লুট দুর্নীতি! লুট দুর্নীতি!! লুট দুর্নীতি!!! by লায়েকুজ্জামান
রাজকীয় লুট। হল-মার্ক, ডেসটিনি,
ইউনিপেটুইউ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, আইসিএল সর্বশেষ ম্যাক্সিম গ্রুপ- এই ৬টি
প্রতিষ্ঠান লুটে নিয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যাপক এই লুটপাটের সঙ্গে
ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
দুর্নীতি
দমন কমিশন ওই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে একাধিকবার তাদের তলবও করেছে। ওই টাকা
ছাড়াও লুটপাটের তালিকায় আছে পদ্মা সেতুর নকশা কেলেঙ্কারি করে হাতিয়ে নেয়া
১১৬ কোটি রাজস্ব খাতের টাকা। বিপুল অঙ্কের ওই টাকার বেশির ভাগ পাচার হয়েছে
বিদেশে। লুটপাটের হোতারাও বেশির ভাগ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। দুবাই,
মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের পসরা খুলে সেখানে নির্বিঘ্নে বাণিজ্য
করছে। লুটপাটের টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার প্রমাণ মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে।
দুদকের এ যাবৎ অনুসন্ধানে কেবল ডেসটিনিরই কানাডা, যুক্তরাজ্য ও
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখার প্রমাণ মিলেছে। আরও অনুসন্ধান
চলছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। হল-মার্ক ও একই সময়ে তাদের সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট আরও ৫টি প্রতিষ্ঠান মিলে লুটে নিয়েছে ৩৬০০ কোটি টাকা। ডেসটিনি
গ্রুপ প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩৩০০ কোটি টাকা।
ইউনিপেটুইউ নিয়েছে ৩৬০০ কোটি টাকা
। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ও শাহজালাল ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। মালটি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি আইসিএল প্রতারণার মাধ্যমে নিয়েছে ৩৭০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ এমএলএম কোম্পানি ম্যাক্সিম গ্রুপ প্রতারণার মাধ্যমে নিয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা।
ব্যাংক জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া ওই ১৫ হাজার কোটি টাকার কানাকড়িও উদ্ধার করা যায়নি। উদ্ধারের কোন সম্ভাবনা আছে এমনটাও মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। উপরন্তু হল-মার্কের ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটিকে আবার অর্থায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যে আতঙ্কগ্রস্ত ব্যাংকপাড়ার লোকেরা এটাকে আরেকটি লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টির কথাই মনে করছেন।
হল-মার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখাকে ভিত্তি করে ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে এলসি জালিয়াতি ও ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে ২৬৮৫ কোটি টাকা। ওই একই সময়ে শাখাটি লুটপাটের এক তীর্থে পরিণত হয়। হল-মার্কের এমডি তানভীর মাহমুদের লুটপাটের সহযোগী বলে পরিচিত আরও চারটি এবং সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী বাহারুলের ভাগ্নের প্রতিষ্ঠান মিলে লুটে নেয় ১০০০ কোটি টাকা। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে কাজী বাহারুলের ভাগ্নে মোতাহার হোসেনের প্রতিষ্ঠান ডিএন স্পোর্টস-এর পরিচালক, তার জামাতা জনি ও মেয়ে শিখা। তাদের সঙ্গে কাজী বাহারুলের আত্মীয়তার সম্পর্ক দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। কেবল কাজী বাহারুলের ভাগ্নে পরিচয়ই তার ঋণ পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হয়ে ওঠে। একই সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ২৬৮ কোটি টাকা লুটে নেয় প্যারাগন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুল ইসলাম রাজা এক সময়ে ছিলেন হল-মার্কের জিএম। নকশী নিট নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নেয় প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা, নকশী নিটের স্বত্বাধিকারী আবদুল মালেক এক সময়ে ছিলেন হল-মার্ক গ্রুপের উপদেষ্টা। হল-মার্ক গ্রুপের লুটপাটের ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়লে সরকারের একজন উপদেষ্টা, সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও ব্যাংক কর্মকর্তা সহ মোট ৭৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মোট ২৭ জনকে আসামি করে মোট ১১টি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ূন কবীরকে আসামি করা হলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কাউকে আসামি করা হয়নি, যদিও হল-মার্ক এমডি আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, তিনি ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক কমল সরোয়ারকে রূপসী বাংলা হোটেলের পুলপাড়ে বসে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন।
পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়াদি নিয়ে দুদক ও সরকারের সঙ্গে টানাপড়েনের মাঝে শেষ পর্যন্ত ঋণ প্রত্যাহার করে ফিরে গেছে বিশ্বব্যাংক সহ সহযোগী দাতারা। পরামর্শক নিয়োগের দুর্নীতির ডামাডোলে অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে পদ্মা সেতুর নকশা তৈরির নামে নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান এইকমের সঙ্গে সরকারের রাজস্বখাতের ১শ’ ১৬ কোটি টাকা ভাগাভাগির ঘটনা।
সৈয়দ আবুল হোসেন দায়িত্বে থাকাকালে সেতুর চূড়ান্ত নকশা গ্রহণ না করেই রাজস্বখাত থেকে ওই টাকা দেয়া হয়। ঠিক হল-মার্ক গ্রুপের আদলে ৪টি ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ। ওই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত খোন্দকার মোশতাকের এক নিকট আত্মীয় এবং কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় এক এমপি’র ছেলে। মূল হোতা ওই আত্মীয় বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলেমান ও গ্রুপের চেয়ারম্যান তার স্ত্রী নওরীন হাবিব দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বর্তমানে আছেন দুবাইতে। বিসমিল্লাহ গ্রুপের লুটপাট অনুসন্ধানে দুদক ইতিমধ্যেই একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করে নথিপত্র পর্যালোচনা শুরু করেছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা থেকে মাত্র ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ নিয়ে এলসি জালিয়াতি করে। কাঁচামাল আমদানির নামে এলসি খুলেও বিপুল অঙ্কের ওই টাকা হাতিয়ে নেয়। কাঁচামাল আমদানির কথা বললেও তারা কোন কাঁচা মাল না এনে ভুয়া এলসি খুলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। সূত্রমতে এ পর্যন্ত তারা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ইস্কাটন শাখা থেকে ১৪৯ কোটি, প্রাইম ব্যাংক থেকে ৩৮০ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ৮০ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৩টি শাখা থেকে ৪০০ কোটি এবং যমুনা ব্যাংক থেকে ১৬৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।
গ্রাহকদের দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে ডেসটিনি গ্রুপ দেশের জনসাধারণের কাছ থেকে ট্রি প্ল্যান্টেশন, আবাসন সহ বিভিন্ন খাতে লাভজনক বিনিয়োগের কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে ৩৩০০ কোটি টাকা। দুদক কর্মকর্তারা তাদের অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া ওই বিপুল পরিমাণ অর্থের পুরোটাই পকেটে তুলেছেন ডেসটিনি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে পাওয়া গেছে মাত্র কয়েক লাখ টাকা। তবে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ওই টাকার মধ্যে প্রায় ১শ’ কোটি টাকা সংস্থার এমডি রফিকুল আমিনের নামে গচ্ছিত আছে কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে। দুদক অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা জানিয়েছেন, ডেসটিনি আরও টাকা বিদেশে পাচার করেছে কিনা তা অনুসন্ধান করছে দুদক। ডেসটিনি’র এমডি রফিকুল আমিন সহ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্যায়ের ৩১ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা দায়ের করেছে দুদক। বর্তমানে ডেসটিনি’র এমডি রফিকুল আমিন সহ কারাগারে আছে ৭ জন। বাকিরা পলাতক।
ডেসটিনি’র মতো আরেক প্রতারক প্রতিষ্ঠান এমএলএম কোম্পানি ইউনিপেটুইউ মাত্র ১০ মাসে বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ দেয়ার কথা বলে জনসাধারণের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়ে ইতিমধ্যে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ৭ জন গ্রাহক। ঘরবাড়ি ছাড়া কয়েক হাজার মধ্যস্বত্ব ভোগী বিনিয়োগকারী। দুই বছর সময় পেরিয়ে গেলেও কোন গ্রাহক তাদের টাকা ফেরত পায়নি। জালিয়াতির মাধ্যমে সাধারণের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ইউনিপেটুইউ’র বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে দুদক। মামলার চার্জশিটও দেয়া হয়েছে। দুদকের দায়ের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানের এমডি মুনতাসির ইমন সহ মোট ১১ জন কারাগারে আছেন। অর্থ আত্মসাতের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে দায়ের করা একটি মামলায় ২ বছরের দণ্ড হয়েছে তাদের। আলাপকালে জানা গেছে, এতে খুশি ইউনিপেটুইউ’র সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা। ৩৬০০ কোটি টাকা লুটে নিয়ে ২ বছর জেলখাটাকে তারা লাভজনকই মনে করছেন।
আইডিয়াল কোঅপারেটিভ সোসাইটি আইসিএল একটি এমএলএম কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নেয় ২০০১ সালে। হজ আমানত, ডিপিএস, মাসিক দ্বিগুণ মুনাফা, বার্ষিক দ্বিগুণ মুনাফা, কোটিপতি স্কিম সহ মোট ১৩টি প্রকল্পে আকর্ষণীয় প্রচারের দ্বিগুণ মুনাফা দেয়ার কথা বলে আইসিএল মোট ৩৭০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে জনগণের কাছ থেকে। গত বছর শেষের দিকে হঠাৎ করে একযোগে তালাবদ্ধ পাওয়া যায় পল্টনে তাদের প্রধান কার্যালয় সহ মোট ৩৬টি শাখা কার্যালয়ে। বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চাইতে গিয়ে গ্রাহকরা জানতে পারে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেও আইসিএল-এর এমডি সফিকুর রহমান, তার স্ত্রী সামসুন নাহার মিনা, ভাই ফকরুল ইসলাম ও ভাগ্নে শেখ আহমেদ। আইসিএল-এর প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গত মাসে দুদক ৫ সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে।
অস্তিত্বহীন আবাসন প্রকল্পের কথা প্রচার করে গ্রাহকের ১৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়েছে ম্যাক্সিম গ্রুপের এমডি হাবিবুর রহমান। গ্রাহকদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাওয়ার পরই চলতি মাসে ম্যাক্সিম গ্রুপ তাদের ইউনিটগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ম্যাক্সিম গ্রুপের লুটপাটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন ও ফরিদপুর-১ আসনের এমপি আবদুর রহমানের একটি ছবি ব্যবহারের কথা, ম্যাক্সিম গ্রুপের পুরানা পল্টনের অফিসে বিশাল করে টাঙানো ছবিতে দেখা যায় গ্রুপের পলাতক এমডি হাবিবুর রহমানকে ক্রেস্ট উপহার দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন ও সংসদ সদস্য আবদুর রহমান। অভিযোগ উঠেছে কেবল ছবি নয়, ওই দুই নেতাকে ব্যবহার করে গ্রুপে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এখন আবার অর্থ ফেরত না দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ওই ছবি।
ম্যাক্সিম গ্রুপের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টিও আমলে নিচ্ছে দুদক। সূত্রমতে সাধারণ গ্রাহকের বিপুল অর্থ ফেরত দেয়ার বদলে উল্টো তাদের ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিতে সরকারকে চিঠি দিয়েছে ডেসটিনি। অন্যদিকে হল-মার্ককে আরও ঋণ দেয়ার অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে তোলপাড় চলছে ব্যবসায়ী সহ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভেতর।
ব্যাপক ওই লুটপাট সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, সামপ্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষের দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রুত অর্থ আয় করে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তাদের এ প্রবণতাকে হালে পানি পাইয়ে দিচ্ছে আইনের বেশ কিছু দুর্বলতা এবং আইনপ্রয়োগকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দুর্নীতির প্রবণতা। অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিজে দুর্নীতি করে দুর্নীতিবাজদের আরও সুযোগ করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রায় মহামারী আকারে বিস্তারিত ওই দুর্নীতি থেকে দেশ ও জাতির পরিত্রাণের জন্য সবার আগে দরকার সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা থেকে মুক্ত হওয়া এবং রাষ্ট্রীয় তদারক বৃদ্ধি করা। দেখা যায়, দুদক অনেক কষ্ট করে অনুসন্ধান শেষে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা করার পর দিনের পর দিন মামলা বিচারাধীন পড়ে থাকে তাতে অন্য দুর্নীতিবাজরা নিজেদেরকে আরও উৎসাহিত বোধ করে। এছাড়া, সব সময়ই দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতার ভেতরে বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে বলে সহসা তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এ ধরনের দুর্নীতি দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে, বাস্তবে দুর্নীতি এখন ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে।
। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ও শাহজালাল ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। মালটি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি আইসিএল প্রতারণার মাধ্যমে নিয়েছে ৩৭০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ এমএলএম কোম্পানি ম্যাক্সিম গ্রুপ প্রতারণার মাধ্যমে নিয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা।
ব্যাংক জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া ওই ১৫ হাজার কোটি টাকার কানাকড়িও উদ্ধার করা যায়নি। উদ্ধারের কোন সম্ভাবনা আছে এমনটাও মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। উপরন্তু হল-মার্কের ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখার কথা বলে প্রতিষ্ঠানটিকে আবার অর্থায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যে আতঙ্কগ্রস্ত ব্যাংকপাড়ার লোকেরা এটাকে আরেকটি লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টির কথাই মনে করছেন।
হল-মার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখাকে ভিত্তি করে ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে এলসি জালিয়াতি ও ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে ২৬৮৫ কোটি টাকা। ওই একই সময়ে শাখাটি লুটপাটের এক তীর্থে পরিণত হয়। হল-মার্কের এমডি তানভীর মাহমুদের লুটপাটের সহযোগী বলে পরিচিত আরও চারটি এবং সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী বাহারুলের ভাগ্নের প্রতিষ্ঠান মিলে লুটে নেয় ১০০০ কোটি টাকা। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে কাজী বাহারুলের ভাগ্নে মোতাহার হোসেনের প্রতিষ্ঠান ডিএন স্পোর্টস-এর পরিচালক, তার জামাতা জনি ও মেয়ে শিখা। তাদের সঙ্গে কাজী বাহারুলের আত্মীয়তার সম্পর্ক দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। কেবল কাজী বাহারুলের ভাগ্নে পরিচয়ই তার ঋণ পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা হয়ে ওঠে। একই সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ২৬৮ কোটি টাকা লুটে নেয় প্যারাগন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুল ইসলাম রাজা এক সময়ে ছিলেন হল-মার্কের জিএম। নকশী নিট নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নেয় প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা, নকশী নিটের স্বত্বাধিকারী আবদুল মালেক এক সময়ে ছিলেন হল-মার্ক গ্রুপের উপদেষ্টা। হল-মার্ক গ্রুপের লুটপাটের ঘটনা প্রকাশিত হয়ে পড়লে সরকারের একজন উপদেষ্টা, সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও ব্যাংক কর্মকর্তা সহ মোট ৭৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মোট ২৭ জনকে আসামি করে মোট ১১টি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ূন কবীরকে আসামি করা হলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কাউকে আসামি করা হয়নি, যদিও হল-মার্ক এমডি আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, তিনি ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক কমল সরোয়ারকে রূপসী বাংলা হোটেলের পুলপাড়ে বসে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন।
পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়াদি নিয়ে দুদক ও সরকারের সঙ্গে টানাপড়েনের মাঝে শেষ পর্যন্ত ঋণ প্রত্যাহার করে ফিরে গেছে বিশ্বব্যাংক সহ সহযোগী দাতারা। পরামর্শক নিয়োগের দুর্নীতির ডামাডোলে অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে পদ্মা সেতুর নকশা তৈরির নামে নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান এইকমের সঙ্গে সরকারের রাজস্বখাতের ১শ’ ১৬ কোটি টাকা ভাগাভাগির ঘটনা।
সৈয়দ আবুল হোসেন দায়িত্বে থাকাকালে সেতুর চূড়ান্ত নকশা গ্রহণ না করেই রাজস্বখাত থেকে ওই টাকা দেয়া হয়। ঠিক হল-মার্ক গ্রুপের আদলে ৪টি ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ। ওই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত খোন্দকার মোশতাকের এক নিকট আত্মীয় এবং কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় এক এমপি’র ছেলে। মূল হোতা ওই আত্মীয় বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলেমান ও গ্রুপের চেয়ারম্যান তার স্ত্রী নওরীন হাবিব দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বর্তমানে আছেন দুবাইতে। বিসমিল্লাহ গ্রুপের লুটপাট অনুসন্ধানে দুদক ইতিমধ্যেই একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করে নথিপত্র পর্যালোচনা শুরু করেছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা থেকে মাত্র ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ নিয়ে এলসি জালিয়াতি করে। কাঁচামাল আমদানির নামে এলসি খুলেও বিপুল অঙ্কের ওই টাকা হাতিয়ে নেয়। কাঁচামাল আমদানির কথা বললেও তারা কোন কাঁচা মাল না এনে ভুয়া এলসি খুলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। সূত্রমতে এ পর্যন্ত তারা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ইস্কাটন শাখা থেকে ১৪৯ কোটি, প্রাইম ব্যাংক থেকে ৩৮০ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ৮০ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৩টি শাখা থেকে ৪০০ কোটি এবং যমুনা ব্যাংক থেকে ১৬৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।
গ্রাহকদের দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে ডেসটিনি গ্রুপ দেশের জনসাধারণের কাছ থেকে ট্রি প্ল্যান্টেশন, আবাসন সহ বিভিন্ন খাতে লাভজনক বিনিয়োগের কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে ৩৩০০ কোটি টাকা। দুদক কর্মকর্তারা তাদের অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া ওই বিপুল পরিমাণ অর্থের পুরোটাই পকেটে তুলেছেন ডেসটিনি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে পাওয়া গেছে মাত্র কয়েক লাখ টাকা। তবে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ওই টাকার মধ্যে প্রায় ১শ’ কোটি টাকা সংস্থার এমডি রফিকুল আমিনের নামে গচ্ছিত আছে কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে। দুদক অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা জানিয়েছেন, ডেসটিনি আরও টাকা বিদেশে পাচার করেছে কিনা তা অনুসন্ধান করছে দুদক। ডেসটিনি’র এমডি রফিকুল আমিন সহ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্যায়ের ৩১ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা দায়ের করেছে দুদক। বর্তমানে ডেসটিনি’র এমডি রফিকুল আমিন সহ কারাগারে আছে ৭ জন। বাকিরা পলাতক।
ডেসটিনি’র মতো আরেক প্রতারক প্রতিষ্ঠান এমএলএম কোম্পানি ইউনিপেটুইউ মাত্র ১০ মাসে বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ দেয়ার কথা বলে জনসাধারণের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়ে ইতিমধ্যে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ৭ জন গ্রাহক। ঘরবাড়ি ছাড়া কয়েক হাজার মধ্যস্বত্ব ভোগী বিনিয়োগকারী। দুই বছর সময় পেরিয়ে গেলেও কোন গ্রাহক তাদের টাকা ফেরত পায়নি। জালিয়াতির মাধ্যমে সাধারণের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ইউনিপেটুইউ’র বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে দুদক। মামলার চার্জশিটও দেয়া হয়েছে। দুদকের দায়ের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানের এমডি মুনতাসির ইমন সহ মোট ১১ জন কারাগারে আছেন। অর্থ আত্মসাতের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে দায়ের করা একটি মামলায় ২ বছরের দণ্ড হয়েছে তাদের। আলাপকালে জানা গেছে, এতে খুশি ইউনিপেটুইউ’র সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা। ৩৬০০ কোটি টাকা লুটে নিয়ে ২ বছর জেলখাটাকে তারা লাভজনকই মনে করছেন।
