শেখ মুজিবের চোখে তার স্ত্রী by ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনাসহ কতিপয় বিদগ্ধজনের লেখালেখি, বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে আমরা আগে
জেনেছি যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছা
রেণু ছিলেন একজন নিরহংকার, নির্লোভ, ত্যাগী, কষ্টসহিষ্ণু, প্রত্যয়ী,
দৃঢ়চেতা, আদর্শ বধূ, আদর্শ পত্নী, আদর্শ ভগ্নি, আদর্শ ভাবী, আদর্শ মাতা,
আদর্শ গৃহিণী। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের রাজনীতি ও গৃহাঙ্গনে প্রেরণাদায়িনী ও
শক্তিদায়িনী। কিন্তু আমরা সম্প্রতি জানতে পারলাম, শেখ মুজিবের ‘অসমাপ্ত
আত্মজীবনী’ রচনায় প্রেরণাদায়িনীও ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা রেণু। ১৯৬৬-১৯৬৯
সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকাবস্থায় শেখ মুজিব আত্মজীবনী লিখেছেন। তার
উপক্রমনিকাতে আছে, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেল গেটে বসে বলল, বসেই তো আছ,
লেখ তোমার জীবন কাহিনী।’ লেখার ব্যাপারে শেখ মুজিব দ্বিধান্বিত ছিলেন,
কিন্তু যেদিন তার স্ত্রী তাকে লেখার জন্য কয়েকটি খাতা দিয়ে গেলেন এবং যখন
হাতে একটি মোক্ষম সুযোগ পেলেন, তখন থেকেই লিখতে বসে গেলেন। স্মৃতিনির্ভর এ
বইটিতে তিনি বহুবিধ প্রসঙ্গের অবতারণাসহ বেশ অনেক জায়গায় তার স্ত্রীর
সম্পর্কে লিখেছেন। এ দেশে বেশ কয়েকজন রাজনীতিক তাদের আত্মজীবনী লিখেছেন,
তাদের কারও কারও স্ত্রী ছিল উচ্চশিক্ষিতা, কিন্তু তাদের লেখায় স্ত্রীর কথা
তেমন আসেনি যা শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে।
শেখ মুজিবের জন্ম ১৯২০ সালে। আত্মজীবনীতে সে সময় থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সময়ের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। স্ত্রীকে শুধু তিনি বই লেখার প্রেরণাদায়িনী হিসেবে তুলে আনেননি, তাকে তুলে ধরেছেন একজন স্বামী অন্তপ্রাণ স্ত্রী হিসেবে, একজন স্নেহময়ী মা হিসেবে, একজন স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবরের প্রতি নিবেদিত ও শ্রদ্ধাবান গৃহবধূ হিসেবে, একজন কষ্ট-সহিষ্ণু, সর্বংসহা সংবেদনশীল নারী হিসেবে। আত্মজীবনীতে মুজিব লিখেছেন, ‘আমার স্ত্রীর ডাক নাম রেণু।’ অবশ্য তার পোশাকি ফজিলাতুন্নেছা নামটি বইয়ের কোথাও উল্লেখ নেই। হিসাব করে দেখা যায়, মুজিব ও তার স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান প্রায় ১০ বছর। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স তের বছর হতে পারে।’ এই বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে তিন বছর বয়সে রেণু’র পিতৃবিয়োগ ও মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কথা এসেছে। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাত ভাই। রেণুর বাবা মানে আমার শ্বশুর ও চাচা তার বাবার সামনেই মারা যান। মুসলিম আইন অনুয়ায়ী রেণু তার সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোনো চাচা না থাকায় তার দাদা (শেখ কাশেম) নাতনি ফজিলাতুন্নেছা ও তার বোন জিন্নাতুন্নেছার নামে সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। ‘রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পর ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার এই নাতনির বিবাহ দিতে হবে।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা; মুরব্বির হুকুম মানার জন্য রেণুর সঙ্গে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। রেণু তখন কিছু বুঝত না, কেননা তার বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে।’ রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান আর দাদা মারা যান ৭ বছর বয়সে। তারপর রেণু শেখ মুজিবের মা’র কাছে চলে আসেন এবং তার ননদ, দেবরদের সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির অপাত্য স্নেহে বড় হতে থাকেন। তিনি ছোটবেলায় বাবা বাবা বলে কান্নাকাটি করলে শাশুড়ি জবাব দিতেন এবং পরবর্তীকালে রেণু শাশুড়িকে বাবা বলে ডাকতেন বলে শোনা যায়। ১৯৩৩ সালে তাদের বিয়ে হলেও শেখ মুজিবের লেখা থেকে জানা যায়, তাদের ফুলসজ্জা হয়েছিল ১৯৪২ সালে।
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তার লেখাপড়া, রাজনীতি ও কলকাতা-ঢাকার জীবনের কথা লিখেছেন। তিনি পড়াশুনার জন্য আব্বা-মা উভয়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন। তদুপরি তিনি পড়াশুনা ও রাজনীতির আংশিক খরচ এমনকি সিগারেট খাওয়ার টাকাও স্ত্রীর কাছ থেকে নিতেন। এই টাকা নেয়ার কথাটা আত্মজীবনীতে এবং বিশেষত রেণু প্রসঙ্গে বেশ কয়েকবার এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আব্বা-আম্মা ছাড়াও সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলেই আমাকে দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্য রাখত।’
টাকা প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আব্বা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্র“জল’ বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ রেখেছে। তবে এবারে একটু অনুযোগের স্বরে বললেন, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না, এবার কলেজ ছুটি হলে বাড়ি এসো।’ টাকা-পয়সার কথা বইয়ের আরও একাধিক জায়গায় এসেছে। বাঙালি জীবনে বাবা-মা, বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে পড়াশুনা করার জন্য অর্থ নেয়াটি তেমন বিরল ঘটনা নয়। বিরল ঘটনা হচ্ছে স্ত্রীর অর্থে পড়াশুনা ও রাজনীতির জন্য টাকা নেয়ার বিষয়টা। আরও বিরল ঘটনা হল তা অকপটে, অসংকোচে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ। শেখ মুজিব বলে কথা, তাই এমন দ্বিধাহীনভাবে তিনি তা প্রকাশ করেছেন। টাকা-পয়সাই নয়, সশরীরে বিএ পরীক্ষার সময় উপস্থিত হয়ে তিনি স্বামীকে প্রণোদনা দিয়েছেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘রেণু কলকাতায় এসে হাজির, কেননা রেণুর ধারণা পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব, বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।’
মুজিব ছিলেন মনে-প্রাণে রাজনীতিবিদ। সেকালে রাজনীতিকে তেমন ভালো চোখে দেখা হতো না বলে স্বামীর রাজনীতিকে স্ত্রীরা কেউই সহজভাবে মেনে নিতেন না। জেলে যাওয়াটা ছিল আরও অগ্রহণযোগ্য বিষয়। শেখ মুজিব বঙ্গশার্দুল বা বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার আগে বেশ কয়েকবার জেলে গেছেন। কিন্তু তার পতœী তাকে কখনও রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বলেননি। তিনি বলতেন, রাজনীতি কর আপত্তি নেই, কিন্তু পড়াশুনাটি করবে। তারপরও যখন রাজনীতির কারণে সঠিকার্থে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে আমরণ অনশন করছিলেন তখন রেণু বললেন, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ।’ পৃথিবীতে যে নারীর কেউ নেই, ছোটবেলায় মা-বাবা-দাদা মারা গেছেন, তার পক্ষে স্বামীকে কণ্টক রাজনীতির ব্ল্যাঙ্ক চেক দেয়া কঠিন ছিল। সে কঠিন কাজটি করেছিলেন একজন অবলা, অনাথ, স্বল্পশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, গ্রামীণ মহিলা। এখানে তার দূরদর্শিতার পরিচয়ও মেলে। স্বামীকে এভাবে সামনে ঠেলে না দিলে তিনি তার স্বামীই থাকতেন; শেখ হাসিনা, জামাল, কামাল, রেহানা, রাসেলের পিতা থাকতেন, বঙ্গপিতা হতেন না। আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে, শেখ মুজিব কলকাতা থেকে ঢাকা এসে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তার ল’পড়া হল না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরজীবনের জন্য বহিষ্কৃত হলেন। তার পিতা ঠিকই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানালেন। তিনি টাকা-পয়সা দিতে চান না। ‘কিন্তু রেণু কিছুই বলে না। নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে।’ এই কষ্ট সহ্য করাটা যেন বিধির বিধান। শিশুবেলা থেকেই কষ্ট সহনে অভ্যস্ত রেণু আমৃত্যু সর্বংসহাই ছিলেন।
শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতে আরও অনেক কথাই বলেছেন, যা এই প্রজন্মর কাছে কেন আমাদের মতো প্রজন্মর কাছেও অজানা। এমন একটি অজানা কথা এসেছে তার প্রথমবার মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কালে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে খবরটি গভীর রাতের আগে স্ত্রীকে জানাতে পারেননি, কেননা তিনি ছিলেন বাঙালি-বিহারি দাঙা দমনে ব্যাপৃত। তিনি লিখেছেন, ‘রাত চার ঘটিকায় বাড়িতে পৌঁছলাম, শপথ নেয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়েনি। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য।’ আজকালকার দিনে কোনো মন্ত্রী দানাপানি পেটে না পেলে ২৪ ঘণ্টা কাজ করবেন আর তার স্ত্রী বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিবেন, তা দুর্লভ না হলেও সুলভ নয়।
রেণুর এই শিক্ষাই হয়তো তাকে আরও বহু কিছু শিখিয়েছে, কোনো কালে কি কেউ শুনেছেন যে, মন্ত্রীর পত্নী নিজের সংসারের ব্যয়ভার বহনের জন্য বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসেছেন কিংবা কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর তার স্ত্রী ভাড়া বাড়ির খোঁজে রাস্তায় নামছেন। শেখ মুজিবের পতœী রেণু এসব নির্দ্বিধায় ও বিনা বাক্যব্যয়ে করেছেন।
১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হন, তবে তার মন্ত্রিত্বের আয়ু ছিল ক্ষণস্থায়ী। ৯২(ক) ধারা জারি হলে তিনি লিখেছেন, ‘বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভালো করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিসভা ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলোও খরচ করে ফেলেছ।’
তারপর বাড়িতে পুলিশ এসেছে। পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে মন্ত্রী রিকশায় চড়ে বাসায় ডুকেছেন। এর পরে অবার জেলের প্রস্তুতি। আমরা জানি যে, রেণু তার স্বামীর কাপড়-চোপড় আমৃত্যু সুন্দর করে গুছিয়ে দিতেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘রেণু আমাকে খেতে বলল। রেণু আমার সবকিছু ঠিকঠাক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। রেণুকে বললাম তোমাকে কি বলে যাব, যা ভালো বোঝ কর।’ নিজের স্ত্রীর সক্ষমতা ও কর্ম কৌশলতার প্রতি কতটা দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে সব দায়িত্ব তার কাঁধে চাপিয়ে হাসিমুখে জেলে যেতে পারতেন শেখ মুজিব।
স্বামী-সন্তানের প্রতি যেমন, তেমনি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতিও রেণুর ছিল অনন্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। তাদের অসুখ-বিসুখে কাছে থাকা ছিল তার রুটিন কাজ। সেদিনের একটি ঘটনা শেখ মুজিবের লেখায় এসেছে। তিনি তখন জেলে, তার বাবা অসুস্থ। শ্বশুরের অসুস্থতার খবর টেলিগ্রাম মারফত পেয়ে রেণু বাড়িতে ছোটেন। তবে যাওয়ার কালে টেলিগ্রামের কপিটি সংযুক্ত করে শেখ মুজিবের মুক্তির আবেদন করে যান। যার ভিত্তিতে শেখ মুজিবকে মুক্তিও দেয়া হল। রেণু যে শুধু তার প্রতি বা তার নিকটজনের প্রতি সংবেদনশীল ও মানবিক ছিলেন তা নয়, তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতিও অতিশয় সংবেদনশীল ছিলেন, তার প্রমাণও নেতার লেখায় মেলে। তিনি মাদারীপুর বোনের বাড়ি যাচ্ছিলেন- দু’জন শুভাকাক্সক্ষী সহযাত্রী সঙ্গে ছিলেন। শীতের রাতে তাদের কোনো চাদর না থাকায় কষ্টের অন্ত ছিল না। রেণু তার নিজের গায়ের চাদর খুলে তাদের দিয়েছিলেন।
