সুমি কেন আসামি? by মবিনুল ইসলাম
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরির্দশক
মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান জোড়া খুনের আসামি হিসাবে নিহত
দম্পতির মেয়ে ঐশীর সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া বাসার গৃহকর্মী খাদিজা খাতুন সুমিকে
আসামি হিসাবে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি ও
আলোচনা চলছে।
সুমিকে আসামি করা, গ্রেফতার ও রিমান্ডে
নেওয়াকে আইন ও শিশু অধিকারবিরোধী বলে উল্লেখ করেছেন অনেক আইনজ্ঞ ও
মানবাধিকার কর্মী। আবার অনেকেই এটি আইনসঙ্গত হলেও বিচারিক কার্যক্রম
পরিচালনার ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশাবলী পালন
করতে হবে বলে জানিয়েছেন।
মামলার এজাহার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী স্বীকৃত মতেই সুমির বয়স ১১ বছর। এ হিসেবে এবং জাতিসংঘ শিশু সনদ ও বাংলাদেশের শিশু আইন’১৯৭৪ সহ সকল ধরনের আইনের বিধানমতেই মেয়েটি শিশু।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে প্রত্যেকেই শিশু। বাংলাদেশের শিশু আইন’১৯৭৪ অনুসারেও সুমী শিশুর সংজ্ঞায় পড়ে।
শিশুর স্বার্থ রক্ষার্থে ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ১৯৭৪ সালে পাস হওয়া শিশু আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের রিমান্ডে নেওয়া যায় না। ১১ বছরের সুমীকে রিমান্ডে নেওয়ায় বিস্মিত আইনজ্ঞরাও।
গ্রেফতার হওয়ার পর ঐশী ও সুমিকে গত ১৮ আগস্ট ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। মামলার প্রধান আসামি হিসাবে ঐশী গত ২৪ আগস্ট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে। ওই দিন সুমিও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি প্রদান করে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর ও ইউএনডিপি বাংলাদেশের সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট (ফৌজদারি কার্যবিধি) অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজি বাংলানিউজকে বলেন, দণ্ডবিধির ৮২ ধারা অনুসারে নয় বছরের কোনো শিশুকে আসামি করা যাবে না।
তবে একই আইনের ৮৩ ধারা মতে, নয় বছরের অধিক ও ১২ বছরের কম বয়স্ক এমন শিশুর কোনো কর্মই অপরাধ নয়, উক্ত অপরাধের ব্যাপারে যে শিশুর বোধশক্তি এতোদূর পরিপক্কতা লাভ করে নাই যে, সে স্বীয় আচরণের প্রকৃতি ও পরিণতি বিচার করতে পারে।
সেক্ষেত্রে সুমির বয়স বয়স ১১ বছর হওয়ায় খুনের ঘটনার আগে-পরে যেকোনো ভাবে সম্পৃক্ত আছে মর্মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মনে করলে তাকে আসামি করতে পারেন। এমনকি রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেও কোনো বাধা নেই। তবে তাকে গ্রেফতার, আদালতে পাঠানো, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি পর্যায়ে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশাবলী পালন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জামিনের ক্ষেত্রে সুমি শিশু আইনের ৪৮ ধারা ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭ ধারার সুবিধা পাবে।
মামলাটি বিচারের সময় সুমি বা তার আইনজীবীরা দণ্ডবিধির ৮৩ ধারায় যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, সে অপরাধের ক্ষেত্রে তার বোধশক্তির পরিপক্কতা ছিল না এবং এর পরিণতি বিচার করতে পারেনি সেক্ষেত্রে হয়তো খালাস পেতে পারেন।
উল্লেখ্য, শিশু আইন’১৯৭৪ যেমন শিশুদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, পাশাপাশি তেমনি অপরাধী শিশুদের জন্য নমনীয় ও সংশোধনমূলক বিচার ব্যবস্থারও বিধান প্রণয়ন করেছে। আইনটির ১৭ ধারায় মামলায় জড়িত শিশুর পরিচয় প্রকাশও নিষিদ্ধ করা রয়েছে।
সেখানে বলা আছে, কোনো সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা সংবাদফলক প্রভৃতি অথবা সংবাদ এজেন্সি এই আইনের অধীনে আদালতে উত্থাপিত কোনো মামলা বা কার্যধারায় কোনো শিশু জড়িত থাকিলে উহার বিস্তারিত বর্ণনা এবং এইরূপ শিশুকে শনাক্তকরণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে এইরূপ কিছু বা শিশুর ছবি প্রকাশ করিবে না।
তবে শর্ত থাকে যে, মামলার বিচারকারী অথবা র্কাযধারা গ্রহণকারী আদালত, যদি উহার মতে এইরূপ রির্পোট প্রকাশ করা শিশুকল্যাণের র্স্বাথে অনুকূল হইবে এবং সংশ্লিষ্ট শিশুর স্বার্থের কোনো ক্ষতি হইবে না বলিয়া মনে করেন, তবে কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া উক্ত আদালত এইরূপ কোনো রিপোর্ট প্রকাশের অনুমতি দিতে পারিবেন’।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সুমির বয়স ১১ বছর হওয়ায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রতীয়মাণ হলে সুমিকে আসামি করায় আইন লঙ্ঘিত হয়নি। কিংবা রিমান্ডে নেওয়াও আইনগতভাবে হয়েছে।
তিনি বলেন, বিষয়টি বুঝতে হবে এটি একটি জোড়া খুনের মামলা। খুনের রহস্য উদঘাটন করতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেনই। কিন্তু আদালতের নির্দেশ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার বেশি কোনো আসামিকেই পুলিশি হেফাজতে রাখা যায় না। সেক্ষেত্রে আসামিকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে অবশ্যই তাকে আদালতের কাছে রিমান্ড চাইতে হবে। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে অবশ্যই শিশু আইন মেনেই গ্রেফতার, আদালতে পাঠানো কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
আর কেউ সরাসরি খুন করলেই আসামি হবে বিষয়টি তা নয়। খুনের যেকোনো পর্যায়ে সহায়তা করলেও সে খুনের সহায়তার জন্য দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় আসামি হবে।
আর বিচারের ক্ষেত্রে তার বিচার অবশ্যই শিশু আইনেই হতে হবে। সেক্ষেত্রে তার সাজা হবে কম। সাজা বলতে নির্দিষ্ট সময় তাকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে তার মানসিক উন্নয়নের জন্য থাকতে হবে।
শিশু আইনের ধারা সাত এ বলা হয়েছে, ‘কোন শিশু অভিযুক্ত রহিয়াছে এমন কোনো মামলার বিচারের ক্ষেত্রে, আদালত যে ভবনে বা কামরায়, যে দিবসে বা যে সময়ে সাধারণত অধিবেশন বসে, তৎ ভিন্ন অন্য কোন ভবন বা কামরায় অথবা অন্য কোন দিবসে বা সময়ে অধিবেশন বসিবে’।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত) আইন’২০০৩ এ বলা আছে, কোন শিশু এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত হইলে বা উক্ত অপরাধের সাক্ষী হইলে তাহার ক্ষেত্রে শিশু আইন’১৯৭৪ এর বিধানাবলী যতদূর সম্ভব অনুসরণ করিতে হইবে’।
এ দিকটি বিবেচনায় আইন অনুসারে সুমির বিচার জুভেনাইল কোর্টের (কিশোর আদালত) মাধ্যমে হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা।
এছাড়া হাইকোর্টের বিচারপতি ঈমান আলীর একটি রায় রয়েছে শিশু-কিশোর অপরাধীদের নিয়ে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, শিশু এবং কিশোরদের সঙ্গে কি করে পুলিশ সদস্যরা কথা বলবেন, কেমন ব্যবহার করবেন। তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক কোনো অপরাধীদের মতো ব্যবহার করা যাবে না।
বিচারপতি ঈমান আলীর রায়টিও অনুসরণ করতে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা মনে করেন, সুমীকে সঠিক উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, সেই সঙ্গে তাদের জন্য মেডিকেল সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে, ব্যবস্থা করতে হবে কাউন্সিলিংয়ের।
