আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশ!
বাইরের দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশ বুঝি ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তা অবশ্য একধরনের লেনদেনের আকর্ষণ। এ লেনদেনে প্রকৃত প্রাপ্তির নিক্তিতে বাংলাদেশ বঞ্চিতই হয়। বিশ্বের কিছু উন্নত দেশের পাশাপাশি অপরিচিত কোনো কোনো দেশের সঙ্গে এ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কিছু মানুষ। এসব মানুষ বেশ ধনী ও সম্পদশালী। তাঁরা তাঁদের অর্জিত কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ নিরাপদে রাখার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ আক্ষরিকভাবেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তাঁদের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়ার তাড়াটা অনেক বেশি। আবার অনেকে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। তাঁরাও চান, বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা অর্থবিত্তের একটা বড় অংশ যদি অন্যত্র নিরাপদে রাখা যায়, মন্দ কী? এভাবে বাংলাদেশের কিছু মানুষের কাছে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ আছে এবং তাঁরা যে তা দেশে রাখতে সাহস পান না, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, সেটা আমরা যতটা জানি, তার চেয়েও বেশি জানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। সে কারণেই এসব দেশে সম্পদ স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ থেকেই নয়, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশ থেকেই অর্থসম্পদ নিয়ে যাওয়ার জন্য ধনী দেশগুলো সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। অর্থসম্পদ নিয়ে যাওয়ার বিনিময়ে ওই সব দেশে সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে,
দেওয়া হচ্ছে নাগরিকত্বও। কিছুদিন আগেই দুবাইতে জমি-বাড়ি কেনার সুযোগ দিতে ঢাকায় এক অভিজাত হোটেলে রীতিমতো মেলা বসেছিল। দুটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে প্রায় এক পাতাজুড়ে একাধিক দিন রঙিন বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয় সম্ভাব্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে। তবে একটি দৈনিক পুরো বিষয়টির অবৈধ দিক তুলে ধরে শীর্ষ প্রতিবেদন করে। তাতে টনক নড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যেহেতু বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বাড়ি-জমি কিনতে অর্থ নেওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই, সেহেতু এ ধরনের বিজ্ঞাপন ও মেলা সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরই বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়, আয়োজকেরা মেলা গুটিয়ে ফেলে। কিন্তু এ ঘটনা সুস্পষ্টভাবে এটাই নির্দেশ করে যে দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বাইরে অর্থসম্পদ নিয়ে যেতে আগ্রহী এবং প্রচুর মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো অর্থসম্পদ আছে। অবশ্যই তা বৈধ পথে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তাই বলে বিদেশে টাকা নিয়ে যাওয়া থেমে নেই। নানা কৌশলে অবৈধ পথে অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। সোজা কথায়, টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে ডলার। ধনী বাংলাদেশিরা টাকা নিয়ে যাচ্ছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মরিশাসে। এর বাইরে এমন কিছু দেশের নাম এখন পাওয়া যাচ্ছে, যা আগে কখনো সেভাবে জানা যায়নি। লাটভিয়া, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের সেইন্ট ক্রিস্টোফার (কিটস নামেও পরিচিত) ও নেভিস ফেডারেশন, বাহামা এবং ডমিনিকায় টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
বিনিময়ে এসব দেশে স্থায়ী বসবাস ও নাগরিকত্বের সুবিধা প্রদানের কথা বলা হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে দেশের একাধিক বহুল প্রচারিত পত্রিকায় এসব দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের বিনিময়ে সেখানে স্থায়ী আবাসন বা নাগরিকত্ব প্রদানের সুযোগসংবলিত বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। দুবাইতে সম্পত্তি ক্রয়ের জন্য বিশালাকারে রঙিন বিজ্ঞাপন নয়, সাদা-কালো ও ছোট আকারের বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে একাধিক দেশের সরকারি ওয়েবসাইট ঘেঁটে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে দেশগুলো সত্যিই এ ধরনের সুযোগ দিচ্ছে। লাটভিয়ার কথাই ধরা যাক। আগামী বছর থেকে দেশটি প্রবেশ করতে যাচ্ছে ইউরো অঞ্চলে। অর্থাত্, বর্তমানে ইউরোপের ১৭টি দেশ যে অভিন্ন মুদ্রা হিসেবে ইউরো ব্যবহার করছে, লাটভিয়া আগামী বছর থেকে তাতে যুক্ত হবে। ফলে, দেশটির নিজস্ব মুদ্রা বলতে কিছু থাকবে না। লাটভিয়ায় রিয়েল এস্টেট বা আবাসন খাতে বাংলাদেশি কেউ যদি দেড় লাখ ইউরো বা দেড় কোটি টাকার কিছু বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন, তাহলে তিনি দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুবিধা পেতে পারেন।
