জনগণ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই চায় by ড. কাজী আবদুস সামাদ
এ বিষয়ে এর আগে দেশে-বিদেশে, প্রিন্ট
মিডিয়ায়, টিভি টকশো’তে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত
দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই চালু ছিল। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার
৯০ দিনের পরিবর্তে ২ বছর ক্ষমতাসীন হওয়ার খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি হওয়ায়
বর্তমান ১৪ দলীয় মহাজোট সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ব্যবস্থা বাতিল করেছে। মহাজোট সরকারের মূল যুক্তি হল, আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক
সরকার যে ২ বছর কিংবা তার চেয়েও দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন হবে না, তার নিশ্চয়তা
কোথায়? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধীদলীয় নেত্রী আবার যে দীর্ঘ সময়ের
জন্য জেলে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
বিষয়টি এর আগে হাইকোর্টে তোলে বর্তমান মহাজোট সরকার। হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ, তবে চলমান রাজনৈতিক পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার কারণে আরও দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হতে পারে। হাইকোর্ট সম্ভবত এটা ভেবেছে যে, আগামী দুই বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা তৈরি হবে, যাতে পরবর্তী সময়ে আর তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন না পড়ে। মহাজোট সরকার আদালতের পর্যবেক্ষণের প্রথম অংশকে গ্রহণ করে দ্বিতীয় অংশকে গুরুত্ব না দিয়ে সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এখন আমরা একটু পেছন ফিরে তাকাই। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এর পর ১৯৯৩ সাল থেকেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আন্দোলন করতে থাকে। এই একটি মাত্র ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল দিয়ে দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। বিএনপি ক্রমাগতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করলেও আন্দোলনে ভাটা পড়েনি আওয়ামী লীগের। তখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু তার নৎধরহ পযরষফ. চাপের মুখে বিএনপি অতঃপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নেয় এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অগোছালো, অপ্রস্তুত বিএনপি পরাজয় বরণ করে এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী মহাজোটের শরিকদের নিয়ে গঠন করে মন্ত্রিসভা। মহাজোট তাতে আরও শক্তিশালী হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে দুইবার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে। অর্থাৎ গত ২০ বছর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাতেই এবং কোনো দলই এ ব্যবস্থাতে নির্বাচন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে মনে করেন দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ।
বিএনপি বিগত ৪ বছর ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছে। এই দলটি ১৭৩ দিন হরতাল না দিলেও নানাভাবে, বিভিন্ন কৌশলে, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি বাঁচিয়ে রেখেছে। বিএনপির বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের নেতা একে কেন্দ্র করে বারবার কারানির্যাতিত হয়েছেন। বিএনপি যত কার্যকরভাবেই আন্দোলন চালিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার তত কঠোরভাবে বিএনপির আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আশা-নিরাশার দোলায় আন্দোলিত হয়েছে রাজপথ। রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সংসদ ভবন এলাকা ও রাজধানীর অন্যান্য জায়গা। বিষয়টি এখনও ফয়সালা হয়নি। যার যার অবস্থানে আছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি। ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রথমে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এবং এর কয়েকদিন পর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। প্রথমে চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পর ক্ষমতাসীনদের নজর পড়ে গাজীপুর নির্বাচনে। এখানে সরকার তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেও আরও বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হন সরকার সমর্থিত প্রার্থী। বিরোধী দল এখন বলছে, পাঁচ-পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে রায় পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনোক্রমেই বিরোধী দল নির্বাচনে যাবে না এবং নির্বাচন হতেও দেবে না। সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি এ অবস্থানে আটকে আছে আগামী নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা। কয়েকটি প্রশ্ন এখানে প্রণিধানযোগ্য যথা- যে আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর হরতাল ধর্মঘট করে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে বিরোধী দলকে বাধ্য করল, সেই আওয়ামী লীগ এখন ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে এর বিপরীত অবস্থান নিচ্ছে কেন? যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তার নৎধরহ পযরষফ, তিনি এখন সেখান থেকে সরে আসছেন কেন? যে আওয়ামী লীগ বলেছিল, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কোনো সরকার ব্যবস্থার অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না এবং নির্বাচন হতেও দেবে না, সেই আওয়ামী লীগ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে আসছে কেন? তত্ত্বাবধায়কে তাদের এত ভয় কিসের? নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে কোনো পক্ষেরই তো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই- যেটার জন্য তারা এত আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ যেহেতু বিএনপিকে আস্থায় ও বিশ্বাসে আনতে পারেনি, বিএনপিও একইভাবে আওয়ামী লীগকে আস্থায় নিতে পারছে না। আওয়ামী লীগ তখন যে অজুহাত দেখিয়েছিল, বিএনপি এখন সেই একই অজুহাত দেখাচ্ছে। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করায় বিএনপি আরও আশাবাদী হয়ে উঠেছে এবং তাদের তত্ত্বাবধায়কের দাবি আরও সুসংগঠিত, বেগবান ও জোরদার হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যদি একটি নির্বাচনমুখী ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ দল হয়, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় তো তাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আওয়ামী লীগ দু’-দু’বার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করেই। তাই এ পদ্ধতিতে তাদের আপত্তির কারণ জনগণ বুঝতে পারছে না। আওয়ামী লীগই তো এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বিএনপি সরকারকে তখন বাধ্য করেছিল। শেখ হাসিনা তার নৎধরহ পযরষফ-কে মেরে ফেলতে চাইছেন কেন? নব্বইয়ের পর এযাবৎকালে দু’বার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে দুই দলই। এবার ভোটের আভাস দেখেও মনে হয় বিএনপির একটি সুযোগ আসতে পারে। তাই কি আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার চিন্তা করছে, যাতে তারা কলকাঠি নাড়িয়ে তৃতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে পারে? এর ফলাফল দু’রকম হতে পারে- ১. বিএনপি আস্থাহীনতার কারণে নির্বাচন বয়কট করতে পারে। ফলে নির্বাচন হবে একতরফা। ২. তত্ত্বাবধায়ক দাবি মেনে নিলে শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় নির্বাচন সুসম্পন্ন হতে পারে। এ বাস্তবতায় জাতির কল্যাণে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু মেনে নিয়ে সরকার যত তাড়াতাড়ি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে, ততই দেশ ও জাতি বিশাল এক সংকট কাটিয়ে উঠবে। বিভিন্ন জরিপেও দেখা যায়, দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। এই বাস্তবতা আওয়ামী লীগ যত তাড়াতাড়ি হƒদয়ঙ্গম করতে পারবে, ততই সবার মঙ্গল। এর বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হবে না। কারণ গণরায় তখন তাদের পক্ষে যাবে না।
তাই আওয়ামী লীগ জনতার মতামত, গণতন্ত্র, দেশ, জাতি ও আগামী প্রজর প্রতি লক্ষ্য রেখে যত তাড়াতাড়ি কার্যকর ব্যবস্থা (সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল) নেবে, ততই মঙ্গল। নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন ব্যবস্থাই এখন সময়ের দাবি।
ড. কাজী আবদুস সামাদ : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়টি এর আগে হাইকোর্টে তোলে বর্তমান মহাজোট সরকার। হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ, তবে চলমান রাজনৈতিক পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার কারণে আরও দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হতে পারে। হাইকোর্ট সম্ভবত এটা ভেবেছে যে, আগামী দুই বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা তৈরি হবে, যাতে পরবর্তী সময়ে আর তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন না পড়ে। মহাজোট সরকার আদালতের পর্যবেক্ষণের প্রথম অংশকে গ্রহণ করে দ্বিতীয় অংশকে গুরুত্ব না দিয়ে সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এখন আমরা একটু পেছন ফিরে তাকাই। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এর পর ১৯৯৩ সাল থেকেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আন্দোলন করতে থাকে। এই একটি মাত্র ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল দিয়ে দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। বিএনপি ক্রমাগতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করলেও আন্দোলনে ভাটা পড়েনি আওয়ামী লীগের। তখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু তার নৎধরহ পযরষফ. চাপের মুখে বিএনপি অতঃপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নেয় এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অগোছালো, অপ্রস্তুত বিএনপি পরাজয় বরণ করে এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী মহাজোটের শরিকদের নিয়ে গঠন করে মন্ত্রিসভা। মহাজোট তাতে আরও শক্তিশালী হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে দুইবার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে। অর্থাৎ গত ২০ বছর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাতেই এবং কোনো দলই এ ব্যবস্থাতে নির্বাচন করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে মনে করেন দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ।
বিএনপি বিগত ৪ বছর ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছে। এই দলটি ১৭৩ দিন হরতাল না দিলেও নানাভাবে, বিভিন্ন কৌশলে, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি বাঁচিয়ে রেখেছে। বিএনপির বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের নেতা একে কেন্দ্র করে বারবার কারানির্যাতিত হয়েছেন। বিএনপি যত কার্যকরভাবেই আন্দোলন চালিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার তত কঠোরভাবে বিএনপির আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আশা-নিরাশার দোলায় আন্দোলিত হয়েছে রাজপথ। রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সংসদ ভবন এলাকা ও রাজধানীর অন্যান্য জায়গা। বিষয়টি এখনও ফয়সালা হয়নি। যার যার অবস্থানে আছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি। ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রথমে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট এবং এর কয়েকদিন পর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। প্রথমে চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পর ক্ষমতাসীনদের নজর পড়ে গাজীপুর নির্বাচনে। এখানে সরকার তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেও আরও বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হন সরকার সমর্থিত প্রার্থী। বিরোধী দল এখন বলছে, পাঁচ-পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে রায় পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনোক্রমেই বিরোধী দল নির্বাচনে যাবে না এবং নির্বাচন হতেও দেবে না। সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি এ অবস্থানে আটকে আছে আগামী নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা। কয়েকটি প্রশ্ন এখানে প্রণিধানযোগ্য যথা- যে আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর হরতাল ধর্মঘট করে শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে বিরোধী দলকে বাধ্য করল, সেই আওয়ামী লীগ এখন ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে এর বিপরীত অবস্থান নিচ্ছে কেন? যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তার নৎধরহ পযরষফ, তিনি এখন সেখান থেকে সরে আসছেন কেন? যে আওয়ামী লীগ বলেছিল, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কোনো সরকার ব্যবস্থার অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না এবং নির্বাচন হতেও দেবে না, সেই আওয়ামী লীগ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে আসছে কেন? তত্ত্বাবধায়কে তাদের এত ভয় কিসের? নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে কোনো পক্ষেরই তো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই- যেটার জন্য তারা এত আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ যেহেতু বিএনপিকে আস্থায় ও বিশ্বাসে আনতে পারেনি, বিএনপিও একইভাবে আওয়ামী লীগকে আস্থায় নিতে পারছে না। আওয়ামী লীগ তখন যে অজুহাত দেখিয়েছিল, বিএনপি এখন সেই একই অজুহাত দেখাচ্ছে। পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করায় বিএনপি আরও আশাবাদী হয়ে উঠেছে এবং তাদের তত্ত্বাবধায়কের দাবি আরও সুসংগঠিত, বেগবান ও জোরদার হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যদি একটি নির্বাচনমুখী ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ দল হয়, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় তো তাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আওয়ামী লীগ দু’-দু’বার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করেই। তাই এ পদ্ধতিতে তাদের আপত্তির কারণ জনগণ বুঝতে পারছে না। আওয়ামী লীগই তো এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বিএনপি সরকারকে তখন বাধ্য করেছিল। শেখ হাসিনা তার নৎধরহ পযরষফ-কে মেরে ফেলতে চাইছেন কেন? নব্বইয়ের পর এযাবৎকালে দু’বার করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে দুই দলই। এবার ভোটের আভাস দেখেও মনে হয় বিএনপির একটি সুযোগ আসতে পারে। তাই কি আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার চিন্তা করছে, যাতে তারা কলকাঠি নাড়িয়ে তৃতীয়বার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে পারে? এর ফলাফল দু’রকম হতে পারে- ১. বিএনপি আস্থাহীনতার কারণে নির্বাচন বয়কট করতে পারে। ফলে নির্বাচন হবে একতরফা। ২. তত্ত্বাবধায়ক দাবি মেনে নিলে শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় নির্বাচন সুসম্পন্ন হতে পারে। এ বাস্তবতায় জাতির কল্যাণে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু মেনে নিয়ে সরকার যত তাড়াতাড়ি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে, ততই দেশ ও জাতি বিশাল এক সংকট কাটিয়ে উঠবে। বিভিন্ন জরিপেও দেখা যায়, দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। এই বাস্তবতা আওয়ামী লীগ যত তাড়াতাড়ি হƒদয়ঙ্গম করতে পারবে, ততই সবার মঙ্গল। এর বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হবে না। কারণ গণরায় তখন তাদের পক্ষে যাবে না।
তাই আওয়ামী লীগ জনতার মতামত, গণতন্ত্র, দেশ, জাতি ও আগামী প্রজর প্রতি লক্ষ্য রেখে যত তাড়াতাড়ি কার্যকর ব্যবস্থা (সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল) নেবে, ততই মঙ্গল। নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন ব্যবস্থাই এখন সময়ের দাবি।
ড. কাজী আবদুস সামাদ : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments