নীতির রাজনীতি বনাম ভোটের রাজনীতি by মেজর সুধীর সাহা (অব.)
রাজনীতি ও গণতন্ত্রের অন্যতম অধ্যায় নির্বাচন। নির্বাচন কিংবা ভোটের রাজনীতির সঙ্গে নীতিগত রাজনীতির কোনো বিভেদ থাকার কথা নয়। কিন্তু রাজনীতি যখন হয়ে উঠে শুধু ভোটের জন্য নিবেদিত এবং নিয়ন্ত্রিত, তখন সেই রাজনীতিতে নীতির জায়গাটি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ কঠিন রোগটি অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে। ঠিক কখন ঢুকে পড়েছে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। সেই দলটির নীতিগত অবস্থান হল তারা স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতন্ত্রের চেতনাবাহক একটি রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার নেতৃত্ব প্রদান থেকে শুরু করে সব প্রগতিশীল আন্দোলনের ইতিহাস এ দলটির রয়েছে। এ দলটি যতদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছিল ততদিন এর নীতিগত অবস্থানের বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পরের দিনগুলো অর্থাৎ বর্তমান সভানেত্রী শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সময়েও এ দলটির নীতিগত রাজনীতিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এ দলে নীতিগত রাজনীতিতে ভোটের রাজনীতি ঢুকে পড়ে দলটির বর্তমান নেতৃত্বের হাত ধরে। ভোটের বিবেচনাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তারা বারবার নীতির রাজনীতিতে সমঝোতা করে। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী এ দলটি এক সময় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করতেও দ্বিধা করে না। গোলাম আযমের মতো যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে তারা এক কাতারে বসে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে শুধু এরশাদের পতনের লক্ষ্যে। আবার সেই এরশাদের দলের সঙ্গে জোট বেঁধে আওয়ামী লীগ বর্তমান সময়ে সরকার পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, অন্যদিকে সমর্থনের আশায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে গোপন আঁতাত করার চেষ্টা করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে ফতোয়া প্রদানের বিষয়ে একটি গোপন চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিল। মৌলবাদী সংগঠনের এবং ধর্মীয় অনুভূতির ভোটারের সমর্থন লাভের আশায় আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখে। সরকার একসময় গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাÍতা প্রকাশ করে; আবার যখন দেখে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে মৌলবাদী কিছু সংগঠন, তখন সরকার ভোটের হিসাবকে বেশি মূল্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মৌলবাদীদের খুশি করতে সরকার প্রমাণ সংগ্রহের আগেই গ্রেফতার করে তিন ব্লগারকে।
বিএনপি ধর্মীয় রাজনীতির একটি প্লাটফর্ম। ধর্মীয় রাজনীতির অপর দল জামায়াতে ইসলামী তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী। বিএনপি কখনও কখনও নিজেদের মু্িক্তযোদ্ধাদের দল বলে ঘোষণা করে। তাদের দলে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা নেতাকর্মী আছে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ধর্মের কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীর মধ্যে একটি পার্থক্য আছে নিশ্চিতভাবেই। সে ক্ষেত্রে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা থাকা দল বিএনপি শুধু ভোটের হিসাব করেই জামায়াতের মতো কট্টর মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করছে। জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব এবং সহিংস কার্যকলাপ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও শুধু ভোটের হিসাব করতে গিয়ে বিএনপি জামায়াতকে তার জোটে ধরে রাখছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর সেই জিয়াউর রহমানের দলের অন্যতম প্রধান শরিক দল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াত; বিবেচনা শুধু ভোটের গুরুত্ব। ভোটের ওপর জোর দিতে গিয়েই বিএনপি জোটের সমর্থক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জামায়াতের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে রাজনীতি করছেন। নীতির রাজনীতি আজ দেশে ভোটের রাজনীতির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো একদিন এর পরিবর্তন আসবে। তবে সেই দিনটি না আসা পর্যন্ত আমাদের যে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা কে বলতে পারে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আজ রাজনীতি করে শুধুই যেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনীতি করার মানসিকতা আজ তারা অনেক পেছনে ফেলে রেখে এসেছে। কীভাবে, কী পদ্ধতিতে, কী চাতুর্যে বেশি ভোট পাওয়া যাবে, কার সঙ্গে থাকলে সরকার গঠন করার মতো ভোট পাওয়া যাবে আজ যেন তা-ই রাজনীতির মূলমন্ত্র হয়ে গেছে। নীতি এবং দলের আদর্শ সেখানে গৌণ অবস্থানে রয়েছে। ক্ষমতা চাই-ই-চাই। আর সেই ক্ষমতা পেতে যদি বিপরীত মেরুর কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে হয়, যদি নীতি বিসর্জন দিয়ে বিপরীত মেরুর কারও সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, তবে তা ঠিক আছে।