লাটভিয়াকে এখন ইউরোপের নতুন করের স্বর্গ (ট্যাক্স হেভেন) হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। কিংবা ধরা যাক দ্বীপদেশগুলোর কথা। সেইন্ট কিটস ও নেভিসে জমি-বাড়ি তথা সম্পত্তি কিনতে চার লাখ ডলার (প্রায় তিন কোটি সাত লাখ টাকা) বিনিয়োগ করলে কিংবা দেশটির চিনিশিল্প বৈচিত্র্যকরণ ফাউন্ডেশনে নগদ দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার (এক কোটি ৯২ লাখ টাকা) অনুদান দিলে ৮ থেকে ১২ মাসের মধ্যে সেখানকার নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট মিলবে। ডমিনিকায় সরকারি তহবিলে এক লাখ ৭৫ হাজার ডলার অনুদান দিলে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যাবে। বাহামা ও মরিশাসের আবাসন খাতে পাঁচ লাখ ডলার (তিন কোটি ৮৪ লাখ টাকা) বিনিয়োগ করলে দেওয়া হবে একই ধরনের সুবিধা। এ পথ দেখাচ্ছে বড় উন্নত কয়েকটি দেশ। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের পল্লি এলাকায় নতুন বাণিজ্যিক কার্যক্রমে পাঁচ লাখ ডলার বিনিয়োগ করলে এবং এর মাধ্যমে ১০ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করলে প্রাথমিকভাবে দুই বছরের ও পরে স্থায়ী আবাসন-সুবিধা (গ্রিন কার্ড) দেওয়া হয়। এটি ইবিএ-৫ অভিবাসন কর্মসূচি নামে পরিচিত।
কানাডার কুইবেক অঙ্গরাজ্যে ন্যূনতম আট লাখ কানাডীয় ডলার (তিন কোটি ৬৬ লাখ টাকা) পাঁচ বছর সুদমুক্তভাবে ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করা হলে স্থায়ী আবাসনের সুযোগ দেওয়া হয়। সরকার এ ঋণের নিশ্চয়তা দেয়। অস্ট্রেলিয়ায় ৫০ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার (প্রায় ৩৬ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করলে অভিবাসনপ্রাপ্তির পথ প্রশস্ত হয়। এসব দেশের কাছে মুখ্য বিবেচনা হলো ধনসম্পদ। কীভাবে তা অর্জিত, সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আর কীভাবে অন্য দেশ থেকে তাদের দেশে এ অর্থ পাঠানো হচ্ছে, সেটা নিয়েও বিশেষ কোনো উদ্বেগ নেই। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ একেবারে শর্তহীন নয়। ছোটখাটো আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যা অবশ্যপালনীয়। সংশ্লিষ্ট দেশের আইনকানুন ও রীতিনীতি মেনে চলার অঙ্গীকারনামাসহ বাংলাদেশে কোনো অপরাধে যুক্ত না থাকার প্রত্যয়ন এর মধ্যে অন্যতম। আর এটা তো সবারই জানা যে বাংলাদেশের ধনাঢ্য-প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষে পুলিশি ছাড়পত্র পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়।
একইভাবে বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র তৈরি করারও ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে সেগুলো সত্যায়নের ব্যবস্থা। আসলে বিশ্বজুড়েই এখন পুঁজি পাচারের বা পুঁজি স্থানান্তরের বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে, যার বৈধতা দিচ্ছে বিভিন্ন উন্নত দেশ। এ ক্ষেত্রে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো হয়ে উঠেছে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এ ধারাতেই বাংলাদেশও হয়ে উঠেছে অন্যতম বড় আকর্ষণ। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে পুঁজিপতি ও কোটিপতির সংখ্যা। বাড়ছে রাজনৈতিক প্রভাব আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা শক্তিশালী গোষ্ঠী। এরাই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠিয়ে দিচ্ছে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আর বাংলাদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ অসহায়ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখছে।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক
asjadulk@gmail.com
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক
asjadulk@gmail.com
No comments