সুমিকে বিনামূল্যে আইনগত সুবিধা দিচ্ছেন তার আইনজীবী সৈয়দ নাজমুল হুদা। তিনি সুমিকে আসামি করা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, সুমিকে আসামি করা ন্যায়সঙ্গত হয়নি।
তিনি বলেন, সুমির বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। পেটের তাগিদে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে তাকে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ বেছে নিতে হয়েছে। বাড়িতে একজন গৃহকর্মীর ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া কিংবা নিজস্ব কোনো মতামত থাকে না। খুনের ক্ষেত্রে ঐশীর মতো তার কোনো পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল না। খুনের সময় সে ঘুমিয়ে ছিল। পরে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে রক্ত পরিস্কারের জন্য বলা হয়েছে। বাসার মালিকের নির্দেশে বাড়ি-ঘর পরিস্কার করাই ছিল তার কাজ।
তিনি আরও বলেন, সুমি সম্পূর্ণভাবে ভিকটিমাইজড হয়েছে। যদি খুনের সম্পর্কে তার বোধশক্তি থাকতো, তবে সে পালাতো। কিন্তু তা না করে ঐশী যখন যেখানে তাকে থাকতে বলেছে, সে সেখানেই থেকেছে। এমনকি ঐশী সুমিকে নিয়েই থানায় আত্মসমর্পণ করেছে। তাই দণ্ডবিধির ৮৩ ধারা অনুযায়ী সুমির কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের ৪৮ ধারায় একজন পুলিশ অফিসারকেই শিশুকে জামিন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে। সেক্ষেত্রে জামিন প্রদান করা হলে রিমান্ডে নেওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।
তিনি সুমির জামিন ও খালাস দেওয়ার দাবি জানান।
উল্লেখ্য, গত ১৪ আগস্ট দিনগত রাতে পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমানকে তাদের চামেলীবাগের ভাড়া বাসায় হত্যা করা হয়। ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের পর ১৭ আগস্ট দুপুরে ঐশী সুমিকে নিয়ে পল্টন থানা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
সুমি বর্তমানে গাজিপুরের কিশোরী উন্নয়ন (সংশোধন) কেন্দ্রে ও ঐশী কাশিমপুর কারাগারে আছে।
মামলার এজাহার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী স্বীকৃত মতেই সুমির বয়স ১১ বছর। এ হিসেবে এবং জাতিসংঘ শিশু সনদ ও বাংলাদেশের শিশু আইন’১৯৭৪ সহ সকল ধরনের আইনের বিধানমতেই মেয়েটি শিশু।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে প্রত্যেকেই শিশু। বাংলাদেশের শিশু আইন’১৯৭৪ অনুসারেও সুমী শিশুর সংজ্ঞায় পড়ে।
শিশুর স্বার্থ রক্ষার্থে ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ১৯৭৪ সালে পাস হওয়া শিশু আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের রিমান্ডে নেওয়া যায় না। ১১ বছরের সুমীকে রিমান্ডে নেওয়ায় বিস্মিত আইনজ্ঞরাও।
গ্রেফতার হওয়ার পর ঐশী ও সুমিকে গত ১৮ আগস্ট ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। মামলার প্রধান আসামি হিসাবে ঐশী গত ২৪ আগস্ট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে। ওই দিন সুমিও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি প্রদান করে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর ও ইউএনডিপি বাংলাদেশের সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট (ফৌজদারি কার্যবিধি) অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজি বাংলানিউজকে বলেন, দণ্ডবিধির ৮২ ধারা অনুসারে নয় বছরের কোনো শিশুকে আসামি করা যাবে না।
তবে একই আইনের ৮৩ ধারা মতে, নয় বছরের অধিক ও ১২ বছরের কম বয়স্ক এমন শিশুর কোনো কর্মই অপরাধ নয়, উক্ত অপরাধের ব্যাপারে যে শিশুর বোধশক্তি এতোদূর পরিপক্কতা লাভ করে নাই যে, সে স্বীয় আচরণের প্রকৃতি ও পরিণতি বিচার করতে পারে।
