বাংলানিউজকে ড. কামাল হোসেনঃ সরকারই গণজাগরণকে বিতর্কিত করছে
শাহবাগ
প্রজন্ম চত্বরে তরুণদের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতদুষ্ট নয়। এটি
সমাজকে বদলে দেওয়ার আন্দোলন। দেশকে কলঙ্কমুক্ত করার আন্দোলন। তরুণদের এই
আন্দোলনকে আমি মনেপ্রাণে সমর্থন করি। তাই এ আন্দোলনে আমিও অংশ নিয়েছি।
সরকার তরুণদের এই আন্দোলন দিয়ে তাদের সব ব্যর্থতা মুছতে চাইছে। তারুণ্যের
গণজাগরণকে ইচ্ছে করেই বিতর্ক সৃষ্টি করে পচানোর চেষ্টা চলছে সরকারের পক্ষ
থেকেই। কিন্তু জনগণ সেটি বুঝতে পেরেছে।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে তরুণদের চলমান গণজাগরণ সম্পর্কে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বেইলি রোডে তার বাসভবনে ড. কামাল হোসেন প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী বাংলানিউজকে এক দীর্ঘ এবং একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, যুদ্ধাপরাধের বিচার, শাহবাগ তরুণদের গণজাগরণ এবং দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত এবং অর্জনগুলো তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আদিত্য আরাফাত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও মাজেদুল নয়ন।
ড. কামাল হোসেন: বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। দেশের রাজনীতিতে তিনি সবসময়ই সোচ্চার। জন্ম ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল। ১৯৫৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি লাভ করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
শাহবাগের তরুণদের যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি সম্পর্কে ড. কামাল বলেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু এটি দিয়ে বাকি সব ভুলিয়ে দিতে চাইলে চলবে না। দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। হলমার্ক, শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মাসেতু, ডেসটিনিসহ অনেক ইস্যু আছে। এগুলো এখন আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকার যদি এটা দিয়ে অন্যকিছু ভুলিয়ে রাখতে চায়, তবে তা ভুল। কারণ জনগণ সচেতন হচ্ছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চায়, আবার দেশের বিদ্যমান সমস্যার সমাধানও দেখতে চায়।’’
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘‘ধরা যাক শরীরে অনেক ব্যাধি। এর মধ্যে ক্যান্সারও আছে, টিউমারও আছে, জটিল অন্যান্য রোগও আছে। এখন শুধু ক্যান্সার নিরাময় করলেই হবে না। অন্যান্য জটিল রোগ যেগুলো আছে, ক্যান্সারের চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য রোগও নিরাময়ের চেষ্টা করতে হবে।’’
গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে বিএনপির অবস্থান শুরুতে স্পষ্ট না থাকলেও পরে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তা স্পষ্ট করেছেন। তিনি (খালেদা) বলেছেন, শাহবাগে যারা গিয়েছেন, তারা নাস্তিক। এ বিষয়ে ড. কামাল বলেন, ‘‘আমার কথা হলো বিএনপি নিয়ে আমরা এত মাথা ঘামাচ্ছি কেন? এটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তারা যা করেছে তার জবাব তো ২০০৮ সালে জনগণ দিয়েছে। বিএনপির কথায় মাথা ঘামানোর কিছু নেই। নাস্তিকতা বাংলাদেশের কোনো ইস্যু নয়। এ দেশে কাউকে বেত্রাঘাত করে মসজিদে পাঠাতে হয় না। নিজ থেকেই মানুষ মসজিদে যায়। এখানে মানুষ পানি খেয়ে রোজা রাখে। কাজেই আস্তিকতা-নাস্তিকতা কোনো ইস্যুই মনে করি না। কে কি বললো তা নিয়ে ভাবিও না।’’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘‘এ দু`দলের উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে তারা মরিয়া।’’
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে তরুণদের দাবি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জামায়াতকে তো জনগণ গত নির্বাচনেই প্রত্যাখ্যান করেছে। মাত্র দু’টি আসন পেয়েছে তারা। তাদেরকে নিয়ে এত ভাবনা কেন?”
তিনি বলেন, ‘‘৭২ এর সংবিধানে থাকলে তো দলটি থাকার কথা না। তখন সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল। তখন জামায়াত ছিলোও না।’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি ১৬ বা ১৭ কোটি হয়, তাহলে জামায়াতের সদস্য-সমর্থক কত। মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই ভাগ তারা। তাই তাদের নিয়ে এত চিন্তা কিসের। সরকার জনগণের বিশাল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সংসদে তাদের যে আসন আছে, তাতে সংবিধান তারা যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে সংশোধন করতে পারে। কিন্তু, জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে, তারা জনগণের সেই সমর্থন কাজে লাগাচ্ছে না কেন?’’
দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘এই গুটি কয়েক মানুষকে সরকার দমন করতে পারছে না কেন। সরকারের ভয় কোথায়? সরকার জনগণের যে সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেটি কাজে লাগাক।’’
ড.কামাল হোসেন বলেন, ‘‘এখন অনেকেই জামায়াতের বিরোধিতা করছে। কিন্তু, তাদের অনেকেই জামায়াত পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা নিয়েছেন। জামায়াতের সুবিধা নিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।’’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এ সংবিধানে কিছু ত্রুটি আছে। এটি বললে অনেকেই বলবেন সংবিধানের বিরোধিতা করছি। তাই সংবিধানের কিছু জায়গায় সংশোধনী করা প্রয়োজন। এখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা শুধু স্বাক্ষর করা।’’
নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘শেখ মুজিবুর রহমান তো তার বাবার দোহাই দিয়ে বঙ্গবন্ধু হননি। তাজউদ্দিনও কারো পরিচয়ে হয়নি। এখন দেখছি মনোয়ন প্রার্থীদের পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছোট হতে শুরু করেছে। তাঁর মেয়ের ছবি বড় হয়ে উঠছে। কারণ, উনি মনোনয়ন দিচ্ছেন। আবার মনোনয়ন দিচ্ছেন টাকার বিনিময়ে। এসব কথা বলতে হবে। তা না হলে জনগণ আরো ক্ষমতাহীন হয়ে যাবে।”
‘‘খালেদা জিয়া হাওয়া ভবনকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে অনেক দুর্নীতি হয়েছে তার ফল তিনি ভোগ করছেন’’, মন্তব্য করেন ড. কামাল হোসেন।
বড় দু`দলের কাছে জনগণ জিম্মি না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কাউকে এ দেশ ইজারা দিইনি। জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। তরুণদের সবকিছুতে সচেতন হতে হবে। তবে আশার কথা এখনকার তরুণরা অনেক সচেতন, যা আমাদের আশা জাগায়।’’
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে বলছে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা বলতে হয় না। আমরা তো জানি কে কে যুদ্ধাপরাধী। তারা যাকে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী মনে করে তাদের নামের তালিকা করলেই তো পারে। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে না মনে করছে, তাদের তালিকা তৈরি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে জমা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের আহবান জানাতে পারে তারা। ঘটনার সাক্ষী, কোথায় কি করেছে তাও তারা দিয়ে দিক।’’
শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের শাস্তি না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে সরকার একটি তদন্ত করতে বলেছে। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দিলো কোথায় তারা? এখন হারিয়ে গেছে সে তদন্ত। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে বিশদ তদন্ত করা দরকার। এখন সেই বিষয়ে সরকার চুপ।’’
তিনি বলেন, ‘‘মানুষ দিনবদলের জন্য ভোট দিয়েছে। কি বদল হয়েছে? কেবল দুই দল, দুই দল—এদের নিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। আমরা বড় দল বলে পরিচিত দুটি দলের কাছে জিম্মি না। তাদের এত অগ্রাধিকার (প্রায়োরিটি) দেওয়ার কি আছে? তাদের কতই বা লোক হবে? বড়জোর কয়েক লাখ হবে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কয়েক লাখ লোক দু`দলে থাকলে তেমন প্রভাব পড়ে না। এ দেশ তো বড় দু`দলের কাছে জিম্মি না।’’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের বোধকে এখন জাগাতে হবে। চিন্তা করতে হবে ক্ষমতায় আমরা কাকে বসাবো? আমরা ৯ কোটি ভোটার কী তাদের কাছে অসহায়? না। আমাদের বিবেককে জাগাতে হবে।’’
‘‘জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। গণতন্ত্র হলো জনগণের ক্ষমতায়ন। কিন্তু রাষ্ট্র তো সেই নিয়মে চলছে না’’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘গণবিরোধী শক্তি গণতন্ত্রের নামে জনগণের ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে, ক্ষমতা আত্মসাৎ করছে অর্থের জোর খাটিয়ে।’’
গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে এবং অর্থবহ করতে হলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রখ্যাত এ আইনজীবী।
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘তরুণরাই পারে দেশকে বদলে দিতে। ক্ষমতার পালাবদল ঘটাতে। কারণ, অতীতে আমাদের যতগুলো ভালো অর্জন সবই এনে দিয়েছে তরুণরাই। তাই দেশের এই ক্রান্তলগ্নে তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিতেও তরুণদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। শাহবাগ থেকেই তরুণরা দেশকে বদলে দেওয়ার ডাক দিতে পারে। তবে তাদেরই ঠিক করতে হবে, তারা কার নেতৃত্বে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘দেশে অনেক তরুণ সৎ রাজনীতিক আছে। তাই তরুণরাই তাদের নেতৃত্ব ঠিক করবে।’’