এসবই ১৯৫৫ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলীর অংশবিশেষ। তারপর ১৯৫৫ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত মুজিব জীবনের ঘটনাপুঞ্জি চমকপ্রদ। সেখানে তার পত্নীর অবস্থান, কিন্তু তার বয়ানে শোনার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে লোকমুখে শুনে, অল্প-স্বল্প লেখালেখি পড়ে জানতে পারি, ‘বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের উপেক্ষিত উর্মিলা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শিশু বয়সে বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঘরণী হয়ে আসেন। এই অবুঝ, অবলা, অনাথ মেয়েটিই কালে মহাকাব্যের মূলনায়ক মুজিবের প্রধান চালিকারূপে আবির্ভূত হন। নীরবে, নিভৃতে এই মহিলা স্বামীসেবা, সন্তান লালন, পিতৃতুল্য শ্বশুর, দেবর-ননদ সবারই পরিচর্যা করেছেন। তদুপরি ফজিলাতুন্নেছা মুজির গৃহাভ্যন্তরে এমন একটি পরিবেশ উপহার দিয়েছিলেন, যার ফলে নেতা মুজিব দুর্গমগিরি, দুস্তর পারাবার পাড়ি দিতে পেরেছিলেন। নিশ্চিন্তে তার সংগঠন ও জনগণের সেবায় নিজের মূল্যবান জীবনও বিসর্জন দিতে পেরেছিলেন। তীক্ষè বুদ্ধি ও দক্ষতার অধিকারী এই মহিলা পরিণত বয়সে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ও তথ্যের আধার ছিলেন। স্বামীর সুষ্ঠু সিদ্ধান্তে মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতা ছাড়াও তার দেয়া তথ্য নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে সহায়ক হয়েছে। অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মহাপ্রয়াণ মহিলা ছিলেন রীতিমতো চুম্বকের মতো। একই সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবের পত্নী, প্রধানমন্ত্রীর বেগম, রাষ্ট্রপতির মহীয়সী ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে শ্যেন দৃষ্টি সম্পন্না এক মহিলা, নেতা মুজিবের defacto friend, philosopher and guide.
অচিরেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা ও ডায়েরির কাজ শেষ হলে আমরা এ সম্পর্কে আরও বহু কিছু জানতে পারব। আমরা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারব যে, তার দাম্পত্য জীবনে বেগম ফজিলাতুন্নেছার ন্যায় এমন ধীরস্থির প্রাজ্ঞ, সর্বংসহা বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী ও স্বামী অন্তপ্রাণ মহিলার আর্বিভাব না হলে শেখ মুজিব বঙ্গশার্দুল, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা বা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হতেন না কিংবা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌমের জš§ হতো না।
ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিষদের সভাপতি
শেখ মুজিবের জন্ম ১৯২০ সালে। আত্মজীবনীতে সে সময় থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সময়ের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। স্ত্রীকে শুধু তিনি বই লেখার প্রেরণাদায়িনী হিসেবে তুলে আনেননি, তাকে তুলে ধরেছেন একজন স্বামী অন্তপ্রাণ স্ত্রী হিসেবে, একজন স্নেহময়ী মা হিসেবে, একজন স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবরের প্রতি নিবেদিত ও শ্রদ্ধাবান গৃহবধূ হিসেবে, একজন কষ্ট-সহিষ্ণু, সর্বংসহা সংবেদনশীল নারী হিসেবে। আত্মজীবনীতে মুজিব লিখেছেন, ‘আমার স্ত্রীর ডাক নাম রেণু।’ অবশ্য তার পোশাকি ফজিলাতুন্নেছা নামটি বইয়ের কোথাও উল্লেখ নেই। হিসাব করে দেখা যায়, মুজিব ও তার স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান প্রায় ১০ বছর। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স তের বছর হতে পারে।’ এই বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে তিন বছর বয়সে রেণু’র পিতৃবিয়োগ ও মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কথা এসেছে। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘রেণুর দাদা আমার দাদার চাচাত ভাই। রেণুর বাবা মানে আমার শ্বশুর ও চাচা তার বাবার সামনেই মারা যান। মুসলিম আইন অনুয়ায়ী রেণু তার সম্পত্তি পায় না। রেণুর কোনো চাচা না থাকায় তার দাদা (শেখ কাশেম) নাতনি ফজিলাতুন্নেছা ও তার বোন জিন্নাতুন্নেছার নামে সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। ‘রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পর ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার এই নাতনির বিবাহ দিতে হবে।’ রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা; মুরব্বির হুকুম মানার জন্য রেণুর সঙ্গে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। রেণু তখন কিছু বুঝত না, কেননা তার বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে।’ রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান আর দাদা মারা যান ৭ বছর বয়সে। তারপর রেণু শেখ মুজিবের মা’র কাছে চলে আসেন এবং তার ননদ, দেবরদের সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির অপাত্য স্নেহে বড় হতে থাকেন। তিনি ছোটবেলায় বাবা বাবা বলে কান্নাকাটি করলে শাশুড়ি জবাব দিতেন এবং পরবর্তীকালে রেণু শাশুড়িকে বাবা বলে ডাকতেন বলে শোনা যায়। ১৯৩৩ সালে তাদের বিয়ে হলেও শেখ মুজিবের লেখা থেকে জানা যায়, তাদের ফুলসজ্জা হয়েছিল ১৯৪২ সালে।
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তার লেখাপড়া, রাজনীতি ও কলকাতা-ঢাকার জীবনের কথা লিখেছেন। তিনি পড়াশুনার জন্য আব্বা-মা উভয়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন। তদুপরি তিনি পড়াশুনা ও রাজনীতির আংশিক খরচ এমনকি সিগারেট খাওয়ার টাকাও স্ত্রীর কাছ থেকে নিতেন। এই টাকা নেয়ার কথাটা আত্মজীবনীতে এবং বিশেষত রেণু প্রসঙ্গে বেশ কয়েকবার এসেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আব্বা-আম্মা ছাড়াও সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলেই আমাকে দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্য রাখত।’
টাকা প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আব্বা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্র“জল’ বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ রেখেছে। তবে এবারে একটু অনুযোগের স্বরে বললেন, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না, এবার কলেজ ছুটি হলে বাড়ি এসো।’ টাকা-পয়সার কথা বইয়ের আরও একাধিক জায়গায় এসেছে। বাঙালি জীবনে বাবা-মা, বড় ভাই-বোনদের কাছ থেকে পড়াশুনা করার জন্য অর্থ নেয়াটি তেমন বিরল ঘটনা নয়। বিরল ঘটনা হচ্ছে স্ত্রীর অর্থে পড়াশুনা ও রাজনীতির জন্য টাকা নেয়ার বিষয়টা। আরও বিরল ঘটনা হল তা অকপটে, অসংকোচে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ। শেখ মুজিব বলে কথা, তাই এমন দ্বিধাহীনভাবে তিনি তা প্রকাশ করেছেন। টাকা-পয়সাই নয়, সশরীরে বিএ পরীক্ষার সময় উপস্থিত হয়ে তিনি স্বামীকে প্রণোদনা দিয়েছেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘রেণু কলকাতায় এসে হাজির, কেননা রেণুর ধারণা পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব, বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।’
