জাহান আরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, গবেষক
No comments