জনগণের সেবা করার যে রাজনীতি তাতে সরকার গঠন করার বিষয়টি মুখ্য নয়। বিরোধী দলে থেকেও জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই প্রধান দল শুধু ক্ষমতাই চায়Ñ বিরোধী আসনে বসতে চায় না। ভোটের হিসাব করতে গিয়ে এ দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল ক্রমশ নীতির রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মিথ্যাই হোক, কৃত্রিমভাবেই হোক অথবা ছলনা করেই হোক, রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতা গ্রহণ অর্থাৎ ভোটের প্রাপ্তি। তাই ভোটের স্বার্থে সবকিছুই করা যেতে পারে। সেখানে নীতিকে টেনে এনে তারা ঝামেলা পোহাতে চায় না। নীতি ধরে রেখে বিরোধী আসনে বসার চেয়ে তারা বরং ভোটের গতি দেখে নীতিতে ছাড় দিয়ে ক্ষমতায় বসতে চায়। ক্ষমতার রাজনীতি নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে তারা শুধু দলীয় স্বার্থের কথাই চিন্তা করে, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে না।
ঠিক এ মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা গোলাম আযমের বিচারের রায় নিয়েও আমরা স্পষ্টত দেখতে পাই ভোটের রাজনীতির খেলা। রায় নিয়ে বিএনপি কোনো মন্তব্য প্রকাশ করছে না। তারা এতে সব মহলকে খুশি করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ৯০ বছরের শাস্তি হওয়ায় সরকারও রায়ে খুশি বলে জানিয়েছে। জাতির যে প্রত্যাশা ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের, সেখানে ভোটের সুবিধার কথা চিন্তা করে মৃত্যুদণ্ড আশা না করে ৯০ বছরের সশ্রম কারাভোগের রায়কেই সরকার বাহবা জানাচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর অন্য সরকার এসে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় থেকে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে দিতে পারে এমন একটি সংশয় বজায় থাকলেও বর্তমান সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সেই ৫৯ ধারায় কোনো পরিবর্তন আনছে না। কেননা তারা ভোটের রাজনীতির কারণে এখানেও নীতির সঙ্গে সমঝোতা করছে। জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল বলে সরকার মনে করলেও শুধু ভোটের হিসাব কষে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ।
নীতির রাজনীতি জয়ী না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনীতির চেহারা বদলাবে না। শুধু নীতি বিসর্জিত ভোটের রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে ক্রমশ প্রকৃত রাজনীতিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং অর্থ-সম্পদশালী ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাতে রাজনীতি বন্দি থাকছে।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলাম লেখক
বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। সেই দলটির নীতিগত অবস্থান হল তারা স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতন্ত্রের চেতনাবাহক একটি রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতার নেতৃত্ব প্রদান থেকে শুরু করে সব প্রগতিশীল আন্দোলনের ইতিহাস এ দলটির রয়েছে। এ দলটি যতদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছিল ততদিন এর নীতিগত অবস্থানের বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পরের দিনগুলো অর্থাৎ বর্তমান সভানেত্রী শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সময়েও এ দলটির নীতিগত রাজনীতিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এ দলে নীতিগত রাজনীতিতে ভোটের রাজনীতি ঢুকে পড়ে দলটির বর্তমান নেতৃত্বের হাত ধরে। ভোটের বিবেচনাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তারা বারবার নীতির রাজনীতিতে সমঝোতা করে। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী এ দলটি এক সময় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করতেও দ্বিধা করে না। গোলাম আযমের মতো যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে তারা এক কাতারে বসে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে শুধু এরশাদের পতনের লক্ষ্যে। আবার সেই এরশাদের দলের সঙ্গে জোট বেঁধে আওয়ামী লীগ বর্তমান সময়ে সরকার পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, অন্যদিকে সমর্থনের আশায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে গোপন আঁতাত করার চেষ্টা করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে ফতোয়া প্রদানের বিষয়ে একটি গোপন চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিল। মৌলবাদী সংগঠনের এবং ধর্মীয় অনুভূতির ভোটারের সমর্থন লাভের আশায় আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখে। সরকার একসময় গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাÍতা প্রকাশ করে; আবার যখন দেখে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে মৌলবাদী কিছু সংগঠন, তখন সরকার ভোটের হিসাবকে বেশি মূল্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মৌলবাদীদের খুশি করতে সরকার প্রমাণ সংগ্রহের আগেই গ্রেফতার করে তিন ব্লগারকে।
