ঢাবি ক্যাম্পাসে অসহনীয় ভিক্ষুক বিড়ম্বনা by সাখাওয়াত আমিন
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বেশির ভাগ
শিক্ষার্থীই গ্রাম, মফস্বল বা জেলা শহর থেকে আসা। তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত
বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।
বেশিরভাগই পড়াশুনা করেন
হলে থেকে। পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহের জন্য বাবার পাঠানো নির্দিষ্ট টাকা নয়তো
টুকটাক টিউশনি করিয়ে পাওয়া টাকার উপরই নির্ভর করতে হয় তাদের। প্রতিটি টাকাই
তাদের খরচ করতে হয় হিসেব করে।
একবেলা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় একটু বেশি খরচ হয়ে গেলে পরের বেলা চলতে কষ্ট করতে হয় অনেকেরই। অনেকে আবার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। তার উপর হলে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ হাজির হন মানবিক সাহায্যের আবেদন নিয়ে।
চারিদিক থেকে উন্মুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন ভিক্ষুক, হকার ও ছিন্নমূল মানুষের অভায়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি নানা সময়ে পড়তে হচ্ছে বিব্রতকর পরিস্থিতে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী আলী আহসান বলেন, ‘বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো দেরি হওয়ায় সেদিন এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ টাকা ধার নিয়ে খেতে বের হয়েছি। হঠাৎ এক ভিক্ষুক এসে পা জড়িয়ে ধরলো। তাকে যতই বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমার কাছে টাকা নেই, সে কিছুতেই ছাড়ছে না। অবশেষে সেই ৩০ টাকা থেকে তাকে ১০ টাকা দিতে হলো। সেদিন আমাকে এককাপ চা আর একটা কেক খেয়েই দিন পার করতে হয়েছে।’
আইইআর এর শিক্ষার্থী জোবায়ের হাসান বলেন, ‘অনেক সময় ক্লাশ পরীক্ষা থাকার ফলে হলে গিয়ে খাওয়া সম্ভব হয়না। লাইব্রেরির সামনে, হাকিম চত্বরে বা ক্যাম্পাস শ্যাডোতে খেতে গেলে এই ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষদের জন্য ঠিকমতো খেতেও পারি না। যেই দেখবে কেউ কিছু খাচ্ছে অমনি চারপাশ থেকে এসে ঘিরে ধরবে। খাওয়ার সময় যদি কেউ এভাবে চায় তাহলে তাকে না দিয়ে খাওয়া যায়? কিন্তু ওদের খাওয়াতে গেলে যে নিজে অর্ধাহারে থাকতে হয় তা ওদের কে বোঝাবে।’
হিসাব বিজ্ঞানের জালাল বলেন, ‘করুণা করে একজনকে ভিক্ষা দিলেন, অমনি তার দেখাদেখি আরও পাঁচজন এসে হাজির হবে। তখন সবাইকেই দিতে হবে। না দিলে উল্টো আপনাকেই নাজেহাল করে ছাড়বে।’
প্রতিদিন শত শত ভিক্ষুক ছিন্নমূল মানুষ আর হকারদের যন্ত্রণায় নাকাল হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গ্রুপস্টাডি, কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, বন্ধুদের মধ্যে আড্ড বা প্রিয় কোনো মানুষের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো, সব জায়গায়ই এদের যন্ত্রণা। কার্জন হল থেকে টিএসসি, ডাস, হাকিম চত্বর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে, বটতলা, ক্যাম্পাস শ্যাডো, মল চত্বর, ভিসি চত্বর, ফুলার রোড বা সবুজ চত্বর সব জায়গায়ই এদের বিচরণ।
ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায় প্রতিদিন প্রায় শতাধিক ভিক্ষুক ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে রয়েছেন। ৪ থেকে ৭০ বছর বয়সী সব ধরনের ভিক্ষুকই চোখে পড়ে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এদের বেশির ভাগই প্রকৃত অর্থে অসহায় নয় বরং ভিক্ষাবৃত্তিটা তাদের ব্যবসা। সুযোগ পেলে এরা নানা অপকর্মও করে।
পাশে কোনোকিছু রেখে আড্ডা মারার সময় একটু বেখেয়াল হলে তা মুহূর্তের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায়। এরকম অভিযোগ আরও অনেক শিক্ষার্থীর। তাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র হারিয়ে প্রায়ই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের ছাত্রী মরিয়ম হাসনা বলেন, ‘পরীক্ষা শেষ করে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে কার্জন হলে ঘুরতে গিয়েছি। বসার সুবিধার্থে আমার ব্যাগটা পাশে রেখে আড্ডা মারছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করি আমার ব্যাগ নেই। তাতে আমার পরীক্ষার প্রবেশপত্র, মোবাইল ফোন ও ঘড়িসহ অনেক মূল্যবান কাগজপত্র ছিল।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগ বলেন, ‘এরা খুব সুযোগ সন্ধানী। যেই কোনো কিছু কেনার জন্য আপনি মানিব্যাগ বের করবেন। দেখবেন সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন এসে হাজির। তখন হয় টাকা দিবেন নয়তো গালি খাবেন।’ এরকম অভিযোগ শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা অনেক অভিভাবক এবং দর্শনার্থীদেরও।
শামসুন নাহার হলের সামনে কথা হয় এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মো. গহর আলী নামের এই অভিভাবক জানান, ১০ মিনিট ধরে এখানে বসে আছি। কমপক্ষে পাঁচজনকে ভিক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে। না দিলে আবার কাপড়চোপড় ধরে টানাটানি করে। কম দিলেও নেবে না।
শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের এসব কথার সত্যতা পাওয়া গেল অচিরেই। কলা ভবনের সামনে ভিক্ষা করছিলেন ৪০/৪৫ বয়সী রজব আলী নামের শারীরিকভাবে শক্ত সামর্থ্য এক ভিক্ষুক। একটু আড়ালে গিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, কাজ করার মতো সামর্থ্য থাকতেও তিনি কেন এ কাজ করছেন। তার উত্তর, কাম কইরা আর কয় টেকা পামু? সারাদিন ভিক্ষা কইরা চার-পাঁচশো টেকা পাই, হেইডাই ভালা।
ভিক্ষার জন্য বিরক্ত করেন কিনা, জানতে চাইলে বলেন, আরে ভাই, বিরক্ত না করলে মাইনষের পকেট তোন টেকা কি এমনি এমনি বাইর অয়?
যখন তখন ঢুকে পড়ছে ক্লাসরুমেও!
তবে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, ক্লাস চলাকালীন সময়ে অনেক ভিক্ষুক সরাসরি ক্লাসরুমে ঢুকে যাচ্ছে হরহামেশাই। বিশেষ করে কলা ভবনের নীচতলা ও দোতলায় অবস্থিত বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রায়ই ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছে এসব ভিক্ষুক।
কলা ভবনের নীচতলায় অবস্থিত বিভাগগুলো হলো- সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ইতিহাস এবং তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা। এসব বিভাগের প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীই প্রতিনিয়ত এসব ঝামেলার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাদের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ইমরান হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘এমনিতেই ক্যাম্পাসে এদের কারণে নানা সময়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তাও না হয় ঠিক আছে। কিন্তু ক্লাসরুমেও যখন এদের যন্ত্রণায় ঠিকমতো ক্লাশ করতে পারি না, তখন আসলেই খুব বিরক্তি লাগে।’
ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মাহবুব বলেন, ‘এদের কারণে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় শিক্ষকও ক্লাস থেকে বের হয়ে যান। ফলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ লেকচার থেকে বঞ্চিত হই।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক ছাত্র আক্ষেপ করে বলেন, ‘সারা দেশের সব ভিক্ষুকদের দেখভালের দায়িত্ব কি শুধু ঢাবি ছাত্রদের ঘাড়ে এসে পড়েছে? আপনি দেখেন এত সংখ্যক ভিক্ষুক আপনি আর কোথাও দেখতে পাবেন না। এদের যন্ত্রণায় ঠিকমতো ক্লাশও করতে পারিনা।’
ঢাবির একজন শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ক্লাসরুমে এসব অনুপ্রবেশ আসলেই দুঃখজনক। এতে মন-মেজাজ ঠিক রেখে পাঠদান আসলেই কষ্টকর।’
ছিন্নমূল মানুষের অভয়াশ্রম
ছিন্নমূল মানুষের স্বর্গও যেন ঢাবি ক্যাম্পাস। এসব মানুষ যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে ক্যাম্পাসের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। বিশেষ করে টিএসসির মোড় থেকে বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর এবং দোয়েল চত্বর থেকে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাশ দিয়ে শহীদুল্লাহ হলের গেট পর্যন্ত পুরো এলাকায় যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করে রাখে এরা। ফলে পথচারী ও শিক্ষার্থীদের চরম অস্বস্তিতে পড়তে হয়।
ক্যাম্পাসে যতগুলো ছাউনি আছে তার একটিতেও বসবার জো নেই। প্রতিটিই দখল করে ইচ্ছেমতো কখনো বা বিছানা, কখনো বা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছে এসব ছিন্নমূল মানুষেরা। কেউ কেউ আবার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কার্জন হল ও শিশু একাডেমির মাঝের জায়গাটুকুতে খুপড়ি পেতে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছেন।
কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা
শিক্ষার্থীদের এ দুর্ভোগের ব্যাপারে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতোই উদাসীন। ক্যাম্পাসে প্রবেশ পথ রয়েছে মোট আটটি। যার একটিও সংরক্ষিত নয়। এসব প্রবেশ পথে নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরী। তাই যার যখন খুশি চাইলেই ঢুকে পড়তে পারে ক্যাম্পাসের মধ্যে।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রক্টরিয়াল বডির টিমসহ অন্যদের দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রক্টরিয়াল বডির টিম, গেটম্যান ও প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব ভিক্ষুক, ছিন্নমূল ও হকাররা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ ব্যাপারে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভিক্ষুক হকার ও ছিন্নমূল এসব মানুষদের চলাচল ক্যাম্পাসে সংরক্ষিত হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
একবেলা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় একটু বেশি খরচ হয়ে গেলে পরের বেলা চলতে কষ্ট করতে হয় অনেকেরই। অনেকে আবার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। তার উপর হলে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ হাজির হন মানবিক সাহায্যের আবেদন নিয়ে।
চারিদিক থেকে উন্মুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন ভিক্ষুক, হকার ও ছিন্নমূল মানুষের অভায়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি নানা সময়ে পড়তে হচ্ছে বিব্রতকর পরিস্থিতে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী আলী আহসান বলেন, ‘বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো দেরি হওয়ায় সেদিন এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ টাকা ধার নিয়ে খেতে বের হয়েছি। হঠাৎ এক ভিক্ষুক এসে পা জড়িয়ে ধরলো। তাকে যতই বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমার কাছে টাকা নেই, সে কিছুতেই ছাড়ছে না। অবশেষে সেই ৩০ টাকা থেকে তাকে ১০ টাকা দিতে হলো। সেদিন আমাকে এককাপ চা আর একটা কেক খেয়েই দিন পার করতে হয়েছে।’
আইইআর এর শিক্ষার্থী জোবায়ের হাসান বলেন, ‘অনেক সময় ক্লাশ পরীক্ষা থাকার ফলে হলে গিয়ে খাওয়া সম্ভব হয়না। লাইব্রেরির সামনে, হাকিম চত্বরে বা ক্যাম্পাস শ্যাডোতে খেতে গেলে এই ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষদের জন্য ঠিকমতো খেতেও পারি না। যেই দেখবে কেউ কিছু খাচ্ছে অমনি চারপাশ থেকে এসে ঘিরে ধরবে। খাওয়ার সময় যদি কেউ এভাবে চায় তাহলে তাকে না দিয়ে খাওয়া যায়? কিন্তু ওদের খাওয়াতে গেলে যে নিজে অর্ধাহারে থাকতে হয় তা ওদের কে বোঝাবে।’
হিসাব বিজ্ঞানের জালাল বলেন, ‘করুণা করে একজনকে ভিক্ষা দিলেন, অমনি তার দেখাদেখি আরও পাঁচজন এসে হাজির হবে। তখন সবাইকেই দিতে হবে। না দিলে উল্টো আপনাকেই নাজেহাল করে ছাড়বে।’
প্রতিদিন শত শত ভিক্ষুক ছিন্নমূল মানুষ আর হকারদের যন্ত্রণায় নাকাল হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গ্রুপস্টাডি, কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, বন্ধুদের মধ্যে আড্ড বা প্রিয় কোনো মানুষের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো, সব জায়গায়ই এদের যন্ত্রণা। কার্জন হল থেকে টিএসসি, ডাস, হাকিম চত্বর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে, বটতলা, ক্যাম্পাস শ্যাডো, মল চত্বর, ভিসি চত্বর, ফুলার রোড বা সবুজ চত্বর সব জায়গায়ই এদের বিচরণ।
ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায় প্রতিদিন প্রায় শতাধিক ভিক্ষুক ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে রয়েছেন। ৪ থেকে ৭০ বছর বয়সী সব ধরনের ভিক্ষুকই চোখে পড়ে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এদের বেশির ভাগই প্রকৃত অর্থে অসহায় নয় বরং ভিক্ষাবৃত্তিটা তাদের ব্যবসা। সুযোগ পেলে এরা নানা অপকর্মও করে।
পাশে কোনোকিছু রেখে আড্ডা মারার সময় একটু বেখেয়াল হলে তা মুহূর্তের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায়। এরকম অভিযোগ আরও অনেক শিক্ষার্থীর। তাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র হারিয়ে প্রায়ই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের ছাত্রী মরিয়ম হাসনা বলেন, ‘পরীক্ষা শেষ করে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে কার্জন হলে ঘুরতে গিয়েছি। বসার সুবিধার্থে আমার ব্যাগটা পাশে রেখে আড্ডা মারছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করি আমার ব্যাগ নেই। তাতে আমার পরীক্ষার প্রবেশপত্র, মোবাইল ফোন ও ঘড়িসহ অনেক মূল্যবান কাগজপত্র ছিল।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগ বলেন, ‘এরা খুব সুযোগ সন্ধানী। যেই কোনো কিছু কেনার জন্য আপনি মানিব্যাগ বের করবেন। দেখবেন সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন এসে হাজির। তখন হয় টাকা দিবেন নয়তো গালি খাবেন।’ এরকম অভিযোগ শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা অনেক অভিভাবক এবং দর্শনার্থীদেরও।
শামসুন নাহার হলের সামনে কথা হয় এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মো. গহর আলী নামের এই অভিভাবক জানান, ১০ মিনিট ধরে এখানে বসে আছি। কমপক্ষে পাঁচজনকে ভিক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে। না দিলে আবার কাপড়চোপড় ধরে টানাটানি করে। কম দিলেও নেবে না।
শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের এসব কথার সত্যতা পাওয়া গেল অচিরেই। কলা ভবনের সামনে ভিক্ষা করছিলেন ৪০/৪৫ বয়সী রজব আলী নামের শারীরিকভাবে শক্ত সামর্থ্য এক ভিক্ষুক। একটু আড়ালে গিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, কাজ করার মতো সামর্থ্য থাকতেও তিনি কেন এ কাজ করছেন। তার উত্তর, কাম কইরা আর কয় টেকা পামু? সারাদিন ভিক্ষা কইরা চার-পাঁচশো টেকা পাই, হেইডাই ভালা।
ভিক্ষার জন্য বিরক্ত করেন কিনা, জানতে চাইলে বলেন, আরে ভাই, বিরক্ত না করলে মাইনষের পকেট তোন টেকা কি এমনি এমনি বাইর অয়?
যখন তখন ঢুকে পড়ছে ক্লাসরুমেও!
তবে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, ক্লাস চলাকালীন সময়ে অনেক ভিক্ষুক সরাসরি ক্লাসরুমে ঢুকে যাচ্ছে হরহামেশাই। বিশেষ করে কলা ভবনের নীচতলা ও দোতলায় অবস্থিত বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রায়ই ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছে এসব ভিক্ষুক।
কলা ভবনের নীচতলায় অবস্থিত বিভাগগুলো হলো- সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ইতিহাস এবং তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা। এসব বিভাগের প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীই প্রতিনিয়ত এসব ঝামেলার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাদের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ইমরান হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘এমনিতেই ক্যাম্পাসে এদের কারণে নানা সময়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তাও না হয় ঠিক আছে। কিন্তু ক্লাসরুমেও যখন এদের যন্ত্রণায় ঠিকমতো ক্লাশ করতে পারি না, তখন আসলেই খুব বিরক্তি লাগে।’
ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মাহবুব বলেন, ‘এদের কারণে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় শিক্ষকও ক্লাস থেকে বের হয়ে যান। ফলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ লেকচার থেকে বঞ্চিত হই।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক ছাত্র আক্ষেপ করে বলেন, ‘সারা দেশের সব ভিক্ষুকদের দেখভালের দায়িত্ব কি শুধু ঢাবি ছাত্রদের ঘাড়ে এসে পড়েছে? আপনি দেখেন এত সংখ্যক ভিক্ষুক আপনি আর কোথাও দেখতে পাবেন না। এদের যন্ত্রণায় ঠিকমতো ক্লাশও করতে পারিনা।’
ঢাবির একজন শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ক্লাসরুমে এসব অনুপ্রবেশ আসলেই দুঃখজনক। এতে মন-মেজাজ ঠিক রেখে পাঠদান আসলেই কষ্টকর।’
ছিন্নমূল মানুষের অভয়াশ্রম
ছিন্নমূল মানুষের স্বর্গও যেন ঢাবি ক্যাম্পাস। এসব মানুষ যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে ক্যাম্পাসের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। বিশেষ করে টিএসসির মোড় থেকে বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর এবং দোয়েল চত্বর থেকে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাশ দিয়ে শহীদুল্লাহ হলের গেট পর্যন্ত পুরো এলাকায় যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করে রাখে এরা। ফলে পথচারী ও শিক্ষার্থীদের চরম অস্বস্তিতে পড়তে হয়।
ক্যাম্পাসে যতগুলো ছাউনি আছে তার একটিতেও বসবার জো নেই। প্রতিটিই দখল করে ইচ্ছেমতো কখনো বা বিছানা, কখনো বা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছে এসব ছিন্নমূল মানুষেরা। কেউ কেউ আবার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কার্জন হল ও শিশু একাডেমির মাঝের জায়গাটুকুতে খুপড়ি পেতে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছেন।
কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা
শিক্ষার্থীদের এ দুর্ভোগের ব্যাপারে ঢাবি কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতোই উদাসীন। ক্যাম্পাসে প্রবেশ পথ রয়েছে মোট আটটি। যার একটিও সংরক্ষিত নয়। এসব প্রবেশ পথে নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরী। তাই যার যখন খুশি চাইলেই ঢুকে পড়তে পারে ক্যাম্পাসের মধ্যে।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রক্টরিয়াল বডির টিমসহ অন্যদের দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রক্টরিয়াল বডির টিম, গেটম্যান ও প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব ভিক্ষুক, ছিন্নমূল ও হকাররা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ ব্যাপারে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ভিক্ষুক হকার ও ছিন্নমূল এসব মানুষদের চলাচল ক্যাম্পাসে সংরক্ষিত হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
No comments