খোলাবাজারে ফরমালিন বিক্রি নিষিদ্ধ করা জরুরি by আ ব ম ফারুক
মাছ আমিষের একটি প্রধান উৎস। শ্বেতসার না
থাকায় ও সহজপাচ্য বলে সব বয়সী মানুষের জন্য এটি উপযোগী। আমাদের দৈনন্দিন
খাদ্য তালিকায় তাই মাছ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু বিগত কয়েক
বছর ধরে মাছ বিক্রেতারা মাছকে দীর্ঘসময় সংরক্ষণ করার জন্য এতে ফরমালিন
নামের একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে চলেছে। খুচরা বিক্রেতারা এজন্য
পাইকারি বিক্রেতাদের দায়ী করছে। কখনও তারা বলছে, আমদানি করা মাছগুলোতে
ফরমালিন থাকে, দেশীগুলোতে নয়। পাইকারি বিক্রেতা ও আমদানিকারকরা আবার এ
অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, খুচরা বিক্রেতারাই ফরমালিন মেশায়। কিন্তু এই
বাদানুবাদে ক্রেতাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। বাস্তব সত্য হচ্ছে, তারা
ফরমালিনযুক্ত মাছই কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
আমরা ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বড় মাছের পাশাপাশি ছোট মাছও পরীক্ষা করে দেখেছি যে, অধিকাংশ মাছের স্যাম্পলেই ফরমালিন দেয়া রয়েছে। ছোট মাছ তো আর বিদেশ থেকে আসে না। তাই এগুলোতে ফরমালিন নিশ্চয়ই আমদানিকারক পর্যায়ে মেশানো হয় না। ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ্-দৌলা যে কাজটি শুরু করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন বাজার থেকে ফরমালিনযুক্ত মাছ ব্যাপকহারে ধরে শাস্তি প্রদানের পর এখন বাজারে ফরমালিনের উৎপাত কিছুটা হলেও কমেছে বলে মনে হয়। ফরমালিন রাসায়নিকটি আগে লাশ বা প্রাণীদেহের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। এছাড়া বিভিন্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, স্টুডিও, ট্যানারি শিল্প, প্লাস্টিক কারখানায় এটি ব্যবহৃত হয়। বিদেশ থেকে তারা এটি আমদানি করে। তাদের হাত থেকে এই ফরমালিন খোলাবাজারে চলে আসছে এবং বাংলাদেশে এখন শুধু মাছই নয়, এমনকি দুধ ও বিভিন্ন ফলমূল সংরক্ষণের জন্যও ফরমালিন লুকিয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ বিশ্বের কোনো দেশেই ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ফরমালিন মেশায় না। খাদ্যসামগ্রীতে এর ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবেই নিষিদ্ধ। ফলে ক্রেতারা এসব খাদ্যসামগ্রী কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একটু সতর্ক হলে কেনার আগে ক্রেতা বুঝতে পারবেন মাছে ফরমালিন দেয়া আছে কি-না। ফরমালিন দেয়া মাছের গায়ে পিচ্ছিলভাব থাকবে না, মাছের গা খস্খসে হবে, চোখের মণি উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ না হয়ে ঘোলা আর মলিন দেখাবে, কান্খা লালের বদলে হালকা বাদামি হবে (অবশ্য অনেক বিক্রেতা ফরমালিন দেয়ার পর এটি লাল দেখানোর জন্য অন্য মাছের রক্ত কিংবা লাল রং লাগিয়ে রাখে)। রান্নার পর এই মাছে স্বাভাবিক স্বাদ পাওয়া যাবে না, বিশেষ করে মাথা ও পেটের অংশ অত্যন্ত বিস্বাদ ও রাসায়নিক গন্ধযুক্ত হবে।
একইভাবে ফরমালিন দেয়া দুধের তৈরি মিষ্টিতে দুধের স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যাবে না। তার বদলে রাসায়নিক গন্ধ ও স্বাদ পাওয়া যাবে। ফরমালিন দেয়া আঙ্গুরের গায়ে মৌমাছি বসবে না, আঙ্গুরের মিষ্টি সুগন্ধ পাওয়া যাবে না। আপেল-নাশপাতির বেলাতেও এই সুগন্ধ থাকবে না। আগে দোকানে আঙ্গুর ঝুলিয়ে রাখলে একদিন পরই আঙ্গুর একটা-দুটা খসে পড়ত। এখন ফরমালিন দেয়ার কারণে পচে না ও খসে পড়ে না। আপেল-নাশপাতিও দিনের পর দিন এ কারণেই পচে না। কোনো মাছের বা ফলের দোকানে ক্রেতার চোখ বা নাকে ঝাঁঝ লাগলে বুঝতে হবে সেখানে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়।
ফরমালিন অত্যন্ত বিষাক্ত বলে নিয়মিত ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার হওয়ার আশংকা থাকে। এছাড়া ফরমালিন খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলীর ক্ষতি করে, লিভারের এনজাইমগুলোকে নষ্ট করে এবং কিডনির কোষ নেফ্রনগুলোকে ধ্বংস করে। ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার বাড়ে, লিভার ও কিডনির নানা রকম জটিল ও দুরারোগ্য রোগ দেখা দেয়। মহিলাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করলে মাসিক ঋতুস্রাবে সমস্যা দেখা দেয়। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফরমালিন আরও ক্ষতিকর, অন্যান্য সমস্যা ছাড়াও এর কারণে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হয়। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি বলেছে, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এর আগে ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার বলেছে, ফরমালিন মানবদেহের বিভিন্ন অংশের ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালে আমেরিকার স্টেট অব ক্যালিফোর্নিয়াও ক্যান্সার সৃষ্টি করে বলে ফরমালিনকে কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বলে চিহ্নিত করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিনকে দায়ী করে (সংস্থার প্রেস বিজ্ঞপ্তি নং ১৫৩)। ২০০৫ সালের ১০ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পোস্ট পত্রিকায় ফরমালিনযুক্ত মাছ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনায় মাছ ও শুঁটকি ব্যবসায় ব্যাপক মন্দার কথা জানা যায়।
মাছ, দুধ বা ফলে যে অসৎ ব্যবসায়ী ফরমালিন মেশায়, তার জন্যও দুঃসংবাদ রয়েছে। ফরমালিন অত্যন্ত ঝাঁঝালো এবং মেশানোর সময় এর বাষ্প চোখের সংস্পর্শে এসে চোখের কর্নিয়ার ক্ষতি করে, কর্নিয়া তার স্বচ্ছতা হারিয়ে ঘোলা হয়ে যায়। এর পরিণামে ব্যবসায়ী চোখে ঝাপসা দেখে, ছানি তৈরি হয়। ফরমালিনের বাষ্প শ্বাস নেয়ার ফলে বমিভাব, মাথাব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট, হাঁপানি এবং ফুসফুস ও গলবিলে ক্যান্সার দেখা দেয়। তাছাড়া ফরমালিন পানিতে মিশিয়ে ব্যবহারের ফলে হাতের ত্বকে ঘা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে সে ঘা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে, কোনো ওষুধেই সারে না। অর্থাৎ ফরমালিনের কারণে শুধু যে ক্রেতারই ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, ব্যবসায়ীও আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা তাই ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করব ক্রেতার ও নিজেদের মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কথা ভেবে ফরমালিনের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য। সেই সঙ্গে সরকারের প্রতিও আমরা আবেদন জানাই খোলাবাজারে ফরমালিনের বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য। অবশ্য আমরা শিল্প-কারখানায় যেখানে সত্যিই প্রয়োজন সেখানে ফরমালিনের ব্যবহার বন্ধ করার কথা বলছি না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিগুলোতে স্যাম্পল সংরক্ষণের জন্য যতটুকু ফরমালিন প্রয়োজন, তা তাদের না দেয়ার কথা বলছি না। মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে ব্যবহার্য ফরমালিনও বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু খোলাবাজারে খুচরা আকারে অবাধে ফরমালিন বিক্রির কোনোই দরকার নেই। অন্য কোথাও এর কোনো ব্যবহার নেই।
ফরমালিন এ দেশে তৈরি হয় না বা চোরাচালান হয়ে ভারত থেকেও আসে না। ফরমালিন আমদানি লাইসেন্স ব্যবহার করে বিদেশ থেকে আনা হয়। তাই কোন শিল্প-কারখানা কতটুকু ফরমালিন আমদানি করল, তা সরকারের জানা আছে। এখন প্রয়োজন কতটুকু ফরমালিন ওই প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করেছে এবং কতটুকু উদ্বৃত্ত আছে তার হিসাব নেয়া। এভাবে হিসাব নিলে খোলাবাজারে ফরমালিন বিক্রি বন্ধ করা যাবে। তাছাড়া মোবাইল কোর্টগুলো মাছের বাজারে অভিযান চালানোর সময় বাজারের ওষুধের ও হার্ডওয়্যারের দোকানগুলোতে ফরমালিন বিক্রি হয় কি-না তা খুঁজে দেখতে পারে। মিটফোর্ড মার্কেটসহ সব রাসায়নিক পদার্থ বিক্রির দোকানে ফরমালিনের বিক্রি অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। আমদানি লাইসেন্স ও ব্যবহারের হিসাব ছাড়া ফরমালিনের মজুদ, বিক্রি, এমনকি বহনও নিষিদ্ধ করা হলে এবং অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে ফরমালিনের ব্যাপক ব্যবহার বন্ধ হতে পারে বলে আমরা মনে করি। আশা করি, জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে সরকার এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
আ ব ম ফারুক : অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বড় মাছের পাশাপাশি ছোট মাছও পরীক্ষা করে দেখেছি যে, অধিকাংশ মাছের স্যাম্পলেই ফরমালিন দেয়া রয়েছে। ছোট মাছ তো আর বিদেশ থেকে আসে না। তাই এগুলোতে ফরমালিন নিশ্চয়ই আমদানিকারক পর্যায়ে মেশানো হয় না। ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ্-দৌলা যে কাজটি শুরু করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন বাজার থেকে ফরমালিনযুক্ত মাছ ব্যাপকহারে ধরে শাস্তি প্রদানের পর এখন বাজারে ফরমালিনের উৎপাত কিছুটা হলেও কমেছে বলে মনে হয়। ফরমালিন রাসায়নিকটি আগে লাশ বা প্রাণীদেহের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। এছাড়া বিভিন্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, স্টুডিও, ট্যানারি শিল্প, প্লাস্টিক কারখানায় এটি ব্যবহৃত হয়। বিদেশ থেকে তারা এটি আমদানি করে। তাদের হাত থেকে এই ফরমালিন খোলাবাজারে চলে আসছে এবং বাংলাদেশে এখন শুধু মাছই নয়, এমনকি দুধ ও বিভিন্ন ফলমূল সংরক্ষণের জন্যও ফরমালিন লুকিয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ বিশ্বের কোনো দেশেই ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ফরমালিন মেশায় না। খাদ্যসামগ্রীতে এর ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবেই নিষিদ্ধ। ফলে ক্রেতারা এসব খাদ্যসামগ্রী কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একটু সতর্ক হলে কেনার আগে ক্রেতা বুঝতে পারবেন মাছে ফরমালিন দেয়া আছে কি-না। ফরমালিন দেয়া মাছের গায়ে পিচ্ছিলভাব থাকবে না, মাছের গা খস্খসে হবে, চোখের মণি উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ না হয়ে ঘোলা আর মলিন দেখাবে, কান্খা লালের বদলে হালকা বাদামি হবে (অবশ্য অনেক বিক্রেতা ফরমালিন দেয়ার পর এটি লাল দেখানোর জন্য অন্য মাছের রক্ত কিংবা লাল রং লাগিয়ে রাখে)। রান্নার পর এই মাছে স্বাভাবিক স্বাদ পাওয়া যাবে না, বিশেষ করে মাথা ও পেটের অংশ অত্যন্ত বিস্বাদ ও রাসায়নিক গন্ধযুক্ত হবে।
একইভাবে ফরমালিন দেয়া দুধের তৈরি মিষ্টিতে দুধের স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যাবে না। তার বদলে রাসায়নিক গন্ধ ও স্বাদ পাওয়া যাবে। ফরমালিন দেয়া আঙ্গুরের গায়ে মৌমাছি বসবে না, আঙ্গুরের মিষ্টি সুগন্ধ পাওয়া যাবে না। আপেল-নাশপাতির বেলাতেও এই সুগন্ধ থাকবে না। আগে দোকানে আঙ্গুর ঝুলিয়ে রাখলে একদিন পরই আঙ্গুর একটা-দুটা খসে পড়ত। এখন ফরমালিন দেয়ার কারণে পচে না ও খসে পড়ে না। আপেল-নাশপাতিও দিনের পর দিন এ কারণেই পচে না। কোনো মাছের বা ফলের দোকানে ক্রেতার চোখ বা নাকে ঝাঁঝ লাগলে বুঝতে হবে সেখানে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়।
ফরমালিন অত্যন্ত বিষাক্ত বলে নিয়মিত ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সার হওয়ার আশংকা থাকে। এছাড়া ফরমালিন খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলীর ক্ষতি করে, লিভারের এনজাইমগুলোকে নষ্ট করে এবং কিডনির কোষ নেফ্রনগুলোকে ধ্বংস করে। ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার বাড়ে, লিভার ও কিডনির নানা রকম জটিল ও দুরারোগ্য রোগ দেখা দেয়। মহিলাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করলে মাসিক ঋতুস্রাবে সমস্যা দেখা দেয়। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফরমালিন আরও ক্ষতিকর, অন্যান্য সমস্যা ছাড়াও এর কারণে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হয়। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি বলেছে, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এর আগে ১৯৮৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার বলেছে, ফরমালিন মানবদেহের বিভিন্ন অংশের ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালে আমেরিকার স্টেট অব ক্যালিফোর্নিয়াও ক্যান্সার সৃষ্টি করে বলে ফরমালিনকে কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বলে চিহ্নিত করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিনকে দায়ী করে (সংস্থার প্রেস বিজ্ঞপ্তি নং ১৫৩)। ২০০৫ সালের ১০ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পোস্ট পত্রিকায় ফরমালিনযুক্ত মাছ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনায় মাছ ও শুঁটকি ব্যবসায় ব্যাপক মন্দার কথা জানা যায়।
মাছ, দুধ বা ফলে যে অসৎ ব্যবসায়ী ফরমালিন মেশায়, তার জন্যও দুঃসংবাদ রয়েছে। ফরমালিন অত্যন্ত ঝাঁঝালো এবং মেশানোর সময় এর বাষ্প চোখের সংস্পর্শে এসে চোখের কর্নিয়ার ক্ষতি করে, কর্নিয়া তার স্বচ্ছতা হারিয়ে ঘোলা হয়ে যায়। এর পরিণামে ব্যবসায়ী চোখে ঝাপসা দেখে, ছানি তৈরি হয়। ফরমালিনের বাষ্প শ্বাস নেয়ার ফলে বমিভাব, মাথাব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট, হাঁপানি এবং ফুসফুস ও গলবিলে ক্যান্সার দেখা দেয়। তাছাড়া ফরমালিন পানিতে মিশিয়ে ব্যবহারের ফলে হাতের ত্বকে ঘা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে সে ঘা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে, কোনো ওষুধেই সারে না। অর্থাৎ ফরমালিনের কারণে শুধু যে ক্রেতারই ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, ব্যবসায়ীও আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা তাই ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করব ক্রেতার ও নিজেদের মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কথা ভেবে ফরমালিনের ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য। সেই সঙ্গে সরকারের প্রতিও আমরা আবেদন জানাই খোলাবাজারে ফরমালিনের বিক্রি বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য। অবশ্য আমরা শিল্প-কারখানায় যেখানে সত্যিই প্রয়োজন সেখানে ফরমালিনের ব্যবহার বন্ধ করার কথা বলছি না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিগুলোতে স্যাম্পল সংরক্ষণের জন্য যতটুকু ফরমালিন প্রয়োজন, তা তাদের না দেয়ার কথা বলছি না। মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে ব্যবহার্য ফরমালিনও বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু খোলাবাজারে খুচরা আকারে অবাধে ফরমালিন বিক্রির কোনোই দরকার নেই। অন্য কোথাও এর কোনো ব্যবহার নেই।
ফরমালিন এ দেশে তৈরি হয় না বা চোরাচালান হয়ে ভারত থেকেও আসে না। ফরমালিন আমদানি লাইসেন্স ব্যবহার করে বিদেশ থেকে আনা হয়। তাই কোন শিল্প-কারখানা কতটুকু ফরমালিন আমদানি করল, তা সরকারের জানা আছে। এখন প্রয়োজন কতটুকু ফরমালিন ওই প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করেছে এবং কতটুকু উদ্বৃত্ত আছে তার হিসাব নেয়া। এভাবে হিসাব নিলে খোলাবাজারে ফরমালিন বিক্রি বন্ধ করা যাবে। তাছাড়া মোবাইল কোর্টগুলো মাছের বাজারে অভিযান চালানোর সময় বাজারের ওষুধের ও হার্ডওয়্যারের দোকানগুলোতে ফরমালিন বিক্রি হয় কি-না তা খুঁজে দেখতে পারে। মিটফোর্ড মার্কেটসহ সব রাসায়নিক পদার্থ বিক্রির দোকানে ফরমালিনের বিক্রি অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। আমদানি লাইসেন্স ও ব্যবহারের হিসাব ছাড়া ফরমালিনের মজুদ, বিক্রি, এমনকি বহনও নিষিদ্ধ করা হলে এবং অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে ফরমালিনের ব্যাপক ব্যবহার বন্ধ হতে পারে বলে আমরা মনে করি। আশা করি, জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে সরকার এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
আ ব ম ফারুক : অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments