বাংলাদেশের রাজনীতি ও জাতিসংঘ by ফরহাদ মজহার
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা রাজনীতির ফুটবল খালেদা জিয়ার পায়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এবার
বিরোধী নেত্রীর খেলার পালা। কিন্তু বল তিনি ধরতে পারেননি, কিংবা তার কাছে
আসেনি, সেটা ফিরতি পদাঘাতে চালান হয়ে গেছে জাতিসংঘে। এই বল ফিরে আসার
সম্ভাবনা খুব কম, সেটা বিরোধী নেত্রীর নির্দেশে হয়েছে, নাকি তিনি অন্য কারও
খেলার ঘুঁটি হয়েছেন, সেটা বাইরে থেকে আমাদের জানার উপায় নেই। বিএনপির
ভবিষ্যৎ বিএনপিই নির্ধারণ করবে, সে ব্যাপারে বলার কিছু নেই। কিন্তু
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশীদেরই নির্ধারণ করতে হবে, তার জন্য পরিস্থিতি
আসলে কী দাঁড়াচ্ছে তা বিবেচনার জন্য এ লেখা। কিভাবে শেখ হাসিনা বল চালান
করলেন? সেটা তো তিনি বহু আগেই করেছেন। তিনি বারবার পরিষ্কার করে বলছেন,
নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। বিএনপি তার কথা সিরিয়াসলি নেয়নি। আসলে শেখ
হাসিনার দিক থেকে এটা ছিল বিরোধী দলের প্রতি চ্যালেঞ্জ। বলা হল, বিএনপির
যদি হিম্মত থাকে তাহলে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করুক। তিনি
নিজেও খালেদা জিয়ার আমলে আন্দোলন করেই আদায় করেছিলেন। আর আন্দোলন করতে
নামলে জেল-জরিমানা, গুলি, টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড আর
পিস্তল-কাঁটাবন্দুক-চাপাতি সজ্জিত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা আছে। বিএনপি যে
চ্যালেঞ্জ বোঝেনি তা নয়, তারা রাস্তা ছেড়ে ঘরে ঢুকে গেছে। জিত হয়েছে শেখ
হাসিনার। খালেদা জিয়াকে বোঝানো হয়েছে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
একটা সমঝোতা হবেই। আর নির্বাচন হলে তো বিএনপিই জিতবে। অতএব চিন্তার কী আছে।
ইজ্জত বাঁচিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায় এমন একটা আপস ফর্মুলা কূটনৈতিক
মহলই বের করে দেবে। বিএনপি রাস্তা থেকে ঘরে এবং ঘর থেকে ঢাকার কূটনৈতিক
মহলে এবং এখন জাতিসংঘের বান কি মুনের কাছে ধরনা দিচ্ছে। এ মাসের মাঝামাঝি
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন। সেখানে সরকারি প্রতিনিধি তো থাকবেই, তারপরও
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দু’জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করার কথা। এই সুযোগে
জাতিসংঘ চাইবে বাংলাদেশকে সংঘাত-সংকুল দেশ হিসেবে প্রমাণ করা, যে দেশ নিজের
সমস্যা নিজে সমাধান করতে পারে না; শুধু নিজের অস্তিত্বের জন্য বাংলাদেশ
বিপন্ন নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যও বাংলাদেশ হুমকি হয়ে
দাঁড়িয়েছে। ঢাকার কূটনৈতিক মহল ও জাতিসংঘ এই সিদ্ধান্তই এখন
আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার করবে। হুশিয়ার না থাকলে জাতিসংঘে দেনদরবার এমন
জায়গায় গিয়ে ঠেকতে পারে যাতে বাংলাদেশ যতটুকু সার্বভৌমত্ব আছে তাও হারিয়ে
জাতিসংঘের অধীনস্থতা মানতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে পরাশক্তির
পরাধীনতা মেনে নেয়। আর, জাতিসংঘ যদি রাজি থাকে, পরাশক্তির শাসন নিজ দেশের
সেনাবাহিনী দিয়েও কায়েম হতে পারে। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সে
জায়গায় নেবে না। কিন্তু ভরসা রাখতে পারছি না। বাংলাদেশের জনগণ যদি দ্রুত
সচেতন না হয়ে ওঠে, তাহলে বিপদ খুব দ্রুতবেগেই ধেয়ে আসবে।
বিপদই বটে। কোনো মীমাংসার আলো ছাড়া নির্বাচন কমিশনও সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে। সংসদ আগে ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন জানে, শেখ হাসিনা সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন না, তিনি পূর্ণ মেয়াদেই ক্ষমতায় থাকবেন। শেখ হাসিনা কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেবেন না। নির্বাচন কমিশন সেভাবেই অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আসছে। তবে সংবাদপত্রের খবর হিসেবে তা চাউর হয়েছে সম্প্রতি। আর, ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে। বোঝা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার কথা অনুযায়ী যা হওয়ার হয়েছে, তার কথা অনুযায়ী যা হওয়ার নির্বাচনেও তাই হবে। নির্বাচন করতে চাইলে বিরোধী দলকে এখন প্রধানমন্ত্রীর ছক মেনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে, অথবা আন্দোলনে যেতে হবে। কিন্তু বিএনপি আন্দোলনে যাবে না, যদি যেত এতদিনে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। আন্দোলনে যাবে না বলে বিএনপি জাতিসংঘে গেছে। প্রথম আলো তিন কলামে সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখে ঠিকই লিখেছে, ‘বিএনপির দৃষ্টি এখন জাতিসংঘের দিকে’। তারা বলছে, ‘সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হলেও সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে চায়।’ এটা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় না দিলেও বিএনপির মধ্যে একটি বড় অংশ বসে আছে যারা খালেদা জিয়াকে ত্যাগ করে হলেও নির্বাচনে যেতে চাইবে। তখন ঢাকার কূটনৈতিক মহল ও জাতিসংঘ বলবে, আমরা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করব। করবেনও, যাতে শেখ হাসিনা জিতে আসেন এবং বিরোধী দল এখনকার চেয়ে কিছু বেশি আসন সংসদে পেলেও পেতে পারে। এ রকম একটি সম্ভাবনা মাথায় রেখে খালেদা জিয়া কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা এ মুহূর্তে বোঝা মুশকিল। তবে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের অধীন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তিনি এখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ক্ষমতায় আসার যে চেষ্টা করছেন, সেটা তার জন্য বুমেরাং হতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্যও।