সেক্ষেত্রে সুমির বয়স বয়স ১১ বছর হওয়ায় খুনের ঘটনার আগে-পরে যেকোনো ভাবে সম্পৃক্ত আছে মর্মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মনে করলে তাকে আসামি করতে পারেন। এমনকি রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেও কোনো বাধা নেই। তবে তাকে গ্রেফতার, আদালতে পাঠানো, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি পর্যায়ে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশাবলী পালন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জামিনের ক্ষেত্রে সুমি শিশু আইনের ৪৮ ধারা ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭ ধারার সুবিধা পাবে।
মামলাটি বিচারের সময় সুমি বা তার আইনজীবীরা দণ্ডবিধির ৮৩ ধারায় যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, সে অপরাধের ক্ষেত্রে তার বোধশক্তির পরিপক্কতা ছিল না এবং এর পরিণতি বিচার করতে পারেনি সেক্ষেত্রে হয়তো খালাস পেতে পারেন।
উল্লেখ্য, শিশু আইন’১৯৭৪ যেমন শিশুদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, পাশাপাশি তেমনি অপরাধী শিশুদের জন্য নমনীয় ও সংশোধনমূলক বিচার ব্যবস্থারও বিধান প্রণয়ন করেছে। আইনটির ১৭ ধারায় মামলায় জড়িত শিশুর পরিচয় প্রকাশও নিষিদ্ধ করা রয়েছে।
সেখানে বলা আছে, কোনো সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা সংবাদফলক প্রভৃতি অথবা সংবাদ এজেন্সি এই আইনের অধীনে আদালতে উত্থাপিত কোনো মামলা বা কার্যধারায় কোনো শিশু জড়িত থাকিলে উহার বিস্তারিত বর্ণনা এবং এইরূপ শিশুকে শনাক্তকরণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করে এইরূপ কিছু বা শিশুর ছবি প্রকাশ করিবে না।
তবে শর্ত থাকে যে, মামলার বিচারকারী অথবা র্কাযধারা গ্রহণকারী আদালত, যদি উহার মতে এইরূপ রির্পোট প্রকাশ করা শিশুকল্যাণের র্স্বাথে অনুকূল হইবে এবং সংশ্লিষ্ট শিশুর স্বার্থের কোনো ক্ষতি হইবে না বলিয়া মনে করেন, তবে কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া উক্ত আদালত এইরূপ কোনো রিপোর্ট প্রকাশের অনুমতি দিতে পারিবেন’।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সুমির বয়স ১১ বছর হওয়ায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রতীয়মাণ হলে সুমিকে আসামি করায় আইন লঙ্ঘিত হয়নি। কিংবা রিমান্ডে নেওয়াও আইনগতভাবে হয়েছে।
তিনি বলেন, বিষয়টি বুঝতে হবে এটি একটি জোড়া খুনের মামলা। খুনের রহস্য উদঘাটন করতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেনই। কিন্তু আদালতের নির্দেশ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার বেশি কোনো আসামিকেই পুলিশি হেফাজতে রাখা যায় না। সেক্ষেত্রে আসামিকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে অবশ্যই তাকে আদালতের কাছে রিমান্ড চাইতে হবে। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে অবশ্যই শিশু আইন মেনেই গ্রেফতার, আদালতে পাঠানো কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
আর কেউ সরাসরি খুন করলেই আসামি হবে বিষয়টি তা নয়। খুনের যেকোনো পর্যায়ে সহায়তা করলেও সে খুনের সহায়তার জন্য দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় আসামি হবে।
আর বিচারের ক্ষেত্রে তার বিচার অবশ্যই শিশু আইনেই হতে হবে। সেক্ষেত্রে তার সাজা হবে কম। সাজা বলতে নির্দিষ্ট সময় তাকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে তার মানসিক উন্নয়নের জন্য থাকতে হবে।
শিশু আইনের ধারা সাত এ বলা হয়েছে, ‘কোন শিশু অভিযুক্ত রহিয়াছে এমন কোনো মামলার বিচারের ক্ষেত্রে, আদালত যে ভবনে বা কামরায়, যে দিবসে বা যে সময়ে সাধারণত অধিবেশন বসে, তৎ ভিন্ন অন্য কোন ভবন বা কামরায় অথবা অন্য কোন দিবসে বা সময়ে অধিবেশন বসিবে’।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধিত) আইন’২০০৩ এ বলা আছে, কোন শিশু এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত হইলে বা উক্ত অপরাধের সাক্ষী হইলে তাহার ক্ষেত্রে শিশু আইন’১৯৭৪ এর বিধানাবলী যতদূর সম্ভব অনুসরণ করিতে হইবে’।
এ দিকটি বিবেচনায় আইন অনুসারে সুমির বিচার জুভেনাইল কোর্টের (কিশোর আদালত) মাধ্যমে হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা।
এছাড়া হাইকোর্টের বিচারপতি ঈমান আলীর একটি রায় রয়েছে শিশু-কিশোর অপরাধীদের নিয়ে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, শিশু এবং কিশোরদের সঙ্গে কি করে পুলিশ সদস্যরা কথা বলবেন, কেমন ব্যবহার করবেন। তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক কোনো অপরাধীদের মতো ব্যবহার করা যাবে না।
বিচারপতি ঈমান আলীর রায়টিও অনুসরণ করতে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীকে আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা মনে করেন, সুমীকে সঠিক উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, সেই সঙ্গে তাদের জন্য মেডিকেল সাপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে, ব্যবস্থা করতে হবে কাউন্সিলিংয়ের।
সুমিকে বিনামূল্যে আইনগত সুবিধা দিচ্ছেন তার আইনজীবী সৈয়দ নাজমুল হুদা। তিনি সুমিকে আসামি করা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, সুমিকে আসামি করা ন্যায়সঙ্গত হয়নি।
তিনি বলেন, সুমির বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। পেটের তাগিদে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে তাকে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ বেছে নিতে হয়েছে। বাড়িতে একজন গৃহকর্মীর ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া কিংবা নিজস্ব কোনো মতামত থাকে না। খুনের ক্ষেত্রে ঐশীর মতো তার কোনো পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল না। খুনের সময় সে ঘুমিয়ে ছিল। পরে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে রক্ত পরিস্কারের জন্য বলা হয়েছে। বাসার মালিকের নির্দেশে বাড়ি-ঘর পরিস্কার করাই ছিল তার কাজ।
তিনি আরও বলেন, সুমি সম্পূর্ণভাবে ভিকটিমাইজড হয়েছে। যদি খুনের সম্পর্কে তার বোধশক্তি থাকতো, তবে সে পালাতো। কিন্তু তা না করে ঐশী যখন যেখানে তাকে থাকতে বলেছে, সে সেখানেই থেকেছে। এমনকি ঐশী সুমিকে নিয়েই থানায় আত্মসমর্পণ করেছে। তাই দণ্ডবিধির ৮৩ ধারা অনুযায়ী সুমির কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে না।
তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের ৪৮ ধারায় একজন পুলিশ অফিসারকেই শিশুকে জামিন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া আছে। সেক্ষেত্রে জামিন প্রদান করা হলে রিমান্ডে নেওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।
তিনি সুমির জামিন ও খালাস দেওয়ার দাবি জানান।
উল্লেখ্য, গত ১৪ আগস্ট দিনগত রাতে পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমানকে তাদের চামেলীবাগের ভাড়া বাসায় হত্যা করা হয়। ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের পর ১৭ আগস্ট দুপুরে ঐশী সুমিকে নিয়ে পল্টন থানা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
সুমি বর্তমানে গাজিপুরের কিশোরী উন্নয়ন (সংশোধন) কেন্দ্রে ও ঐশী কাশিমপুর কারাগারে আছে।
No comments