বিএনপি ধর্মীয় রাজনীতির একটি প্লাটফর্ম। ধর্মীয় রাজনীতির অপর দল জামায়াতে ইসলামী তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী। বিএনপি কখনও কখনও নিজেদের মু্িক্তযোদ্ধাদের দল বলে ঘোষণা করে। তাদের দলে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা নেতাকর্মী আছে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ধর্মের কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীর মধ্যে একটি পার্থক্য আছে নিশ্চিতভাবেই। সে ক্ষেত্রে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা থাকা দল বিএনপি শুধু ভোটের হিসাব করেই জামায়াতের মতো কট্টর মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করছে। জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব এবং সহিংস কার্যকলাপ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও শুধু ভোটের হিসাব করতে গিয়ে বিএনপি জামায়াতকে তার জোটে ধরে রাখছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আর সেই জিয়াউর রহমানের দলের অন্যতম প্রধান শরিক দল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াত; বিবেচনা শুধু ভোটের গুরুত্ব। ভোটের ওপর জোর দিতে গিয়েই বিএনপি জোটের সমর্থক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জামায়াতের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে রাজনীতি করছেন। নীতির রাজনীতি আজ দেশে ভোটের রাজনীতির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো একদিন এর পরিবর্তন আসবে। তবে সেই দিনটি না আসা পর্যন্ত আমাদের যে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা কে বলতে পারে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আজ রাজনীতি করে শুধুই যেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনীতি করার মানসিকতা আজ তারা অনেক পেছনে ফেলে রেখে এসেছে। কীভাবে, কী পদ্ধতিতে, কী চাতুর্যে বেশি ভোট পাওয়া যাবে, কার সঙ্গে থাকলে সরকার গঠন করার মতো ভোট পাওয়া যাবে আজ যেন তা-ই রাজনীতির মূলমন্ত্র হয়ে গেছে। নীতি এবং দলের আদর্শ সেখানে গৌণ অবস্থানে রয়েছে। ক্ষমতা চাই-ই-চাই। আর সেই ক্ষমতা পেতে যদি বিপরীত মেরুর কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে হয়, যদি নীতি বিসর্জন দিয়ে বিপরীত মেরুর কারও সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, তবে তা ঠিক আছে।
জনগণের সেবা করার যে রাজনীতি তাতে সরকার গঠন করার বিষয়টি মুখ্য নয়। বিরোধী দলে থেকেও জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই প্রধান দল শুধু ক্ষমতাই চায়Ñ বিরোধী আসনে বসতে চায় না। ভোটের হিসাব করতে গিয়ে এ দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল ক্রমশ নীতির রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মিথ্যাই হোক, কৃত্রিমভাবেই হোক অথবা ছলনা করেই হোক, রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতা গ্রহণ অর্থাৎ ভোটের প্রাপ্তি। তাই ভোটের স্বার্থে সবকিছুই করা যেতে পারে। সেখানে নীতিকে টেনে এনে তারা ঝামেলা পোহাতে চায় না। নীতি ধরে রেখে বিরোধী আসনে বসার চেয়ে তারা বরং ভোটের গতি দেখে নীতিতে ছাড় দিয়ে ক্ষমতায় বসতে চায়। ক্ষমতার রাজনীতি নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে তারা শুধু দলীয় স্বার্থের কথাই চিন্তা করে, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে না।
ঠিক এ মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা গোলাম আযমের বিচারের রায় নিয়েও আমরা স্পষ্টত দেখতে পাই ভোটের রাজনীতির খেলা। রায় নিয়ে বিএনপি কোনো মন্তব্য প্রকাশ করছে না। তারা এতে সব মহলকে খুশি করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ৯০ বছরের শাস্তি হওয়ায় সরকারও রায়ে খুশি বলে জানিয়েছে। জাতির যে প্রত্যাশা ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের, সেখানে ভোটের সুবিধার কথা চিন্তা করে মৃত্যুদণ্ড আশা না করে ৯০ বছরের সশ্রম কারাভোগের রায়কেই সরকার বাহবা জানাচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর অন্য সরকার এসে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় থেকে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে দিতে পারে এমন একটি সংশয় বজায় থাকলেও বর্তমান সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সেই ৫৯ ধারায় কোনো পরিবর্তন আনছে না। কেননা তারা ভোটের রাজনীতির কারণে এখানেও নীতির সঙ্গে সমঝোতা করছে। জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল বলে সরকার মনে করলেও শুধু ভোটের হিসাব কষে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ।
নীতির রাজনীতি জয়ী না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনীতির চেহারা বদলাবে না। শুধু নীতি বিসর্জিত ভোটের রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে ক্রমশ প্রকৃত রাজনীতিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং অর্থ-সম্পদশালী ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাতে রাজনীতি বন্দি থাকছে।
মেজর সুধীর সাহা (অব.) : কলাম লেখক
No comments