ভেজাল থেকে রেহাই নেই? by ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
আমাদের দেশে মানুষ যে ধরনের খাবার খায়,
তার মধ্যে সম্ভবত এমন একটিরও নাম বলা যাবে না যেটি ভেজাল বা বিষমুক্ত।
অর্থাৎ জনগণ প্রতিনিয়তই ভেজাল খাবার খাচ্ছে। এ থেকে যেন কোনোভাবেই মুক্তি
মিলছে না। এ অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সরকার ও কর্তৃপক্ষের
গাফিলতির কারণে পরিস্থিতি আজ এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য মানুষের প্রথম
ও প্রধান মৌলিক চাহিদা। ভেজালমুক্ত বা নির্ভেজাল খাদ্য যেমন দেহের ক্ষয়
পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং রোগ প্রতিরোধ করে, তেমনি ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণের
ফলে স্বাস্থ্যহানি হওয়াসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন পর্যন্ত
বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু দেশে শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংস, দুধ, গুড়, মশলা
থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যেই ভেজাল মেশানো চলছে অবাধে।
এমনকি শিশুখাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মেশানো হচ্ছে।
বর্তমানে চলছে আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের মৌসুম। আর কাঁচা ফল পাকানো হচ্ছে রাসায়নিক পদ্ধতিতে। এসব ‘টসটসে পাকা’ ফল খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ফল পাকানোর ক্ষেত্রে ব্যবহƒত বিষাক্ত রাসায়নিকের কিছু অংশ ফলের খোসার সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ফলের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। আর এ ধরনের ফল খাওয়ার ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের অংশবিশেষ শরীরে ঢুকে পড়ে যে লিভার, কিডনিসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করছে, তা সহজেই অনুমেয়। বিকল্প উপায় না থাকায় জনগণকে এক ধরনের বাধ্য হয়েই এসব ভেজাল খাদ্য খেতে হচ্ছে। ফলে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়েও অনেক শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়াসহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারটি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ, বাস্তবে এ ক্ষেত্রে কী ঘটছে তা চোখ বন্ধ করে ভালোভাবে চিন্তা করলে সহজেই অনুধাবন করা যাবে।
খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল বা মারাÍক ক্ষতিকর উপাদান (যেমন- ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি এ দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হওয়াসহ সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে বেশ তীব্রভাবেই নিন্দিত হয়ে আসছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে শিল্প খাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু গত অর্থবছরে ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে ২০৫ টন। তার মানে বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে। অনেক সময় দেখা যায়, ঢাকঢোল পিটিয়ে বিভিন্ন বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করতে। অথচ ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই বাজারে নিয়মিত কোনো পরীক্ষাই করা হয় না। ভেজালযুক্ত তথা বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ফলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরাও (যাদের বলা হচ্ছে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ)। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সবার জন্য উদ্বেগজনক। আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাতে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বেশ দ্রুতগতিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ এসব প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ কোনো সরকারের পক্ষ থেকেই তেমন কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বা বর্তমানেও হচ্ছে না। এমনকি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশের চার বছরেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারাদেশে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে সবাই সোচ্চার হলেও জনস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থের কথা কেউ চিন্তা করেন না। খাদ্যে ভেজাল রোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন সরকারের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। অথচ এর মাধ্যমে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
কনজুমার রাইটস সোসাইটি ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একসঙ্গে আন্দোলন করার পর সরকার কর্তৃক ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটি বিশেষজ্ঞনির্ভর না হয়ে আমলানির্ভর হওয়ায় তা এক ধরনের নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। সরকার ও প্রশাসনের অব্যাহত গাফিলতি এবং দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনতার কারণে এখন যেন কোনোভাবেই খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই চলছে মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে তিন লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস এবং প্রায় দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশু ও গর্ভবতী নারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলেও ওই পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে গর্ভবতী মায়ের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় এবং গর্ভজাত অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। ভেজাল খাদ্যের কারণে শিশু বিকলাঙ্গ হওয়া এবং শিশু খাদ্যে ভেজাল মেশানো যে আগামী প্রজšে§র জন্য এক বিরাট অশনি সংকেত, তা সহজেই অনুমেয়। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানিয়ে এর আগে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ছয়জন আইনজীবী জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে রিট করেন। এরপর ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট ‘কেন খাদ্য উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে না’ তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। একই সঙ্গে একটি সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পিওর ফুড অধ্যাদেশের ৪(৪১) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রতিটি জেলায় খাদ্য বিশ্লেষক ও খাদ্য আদালত গঠনের নির্দেশ দেন। রায় কার্যকর করতে আদালত সরকারকে দু’বছর সময় বেঁধে দিয়েছিল। অথচ চার বছরেও সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি। চলতি বছর ভোক্তা অধিকার দিবসে খাদ্যমন্ত্রী ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘দেশের ৬৪ জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন করা হবে।’ কিন্তু বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে হওয়ায় সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করা এ সরকারের আমলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
খাদ্যে ভেজাল রোধ এবং খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণে এ দেশে একটি আইন রয়েছে, যার নাম ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ-১৯৫৯’। কিন্তু এ আইনটি প্রচলিত হওয়ার পর এর বেশির ভাগ বিধানই কার্যকর না হওয়ায় তা মূলত কাগজে-কলমের মধ্যেই রয়ে গেছে। তাছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোয় যারা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা, তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের রাস্তাটা খুলে দিয়েছে। শাক-সবজি, ফল-মূল, গুড়, মুড়ি, মাছ-মাংস, দুধ, মশলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের খাদ্য সামগ্রীতে বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করেই অধিক মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে। অনেক সময় তাদের কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লেও তারা টাকা ও পেশিশক্তির জোরে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। মূলত এসব কারণসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, মানুষের অসচেতনতাসহ এ ব্যাপারে জনগণ তীব্রভাবে সোচ্চার না হওয়ার কারণে খাদ্যে ভেজাল নিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার যদি অবসান না ঘটানো হয় অর্থাৎ এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে এর ভয়াবহ কুফল সময়মতো সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। তখন হয়তো করার মতো তেমন কিছুই থাকবে না।
একটি আশার কথা হল, সরকার সম্প্রতি ফরমালিন আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’-এর খসড়া সম্প্রতি নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ আইনে খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করায় এখন তা দ্রুত চূড়ান্ত করা হবে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো আইন প্রণয়ন করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকার জনস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশের সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠায়ও যথেষ্ট আন্তরিক হবে বলে সবার প্রত্যাশা। দুর্নীতি ও শৈথিল্যের কারণে সরকারের নানা উদ্যোগের মতো এ উদ্যোগগুলোও যেন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সর্বোপরি, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আশা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ ব্যাপারে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে খাদ্যে ভেজাল রোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের নৈতিকতাবোধ ও বিবেককে জাগ্রত করা।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইউআইটিএস; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
বর্তমানে চলছে আম-কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের মৌসুম। আর কাঁচা ফল পাকানো হচ্ছে রাসায়নিক পদ্ধতিতে। এসব ‘টসটসে পাকা’ ফল খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ফল পাকানোর ক্ষেত্রে ব্যবহƒত বিষাক্ত রাসায়নিকের কিছু অংশ ফলের খোসার সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ফলের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। আর এ ধরনের ফল খাওয়ার ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের অংশবিশেষ শরীরে ঢুকে পড়ে যে লিভার, কিডনিসহ মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করছে, তা সহজেই অনুমেয়। বিকল্প উপায় না থাকায় জনগণকে এক ধরনের বাধ্য হয়েই এসব ভেজাল খাদ্য খেতে হচ্ছে। ফলে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি ভেজালযুক্ত ওষুধ খেয়েও অনেক শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়াসহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারটি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ, বাস্তবে এ ক্ষেত্রে কী ঘটছে তা চোখ বন্ধ করে ভালোভাবে চিন্তা করলে সহজেই অনুধাবন করা যাবে।
খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল বা মারাÍক ক্ষতিকর উপাদান (যেমন- ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম পাউডার, ইথেফেন ইত্যাদি) মেশানোর বিষয়টি এ দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হওয়াসহ সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে বেশ তীব্রভাবেই নিন্দিত হয়ে আসছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে শিল্প খাতে ফরমালিনের প্রয়োজন ৪০-৫০ টন। কিন্তু গত অর্থবছরে ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে ২০৫ টন। তার মানে বাড়তি ১৫০ টনের বেশি ফরমালিন বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে দেশবাসীর পেটে গেছে। অনেক সময় দেখা যায়, ঢাকঢোল পিটিয়ে বিভিন্ন বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করতে। অথচ ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই বাজারে নিয়মিত কোনো পরীক্ষাই করা হয় না। ভেজালযুক্ত তথা বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ফলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরাও (যাদের বলা হচ্ছে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ)। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সবার জন্য উদ্বেগজনক। আমাদের পুরো খাদ্যচক্রের মধ্যে প্রতিনিয়ত যেভাবে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাতে মনে হয় জাতি হিসেবে আমরা বেশ দ্রুতগতিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ এসব প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ কোনো সরকারের পক্ষ থেকেই তেমন কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বা বর্তমানেও হচ্ছে না। এমনকি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ প্রশাসন’ ধরনের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশের চার বছরেও খাদ্যে ভেজাল রোধে সারাদেশে খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে সবাই সোচ্চার হলেও জনস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থের কথা কেউ চিন্তা করেন না। খাদ্যে ভেজাল রোধে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যেই যেন সরকারের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। অথচ এর মাধ্যমে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
কনজুমার রাইটস সোসাইটি ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একসঙ্গে আন্দোলন করার পর সরকার কর্তৃক ২০১০ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করা হয়। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটি বিশেষজ্ঞনির্ভর না হয়ে আমলানির্ভর হওয়ায় তা এক ধরনের নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। সরকার ও প্রশাসনের অব্যাহত গাফিলতি এবং দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বহীনতার কারণে এখন যেন কোনোভাবেই খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর এভাবেই চলছে মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে তিন লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ ডায়াবেটিস এবং প্রায় দুই লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে শিশু ও গর্ভবতী নারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলেও ওই পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়। ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে গর্ভবতী মায়ের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় এবং গর্ভজাত অনেক শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। ভেজাল খাদ্যের কারণে শিশু বিকলাঙ্গ হওয়া এবং শিশু খাদ্যে ভেজাল মেশানো যে আগামী প্রজšে§র জন্য এক বিরাট অশনি সংকেত, তা সহজেই অনুমেয়। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানিয়ে এর আগে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ছয়জন আইনজীবী জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে রিট করেন। এরপর ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট ‘কেন খাদ্য উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে না’ তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। একই সঙ্গে একটি সম্পূরক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত পিওর ফুড অধ্যাদেশের ৪(৪১) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রতিটি জেলায় খাদ্য বিশ্লেষক ও খাদ্য আদালত গঠনের নির্দেশ দেন। রায় কার্যকর করতে আদালত সরকারকে দু’বছর সময় বেঁধে দিয়েছিল। অথচ চার বছরেও সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি। চলতি বছর ভোক্তা অধিকার দিবসে খাদ্যমন্ত্রী ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘দেশের ৬৪ জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন করা হবে।’ কিন্তু বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে হওয়ায় সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠা করা এ সরকারের আমলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
খাদ্যে ভেজাল রোধ এবং খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণে এ দেশে একটি আইন রয়েছে, যার নাম ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ-১৯৫৯’। কিন্তু এ আইনটি প্রচলিত হওয়ার পর এর বেশির ভাগ বিধানই কার্যকর না হওয়ায় তা মূলত কাগজে-কলমের মধ্যেই রয়ে গেছে। তাছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোয় যারা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবক্তা, তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের রাস্তাটা খুলে দিয়েছে। শাক-সবজি, ফল-মূল, গুড়, মুড়ি, মাছ-মাংস, দুধ, মশলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের খাদ্য সামগ্রীতে বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করেই অধিক মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশাচ্ছে। অনেক সময় তাদের কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লেও তারা টাকা ও পেশিশক্তির জোরে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়। মূলত এসব কারণসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা, মানুষের অসচেতনতাসহ এ ব্যাপারে জনগণ তীব্রভাবে সোচ্চার না হওয়ার কারণে খাদ্যে ভেজাল নিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার যদি অবসান না ঘটানো হয় অর্থাৎ এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে এর ভয়াবহ কুফল সময়মতো সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। তখন হয়তো করার মতো তেমন কিছুই থাকবে না।
একটি আশার কথা হল, সরকার সম্প্রতি ফরমালিন আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’-এর খসড়া সম্প্রতি নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ আইনে খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করায় এখন তা দ্রুত চূড়ান্ত করা হবে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো আইন প্রণয়ন করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। সরকার জনস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে দেশের সব জেলায় খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠায়ও যথেষ্ট আন্তরিক হবে বলে সবার প্রত্যাশা। দুর্নীতি ও শৈথিল্যের কারণে সরকারের নানা উদ্যোগের মতো এ উদ্যোগগুলোও যেন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সর্বোপরি, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আশা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ ব্যাপারে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তবে খাদ্যে ভেজাল রোধে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের নৈতিকতাবোধ ও বিবেককে জাগ্রত করা।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইউআইটিএস; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
No comments