কিন্তু বিএনপি একটি নির্বাচনী দল। শেখ হাসিনা কোনো আপস না করলে নির্বাচনে যাওয়া বিরোধী দলের জন্য অমর্যাদাকর। অন্যদিকে আন্দোলন করে শেখ হাসিনার কাছ থেকে দাবি আদায় করার শক্তি বিএনপির নেই। সেটা চাইলে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আঁতাত আরও আদর্শগত জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। কিভাবে সেটা বিএনপির রাজনীতি বিসর্জন না দিয়ে করা সম্ভব, বিএনপি তা জানে না। ফলে বিএনপি ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে দূরে থাকাই উত্তম বলে গণ্য করছে। এতে হেফাজতের উত্থানে ভীত ঢাকার কূটনৈতিক মহলকে বিএনপি কিছুটা আশ্বস্ত করতে পারবে। বিএনপি ধরে নিয়েছে ইসলামপন্থীরা তাদেরই ভোট দেবে। সেটা অসম্ভব নয়। যে কারণে বিএনপি ভাবছে, যে কোনোভাবে চূড়ান্ত ছাড় দিয়ে হলেও একটা সমঝোতা হোক। যেন বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে
কোনো সংঘাত ও সংঘর্ষ ছাড়া বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অটুট রেখে নির্বাচন হোক- এটা সুশীলদেরও রাজনীতি। কূটনৈতিক তৎপরতা ও জাতিসংঘের উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশে সুশীল সমাজ নামে যারা পরিচিত, তারা যুক্ত থাকবে এটা আন্দাজ করা যায়। কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারাও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান, যেন কোন হৈ-হাঙ্গামা না হয় বিশেষত জামায়াতি, হেফাজতি, ইসলামপন্থী কিংবা কোনো ‘অশুভ’ শক্তি তাদের সাজানো বাগান যেন নাস্তানাবুদ করে না দেয়।
সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে মীমাংসার নানান ছক ও ফর্মুলা পেশ করা হচ্ছে। প্রতিভাবান প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রতিভা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। মন্দ না। শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, তিনি একচুলও নড়ছেন না। এ পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের কাজ হচ্ছে বিএনপিকে যেভাবেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ছকের মধ্যে ধরে রাখা। নির্বাচন না হলে সংঘাত ও রক্তপাতের আশংকা অমূলক নয়, শাহদীন মালিক তার কলাম ‘ইদানীং রাজনীতি’তে তার উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেছেন সিরিয়ার বর্তমান গৃহযুদ্ধের অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে। বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ঢাকা থেকে দামেস্কের দূরত্ব হয়তো অনেক বেশি। আমার কাছে অনেক কম। আর সময় তার থেকেও কম।’ তিনি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নতুন নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবও দিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রতি নয়জন নির্বাচিত মন্ত্রীর জন্য একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি মন্ত্রী হতে পারেন। এই বিধানটির সুবিধা শাহদীন মালিক নিতে চান। সেটা হবে এ রকম যে, আঠারো জনের নির্বাচিত মন্ত্রিসভার সঙ্গে দু’জন অনির্বাচিত মন্ত্রী থাকবেন। তাদের হাতে থাকবে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। নির্বাহী ক্ষমতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। আর সেই দু’জন হবেন বিএনপিরও আস্থাভাজন। এই দুই মন্ত্রীকে দলীয় মন্ত্রিসভার নাগালের বাইরে রাখা হবে আর সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। তাহলে ‘জোড়াতালির অথচ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য’ একটা ব্যবস্থা দাঁড় করানো যায়, সে প্রস্তাব তিনি পেশ করেছেন। (দেখুন ‘নির্বাচন নিয়ে জটিলতা কি বাড়ল?’ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩)। তাই বলছিলাম, নানান ফর্মুলা পেশের চেষ্টা এখনও চলছে। বাকি আল্লাহ ভরসা।
প্রবীণ সাংবাদিক দুই নেত্রীর ‘চুলোচুলি’তে খুবই শরমিন্দা হয়েছেন। আসলেই। কিন্তু তার ভয়, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে ফেলতে পারেন। এমনকি পঞ্চদশ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা গ্রহণ না করা পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেও যেতে পারেন। ‘বেগতিক’ দেখলে শেখ হাসিনা সংবিধানে নতুন সংযোজিত এ ধারার ‘কৌশলী’ ব্যবহার করতে পারেন। এবিএম মূসা এতে সঙ্গত কারণেই উদ্বিগ্ন। আর এটা যে সম্ভব, আইনবিদ শাহদীন মালিক তার লেখায় ধরিয়েও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংবিধানে জাতীয় সংসদের মেয়াদের কথা আছে, কিন্তু সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোথাও কিছু বলা নেই। অর্থাৎ সংসদ ভেঙে দিলেও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। সেটা তিনি আসলেই পারবেন কি-না সেটা রাজনৈতিক প্রশ্ন, সাংবিধানিক নয়। অর্থাৎ তার ক্ষমতায় থাকাটা অসাংবিধানিক হবে না। তবে সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক এবিএম মূসার সরল প্রস্তাব হচ্ছে, শেখ হাসিনা যদি পঞ্চদশ সংশোধনী আনতে পারেন, তাহলে ‘ষোড়শ’ সংশোধনী আনতে পারবেন না কেন? নিশ্চয়ই পারবেন, কিন্তু তিনি তো একচুলও নড়বেন না। মুশকিল তো আসলেই এখানে। (দেখুন ‘পঞ্চদশ হলে ষোড়শ নয় কেন?’ ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩)।
বাংলাদেশের বর্তমান সংকট সুশীল সমাজ কিভাবে দেখে, সেটা বোঝার জন্য সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের ‘বিএনপির বিকল্প ও মির্জার সঙ্গে এক ঘণ্টা’ লেখাটি খুবই কাজের হতে পারে। লেখাটি পড়ে আমি খুবই আনন্দবোধ করেছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ সম্পর্কে মিজানের বিশ্লেষণ হচ্ছে ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা’র সমস্যা। শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা করেন না, খালেদা জিয়াও মুজিব কন্যাকে ইজ্জত করেন না। অতএব আমরা এখন যে সংকট দেখছি সেই সংকট সৃষ্টি হতোই। ‘আমরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত না করলেও চলমান রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতো,’ পঞ্চদশ সংশোধনী শুধু বাড়তি ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এর কারণ প্রধান দুই দল এখনও পর্যন্ত পারস্পরিক ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখানোর জায়গা থেকে দূরে সরে আছে। তারা পরস্পরকে ইজ্জত করলেই এখনকার রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়ে যায়। জনাব খান মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রথম আলো একথা ‘দীর্ঘদিন ধরে’ বলে আসছে। এবিএম মূসা ও শাহদীন মালিকের বক্তব্য তাদের ব্যক্তিগত। কিন্তু মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর নিজস্ব সাংবাদিক। তিনি তাদের নীতির জায়গা থেকেই লিখে থাকেন। তার বক্তব্যকে এ কারণেই আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। গুরুত্ব দেয়া উচিতও বটে।
জনাব খানের প্রায় লেখাতেই বিএনপির বিরুদ্ধে নিন্দা ও বিষোদগার থাকে। এক্ষেত্রে প্রথম আলোর প্রধান অভিযোগ হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও ইসলামপন্থীদের সম্পর্ক। বিএনপি সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও ইসলামী জঙ্গিবাদের প্রশ্রয়দাতা ইত্যাদি। প্রথম আলোর নীতি-নির্ধারণী জায়গা গোঁড়া আওয়ামী লীগ ও দিল্লির আঞ্চলিক রাজনীতির সমর্থকদের দখলে। এই প্রথম খেয়াল করলাম বিএনপিকে আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের ‘জঙ্গিবাদের কারখানা’, ‘দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ’ লালন করা পার্টি ইত্যাদি গালির জন্য আপত্তি করা হচ্ছে। হঠাৎ প্রথম আলোর হুঁশ হয়েছে সরকারি দলের এই গালাগালি হচ্ছে, ‘একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার আÍঘাতী প্রবণতা।’ অথচ এ মহৎ কাজটি প্রথম আলো দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত করে আসছে। লেখাটির গুরুত্ব এদিক থেকেও। বিএনপির প্রতি অতিরিক্ত দরদটা সহজেই চোখে পড়ার মতো। ‘কথাটা পরিষ্কার করা উচিত যে, যখন যখন দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিকের সমর্থিত বিরোধী দলকে পাইকারিভাবে অভিযুক্ত করা হবে, তখন জাতি হিসেবে আমরা খাটো হব।’ এ সুবুদ্ধির উদয়ে আমোদিত হওয়া উচিত। এরপরই অবশ্য বলা হয়েছে, পাইকারিভাবে অভিযুক্ত করার অপরাধ বিএনপিও করেছে। কিভাবে? ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের কুৎসা রটিয়েছে বিএনপি। ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের নীতির সমালোচনা করা যাবে না। সেটা কিন্তু ‘কুৎসা’।
কিন্তু বিএনপির প্রতি সুশীল রাজনীতির মূল প্রস্তাব অন্যত্র। সেটা পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে, ‘বিএনপির উচিত শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচনে যাওয়ার বিকল্প খুলে রাখা।’ বিএনপি বা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কী করবেন সেটা আমরা জানি না, কিন্তু বিএনপি সুশীল সমাজের হাত ধরার দরকারে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে। সে সম্ভাবনা পুরো মাত্রাই বর্তমান। মির্জা জনাব খানকে এই ধারণাই দিয়েছেন যে, বিদ্যমান ‘সংবিধানের মধ্যে নির্দলীয় সরকার পেলেও তাদের চলে’। এ ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে যে, গওহর রিজভী ও শমসের মবিন খানের গোপন মিটিং আবার সচল করলে বাংলাদেশের বর্তমান সংকটের সমাধান হয়ে যাবে। বেশ।
বর্তমান নির্বাচনী সংকটের পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজ ও নির্বাচনী রাজনীতির সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আমরা পেলাম। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে বিএনপি, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই সুযোগে গণমানুষের রাজনীতি আর সুশীল রাজনীতির মধ্যে মোটা দাগের পার্থক্য সম্পর্কে দু’-একটি কথা বলে শেষ করি।
গণমানুষের রাজনীতি বনাম সুশীল রাজনীতি সুশীল বা ভদ্রলোকের সমাজ আর তাদের রাজনীতি শ্রেণী ও মতাদর্শের দিক থেকে পর্যালোচনা করা দরকার। এ কাজটি হয়নি। কিছু চেনা গণমাধ্যম, বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির সমালোচনার সস্তা রাজনীতি আমরা পরিহার করতে চাই। কারণ বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনা ছাড়া ব্যক্তি নিন্দা ও বিমূর্তভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে কোনো রণনৈতিক ও রণকৌশলগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারে না। আপাতত বলে রাখা যায়, ইংরেজিতে যাকে নিউ লিবারেলিজম বলা হয়, তারই বাংলাদেশীয় সংস্করণ হিসেবে আমরা সুশীলতাকে ব্যাখ্যা করতে পারি। লিবারেলরা গণতন্ত্রের কথা বলে, ব্যক্তির অধিকার, মানবতা ইত্যাদি মধুর সব কথাই তারা বলে, কিন্তু গণতন্ত্র বা গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে হলে বিদ্যমান গণবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা গণশক্তির বা জনগণের বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে, সেটা তারা স্বীকার করে না। অর্থাৎ গণবিরোধী রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিকল্প নেই এটা তারা মানে না; তারা দাবি করে, তাদের বেঁধে দেয়া নিয়ম মেনে, জনগণের অধিকার হরণকারী দুশমনদের তৈরি সাংবিধানিক বা আইনি ব্যবস্থার মধ্যে দেন-দরবার করে নাগরিক ও মানবিক অধিকার আদায় করা সম্ভব। সোজা কথায়, বিদ্যমান গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম রেখে, ওর খাপের মধ্যে বন্দি থেকেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এর চেয়ে অবাস্তব, অনৈতিহাসিক আর মিথ্যাচার আর কী হতে পারে। সুশীল রাজনীতির সঙ্গে গণমানুষের এক নম্বর বিরোধ এখানে।
