রাজনৈতিক দাবা খেলায় আন্তর্জাতিক ক্রীড়াচক্র by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
২৭
আগস্ট হঠাৎ করে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা এবং
জাতিসংঘসহ এর অঙ্গসংস্থার কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে
মিলিত হন। এর পর থেকে বিশ্লেষক মহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক বৃহৎ
শক্তিগুলোর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। এ লেখার মূল
প্রতিপাদ্য বিষয় হল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দাবা খেলায় আন্তর্জাতিক
ক্রীড়াচক্রের কলাকৌশলের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে একটি
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অপর কোনো রাষ্ট্রের ‘ইতিবাচক সংশ্লিষ্টতা’ তেমন
ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয় না। বিশেষত, বিশ্বায়নের ‘বৈশ্বিক গ্রাম’ (গ্লোবাল
ভিলেজ) চেতনা ধারণ করে বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার
মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে ইতিবাচক বহিঃসংযোগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে
থাকে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো বিভিন্ন কারণে উন্নত দেশ থেকে
সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করে বলে দরিদ্র দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ধনী
দেশগুলো হস্তক্ষেপ করে থাকে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল পি টোডারো এ ধারায়
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের বৈদেশিক
হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। তৃতীয়ত, উন্নয়নের ‘বৈদেশিক সাহায্য তত্ত্ব’
বিশ্লেষণ করে ছকবাদী (স্ট্রাকচারাল) অর্থনীতিবিদরা সাহায্য দান ও সাহায্য
গ্রহণের মধ্যে ‘নির্ভরশীলতার’ অনিরাময়যোগ্য বিকার আবিষ্কার করেছেন। অর্থাৎ
দাতা দেশগুলো গ্রহীতা দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে এমন হস্তক্ষেপ
করে থাকে, যা থেকে গ্রহীতা দেশ কখনও মুক্ত হতে পারে না। চতুর্থত,
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ‘জবর শাসন তত্ত্ব’ (হেজিমোন থিওরি) অনুযায়ী বিশ্বের
বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে
আন্তর্জাতিক ‘শাসন-শোষণ’ অবস্থাকে ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নানাভাবে জড়িয়ে পড়ে।
একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তিত বাস্তবতায় একথা বিশ্বাস করার তেমন কোনো কারণ নেই যে, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো ইতিবাচক কারণে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোতে ধনী দেশগুলো প্রতিনিয়ত যেভাবে জড়িয়ে পড়ছে, তা খুব নেতিবাচক ফলাফলই বয়ে আনছে। এ বাস্তবতা ঐতিহাসিক, এ সত্য অনস্বীকার্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানো সমাজ দর্শনিক কার্ল মার্কস তাই এ স্বচ্ছ সত্যটিকে ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলোর সংশ্লিষ্টতা কি উপরের কোনো তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়? এ বিষয়ে বেশ ভাবার সময় এখন এবং এখনই। নির্বাচন কমিশনে বিদেশীরা কেন ঢুকলেন এমন প্রশ্ন যেমন অনেকের, আবার তাদের এখানে আসার প্রয়োজন ছিল এমন উত্তরও অনেকের। অনেকে স্তম্ভিত, অনেকে দ্বিধান্বিত, অনেকে হতাশাগ্রস্ত, আবার অনেকে আশান্বিত। এমন বহুমুখী মনোজাগতিক ও সমন্বয়হীন মিশ্র অনুভূতি একটি দেশ ও জাতির জন্য যে কত ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনে, তা পৃথিবীর অনেক দেশের ইতিহাস থেকে অবগত হওয়া যায়।
বাংলাদেশ একটি দরিদ্র, উন্নয়নশীল, সাহায্যগ্রহীতা দেশ হিসেবে এখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৈদেশিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে। কিন্তু সেই আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা যেন কোনোভাবে বহিঃহস্তক্ষেপের করাল থাবায় বিস্তৃত হতে না পারে, তার কৌশল অবলম্বন করা উচিত ছিল অনেক আগেই। এই একটি জায়গায় মনোনিবেশ না করার কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বাভাবিক আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার ইতিবাচক ফলাফলের পরিবর্তে বৈশ্বিক হস্তক্ষেপের অভিশাপ নেমে আসছে বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনে ১৪-১৫টি দেশের শীর্ষ কূটনীতিক, জাতিসংঘ, ইইউ কর্তাব্যক্তিরা এসে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, এ ঘটনা বিরল ও হতাশাব্যঞ্জক হলেও তা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনভিপ্রেত বা অস্বাভাবিক নয়। ২৯ আগস্ট একটি সংবাদপত্রে ড. কামাল হোসেন, ড. আকবর আলি খান, ড. শাহদীন মালিক, সিএম শফি সামি, ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হলে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না বাংলাদেশের।
সেদিন বিদেশীরা কেন এসেছিলেন ইসি কার্যালয়ে? পত্রিকা মারফত জেনেছি, নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে তারা নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন শংকা ও দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলতে এসেছিলেন। একটি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার আমাকে বলেছিলেন, ইউএনডিপির আয়োজনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সম্রাট আলেকজান্ডারের মতো আমার অবচেতন মন সে মুহূর্তে বলে উঠেছিল, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ!’ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত জননেত্রীদ্বয় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনে একসঙ্গে চা খেতেও বসতে পারলেন না, আর ‘পলাশীর আম্রকাননে’র সেই বন্ধুদের (!) সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের কী মহব্বতের আলাপটিই না জমে উঠল!
এ বৈঠকের কথা জেনে আমার মনে খুবই অস্বস্তি জেগে উঠছিল। বড় অপমান বোধ হচ্ছিল। অসহায় লাগছিল। তবু এ যে আমাদের নিয়তি! বড় নিষ্ঠুর নিয়তি। আমাদের হাতে গড়া নিয়তি। আমি সেদিন একটি টিভি আলোচনায় বলেছি, বাহ্যিকভাবে ইসি-বিদেশী কূটনীতিক বৈঠক আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ বলে মনে হলেও এমন একটা ঘটনা আমাদের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিস্ফোরন্মোখ মুহূর্তে অস্বাভাবিক নয়। মনে হয় সে কারণে এম হাফিজউদ্দীন খানসহ অনেকে এ ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কেন? আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনোভাবেই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক দূর করতে সক্ষম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এ নিয়ে বিএনপি শংকিত হলেও সরকারের বা আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর আগে বহুবার এটাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য দাতা সংস্থা ও দাতা দেশ থেকে নানা অনুরোধ ও চাপ দেয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ সফর করেছেন। ইইউ ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের অনেক কূটনীতিকও একই সুরে সরকার ও বিরোধী দলকে সব বিতর্ক দূর করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু সব আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ভেস্তে যেতে দেখে ওই দেশগুলোই শেষ পর্যন্ত বিশ্বফোরাম জাতিসংঘের মহাসচিবকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন। সম্ভবত কোরীয় বান কি মুনের নম্র-ভদ্র কণ্ঠস্বর বাঙালি নেত্রীদ্বয়ের কর্ণকুহরে বৈশ্বিক অশনিবার্তা পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা ঢাকায় অবস্থানরত তাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে এ কাজে ইসিতে পাঠিয়েছেন। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য এটাই শেষ সুযোগ। এরপর অনাগত এক আশংকাময়, অভিশপ্ত ভাগ্য হয়তো নেমে আসবে জাতীয় জীবনে।
রাজনীতির দরকষাকষি ও দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ চমৎকারভাবে করা যায় ক্রীড়া তত্ত্বের (গেইম থিওরি) দ্বারা। ক্রীড়া তত্ত্বের ‘চিকেন মডেলে’ সরু রাস্তায় দু’জন কিশোর খেলোয়াড়ের প্রত্যেকেই যদি অবুঝের মতো প্রবল বেগে গাড়ি চালিয়ে সামনে যায়, তাহলে এক সময় উভয়ে মারাÍক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এদের একজন যদি রাস্তার পাশে সরে দাঁড়ায়, সে চিকেনে পরিণত হয়। আর যে সোজা গাড়ি চালিয়ে যায়, সে বীরে পরিণত হয়। এ তিন বিকল্পের কোনটা বেছে নেবেন রাজনৈতিক খেলোয়াড়রা? এ এক বিরাট সিদ্ধান্ত, কঠিন পদক্ষেপ! আমাদের দু’নেত্রী উভয়েই বীর হতে চান। তাই তারা রাজনীতির সরল পথে ভীষণ বেগে গাড়ি চালাচ্ছেন। কেউ-ই সরে আসতে চান না। কেউ-ই চিকেন হতে চান না। আমরা চিন্তিত, বিষণœ; দু’নেত্রীর কাউকে আমরা হারাতে চাই না। তবে তাদের কে চিকেন হবেন আর কে বীর হবেন, তা নির্ভর করছে জনগণের ওপর, তাদের ওপর নয়। তাই এখানে ক্রীড়া তত্ত্ব প্রযোজ্য নয়!