আইডিয়াল কোঅপারেটিভ সোসাইটি আইসিএল একটি এমএলএম কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নেয় ২০০১ সালে। হজ আমানত, ডিপিএস, মাসিক দ্বিগুণ মুনাফা, বার্ষিক দ্বিগুণ মুনাফা, কোটিপতি স্কিম সহ মোট ১৩টি প্রকল্পে আকর্ষণীয় প্রচারের দ্বিগুণ মুনাফা দেয়ার কথা বলে আইসিএল মোট ৩৭০০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে জনগণের কাছ থেকে। গত বছর শেষের দিকে হঠাৎ করে একযোগে তালাবদ্ধ পাওয়া যায় পল্টনে তাদের প্রধান কার্যালয় সহ মোট ৩৬টি শাখা কার্যালয়ে। বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চাইতে গিয়ে গ্রাহকরা জানতে পারে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেও আইসিএল-এর এমডি সফিকুর রহমান, তার স্ত্রী সামসুন নাহার মিনা, ভাই ফকরুল ইসলাম ও ভাগ্নে শেখ আহমেদ। আইসিএল-এর প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গত মাসে দুদক ৫ সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে।
অস্তিত্বহীন আবাসন প্রকল্পের কথা প্রচার করে গ্রাহকের ১৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়েছে ম্যাক্সিম গ্রুপের এমডি হাবিবুর রহমান। গ্রাহকদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাওয়ার পরই চলতি মাসে ম্যাক্সিম গ্রুপ তাদের ইউনিটগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ম্যাক্সিম গ্রুপের লুটপাটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন ও ফরিদপুর-১ আসনের এমপি আবদুর রহমানের একটি ছবি ব্যবহারের কথা, ম্যাক্সিম গ্রুপের পুরানা পল্টনের অফিসে বিশাল করে টাঙানো ছবিতে দেখা যায় গ্রুপের পলাতক এমডি হাবিবুর রহমানকে ক্রেস্ট উপহার দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন ও সংসদ সদস্য আবদুর রহমান। অভিযোগ উঠেছে কেবল ছবি নয়, ওই দুই নেতাকে ব্যবহার করে গ্রুপে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এখন আবার অর্থ ফেরত না দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ওই ছবি।
ম্যাক্সিম গ্রুপের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টিও আমলে নিচ্ছে দুদক। সূত্রমতে সাধারণ গ্রাহকের বিপুল অর্থ ফেরত দেয়ার বদলে উল্টো তাদের ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিতে সরকারকে চিঠি দিয়েছে ডেসটিনি। অন্যদিকে হল-মার্ককে আরও ঋণ দেয়ার অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে তোলপাড় চলছে ব্যবসায়ী সহ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভেতর।
ব্যাপক ওই লুটপাট সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, সামপ্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষের দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রুত অর্থ আয় করে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তাদের এ প্রবণতাকে হালে পানি পাইয়ে দিচ্ছে আইনের বেশ কিছু দুর্বলতা এবং আইনপ্রয়োগকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দুর্নীতির প্রবণতা। অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিজে দুর্নীতি করে দুর্নীতিবাজদের আরও সুযোগ করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রায় মহামারী আকারে বিস্তারিত ওই দুর্নীতি থেকে দেশ ও জাতির পরিত্রাণের জন্য সবার আগে দরকার সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা থেকে মুক্ত হওয়া এবং রাষ্ট্রীয় তদারক বৃদ্ধি করা। দেখা যায়, দুদক অনেক কষ্ট করে অনুসন্ধান শেষে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা করার পর দিনের পর দিন মামলা বিচারাধীন পড়ে থাকে তাতে অন্য দুর্নীতিবাজরা নিজেদেরকে আরও উৎসাহিত বোধ করে। এছাড়া, সব সময়ই দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতার ভেতরে বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে বলে সহসা তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এ ধরনের দুর্নীতি দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছে, বাস্তবে দুর্নীতি এখন ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে।
No comments