দ্বিতীয় স্তরের বিরোধ আদর্শিক বা দার্শনিক। এ স্তরের বিরোধ সবচেয়ে প্রকট ধর্মের প্রশ্নে। সুশীল সমাজের রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্ম সম্পর্কে সুশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্য ইতিহাস ও চিন্তার দ্বারা অন্ধ। ফলে অধিকাংশ সময় তাদের ধর্মের বিরোধিতা ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণায় পর্যবসিত হয়। ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে ধর্মের যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক মোকাবেলার প্রয়োজন রয়েছে, সুশীল রাজনীতি তা মনে করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এ কালে এই মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়েছে। সুশীল রাজনীতি পরাশক্তির সূত্র মেনে মনে করে, ইসলামপন্থীদের নির্দয়ভাবে দমন করাই বাংলাদেশকে ‘সুশীল’ সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত করার একমাত্র পথ। অথচ গণমানুষের রাজনীতির কাছে ধর্ম আপদ হতে পারে না, বরং সম্পদ। সাম্রাজ্যবাদ এবং বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তরের ক্ষেত্রে ধর্ম কী ভূমিকা গ্রহণ করে, তার দ্বারাই ধর্মের রাজনৈতিক ভূমিকার বিচার হতে পারে। ধর্ম মাত্রই পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল- এই অবস্থানের পক্ষে কোনো শক্ত দার্শনিক যুক্তি নেই। কারণ তা নির্ভর করছে কিভাবে মানুষ ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের ব্যাখা করে তার ওপর।
শুধু ধর্ম নয়, এ স্তরের বিরোধ আরও গভীরে। সুশীল সমাজের ‘গণতন্ত্র’ ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করে, ফলে তা অচিরেই ব্যক্তিতান্ত্রিকতা বা ব্যক্তিপূজায় পর্যবসিত হয়। সমাজের মধ্যে কিংবা সমাজের জন্য ব্যক্তি নয়, বরং সমাজের স্বার্থ বলি দিতে হয় ব্যক্তির স্বার্থে। ব্যক্তিই সার্বভৌম ও একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। সুশীল সমাজে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারকে ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে প্রশ্রয় দেয়া হয়। ফলে শুধু সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, ব্যক্তির বিকাশও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। অন্যদিকে আবার সমাজ বা সমষ্টির বিমূর্ত স্বার্থের কথা বলে ব্যক্তির ওপর জোর খাটালে সেই সমাজও টেকে না। ব্যক্তির নিজের বিকাশ ও আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে তাকে উপলব্ধি করতে হয় যে মানুষ সমাজের মধ্যেই বাস করে, সমাজের বাইরে নয়। এ উপলব্ধি হলেই ব্যক্তি বুঝতে পারে, সমাজ বা সমষ্টির স্বার্থের মধ্যেই তার নিজের স্বার্থ নিহিত। এই উপলব্ধি ছাড়া ব্যক্তি সামাজিক হয়ে ওঠে না, কিংবা সমাজও ব্যক্তির স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এতে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়। গণশক্তি ব্যক্তির অঙ্গীকার, শক্তি ও অনেকের সঙ্গে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই গণশক্তি হয়ে ওঠে। শুরু থেকেই ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্ক চর্চার মধ্য দিয়ে গণশক্তির বিকাশ ঘটে, নইলে নয়। ব্যক্তির ইচ্ছা ও অভিপ্রায় গণশক্তির ভিত্তি। কিন্তু এই রাজনৈতিক কর্তাশক্তি জনগণের সামষ্টিক শক্তি দিয়েই পরিগঠিত হয়। এখানেই গণশক্তির রাজনীতির সঙ্গে সুশীল রাজনীতির মৌলিক আদর্শিক বা দার্শনিক ফারাক। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির পথ হচ্ছে গণশক্তির বিকাশের পথ, বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা নয়। তাকে বদলে দেয়া, তার রূপান্তর ঘটিয়ে গণশক্তিকে রাষ্ট্রশক্তিতে রূপান্তরই এখনকার কাজ।
সুশীল সমাজের রাজনীতি আওয়ামী লীগকে মাঝেমধ্যে সমালোচনা করে, কিন্তু মোটা দাগে এ রাজনীতি আওয়ামীপন্থী। তারপরও আওয়ামী লীগ ও তার অধীনে জোটভুক্ত দলগুলোর তারা সমালোচনা করে, যেন সুশীলতার মানদণ্ডের বাইরে তারা চলে না যায়। তারা চায় বিএনপিও ইসলামপন্থীদের ছেড়ে দিক, ‘সুশীল’ হয়ে উঠুক এবং তাদের সমর্থনে একটা প্রতিযোগিতামূলক সুশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলুক। বলা বাহুল্য, সুশীল রাজনীতি আÍপরিচয়ের দিক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বৃত্তের মধ্যেই বাস করে। যদিও জাতীয়তাবাদী উগ্রতায় ব্যথিত হয়ে তারা পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পক্ষে নির্বিচার ওকালতি করে, কিন্তু তাদের সমস্যার সমাধান করে না। পাহাড়িদের সমস্যা জমি এবং তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের নিঃশর্ত পক্ষাবলম্বন। কিন্তু যে রাষ্ট্র তার কোনো নাগরিকেরই অধিকার রক্ষা করে না, বরং হরণ করে সে রাষ্ট্র কিভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও তাদের অন্তর্গত বাংলাদেশের নাগরিকদের রক্ষা করবে? বাংলাদেশে গণমানুষের রাজনীতির বিকাশের অর্থ হচ্ছে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের লড়াইয়ে শামিল করে নেয়া। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সমতল বা পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
আর্থ-সামাজিক দিক থেকে সুশীল সমাজ আর গণমানুষের পার্থক্য হচ্ছে প্রকট শ্রেণীভেদ। সুশীল সমাজ মূলত ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী দিয়ে পরিগঠিত। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন ও বিদ্যমান অবাধ বাজারব্যবস্থার তারা সুবিধাভোগী। এর বিপরীতে রয়েছে নিুবিত্ত মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া জনগণ। যারা এ ব্যবস্থায় শোষিত ও নির্যাতিত। সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও মতাদর্শিকভাবে তারা দুর্বল। সাধারণত সমাজ ও ইতিহাস সচেতন বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীরা জনগণকে সংগঠিত করে, শত্র“-মিত্র চেনায় এবং বর্তমানের রাজনৈতিক কর্তব্য বুঝিয়ে দেয়। সমাজ একটা বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্তাসত্তার আবির্ভাবও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। ফলে গণমানুষের রাজনীতির বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং জাতীয় রাজনীতিতে সুশীল ছকে ঘুরপাক খেতে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে সুশীল রাজনীতির ছক থেকে বেরিয়ে আসা সহজ কাজ নয়। সুশীল রাজনীতির মোকাবেলা করতে হলে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে গণমানুষের রাজনীতির মতাদর্শিক বয়ান কী হবে? যে বয়ানের মধ্যে অবশ্যই ধর্মের ভূমিকা থাকবে। একই সঙ্গে মানবেতিহাসে ইউরোপীয় অর্জনকেও অস্বীকার করার প্রয়োজন পড়বে না। এ সত্য এখন স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জনগণের কাছে ইসলাম গত কয়েক দশকে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেভাবে হাজির হয়েছে, তাকে আর উপেক্ষা করার জো নেই।
আগেই বলেছি সুশীল সমাজের রাজনীতির বিরুদ্ধে গণমানুষের রাজনীতির বয়ান দুর্বল। কিন্তু নিপীড়িত, নির্যাতিত মজলুম জনগণ ইসলামের ঝাণ্ডা নিয়ে হাজির হলে তাতে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। ইসলামের যে বয়ান নিয়ে জনগণ সুশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তার দুর্বলতার জন্য সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা দায়ী, জনগণ নয়। কিন্তু জনগণ যখন তাদের সংঘবদ্ধ শক্তির কিছু নমুনা দেখায়, সুশীল সমাজ তাতে আতংকিত হয়ে ওঠে।
গণমানুষের রাজনীতি যারা করেন ও করবেন, তাদের কাজ হচ্ছে নির্ভয়ে কান পাতা ও সাধারণ মানুষের কথা সাধারণ মানুষের ভাষায় ও বয়ানে শোনা এবং বোঝার ক্ষমতা অর্জন করা। একে আক্ষরিকভাবে বুঝলে চলবে না। গণমানুষের ঐতিহাসিক ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ও সংকল্প বোঝা এবং ঠিক নিশানা দেখিয়ে দেয়ার ওপর নির্ভর করছে আমরা আগামী দিনে কোন দিকে যাব।
আমি সব সময়ই আশাবাদী। কারণ আমি সাধারণ মানুষের শক্তি ও ক্ষমতার ওপর নির্ভর করি। বিশেষত যখন জানি, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের অসাধারণ। রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর আর যাই হোক ডিনার পার্টি হবে না, এটা নিশ্চিত।
গণশক্তির জয় হোক।
বিপদই বটে। কোনো মীমাংসার আলো ছাড়া নির্বাচন কমিশনও সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে। সংসদ আগে ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার দিন থেকে পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন জানে, শেখ হাসিনা সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন না, তিনি পূর্ণ মেয়াদেই ক্ষমতায় থাকবেন। শেখ হাসিনা কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেবেন না। নির্বাচন কমিশন সেভাবেই অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আসছে। তবে সংবাদপত্রের খবর হিসেবে তা চাউর হয়েছে সম্প্রতি। আর, ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, সংবিধান অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে। বোঝা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার কথা অনুযায়ী যা হওয়ার হয়েছে, তার কথা অনুযায়ী যা হওয়ার নির্বাচনেও তাই হবে। নির্বাচন করতে চাইলে বিরোধী দলকে এখন প্রধানমন্ত্রীর ছক মেনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে, অথবা আন্দোলনে যেতে হবে। কিন্তু বিএনপি আন্দোলনে যাবে না, যদি যেত এতদিনে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। আন্দোলনে যাবে না বলে বিএনপি জাতিসংঘে গেছে। প্রথম আলো তিন কলামে সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখে ঠিকই লিখেছে, ‘বিএনপির দৃষ্টি এখন জাতিসংঘের দিকে’। তারা বলছে, ‘সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে হলেও সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে চায়।’ এটা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় না দিলেও বিএনপির মধ্যে একটি বড় অংশ বসে আছে যারা খালেদা জিয়াকে ত্যাগ করে হলেও নির্বাচনে যেতে চাইবে। তখন ঢাকার কূটনৈতিক মহল ও জাতিসংঘ বলবে, আমরা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করব। করবেনও, যাতে শেখ হাসিনা জিতে আসেন এবং বিরোধী দল এখনকার চেয়ে কিছু বেশি আসন সংসদে পেলেও পেতে পারে। এ রকম একটি সম্ভাবনা মাথায় রেখে খালেদা জিয়া কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা এ মুহূর্তে বোঝা মুশকিল। তবে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের অধীন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তিনি এখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ক্ষমতায় আসার যে চেষ্টা করছেন, সেটা তার জন্য বুমেরাং হতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্যও।
কিন্তু বিএনপি একটি নির্বাচনী দল। শেখ হাসিনা কোনো আপস না করলে নির্বাচনে যাওয়া বিরোধী দলের জন্য অমর্যাদাকর। অন্যদিকে আন্দোলন করে শেখ হাসিনার কাছ থেকে দাবি আদায় করার শক্তি বিএনপির নেই। সেটা চাইলে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আঁতাত আরও আদর্শগত জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। কিভাবে সেটা বিএনপির রাজনীতি বিসর্জন না দিয়ে করা সম্ভব, বিএনপি তা জানে না। ফলে বিএনপি ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে দূরে থাকাই উত্তম বলে গণ্য করছে। এতে হেফাজতের উত্থানে ভীত ঢাকার কূটনৈতিক মহলকে বিএনপি কিছুটা আশ্বস্ত করতে পারবে। বিএনপি ধরে নিয়েছে ইসলামপন্থীরা তাদেরই ভোট দেবে। সেটা অসম্ভব নয়। যে কারণে বিএনপি ভাবছে, যে কোনোভাবে চূড়ান্ত ছাড় দিয়ে হলেও একটা সমঝোতা হোক। যেন বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে।
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেই বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে
কোনো সংঘাত ও সংঘর্ষ ছাড়া বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা অটুট রেখে নির্বাচন হোক- এটা সুশীলদেরও রাজনীতি। কূটনৈতিক তৎপরতা ও জাতিসংঘের উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশে সুশীল সমাজ নামে যারা পরিচিত, তারা যুক্ত থাকবে এটা আন্দাজ করা যায়। কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারাও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান, যেন কোন হৈ-হাঙ্গামা না হয় বিশেষত জামায়াতি, হেফাজতি, ইসলামপন্থী কিংবা কোনো ‘অশুভ’ শক্তি তাদের সাজানো বাগান যেন নাস্তানাবুদ করে না দেয়।
সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে মীমাংসার নানান ছক ও ফর্মুলা পেশ করা হচ্ছে। প্রতিভাবান প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রতিভা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। মন্দ না। শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, তিনি একচুলও নড়ছেন না। এ পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের কাজ হচ্ছে বিএনপিকে যেভাবেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ছকের মধ্যে ধরে রাখা। নির্বাচন না হলে সংঘাত ও রক্তপাতের আশংকা অমূলক নয়, শাহদীন মালিক তার কলাম ‘ইদানীং রাজনীতি’তে তার উৎকণ্ঠা ব্যক্ত করেছেন সিরিয়ার বর্তমান গৃহযুদ্ধের অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে। বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ঢাকা থেকে দামেস্কের দূরত্ব হয়তো অনেক বেশি। আমার কাছে অনেক কম। আর সময় তার থেকেও কম।’ তিনি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নতুন নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবও দিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রতি নয়জন নির্বাচিত মন্ত্রীর জন্য একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি মন্ত্রী হতে পারেন। এই বিধানটির সুবিধা শাহদীন মালিক নিতে চান। সেটা হবে এ রকম যে, আঠারো জনের নির্বাচিত মন্ত্রিসভার সঙ্গে দু’জন অনির্বাচিত মন্ত্রী থাকবেন। তাদের হাতে থাকবে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। নির্বাহী ক্ষমতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। আর সেই দু’জন হবেন বিএনপিরও আস্থাভাজন। এই দুই মন্ত্রীকে দলীয় মন্ত্রিসভার নাগালের বাইরে রাখা হবে আর সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। তাহলে ‘জোড়াতালির অথচ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য’ একটা ব্যবস্থা দাঁড় করানো যায়, সে প্রস্তাব তিনি পেশ করেছেন। (দেখুন ‘নির্বাচন নিয়ে জটিলতা কি বাড়ল?’ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩)। তাই বলছিলাম, নানান ফর্মুলা পেশের চেষ্টা এখনও চলছে। বাকি আল্লাহ ভরসা।
প্রবীণ সাংবাদিক দুই নেত্রীর ‘চুলোচুলি’তে খুবই শরমিন্দা হয়েছেন। আসলেই। কিন্তু তার ভয়, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে ফেলতে পারেন। এমনকি পঞ্চদশ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা গ্রহণ না করা পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেও যেতে পারেন। ‘বেগতিক’ দেখলে শেখ হাসিনা সংবিধানে নতুন সংযোজিত এ ধারার ‘কৌশলী’ ব্যবহার করতে পারেন। এবিএম মূসা এতে সঙ্গত কারণেই উদ্বিগ্ন। আর এটা যে সম্ভব, আইনবিদ শাহদীন মালিক তার লেখায় ধরিয়েও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংবিধানে জাতীয় সংসদের মেয়াদের কথা আছে, কিন্তু সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোথাও কিছু বলা নেই। অর্থাৎ সংসদ ভেঙে দিলেও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। সেটা তিনি আসলেই পারবেন কি-না সেটা রাজনৈতিক প্রশ্ন, সাংবিধানিক নয়। অর্থাৎ তার ক্ষমতায় থাকাটা অসাংবিধানিক হবে না। তবে সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক এবিএম মূসার সরল প্রস্তাব হচ্ছে, শেখ হাসিনা যদি পঞ্চদশ সংশোধনী আনতে পারেন, তাহলে ‘ষোড়শ’ সংশোধনী আনতে পারবেন না কেন? নিশ্চয়ই পারবেন, কিন্তু তিনি তো একচুলও নড়বেন না। মুশকিল তো আসলেই এখানে। (দেখুন ‘পঞ্চদশ হলে ষোড়শ নয় কেন?’ ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩)।
বাংলাদেশের বর্তমান সংকট সুশীল সমাজ কিভাবে দেখে, সেটা বোঝার জন্য সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের ‘বিএনপির বিকল্প ও মির্জার সঙ্গে এক ঘণ্টা’ লেখাটি খুবই কাজের হতে পারে। লেখাটি পড়ে আমি খুবই আনন্দবোধ করেছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণ সম্পর্কে মিজানের বিশ্লেষণ হচ্ছে ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা’র সমস্যা। শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা করেন না, খালেদা জিয়াও মুজিব কন্যাকে ইজ্জত করেন না। অতএব আমরা এখন যে সংকট দেখছি সেই সংকট সৃষ্টি হতোই। ‘আমরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত না করলেও চলমান রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতো,’ পঞ্চদশ সংশোধনী শুধু বাড়তি ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এর কারণ প্রধান দুই দল এখনও পর্যন্ত পারস্পরিক ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখানোর জায়গা থেকে দূরে সরে আছে। তারা পরস্পরকে ইজ্জত করলেই এখনকার রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়ে যায়। জনাব খান মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রথম আলো একথা ‘দীর্ঘদিন ধরে’ বলে আসছে। এবিএম মূসা ও শাহদীন মালিকের বক্তব্য তাদের ব্যক্তিগত। কিন্তু মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর নিজস্ব সাংবাদিক। তিনি তাদের নীতির জায়গা থেকেই লিখে থাকেন। তার বক্তব্যকে এ কারণেই আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। গুরুত্ব দেয়া উচিতও বটে।
জনাব খানের প্রায় লেখাতেই বিএনপির বিরুদ্ধে নিন্দা ও বিষোদগার থাকে। এক্ষেত্রে প্রথম আলোর প্রধান অভিযোগ হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও ইসলামপন্থীদের সম্পর্ক। বিএনপি সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও ইসলামী জঙ্গিবাদের প্রশ্রয়দাতা ইত্যাদি। প্রথম আলোর নীতি-নির্ধারণী জায়গা গোঁড়া আওয়ামী লীগ ও দিল্লির আঞ্চলিক রাজনীতির সমর্থকদের দখলে। এই প্রথম খেয়াল করলাম বিএনপিকে আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের ‘জঙ্গিবাদের কারখানা’, ‘দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ’ লালন করা পার্টি ইত্যাদি গালির জন্য আপত্তি করা হচ্ছে। হঠাৎ প্রথম আলোর হুঁশ হয়েছে সরকারি দলের এই গালাগালি হচ্ছে, ‘একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার আÍঘাতী প্রবণতা।’ অথচ এ মহৎ কাজটি প্রথম আলো দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত করে আসছে। লেখাটির গুরুত্ব এদিক থেকেও। বিএনপির প্রতি অতিরিক্ত দরদটা সহজেই চোখে পড়ার মতো। ‘কথাটা পরিষ্কার করা উচিত যে, যখন যখন দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিকের সমর্থিত বিরোধী দলকে পাইকারিভাবে অভিযুক্ত করা হবে, তখন জাতি হিসেবে আমরা খাটো হব।’ এ সুবুদ্ধির উদয়ে আমোদিত হওয়া উচিত। এরপরই অবশ্য বলা হয়েছে, পাইকারিভাবে অভিযুক্ত করার অপরাধ বিএনপিও করেছে। কিভাবে? ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের কুৎসা রটিয়েছে বিএনপি। ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের নীতির সমালোচনা করা যাবে না। সেটা কিন্তু ‘কুৎসা’।
কিন্তু বিএনপির প্রতি সুশীল রাজনীতির মূল প্রস্তাব অন্যত্র। সেটা পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে, ‘বিএনপির উচিত শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচনে যাওয়ার বিকল্প খুলে রাখা।’ বিএনপি বা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কী করবেন সেটা আমরা জানি না, কিন্তু বিএনপি সুশীল সমাজের হাত ধরার দরকারে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে। সে সম্ভাবনা পুরো মাত্রাই বর্তমান। মির্জা জনাব খানকে এই ধারণাই দিয়েছেন যে, বিদ্যমান ‘সংবিধানের মধ্যে নির্দলীয় সরকার পেলেও তাদের চলে’। এ ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে যে, গওহর রিজভী ও শমসের মবিন খানের গোপন মিটিং আবার সচল করলে বাংলাদেশের বর্তমান সংকটের সমাধান হয়ে যাবে। বেশ।
বর্তমান নির্বাচনী সংকটের পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজ ও নির্বাচনী রাজনীতির সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আমরা পেলাম। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে পারে বিএনপি, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই সুযোগে গণমানুষের রাজনীতি আর সুশীল রাজনীতির মধ্যে মোটা দাগের পার্থক্য সম্পর্কে দু’-একটি কথা বলে শেষ করি।
গণমানুষের রাজনীতি বনাম সুশীল রাজনীতি সুশীল বা ভদ্রলোকের সমাজ আর তাদের রাজনীতি শ্রেণী ও মতাদর্শের দিক থেকে পর্যালোচনা করা দরকার। এ কাজটি হয়নি। কিছু চেনা গণমাধ্যম, বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির সমালোচনার সস্তা রাজনীতি আমরা পরিহার করতে চাই। কারণ বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনা ছাড়া ব্যক্তি নিন্দা ও বিমূর্তভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে কোনো রণনৈতিক ও রণকৌশলগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারে না। আপাতত বলে রাখা যায়, ইংরেজিতে যাকে নিউ লিবারেলিজম বলা হয়, তারই বাংলাদেশীয় সংস্করণ হিসেবে আমরা সুশীলতাকে ব্যাখ্যা করতে পারি। লিবারেলরা গণতন্ত্রের কথা বলে, ব্যক্তির অধিকার, মানবতা ইত্যাদি মধুর সব কথাই তারা বলে, কিন্তু গণতন্ত্র বা গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে হলে বিদ্যমান গণবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা গণশক্তির বা জনগণের বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে, সেটা তারা স্বীকার করে না। অর্থাৎ গণবিরোধী রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিকল্প নেই এটা তারা মানে না; তারা দাবি করে, তাদের বেঁধে দেয়া নিয়ম মেনে, জনগণের অধিকার হরণকারী দুশমনদের তৈরি সাংবিধানিক বা আইনি ব্যবস্থার মধ্যে দেন-দরবার করে নাগরিক ও মানবিক অধিকার আদায় করা সম্ভব। সোজা কথায়, বিদ্যমান গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম রেখে, ওর খাপের মধ্যে বন্দি থেকেই নাগরিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এর চেয়ে অবাস্তব, অনৈতিহাসিক আর মিথ্যাচার আর কী হতে পারে। সুশীল রাজনীতির সঙ্গে গণমানুষের এক নম্বর বিরোধ এখানে।
দ্বিতীয় স্তরের বিরোধ আদর্শিক বা দার্শনিক। এ স্তরের বিরোধ সবচেয়ে প্রকট ধর্মের প্রশ্নে। সুশীল সমাজের রাজনীতির মূল কথা হচ্ছে, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্ম সম্পর্কে সুশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্য ইতিহাস ও চিন্তার দ্বারা অন্ধ। ফলে অধিকাংশ সময় তাদের ধর্মের বিরোধিতা ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণায় পর্যবসিত হয়। ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে ধর্মের যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক মোকাবেলার প্রয়োজন রয়েছে, সুশীল রাজনীতি তা মনে করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এ কালে এই মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়েছে। সুশীল রাজনীতি পরাশক্তির সূত্র মেনে মনে করে, ইসলামপন্থীদের নির্দয়ভাবে দমন করাই বাংলাদেশকে ‘সুশীল’ সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত করার একমাত্র পথ। অথচ গণমানুষের রাজনীতির কাছে ধর্ম আপদ হতে পারে না, বরং সম্পদ। সাম্রাজ্যবাদ এবং বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তরের ক্ষেত্রে ধর্ম কী ভূমিকা গ্রহণ করে, তার দ্বারাই ধর্মের রাজনৈতিক ভূমিকার বিচার হতে পারে। ধর্ম মাত্রই পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল- এই অবস্থানের পক্ষে কোনো শক্ত দার্শনিক যুক্তি নেই। কারণ তা নির্ভর করছে কিভাবে মানুষ ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের ব্যাখা করে তার ওপর।
শুধু ধর্ম নয়, এ স্তরের বিরোধ আরও গভীরে। সুশীল সমাজের ‘গণতন্ত্র’ ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করে, ফলে তা অচিরেই ব্যক্তিতান্ত্রিকতা বা ব্যক্তিপূজায় পর্যবসিত হয়। সমাজের মধ্যে কিংবা সমাজের জন্য ব্যক্তি নয়, বরং সমাজের স্বার্থ বলি দিতে হয় ব্যক্তির স্বার্থে। ব্যক্তিই সার্বভৌম ও একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। সুশীল সমাজে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারকে ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে প্রশ্রয় দেয়া হয়। ফলে শুধু সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, ব্যক্তির বিকাশও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। অন্যদিকে আবার সমাজ বা সমষ্টির বিমূর্ত স্বার্থের কথা বলে ব্যক্তির ওপর জোর খাটালে সেই সমাজও টেকে না। ব্যক্তির নিজের বিকাশ ও আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে তাকে উপলব্ধি করতে হয় যে মানুষ সমাজের মধ্যেই বাস করে, সমাজের বাইরে নয়। এ উপলব্ধি হলেই ব্যক্তি বুঝতে পারে, সমাজ বা সমষ্টির স্বার্থের মধ্যেই তার নিজের স্বার্থ নিহিত। এই উপলব্ধি ছাড়া ব্যক্তি সামাজিক হয়ে ওঠে না, কিংবা সমাজও ব্যক্তির স্বাধীনতা, অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এতে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়। গণশক্তি ব্যক্তির অঙ্গীকার, শক্তি ও অনেকের সঙ্গে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই গণশক্তি হয়ে ওঠে। শুরু থেকেই ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্ক চর্চার মধ্য দিয়ে গণশক্তির বিকাশ ঘটে, নইলে নয়। ব্যক্তির ইচ্ছা ও অভিপ্রায় গণশক্তির ভিত্তি। কিন্তু এই রাজনৈতিক কর্তাশক্তি জনগণের সামষ্টিক শক্তি দিয়েই পরিগঠিত হয়। এখানেই গণশক্তির রাজনীতির সঙ্গে সুশীল রাজনীতির মৌলিক আদর্শিক বা দার্শনিক ফারাক। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির পথ হচ্ছে গণশক্তির বিকাশের পথ, বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা নয়। তাকে বদলে দেয়া, তার রূপান্তর ঘটিয়ে গণশক্তিকে রাষ্ট্রশক্তিতে রূপান্তরই এখনকার কাজ।
সুশীল সমাজের রাজনীতি আওয়ামী লীগকে মাঝেমধ্যে সমালোচনা করে, কিন্তু মোটা দাগে এ রাজনীতি আওয়ামীপন্থী। তারপরও আওয়ামী লীগ ও তার অধীনে জোটভুক্ত দলগুলোর তারা সমালোচনা করে, যেন সুশীলতার মানদণ্ডের বাইরে তারা চলে না যায়। তারা চায় বিএনপিও ইসলামপন্থীদের ছেড়ে দিক, ‘সুশীল’ হয়ে উঠুক এবং তাদের সমর্থনে একটা প্রতিযোগিতামূলক সুশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলুক। বলা বাহুল্য, সুশীল রাজনীতি আÍপরিচয়ের দিক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বৃত্তের মধ্যেই বাস করে। যদিও জাতীয়তাবাদী উগ্রতায় ব্যথিত হয়ে তারা পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পক্ষে নির্বিচার ওকালতি করে, কিন্তু তাদের সমস্যার সমাধান করে না। পাহাড়িদের সমস্যা জমি এবং তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের নিঃশর্ত পক্ষাবলম্বন। কিন্তু যে রাষ্ট্র তার কোনো নাগরিকেরই অধিকার রক্ষা করে না, বরং হরণ করে সে রাষ্ট্র কিভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও তাদের অন্তর্গত বাংলাদেশের নাগরিকদের রক্ষা করবে? বাংলাদেশে গণমানুষের রাজনীতির বিকাশের অর্থ হচ্ছে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের লড়াইয়ে শামিল করে নেয়া। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সমতল বা পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
আর্থ-সামাজিক দিক থেকে সুশীল সমাজ আর গণমানুষের পার্থক্য হচ্ছে প্রকট শ্রেণীভেদ। সুশীল সমাজ মূলত ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী দিয়ে পরিগঠিত। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন ও বিদ্যমান অবাধ বাজারব্যবস্থার তারা সুবিধাভোগী। এর বিপরীতে রয়েছে নিুবিত্ত মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও খেটে খাওয়া জনগণ। যারা এ ব্যবস্থায় শোষিত ও নির্যাতিত। সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও মতাদর্শিকভাবে তারা দুর্বল। সাধারণত সমাজ ও ইতিহাস সচেতন বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীরা জনগণকে সংগঠিত করে, শত্র“-মিত্র চেনায় এবং বর্তমানের রাজনৈতিক কর্তব্য বুঝিয়ে দেয়। সমাজ একটা বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্তাসত্তার আবির্ভাবও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। ফলে গণমানুষের রাজনীতির বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং জাতীয় রাজনীতিতে সুশীল ছকে ঘুরপাক খেতে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে সুশীল রাজনীতির ছক থেকে বেরিয়ে আসা সহজ কাজ নয়। সুশীল রাজনীতির মোকাবেলা করতে হলে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে গণমানুষের রাজনীতির মতাদর্শিক বয়ান কী হবে? যে বয়ানের মধ্যে অবশ্যই ধর্মের ভূমিকা থাকবে। একই সঙ্গে মানবেতিহাসে ইউরোপীয় অর্জনকেও অস্বীকার করার প্রয়োজন পড়বে না। এ সত্য এখন স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জনগণের কাছে ইসলাম গত কয়েক দশকে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেভাবে হাজির হয়েছে, তাকে আর উপেক্ষা করার জো নেই।
আগেই বলেছি সুশীল সমাজের রাজনীতির বিরুদ্ধে গণমানুষের রাজনীতির বয়ান দুর্বল। কিন্তু নিপীড়িত, নির্যাতিত মজলুম জনগণ ইসলামের ঝাণ্ডা নিয়ে হাজির হলে তাতে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। ইসলামের যে বয়ান নিয়ে জনগণ সুশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তার দুর্বলতার জন্য সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা দায়ী, জনগণ নয়। কিন্তু জনগণ যখন তাদের সংঘবদ্ধ শক্তির কিছু নমুনা দেখায়, সুশীল সমাজ তাতে আতংকিত হয়ে ওঠে।
গণমানুষের রাজনীতি যারা করেন ও করবেন, তাদের কাজ হচ্ছে নির্ভয়ে কান পাতা ও সাধারণ মানুষের কথা সাধারণ মানুষের ভাষায় ও বয়ানে শোনা এবং বোঝার ক্ষমতা অর্জন করা। একে আক্ষরিকভাবে বুঝলে চলবে না। গণমানুষের ঐতিহাসিক ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ও সংকল্প বোঝা এবং ঠিক নিশানা দেখিয়ে দেয়ার ওপর নির্ভর করছে আমরা আগামী দিনে কোন দিকে যাব।
আমি সব সময়ই আশাবাদী। কারণ আমি সাধারণ মানুষের শক্তি ও ক্ষমতার ওপর নির্ভর করি। বিশেষত যখন জানি, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের অসাধারণ। রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপান্তর আর যাই হোক ডিনার পার্টি হবে না, এটা নিশ্চিত।
গণশক্তির জয় হোক।
No comments