মুজিব ছিলেন মনে-প্রাণে রাজনীতিবিদ। সেকালে রাজনীতিকে তেমন ভালো চোখে দেখা হতো না বলে স্বামীর রাজনীতিকে স্ত্রীরা কেউই সহজভাবে মেনে নিতেন না। জেলে যাওয়াটা ছিল আরও অগ্রহণযোগ্য বিষয়। শেখ মুজিব বঙ্গশার্দুল বা বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার আগে বেশ কয়েকবার জেলে গেছেন। কিন্তু তার পতœী তাকে কখনও রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বলেননি। তিনি বলতেন, রাজনীতি কর আপত্তি নেই, কিন্তু পড়াশুনাটি করবে। তারপরও যখন রাজনীতির কারণে সঠিকার্থে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে আমরণ অনশন করছিলেন তখন রেণু বললেন, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ।’ পৃথিবীতে যে নারীর কেউ নেই, ছোটবেলায় মা-বাবা-দাদা মারা গেছেন, তার পক্ষে স্বামীকে কণ্টক রাজনীতির ব্ল্যাঙ্ক চেক দেয়া কঠিন ছিল। সে কঠিন কাজটি করেছিলেন একজন অবলা, অনাথ, স্বল্পশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, গ্রামীণ মহিলা। এখানে তার দূরদর্শিতার পরিচয়ও মেলে। স্বামীকে এভাবে সামনে ঠেলে না দিলে তিনি তার স্বামীই থাকতেন; শেখ হাসিনা, জামাল, কামাল, রেহানা, রাসেলের পিতা থাকতেন, বঙ্গপিতা হতেন না। আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে, শেখ মুজিব কলকাতা থেকে ঢাকা এসে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তার ল’পড়া হল না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরজীবনের জন্য বহিষ্কৃত হলেন। তার পিতা ঠিকই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানালেন। তিনি টাকা-পয়সা দিতে চান না। ‘কিন্তু রেণু কিছুই বলে না। নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে।’ এই কষ্ট সহ্য করাটা যেন বিধির বিধান। শিশুবেলা থেকেই কষ্ট সহনে অভ্যস্ত রেণু আমৃত্যু সর্বংসহাই ছিলেন।
শেখ মুজিব তার আত্মজীবনীতে আরও অনেক কথাই বলেছেন, যা এই প্রজন্মর কাছে কেন আমাদের মতো প্রজন্মর কাছেও অজানা। এমন একটি অজানা কথা এসেছে তার প্রথমবার মন্ত্রিত্ব গ্রহণের কালে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে খবরটি গভীর রাতের আগে স্ত্রীকে জানাতে পারেননি, কেননা তিনি ছিলেন বাঙালি-বিহারি দাঙা দমনে ব্যাপৃত। তিনি লিখেছেন, ‘রাত চার ঘটিকায় বাড়িতে পৌঁছলাম, শপথ নেয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়েনি। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য।’ আজকালকার দিনে কোনো মন্ত্রী দানাপানি পেটে না পেলে ২৪ ঘণ্টা কাজ করবেন আর তার স্ত্রী বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিবেন, তা দুর্লভ না হলেও সুলভ নয়।
রেণুর এই শিক্ষাই হয়তো তাকে আরও বহু কিছু শিখিয়েছে, কোনো কালে কি কেউ শুনেছেন যে, মন্ত্রীর পত্নী নিজের সংসারের ব্যয়ভার বহনের জন্য বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসেছেন কিংবা কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর তার স্ত্রী ভাড়া বাড়ির খোঁজে রাস্তায় নামছেন। শেখ মুজিবের পতœী রেণু এসব নির্দ্বিধায় ও বিনা বাক্যব্যয়ে করেছেন।
১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হন, তবে তার মন্ত্রিত্বের আয়ু ছিল ক্ষণস্থায়ী। ৯২(ক) ধারা জারি হলে তিনি লিখেছেন, ‘বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভালো করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিসভা ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলোও খরচ করে ফেলেছ।’
তারপর বাড়িতে পুলিশ এসেছে। পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে মন্ত্রী রিকশায় চড়ে বাসায় ডুকেছেন। এর পরে অবার জেলের প্রস্তুতি। আমরা জানি যে, রেণু তার স্বামীর কাপড়-চোপড় আমৃত্যু সুন্দর করে গুছিয়ে দিতেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘রেণু আমাকে খেতে বলল। রেণু আমার সবকিছু ঠিকঠাক করে দিল এবং কাঁদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। রেণুকে বললাম তোমাকে কি বলে যাব, যা ভালো বোঝ কর।’ নিজের স্ত্রীর সক্ষমতা ও কর্ম কৌশলতার প্রতি কতটা দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে সব দায়িত্ব তার কাঁধে চাপিয়ে হাসিমুখে জেলে যেতে পারতেন শেখ মুজিব।
স্বামী-সন্তানের প্রতি যেমন, তেমনি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতিও রেণুর ছিল অনন্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। তাদের অসুখ-বিসুখে কাছে থাকা ছিল তার রুটিন কাজ। সেদিনের একটি ঘটনা শেখ মুজিবের লেখায় এসেছে। তিনি তখন জেলে, তার বাবা অসুস্থ। শ্বশুরের অসুস্থতার খবর টেলিগ্রাম মারফত পেয়ে রেণু বাড়িতে ছোটেন। তবে যাওয়ার কালে টেলিগ্রামের কপিটি সংযুক্ত করে শেখ মুজিবের মুক্তির আবেদন করে যান। যার ভিত্তিতে শেখ মুজিবকে মুক্তিও দেয়া হল। রেণু যে শুধু তার প্রতি বা তার নিকটজনের প্রতি সংবেদনশীল ও মানবিক ছিলেন তা নয়, তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতিও অতিশয় সংবেদনশীল ছিলেন, তার প্রমাণও নেতার লেখায় মেলে। তিনি মাদারীপুর বোনের বাড়ি যাচ্ছিলেন- দু’জন শুভাকাক্সক্ষী সহযাত্রী সঙ্গে ছিলেন। শীতের রাতে তাদের কোনো চাদর না থাকায় কষ্টের অন্ত ছিল না। রেণু তার নিজের গায়ের চাদর খুলে তাদের দিয়েছিলেন।
এসবই ১৯৫৫ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলীর অংশবিশেষ। তারপর ১৯৫৫ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত মুজিব জীবনের ঘটনাপুঞ্জি চমকপ্রদ। সেখানে তার পত্নীর অবস্থান, কিন্তু তার বয়ানে শোনার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে লোকমুখে শুনে, অল্প-স্বল্প লেখালেখি পড়ে জানতে পারি, ‘বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের উপেক্ষিত উর্মিলা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শিশু বয়সে বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঘরণী হয়ে আসেন। এই অবুঝ, অবলা, অনাথ মেয়েটিই কালে মহাকাব্যের মূলনায়ক মুজিবের প্রধান চালিকারূপে আবির্ভূত হন। নীরবে, নিভৃতে এই মহিলা স্বামীসেবা, সন্তান লালন, পিতৃতুল্য শ্বশুর, দেবর-ননদ সবারই পরিচর্যা করেছেন। তদুপরি ফজিলাতুন্নেছা মুজির গৃহাভ্যন্তরে এমন একটি পরিবেশ উপহার দিয়েছিলেন, যার ফলে নেতা মুজিব দুর্গমগিরি, দুস্তর পারাবার পাড়ি দিতে পেরেছিলেন। নিশ্চিন্তে তার সংগঠন ও জনগণের সেবায় নিজের মূল্যবান জীবনও বিসর্জন দিতে পেরেছিলেন। তীক্ষè বুদ্ধি ও দক্ষতার অধিকারী এই মহিলা পরিণত বয়সে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ও তথ্যের আধার ছিলেন। স্বামীর সুষ্ঠু সিদ্ধান্তে মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতা ছাড়াও তার দেয়া তথ্য নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে সহায়ক হয়েছে। অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মহাপ্রয়াণ মহিলা ছিলেন রীতিমতো চুম্বকের মতো। একই সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবের পত্নী, প্রধানমন্ত্রীর বেগম, রাষ্ট্রপতির মহীয়সী ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে শ্যেন দৃষ্টি সম্পন্না এক মহিলা, নেতা মুজিবের defacto friend, philosopher and guide.
অচিরেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা ও ডায়েরির কাজ শেষ হলে আমরা এ সম্পর্কে আরও বহু কিছু জানতে পারব। আমরা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারব যে, তার দাম্পত্য জীবনে বেগম ফজিলাতুন্নেছার ন্যায় এমন ধীরস্থির প্রাজ্ঞ, সর্বংসহা বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী ও স্বামী অন্তপ্রাণ মহিলার আর্বিভাব না হলে শেখ মুজিব বঙ্গশার্দুল, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা বা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হতেন না কিংবা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌমের জš§ হতো না।
ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিষদের সভাপতি
No comments