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের। জাতিসংঘ ও কূটনীতিকদের পদক্ষেপ বাংলাদেশকে রাজনীতির ১০ নম্বর মহাসংকেত পৌঁছে দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদের আগেই দু’দলের সংলাপ জরুরি, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ঐকমত্য অপরিহার্য। এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা তেমন উপযোগী হবে না। কারণ তা ‘হ্যাঁ বলুন’, ‘না বলুন’ প্রক্রিয়ায় জোড়াতালির সমাধান নিয়ে আসবে, মূল সংকটের গভীরতা আরও বাড়বে। সরকারি দল, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল, এমন একটি নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার কাঠামোর প্রস্তাব করা, যা বিএনপিসহ অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব না করে অকপটতা ও সততার সঙ্গে গ্রহণযোগ্য রূপরেখা প্রণয়ন করে তিনি জাতিকে সমূহ বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পারেন।
পরিশেষে আমরা অনুরোধ করব- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়েই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করুন। জয়-পরাজয় তো ঐতিহাসিক সত্য। তাতে যিনি বীর হিসেবে গৃহীত হবেন, তাকে আমরা অভিবাদন জানাব। আর যিনি চিকেনের আসনে অধিষ্ঠিত হবেন, তাকে ধন্যবাদ জানাব।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তিত বাস্তবতায় একথা বিশ্বাস করার তেমন কোনো কারণ নেই যে, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো ইতিবাচক কারণে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোতে ধনী দেশগুলো প্রতিনিয়ত যেভাবে জড়িয়ে পড়ছে, তা খুব নেতিবাচক ফলাফলই বয়ে আনছে। এ বাস্তবতা ঐতিহাসিক, এ সত্য অনস্বীকার্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানো সমাজ দর্শনিক কার্ল মার্কস তাই এ স্বচ্ছ সত্যটিকে ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলোর সংশ্লিষ্টতা কি উপরের কোনো তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়? এ বিষয়ে বেশ ভাবার সময় এখন এবং এখনই। নির্বাচন কমিশনে বিদেশীরা কেন ঢুকলেন এমন প্রশ্ন যেমন অনেকের, আবার তাদের এখানে আসার প্রয়োজন ছিল এমন উত্তরও অনেকের। অনেকে স্তম্ভিত, অনেকে দ্বিধান্বিত, অনেকে হতাশাগ্রস্ত, আবার অনেকে আশান্বিত। এমন বহুমুখী মনোজাগতিক ও সমন্বয়হীন মিশ্র অনুভূতি একটি দেশ ও জাতির জন্য যে কত ক্ষতিকর পরিণতি বয়ে আনে, তা পৃথিবীর অনেক দেশের ইতিহাস থেকে অবগত হওয়া যায়।
বাংলাদেশ একটি দরিদ্র, উন্নয়নশীল, সাহায্যগ্রহীতা দেশ হিসেবে এখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৈদেশিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে। কিন্তু সেই আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা যেন কোনোভাবে বহিঃহস্তক্ষেপের করাল থাবায় বিস্তৃত হতে না পারে, তার কৌশল অবলম্বন করা উচিত ছিল অনেক আগেই। এই একটি জায়গায় মনোনিবেশ না করার কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বাভাবিক আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার ইতিবাচক ফলাফলের পরিবর্তে বৈশ্বিক হস্তক্ষেপের অভিশাপ নেমে আসছে বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনে ১৪-১৫টি দেশের শীর্ষ কূটনীতিক, জাতিসংঘ, ইইউ কর্তাব্যক্তিরা এসে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, এ ঘটনা বিরল ও হতাশাব্যঞ্জক হলেও তা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনভিপ্রেত বা অস্বাভাবিক নয়। ২৯ আগস্ট একটি সংবাদপত্রে ড. কামাল হোসেন, ড. আকবর আলি খান, ড. শাহদীন মালিক, সিএম শফি সামি, ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রমুখ বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হলে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না বাংলাদেশের।
সেদিন বিদেশীরা কেন এসেছিলেন ইসি কার্যালয়ে? পত্রিকা মারফত জেনেছি, নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে তারা নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন শংকা ও দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলতে এসেছিলেন। একটি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার আমাকে বলেছিলেন, ইউএনডিপির আয়োজনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সম্রাট আলেকজান্ডারের মতো আমার অবচেতন মন সে মুহূর্তে বলে উঠেছিল, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ!’ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত জননেত্রীদ্বয় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনে একসঙ্গে চা খেতেও বসতে পারলেন না, আর ‘পলাশীর আম্রকাননে’র সেই বন্ধুদের (!) সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের কী মহব্বতের আলাপটিই না জমে উঠল!
এ বৈঠকের কথা জেনে আমার মনে খুবই অস্বস্তি জেগে উঠছিল। বড় অপমান বোধ হচ্ছিল। অসহায় লাগছিল। তবু এ যে আমাদের নিয়তি! বড় নিষ্ঠুর নিয়তি। আমাদের হাতে গড়া নিয়তি। আমি সেদিন একটি টিভি আলোচনায় বলেছি, বাহ্যিকভাবে ইসি-বিদেশী কূটনীতিক বৈঠক আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ বলে মনে হলেও এমন একটা ঘটনা আমাদের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিস্ফোরন্মোখ মুহূর্তে অস্বাভাবিক নয়। মনে হয় সে কারণে এম হাফিজউদ্দীন খানসহ অনেকে এ ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কেন? আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনোভাবেই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক দূর করতে সক্ষম হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এ নিয়ে বিএনপি শংকিত হলেও সরকারের বা আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর আগে বহুবার এটাসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য দাতা সংস্থা ও দাতা দেশ থেকে নানা অনুরোধ ও চাপ দেয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ সফর করেছেন। ইইউ ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের অনেক কূটনীতিকও একই সুরে সরকার ও বিরোধী দলকে সব বিতর্ক দূর করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু সব আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ভেস্তে যেতে দেখে ওই দেশগুলোই শেষ পর্যন্ত বিশ্বফোরাম জাতিসংঘের মহাসচিবকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন। সম্ভবত কোরীয় বান কি মুনের নম্র-ভদ্র কণ্ঠস্বর বাঙালি নেত্রীদ্বয়ের কর্ণকুহরে বৈশ্বিক অশনিবার্তা পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা ঢাকায় অবস্থানরত তাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে এ কাজে ইসিতে পাঠিয়েছেন। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য এটাই শেষ সুযোগ। এরপর অনাগত এক আশংকাময়, অভিশপ্ত ভাগ্য হয়তো নেমে আসবে জাতীয় জীবনে।
রাজনীতির দরকষাকষি ও দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ চমৎকারভাবে করা যায় ক্রীড়া তত্ত্বের (গেইম থিওরি) দ্বারা। ক্রীড়া তত্ত্বের ‘চিকেন মডেলে’ সরু রাস্তায় দু’জন কিশোর খেলোয়াড়ের প্রত্যেকেই যদি অবুঝের মতো প্রবল বেগে গাড়ি চালিয়ে সামনে যায়, তাহলে এক সময় উভয়ে মারাÍক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এদের একজন যদি রাস্তার পাশে সরে দাঁড়ায়, সে চিকেনে পরিণত হয়। আর যে সোজা গাড়ি চালিয়ে যায়, সে বীরে পরিণত হয়। এ তিন বিকল্পের কোনটা বেছে নেবেন রাজনৈতিক খেলোয়াড়রা? এ এক বিরাট সিদ্ধান্ত, কঠিন পদক্ষেপ! আমাদের দু’নেত্রী উভয়েই বীর হতে চান। তাই তারা রাজনীতির সরল পথে ভীষণ বেগে গাড়ি চালাচ্ছেন। কেউ-ই সরে আসতে চান না। কেউ-ই চিকেন হতে চান না। আমরা চিন্তিত, বিষণœ; দু’নেত্রীর কাউকে আমরা হারাতে চাই না। তবে তাদের কে চিকেন হবেন আর কে বীর হবেন, তা নির্ভর করছে জনগণের ওপর, তাদের ওপর নয়। তাই এখানে ক্রীড়া তত্ত্ব প্রযোজ্য নয়!
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের। জাতিসংঘ ও কূটনীতিকদের পদক্ষেপ বাংলাদেশকে রাজনীতির ১০ নম্বর মহাসংকেত পৌঁছে দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদের আগেই দু’দলের সংলাপ জরুরি, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ঐকমত্য অপরিহার্য। এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা তেমন উপযোগী হবে না। কারণ তা ‘হ্যাঁ বলুন’, ‘না বলুন’ প্রক্রিয়ায় জোড়াতালির সমাধান নিয়ে আসবে, মূল সংকটের গভীরতা আরও বাড়বে। সরকারি দল, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল, এমন একটি নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার কাঠামোর প্রস্তাব করা, যা বিএনপিসহ অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব না করে অকপটতা ও সততার সঙ্গে গ্রহণযোগ্য রূপরেখা প্রণয়ন করে তিনি জাতিকে সমূহ বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পারেন।
পরিশেষে আমরা অনুরোধ করব- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়েই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করুন। জয়-পরাজয় তো ঐতিহাসিক সত্য। তাতে যিনি বীর হিসেবে গৃহীত হবেন, তাকে আমরা অভিবাদন জানাব। আর যিনি চিকেনের আসনে অধিষ্ঠিত হবেন, তাকে ধন্যবাদ জানাব।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments