তসলিমা দিদি চারটে ছেলে এসেছে তোমাকে প্রণাম করতে
চারটে ছেলে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। একবার তোমাকে প্রণাম করতে এসেছে। করেই চলে যাবে। আমি প্রণামের লোভে নয়, কেন এসেছেন…।
…আমার
দিকে এগিয়ে হাত বাড়ালো আমার পায়ের দিকে…শংকর নামের ছেলেটি করজোড়ে আমার
সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দিদি, আপনি আমাদের দেবী। আপনাকে দেখতে পেয়ে জীবন
আমাদের সার্থক হল। …একবার প্রণাম করতে দেন…। আবারও মাথা আমার পায়ের দিকে
নাবাতেই বলি, না না প্রণাম করতে হবে না।
‘দিদি, আপনার লজ্জা বইটা আমরা পড়েছি দিদি…। দিদি আপনি যা করেছেন, তা যে কত বড়…। …বলতে বলতে চার যুবক আমি বাধা দেওয়ার পরও আমার পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। কেঁদে, চোখ মুছে, শংকর তার ভাই বন্ধুসহ বিদায় হল।”
(এই অংশটুকু তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘ক’ বইয়ের ৩০১, ৩০২ পৃষ্ঠার)
আহা, এই মানুষগুলো কী ভাগ্যবান প্রণাম করার জন্য তসলিমার পার নাগাল পেয়েছে কিন্তু আমার তো সেই উপায় এখন নাই নইলে আমিও দেবীর খানিকটা ‘চরণকাদা’ (বর্ষাকালে ধুলা নেয়ার উপায় নাই, ধুলা এখন আর নাই সবই কাদা!) নেয়ার চেষ্টা করতাম। ইন্টানেটের কল্যাণে দেবীর নগ্ন চিকন-চিকন ঠ্যাং-এর যে নমুনা দেখতে পাই- ‘চরণকাদা’ নেয়ার জন্য সাহস পেতাম না এ নিশ্চিত।
এই নির্বোধ মহিলার এটা বোঝার ক্ষমতা কখনই হবে না (এই দলে আমাদের লেখক মিলন ভাইয়া, সৈয়দ বংশের লোক শামসুল হকরাও আছেন)। এই প্রকৃতিই আমাদেরকে শিখিয়েছে সমস্ত কিছুই আলো-ছায়ার কাজ, দিন এবং রাত। নইলে সবই ফকফকা, কেবল আলো- রাতের কোনো বালাই থাকত না। সমস্ত কিছু উম্মুক্ত করে দেয়া যায় না। প্রকৃতি পেটটাকে চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে আর খানিকটা আমরা চেষ্টা করি সুদৃশ্য কাপড়ে মুড়িয়ে রাখতে। নইলে তসলিমার পেট হোক আর জরিনার- ‘হলুদ ফুলে মাখামাখি হয়ে আছি আমি’ এটা বলে তসলিমা যতই চমৎকার গদ্য লিখুক না কেন আমরা হড়হড় করে বমি করে দিতাম।
যাই হোক, চার যুবকের সঙ্গে আমারও একচোখে জল একচোখে পানি চলে আসে। শংকর গং বেচারাদের চোখ মোছার উপায় ছিল কিন্তু চোখে চশমার থাকার কারণে আমার যে সে উপায়ও নাই। উপায় নাই- নাই! ওয়াল্লা, আমি যে ‘নেই’ এর স্থলে ‘নাই’ লিখে ফেললাম, এখন আমার কী উপায় হবে গো! নিজেকে ‘দিক্কার দি’- রে পাপিষ্ঠ, কুড়ালে পা মারিলি?
এদিকে দেকো দিকি কান্ড, তসলিমা তো আবার দেবীর পর্যায়ে চলে গেছেন। দেবী ক্ষেপে গেলে রক্ষা আছে। বেচারা হুমায়ূন আহমেদ তো মরে বেঁচে গেলেন দেবীর রোষ থেকে কিন্তু আমরা যারা এখনও মরার সুযোগ পাইনি তাদের উপায় কী? কারণ ‘নাই’ লিখলে যে আমাদের দেবী ক্ষেপে যান। সম্প্রতি এক লেখায় ‘হুমায়ূন: পুরুষতন্ত্রের সম্রাটে’ দেবী লিখেছেন:
“হুমায়ূন আহমেদের ‘নেই’-কে ‘নাই’ লেখাটা আমাকে বরাবরই বড় পীড়া দিয়েছে। জানি না পরে তিনি ‘নাই’ এবং আরও কিছু ভাষার দোষ কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন কি না।” [১]
দেবী তসলিমার এই লেখার উত্তরে বিশাল এক লেখা লেখা যেত। কিন্তু ওপথ আর মাড়ালাম না। এই বিষয়ে সহ-ব্লগার রাগিব হাসান ফেসবুকে চমৎকার এক নোট লিখেছেন:
“নাই, নাই, নাই, নাই, নাই, নাই!
“তসলিমা নাসরিন হুমায়ূনের ছিদ্রান্বেষণ করতে গিয়ে বস্তুত কয়েক কোটি বাংলাদেশীকে অশিক্ষিত এবং পশ্চিমবংগের বাঙালিদের তুলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষিত বলে রায় দিয়েছেন। আনন্দ পুরষ্কার পেলে কি এরকম প্রতিদান দিতে হয় কি না জানিনা, তবে হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিনের অনেক রাগের একটা হলো- হুমায়ূন নাকি “নেই” এর বদলে “নাই” বলতেন, যা তসলিমা নাসরিনের কাছে “ভাষার দোষ”।
সগর্বে বলতে চাই, আমি এই দোষে দুষ্ট, এবং সর্বত্র “নাই” বলে আমি আনন্দিত। নাই, নাই, নাই, নাই, নাই… :)”
রাগিব হাসানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও লাজহীন কন্ঠে বলতে চাই, নাই-নাই-নাই-নাই-নাই-নাই- নাইরে নাই, নাই… :D। ‘চুশিক্ষিতদের’ জন্য নাহয় খেলুম-গেলুম-চান করলুম-হেগে এলুম এই সব তোলা থাকুক।
ওই লেখায় একালের দেবী তসলিমা আরেক জায়গায় লিখেছেন:
“বাংলাদেশের জনগণ যদি এত বিপুল পরিমাণে অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত না হত, হুমায়ূন আহমেদের পক্ষে এত প্রচন্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব হত না। …পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিতের মানটা বাংলাদেশের চেয়ে তুলনায় সামান্য বেশি।”
অথচ এই দেবীই তার ‘ক’ বইয়ে লিখেছেন:
“হুমায়ূন আহমেদের লেখার আমি শুরু থেকেই ভক্ত। …যে যাই বলুক আমার মনে হয় তিনি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছেন তাঁর লেখা দিয়ে…যারা কখনও বই পড়েনি বা পড়তে চায়নি, তারা আর কারও বই না পড়লেও তাঁর বই পড়ে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি প্রচুর পাঠক তৈরি করেছেন।”
(’ক’, পৃষ্ঠা নম্বর: ১৯২)
পূর্বের এক লেখায় আমি লিখেছিলাম: [২]
“…আনন্দবাজার তসলিমাকে ঘটা করে পুরষ্কার দিল। আনন্দবাজার গং তসলিমার ‘লজ্জা’ বইটা ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করল। এর পেছনে আনন্দবাজার গং এমন মেধা খরচ করল যে সেই বইটার লক্ষ-লক্ষ কপি বিক্রি হলো। চারদিকে আগুন লেগেই ছিল বইটা প্রকাশ করে কেবল আগুনটা উসকে দেয়ার অপেক্ষায় ছিল।”
অল্প কথায় বলা চলে, একটা খুন করলে ফাঁসি হয় অথচ কলমের খোঁচায় উস্কানি দিয়ে শত-হাজার মানুষকে মেরে ফেললে পুরস্কৃত করা হয়। কী বিচিত্র! আহ, যে দাদারা অতিথিদের বলেন, গোটা বিস্কিটটা কিন্তু খেতে হবে, দাদা। সেই দাদারা কবে থেকে এমন হাতেমতাই হলেন যে তসলিমাকে নিয়ে নাচানাচি করার জন্য রসগোল্লা-সন্দেশের ভান্ডার নিয়ে গা দুলিয়ে দুলিয়ে এগিয়ে এলেন! আসলে ঘটনা হচ্ছে এই, দাদারা বাবরি মসজিদ নিয়ে যে পুরীষ গায়ে মেখেছিলেন তা ধোয়ার জন্য তসলিমার ‘লজ্জা’ নামের সাবানটার যে খুব প্রয়োজন ছিল, আমাদের দাদাদের ।
এমনিতে যে লেখাগুলোর জন্য তসলিমাকে দাদারা পুরস্কৃত করেছিল সেই লেখার অনেকাংশই চুরির মাল। সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা মেরে তসলিমা বাহবা কুড়িয়েছেন। তসলিমা নাসরিন একটা চোর, স্রেফ চোর! না, ভুল বললাম, একটা মহিলা চোর।
এমনিতে একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার জানার খুব ইচ্ছা ‘লজ্জা’ বইটা কি ছড়া, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কলাম? জিনিসটা কি? দাদারা এই বইটায় কী এমন ‘বাছাল’ পেলেন যে এই দেশে আর কারও দিকে চোখ দেয়ার অবকাশই পেলেন না?