শাহবাগের তরুণরা তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি রাজি হবেন কী না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কখনও নেতৃত্ব চাই না। কারণ, ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ আমার নেই। আমি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। তাই তরুণরা চাইলে আমি তাদের শিক্ষক হতে পারি।’’
(সাক্ষাৎকারের বাকি অংশ দেখুন শনিবার)
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে তরুণদের চলমান গণজাগরণ সম্পর্কে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বেইলি রোডে তার বাসভবনে ড. কামাল হোসেন প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী বাংলানিউজকে এক দীর্ঘ এবং একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, যুদ্ধাপরাধের বিচার, শাহবাগ তরুণদের গণজাগরণ এবং দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত এবং অর্জনগুলো তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজের চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আদিত্য আরাফাত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও মাজেদুল নয়ন।
ড. কামাল হোসেন: বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। দেশের রাজনীতিতে তিনি সবসময়ই সোচ্চার। জন্ম ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল। ১৯৫৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি লাভ করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
শাহবাগের তরুণদের যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি সম্পর্কে ড. কামাল বলেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু এটি দিয়ে বাকি সব ভুলিয়ে দিতে চাইলে চলবে না। দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। হলমার্ক, শেয়ার কেলেঙ্কারি, পদ্মাসেতু, ডেসটিনিসহ অনেক ইস্যু আছে। এগুলো এখন আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকার যদি এটা দিয়ে অন্যকিছু ভুলিয়ে রাখতে চায়, তবে তা ভুল। কারণ জনগণ সচেতন হচ্ছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চায়, আবার দেশের বিদ্যমান সমস্যার সমাধানও দেখতে চায়।’’
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘‘ধরা যাক শরীরে অনেক ব্যাধি। এর মধ্যে ক্যান্সারও আছে, টিউমারও আছে, জটিল অন্যান্য রোগও আছে। এখন শুধু ক্যান্সার নিরাময় করলেই হবে না। অন্যান্য জটিল রোগ যেগুলো আছে, ক্যান্সারের চিকিৎসার পাশাপাশি অন্য রোগও নিরাময়ের চেষ্টা করতে হবে।’’
গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে বিএনপির অবস্থান শুরুতে স্পষ্ট না থাকলেও পরে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তা স্পষ্ট করেছেন। তিনি (খালেদা) বলেছেন, শাহবাগে যারা গিয়েছেন, তারা নাস্তিক। এ বিষয়ে ড. কামাল বলেন, ‘‘আমার কথা হলো বিএনপি নিয়ে আমরা এত মাথা ঘামাচ্ছি কেন? এটাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তারা যা করেছে তার জবাব তো ২০০৮ সালে জনগণ দিয়েছে। বিএনপির কথায় মাথা ঘামানোর কিছু নেই। নাস্তিকতা বাংলাদেশের কোনো ইস্যু নয়। এ দেশে কাউকে বেত্রাঘাত করে মসজিদে পাঠাতে হয় না। নিজ থেকেই মানুষ মসজিদে যায়। এখানে মানুষ পানি খেয়ে রোজা রাখে। কাজেই আস্তিকতা-নাস্তিকতা কোনো ইস্যুই মনে করি না। কে কি বললো তা নিয়ে ভাবিও না।’’
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘‘এ দু`দলের উদ্দেশ্য ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে তারা মরিয়া।’’
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে তরুণদের দাবি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জামায়াতকে তো জনগণ গত নির্বাচনেই প্রত্যাখ্যান করেছে। মাত্র দু’টি আসন পেয়েছে তারা। তাদেরকে নিয়ে এত ভাবনা কেন?”
তিনি বলেন, ‘‘৭২ এর সংবিধানে থাকলে তো দলটি থাকার কথা না। তখন সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল। তখন জামায়াত ছিলোও না।’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি ১৬ বা ১৭ কোটি হয়, তাহলে জামায়াতের সদস্য-সমর্থক কত। মোট জনসংখ্যার মাত্র দুই ভাগ তারা। তাই তাদের নিয়ে এত চিন্তা কিসের। সরকার জনগণের বিশাল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সংসদে তাদের যে আসন আছে, তাতে সংবিধান তারা যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে সংশোধন করতে পারে। কিন্তু, জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে, তারা জনগণের সেই সমর্থন কাজে লাগাচ্ছে না কেন?’’
দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘এই গুটি কয়েক মানুষকে সরকার দমন করতে পারছে না কেন। সরকারের ভয় কোথায়? সরকার জনগণের যে সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেটি কাজে লাগাক।’’
ড.কামাল হোসেন বলেন, ‘‘এখন অনেকেই জামায়াতের বিরোধিতা করছে। কিন্তু, তাদের অনেকেই জামায়াত পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা নিয়েছেন। জামায়াতের সুবিধা নিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।’’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এ সংবিধানে কিছু ত্রুটি আছে। এটি বললে অনেকেই বলবেন সংবিধানের বিরোধিতা করছি। তাই সংবিধানের কিছু জায়গায় সংশোধনী করা প্রয়োজন। এখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা শুধু স্বাক্ষর করা।’’
নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘শেখ মুজিবুর রহমান তো তার বাবার দোহাই দিয়ে বঙ্গবন্ধু হননি। তাজউদ্দিনও কারো পরিচয়ে হয়নি। এখন দেখছি মনোয়ন প্রার্থীদের পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছোট হতে শুরু করেছে। তাঁর মেয়ের ছবি বড় হয়ে উঠছে। কারণ, উনি মনোনয়ন দিচ্ছেন। আবার মনোনয়ন দিচ্ছেন টাকার বিনিময়ে। এসব কথা বলতে হবে। তা না হলে জনগণ আরো ক্ষমতাহীন হয়ে যাবে।”
‘‘খালেদা জিয়া হাওয়া ভবনকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে অনেক দুর্নীতি হয়েছে তার ফল তিনি ভোগ করছেন’’, মন্তব্য করেন ড. কামাল হোসেন।
বড় দু`দলের কাছে জনগণ জিম্মি না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কাউকে এ দেশ ইজারা দিইনি। জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। তরুণদের সবকিছুতে সচেতন হতে হবে। তবে আশার কথা এখনকার তরুণরা অনেক সচেতন, যা আমাদের আশা জাগায়।’’
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে বলছে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা বলতে হয় না। আমরা তো জানি কে কে যুদ্ধাপরাধী। তারা যাকে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী মনে করে তাদের নামের তালিকা করলেই তো পারে। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে না মনে করছে, তাদের তালিকা তৈরি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে জমা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের আহবান জানাতে পারে তারা। ঘটনার সাক্ষী, কোথায় কি করেছে তাও তারা দিয়ে দিক।’’
শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের শাস্তি না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে সরকার একটি তদন্ত করতে বলেছে। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দিলো কোথায় তারা? এখন হারিয়ে গেছে সে তদন্ত। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে বিশদ তদন্ত করা দরকার। এখন সেই বিষয়ে সরকার চুপ।’’
তিনি বলেন, ‘‘মানুষ দিনবদলের জন্য ভোট দিয়েছে। কি বদল হয়েছে? কেবল দুই দল, দুই দল—এদের নিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। আমরা বড় দল বলে পরিচিত দুটি দলের কাছে জিম্মি না। তাদের এত অগ্রাধিকার (প্রায়োরিটি) দেওয়ার কি আছে? তাদের কতই বা লোক হবে? বড়জোর কয়েক লাখ হবে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কয়েক লাখ লোক দু`দলে থাকলে তেমন প্রভাব পড়ে না। এ দেশ তো বড় দু`দলের কাছে জিম্মি না।’’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের বোধকে এখন জাগাতে হবে। চিন্তা করতে হবে ক্ষমতায় আমরা কাকে বসাবো? আমরা ৯ কোটি ভোটার কী তাদের কাছে অসহায়? না। আমাদের বিবেককে জাগাতে হবে।’’
‘‘জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। গণতন্ত্র হলো জনগণের ক্ষমতায়ন। কিন্তু রাষ্ট্র তো সেই নিয়মে চলছে না’’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘গণবিরোধী শক্তি গণতন্ত্রের নামে জনগণের ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে, ক্ষমতা আত্মসাৎ করছে অর্থের জোর খাটিয়ে।’’
গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে এবং অর্থবহ করতে হলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রখ্যাত এ আইনজীবী।
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘তরুণরাই পারে দেশকে বদলে দিতে। ক্ষমতার পালাবদল ঘটাতে। কারণ, অতীতে আমাদের যতগুলো ভালো অর্জন সবই এনে দিয়েছে তরুণরাই। তাই দেশের এই ক্রান্তলগ্নে তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিতেও তরুণদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। শাহবাগ থেকেই তরুণরা দেশকে বদলে দেওয়ার ডাক দিতে পারে। তবে তাদেরই ঠিক করতে হবে, তারা কার নেতৃত্বে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘দেশে অনেক তরুণ সৎ রাজনীতিক আছে। তাই তরুণরাই তাদের নেতৃত্ব ঠিক করবে।’’
শাহবাগের তরুণরা তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি রাজি হবেন কী না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কখনও নেতৃত্ব চাই না। কারণ, ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ আমার নেই। আমি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। তাই তরুণরা চাইলে আমি তাদের শিক্ষক হতে পারি।’’
(সাক্ষাৎকারের বাকি অংশ দেখুন শনিবার)
No comments