তসলিমার ভাষায় এই দেশের লোকজন শিক্ষিত না অশিক্ষিত তার সঙ্গে এই বাহাসে আমি যাই না কিন্তু এই দেশে লজ্জা নিষিদ্ধ করার মত সিদ্ধান্ত যারা নেন এরা অশিক্ষিত, মূর্খ এটা বলার অবকাশ রাখে না। নইলে কি আর ‘লজ্জা’ বইটা নিষিদ্ধ করা হয়? শ্লা, লজ্জাও একটা বই! এরও আবার নিষেধের বেড়াজাল! আরজ আলী মাতুব্বরের প্রথম বইটা পড়ে, বোঝার যোগ্যতা থাকলে সরকারের লোকজনেরা লজ্জা নিষিদ্ধ করার জন্য লজ্জিত হত।
আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি লজ্জা বইটা নিষিদ্ধ না-করলে কিসসু হতো না। এই বইটা এক ভাগ মানুষও পড়ত কি না সন্দেহ।
নিষিদ্ধ করে জুতার ময়লা হাতে, হাত থেকে নাকে। লাভের লাভ যা হল দাদাদের হাতে এক ভয়ংকর মারণাস্ত্র তুলে দেয়া হল।
এই বিষয়ে আহমদ ছফা লিখেছিলেন:
“কংগ্রেসের গৌহাটি সম্মেলনের প্রতিবেদনে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটার বিবরণ পাতার পর পাতা জুড়ে দেয়া হলো। যা অভূতপূর্ব! বিজেপি দিল্লির লালালাজ শহরে তসলিমার ছবি বিলবোর্ড আকারে ঝুলিয়ে দিল”। (আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ)
এই ২০১২ সালে, ডিজিটাল সময়ে এসেও ‘লজ্জা’ বইটা নিয়ে আর কত লজ্জা পেতে হবে? পিরোজপুরে এক অধ্যক্ষকে পুলিশ হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেছে ‘লজ্জা’ রাখার অভিযোগে। হা ঈশ্বর, লজ্জা ঢাকার জন্য একচিলতে কাপড়ের আজ যে বড় প্রয়োজন। নাকি নগ্ন থাকতেই আমাদের উল্লাস, কে জানে…!
যদিও বিষয়টা ভিন্ন কিন্তু এই লেখার সূত্র ধরে জরুরি একটা বিষয় সামনে চলে এসেছে। সেটা হচ্ছে, তসলিমার দেশে ফেরা। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার বিষয়ে কার কি ভাবনা আমি জানি না। তবে এই বিষয়ে আমার নরোম সুর,
দেশ হচ্ছে মা। মার কাছে ফেরা [৩]। মা তো অপেক্ষায় থাকে, কে খুনি কে গুণি এই বিচার মা কবে থেকে করা শুরু করল? মার কাছে ফিরে আসার জন্য তো কোনো কথা চলে না। সেটা জরিনা নাকি তসলিমা তাতে কী আসে যায়! ছলিমুদ্দিন নাকি দাউদ হায়দার [৪] তাতেই বা কী!
আর খানিক কঠিন করে বললে, এ পাপ! কঠিন এক পাপ! পাপ কেবল আমরাই করি না, রাষ্ট্র-দেশও করে। একটা দেশের হাতে এই ক্ষমতা থাকার প্রশ্নই আসে না যে সে তার কোনো নাগরিককে দেশে ফিরে আসতে দেবে না!
হ্যাঁ, দেশ যেটা করতে পারে, আইনের আওতায় প্রয়োজন মনে করলে তার নাগরিককে আটকে রাখতে পারে- চরম নিষ্ঠুরতা দেখাতে গিয়ে কারও প্রাণও নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু…। কোনো দেশের, বিশেষ করে সভ্য কোনো দেশের এই পাপ করার প্রশ্নই আসে না। এতে করে যে গোটা দেশ নগ্ন হয়ে পড়ে- নিমিষেই গণতন্ত্রের শাড়ি দমকা হাওয়ায় উড়ে যায়।
তসলিমার ঠ্যাং লোকজনেরা যে কেবল প্রণাম করার জন্যই ধরত এমনটাই না। তসলিমা কেবল তাই বলছেন না, বলছেন অন্য কথাও। তার ঠ্যাং লোকজনেরা কেন ধরত এটা পূর্বেও জানিয়েছেন সম্প্রতি অন্য রকম ঠ্যাং ধরা সম্বন্ধে তিনি জানালেন, রয়েসয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবে নাকি তসলিমাকে যৌন-নির্যাতন করেছিলেন। আমার তো হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে উল্টে পড়ার দশা! যৌন-নির্যাতন, তসলিমাকে…!
এই মহিলা বিচিত্র কাশি দেন, ‘যুগ-কাশাকাশি’। কিছু কাশি আছে যেটা ১০/ ১২ বছর পরপর কাশাকাশি করারই নিয়ম। তসলিমা সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
এই লেখায়ই লিখেছিলাম: “…হ্যাঁ, দেশ যেটা করতে পারে, আইনের আওতায় প্রয়োজন মনে করলে তার নাগরিককে আটকে রাখতে পারে- চরম নিষ্ঠুরতা দেখাতে গিয়ে রাষ্ট্র কারও প্রাণও নষ্ট করে ফেলে”।
এর সঙ্গে যোগ হবে, প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্র কাউকে পাগলা গারাদেও আবদ্ধ করে রাখতে পারে, যেমন তসলিমাকে। তবে দেশে ফিরতে বাঁধা দিতে পারে না…।
‘দিদি, আপনার লজ্জা বইটা আমরা পড়েছি দিদি…। দিদি আপনি যা করেছেন, তা যে কত বড়…। …বলতে বলতে চার যুবক আমি বাধা দেওয়ার পরও আমার পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। কেঁদে, চোখ মুছে, শংকর তার ভাই বন্ধুসহ বিদায় হল।”
(এই অংশটুকু তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘ক’ বইয়ের ৩০১, ৩০২ পৃষ্ঠার)
আহা, এই মানুষগুলো কী ভাগ্যবান প্রণাম করার জন্য তসলিমার পার নাগাল পেয়েছে কিন্তু আমার তো সেই উপায় এখন নাই নইলে আমিও দেবীর খানিকটা ‘চরণকাদা’ (বর্ষাকালে ধুলা নেয়ার উপায় নাই, ধুলা এখন আর নাই সবই কাদা!) নেয়ার চেষ্টা করতাম। ইন্টানেটের কল্যাণে দেবীর নগ্ন চিকন-চিকন ঠ্যাং-এর যে নমুনা দেখতে পাই- ‘চরণকাদা’ নেয়ার জন্য সাহস পেতাম না এ নিশ্চিত।
এই নির্বোধ মহিলার এটা বোঝার ক্ষমতা কখনই হবে না (এই দলে আমাদের লেখক মিলন ভাইয়া, সৈয়দ বংশের লোক শামসুল হকরাও আছেন)। এই প্রকৃতিই আমাদেরকে শিখিয়েছে সমস্ত কিছুই আলো-ছায়ার কাজ, দিন এবং রাত। নইলে সবই ফকফকা, কেবল আলো- রাতের কোনো বালাই থাকত না। সমস্ত কিছু উম্মুক্ত করে দেয়া যায় না। প্রকৃতি পেটটাকে চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে আর খানিকটা আমরা চেষ্টা করি সুদৃশ্য কাপড়ে মুড়িয়ে রাখতে। নইলে তসলিমার পেট হোক আর জরিনার- ‘হলুদ ফুলে মাখামাখি হয়ে আছি আমি’ এটা বলে তসলিমা যতই চমৎকার গদ্য লিখুক না কেন আমরা হড়হড় করে বমি করে দিতাম।
যাই হোক, চার যুবকের সঙ্গে আমারও একচোখে জল একচোখে পানি চলে আসে। শংকর গং বেচারাদের চোখ মোছার উপায় ছিল কিন্তু চোখে চশমার থাকার কারণে আমার যে সে উপায়ও নাই। উপায় নাই- নাই! ওয়াল্লা, আমি যে ‘নেই’ এর স্থলে ‘নাই’ লিখে ফেললাম, এখন আমার কী উপায় হবে গো! নিজেকে ‘দিক্কার দি’- রে পাপিষ্ঠ, কুড়ালে পা মারিলি?
এদিকে দেকো দিকি কান্ড, তসলিমা তো আবার দেবীর পর্যায়ে চলে গেছেন। দেবী ক্ষেপে গেলে রক্ষা আছে। বেচারা হুমায়ূন আহমেদ তো মরে বেঁচে গেলেন দেবীর রোষ থেকে কিন্তু আমরা যারা এখনও মরার সুযোগ পাইনি তাদের উপায় কী? কারণ ‘নাই’ লিখলে যে আমাদের দেবী ক্ষেপে যান। সম্প্রতি এক লেখায় ‘হুমায়ূন: পুরুষতন্ত্রের সম্রাটে’ দেবী লিখেছেন:
“হুমায়ূন আহমেদের ‘নেই’-কে ‘নাই’ লেখাটা আমাকে বরাবরই বড় পীড়া দিয়েছে। জানি না পরে তিনি ‘নাই’ এবং আরও কিছু ভাষার দোষ কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন কি না।” [১]
দেবী তসলিমার এই লেখার উত্তরে বিশাল এক লেখা লেখা যেত। কিন্তু ওপথ আর মাড়ালাম না। এই বিষয়ে সহ-ব্লগার রাগিব হাসান ফেসবুকে চমৎকার এক নোট লিখেছেন:
“নাই, নাই, নাই, নাই, নাই, নাই!
“তসলিমা নাসরিন হুমায়ূনের ছিদ্রান্বেষণ করতে গিয়ে বস্তুত কয়েক কোটি বাংলাদেশীকে অশিক্ষিত এবং পশ্চিমবংগের বাঙালিদের তুলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষিত বলে রায় দিয়েছেন। আনন্দ পুরষ্কার পেলে কি এরকম প্রতিদান দিতে হয় কি না জানিনা, তবে হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিনের অনেক রাগের একটা হলো- হুমায়ূন নাকি “নেই” এর বদলে “নাই” বলতেন, যা তসলিমা নাসরিনের কাছে “ভাষার দোষ”।
সগর্বে বলতে চাই, আমি এই দোষে দুষ্ট, এবং সর্বত্র “নাই” বলে আমি আনন্দিত। নাই, নাই, নাই, নাই, নাই… :)”
রাগিব হাসানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও লাজহীন কন্ঠে বলতে চাই, নাই-নাই-নাই-নাই-নাই-নাই- নাইরে নাই, নাই… :D। ‘চুশিক্ষিতদের’ জন্য নাহয় খেলুম-গেলুম-চান করলুম-হেগে এলুম এই সব তোলা থাকুক।
ওই লেখায় একালের দেবী তসলিমা আরেক জায়গায় লিখেছেন:
“বাংলাদেশের জনগণ যদি এত বিপুল পরিমাণে অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত না হত, হুমায়ূন আহমেদের পক্ষে এত প্রচন্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব হত না। …পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিতের মানটা বাংলাদেশের চেয়ে তুলনায় সামান্য বেশি।”
অথচ এই দেবীই তার ‘ক’ বইয়ে লিখেছেন:
“হুমায়ূন আহমেদের লেখার আমি শুরু থেকেই ভক্ত। …যে যাই বলুক আমার মনে হয় তিনি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছেন তাঁর লেখা দিয়ে…যারা কখনও বই পড়েনি বা পড়তে চায়নি, তারা আর কারও বই না পড়লেও তাঁর বই পড়ে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি প্রচুর পাঠক তৈরি করেছেন।”
(’ক’, পৃষ্ঠা নম্বর: ১৯২)
পূর্বের এক লেখায় আমি লিখেছিলাম: [২]
“…আনন্দবাজার তসলিমাকে ঘটা করে পুরষ্কার দিল। আনন্দবাজার গং তসলিমার ‘লজ্জা’ বইটা ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করল। এর পেছনে আনন্দবাজার গং এমন মেধা খরচ করল যে সেই বইটার লক্ষ-লক্ষ কপি বিক্রি হলো। চারদিকে আগুন লেগেই ছিল বইটা প্রকাশ করে কেবল আগুনটা উসকে দেয়ার অপেক্ষায় ছিল।”
অল্প কথায় বলা চলে, একটা খুন করলে ফাঁসি হয় অথচ কলমের খোঁচায় উস্কানি দিয়ে শত-হাজার মানুষকে মেরে ফেললে পুরস্কৃত করা হয়। কী বিচিত্র! আহ, যে দাদারা অতিথিদের বলেন, গোটা বিস্কিটটা কিন্তু খেতে হবে, দাদা। সেই দাদারা কবে থেকে এমন হাতেমতাই হলেন যে তসলিমাকে নিয়ে নাচানাচি করার জন্য রসগোল্লা-সন্দেশের ভান্ডার নিয়ে গা দুলিয়ে দুলিয়ে এগিয়ে এলেন! আসলে ঘটনা হচ্ছে এই, দাদারা বাবরি মসজিদ নিয়ে যে পুরীষ গায়ে মেখেছিলেন তা ধোয়ার জন্য তসলিমার ‘লজ্জা’ নামের সাবানটার যে খুব প্রয়োজন ছিল, আমাদের দাদাদের ।
এমনিতে যে লেখাগুলোর জন্য তসলিমাকে দাদারা পুরস্কৃত করেছিল সেই লেখার অনেকাংশই চুরির মাল। সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা মেরে তসলিমা বাহবা কুড়িয়েছেন। তসলিমা নাসরিন একটা চোর, স্রেফ চোর! না, ভুল বললাম, একটা মহিলা চোর।
এমনিতে একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার জানার খুব ইচ্ছা ‘লজ্জা’ বইটা কি ছড়া, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কলাম? জিনিসটা কি? দাদারা এই বইটায় কী এমন ‘বাছাল’ পেলেন যে এই দেশে আর কারও দিকে চোখ দেয়ার অবকাশই পেলেন না?
তসলিমার ভাষায় এই দেশের লোকজন শিক্ষিত না অশিক্ষিত তার সঙ্গে এই বাহাসে আমি যাই না কিন্তু এই দেশে লজ্জা নিষিদ্ধ করার মত সিদ্ধান্ত যারা নেন এরা অশিক্ষিত, মূর্খ এটা বলার অবকাশ রাখে না। নইলে কি আর ‘লজ্জা’ বইটা নিষিদ্ধ করা হয়? শ্লা, লজ্জাও একটা বই! এরও আবার নিষেধের বেড়াজাল! আরজ আলী মাতুব্বরের প্রথম বইটা পড়ে, বোঝার যোগ্যতা থাকলে সরকারের লোকজনেরা লজ্জা নিষিদ্ধ করার জন্য লজ্জিত হত।
আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি লজ্জা বইটা নিষিদ্ধ না-করলে কিসসু হতো না। এই বইটা এক ভাগ মানুষও পড়ত কি না সন্দেহ।
নিষিদ্ধ করে জুতার ময়লা হাতে, হাত থেকে নাকে। লাভের লাভ যা হল দাদাদের হাতে এক ভয়ংকর মারণাস্ত্র তুলে দেয়া হল।
এই বিষয়ে আহমদ ছফা লিখেছিলেন:
“কংগ্রেসের গৌহাটি সম্মেলনের প্রতিবেদনে তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইটার বিবরণ পাতার পর পাতা জুড়ে দেয়া হলো। যা অভূতপূর্ব! বিজেপি দিল্লির লালালাজ শহরে তসলিমার ছবি বিলবোর্ড আকারে ঝুলিয়ে দিল”। (আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ)
এই ২০১২ সালে, ডিজিটাল সময়ে এসেও ‘লজ্জা’ বইটা নিয়ে আর কত লজ্জা পেতে হবে? পিরোজপুরে এক অধ্যক্ষকে পুলিশ হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেছে ‘লজ্জা’ রাখার অভিযোগে। হা ঈশ্বর, লজ্জা ঢাকার জন্য একচিলতে কাপড়ের আজ যে বড় প্রয়োজন। নাকি নগ্ন থাকতেই আমাদের উল্লাস, কে জানে…!
যদিও বিষয়টা ভিন্ন কিন্তু এই লেখার সূত্র ধরে জরুরি একটা বিষয় সামনে চলে এসেছে। সেটা হচ্ছে, তসলিমার দেশে ফেরা। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার বিষয়ে কার কি ভাবনা আমি জানি না। তবে এই বিষয়ে আমার নরোম সুর,
দেশ হচ্ছে মা। মার কাছে ফেরা [৩]। মা তো অপেক্ষায় থাকে, কে খুনি কে গুণি এই বিচার মা কবে থেকে করা শুরু করল? মার কাছে ফিরে আসার জন্য তো কোনো কথা চলে না। সেটা জরিনা নাকি তসলিমা তাতে কী আসে যায়! ছলিমুদ্দিন নাকি দাউদ হায়দার [৪] তাতেই বা কী!
আর খানিক কঠিন করে বললে, এ পাপ! কঠিন এক পাপ! পাপ কেবল আমরাই করি না, রাষ্ট্র-দেশও করে। একটা দেশের হাতে এই ক্ষমতা থাকার প্রশ্নই আসে না যে সে তার কোনো নাগরিককে দেশে ফিরে আসতে দেবে না!
হ্যাঁ, দেশ যেটা করতে পারে, আইনের আওতায় প্রয়োজন মনে করলে তার নাগরিককে আটকে রাখতে পারে- চরম নিষ্ঠুরতা দেখাতে গিয়ে কারও প্রাণও নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু…। কোনো দেশের, বিশেষ করে সভ্য কোনো দেশের এই পাপ করার প্রশ্নই আসে না। এতে করে যে গোটা দেশ নগ্ন হয়ে পড়ে- নিমিষেই গণতন্ত্রের শাড়ি দমকা হাওয়ায় উড়ে যায়।
তসলিমার ঠ্যাং লোকজনেরা যে কেবল প্রণাম করার জন্যই ধরত এমনটাই না। তসলিমা কেবল তাই বলছেন না, বলছেন অন্য কথাও। তার ঠ্যাং লোকজনেরা কেন ধরত এটা পূর্বেও জানিয়েছেন সম্প্রতি অন্য রকম ঠ্যাং ধরা সম্বন্ধে তিনি জানালেন, রয়েসয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবে নাকি তসলিমাকে যৌন-নির্যাতন করেছিলেন। আমার তো হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে উল্টে পড়ার দশা! যৌন-নির্যাতন, তসলিমাকে…!
এই মহিলা বিচিত্র কাশি দেন, ‘যুগ-কাশাকাশি’। কিছু কাশি আছে যেটা ১০/ ১২ বছর পরপর কাশাকাশি করারই নিয়ম। তসলিমা সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
এই লেখায়ই লিখেছিলাম: “…হ্যাঁ, দেশ যেটা করতে পারে, আইনের আওতায় প্রয়োজন মনে করলে তার নাগরিককে আটকে রাখতে পারে- চরম নিষ্ঠুরতা দেখাতে গিয়ে রাষ্ট্র কারও প্রাণও নষ্ট করে ফেলে”।
এর সঙ্গে যোগ হবে, প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্র কাউকে পাগলা গারাদেও আবদ্ধ করে রাখতে পারে, যেমন তসলিমাকে। তবে দেশে ফিরতে বাঁধা দিতে পারে না…।
No comments