২২ মার্চ শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কী ঘটেছিল
‘বিকাল তখন
সোয়া ৫টা হবে। হাবলা উচ্চ গ্রামের পশ্চিম দিকে লক্ষ্য করি হাতির সুরের মতো
একটি কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি তীব্র বেগে এগিয়ে আসছিল। সঙ্গে উড়ছে মানুষের
কাপড়-চোপড় এবং গাছের পাতা।
তখন লু-হাওয়াও ছিল। এই হাওয়া যার শরীরে লেগেছে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দেখে আমরা কোরআন শরীফ পড়তে শুরু করি।’
একই উপজেলার আমোদাবাদ গ্রামের বাসিন্দা আবদুল বাছির বলেন, ‘শোঁ শোঁ শব্দে পোড়াগন্ধ আর তাপ ছিল ধোঁয়ার কুণ্ডুলিতে। এটি যে দিকে গেছে সে দিকেই শেষ করে দিয়ে গেছে।’
সদর উপজেলার বাসুদেব গ্রামে টর্নেডোর তাণ্ডব প্রত্যক্ষ্য করেন মো. মালেক। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে একটি দোকানে চা খাচ্ছিলাম। এ সময় উত্তর দিকে আকাশে কালো কুণ্ডলী দেখতে পাই। মুহূর্তের মধ্যেই পাশের জারুলতলা গ্রাম যেন উড়ে যেতে দেখি। আমরা সবাই তখন নিচে শুয়ে পড়ি। অনেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুক্রবার বিকেল ৫টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিভিন্ন স্থানে বড় আকারের শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। এর কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় টর্নেডোর তান্ডব।
মুহূর্তের মধ্যেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সদর উপজেলার রামরাইল, উড়শিউড়া, ভাতশালা, পাতিরহাতা, পাইকপাড়া, চিনাইর, চান্দি, সোহাতা, বাসুদেব, খেওয়াই; আখাউড়া উপজেলার আজমপুর, আমোদাবাদ ও জারুইতলা এবং বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ও পত্তনসহ কমপক্ষে ১৫টি গ্রাম।
এ সময় কাঁচা বাড়িঘরের টিনের চাল, কাপড়চোপর, বিছানাপত্র, থালা-বাসন আকাশে উড়তে থাকে। বহু ঘরের শত শত টিনের চাল ৩৩ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের লাইনের ওপর আঘাত হানে। টর্নেডোর প্রচণ্ডতায় বিপুল সংখ্যক শিশু, নারী ও পুরুষ এক এলাকা থেকে উড়ে গিয়ে অন্য এলাকায় আছড়ে পড়ে।
কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের ওপর একের পর এক রাস্তার পাশের গাছ উপড়ে পড়ে। যাত্রীবাহী বাস, সিএনজিসহ বিভিন্ন যানবাহন সড়কের পাশের খাদে গিয়ে আছড়ে পড়ে। এতে বাসযাত্রীসহ বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা গুরুতর আহত হয়।
আখাউড়ার রাধানগর গ্রামের রুকন উদ্দিন জানান, ‘আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া আসছিলেন। উড়শিউড়া পার হওয়ার পর পেছন ফিরে দেখি অনেক গাড়ি বাতাসে উড়ে যাচ্ছে।’
টর্নেডোর আঘাতে উড়শিউড়া গ্রামে অবস্থিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের পশ্চিম পাশের দেয়াল ধ্বসে পড়ে। এ দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে কারারক্ষী মাসুদুর রহমান ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময়ের দেয়াল চাপা পড়ে কয়েকজন কয়েদিও নিহত হন।
টর্নেডোর শিকার গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে এসব এলাকার পাক ভবন গুলো ছাড়া প্রায় সব কাঁচাবাড়ি ঘরবাড়ি ঝড়ে উড়ে গেছে। ভাতশালা রেলস্টেশনটি পুরোপুরি উড়ে গেছে। স্থানীয় বাজারগুলোর কাঁচা দোকানপাটের বেশির ভাগ উড়ে গেছে বা ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় বিদুৎতের খুঁটি উপড়ে পড়েছ। ধুবলার চরসহ অনেক জায়গায় পাকা রাস্তা পর্যন্ত উঠে গেছে।
স্থানীয় পুলিশ, বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫ জন শিশু, নারী ও পুরুষ নিহত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া গেছে, সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের আবু তাহের মিয়া(৬০) ও জেলা কারাগারের রক্ষী মাসুদুর রহমান(২৫); উরশিউড়া গ্রামের হাসনা; পাইকপাড়া গ্রাম নিবাসী আশুগঞ্জ সার কারখানার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মাহমুদুল হক (৩৮), তার ভাই এমদাদুল বারী (৪০) ও আজমল; চিনাইর গ্রামের ঝানু চৌধুরী(৫২); পাতিরহাতা গ্রামের ডলি রানী দে(২৭) ও জরি আক্তার (২৫); জারুলতলা গ্রামের সুমা আক্তার (১০), জয়নাল মিয়া (৩২), মোবাইল ব্যবসায়ী বাবু (২৫), মিজান (৩২), অজ্ঞাত পরিচয়ের দেড় বছরের মেয়ে শিশু ও ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ; বিজয়নগরের পত্তন গ্রামের লাবলী বেগম(৩৫) এবং আখাউড়ার জারুইতলা গ্রামের জয়নাল মিয়া(৩২), ইলি বেগম(৪০), কাশেম মিয়া(৫৫) ও ইমরানের।
এছাড়াও কোড্ডা গ্রামের রানা মিয়া, চান্দি গ্রামের ফজলু মিয়া, তাজুল ইসলাম ও দোবলা গ্রামের নাজমা বেগম মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেলেও তাদের বিস্তারিত পরিচয় ও বয়স নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাকি এক জনের পরিচয় জানা যায় নি।
সূত্র জানায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, বিজয়নগর ও আখাউড়া উপজেলার কমপক্ষে ১২শ’ শিশু, নারী ও পুরুষ আহত অবস্থায় কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল, আখাউড় হাসপাতাল ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তবে দুর্গত গ্রামগুলোর সড়কে গাছগাছালি ভেঙে পড়ায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে বহু আহত রোগীকে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ব্যাপক সংখ্যক আহত রোগীর চিকিত্সার ব্যাপারে ১২ নম্বর সেক্টর বিজিবির সেক্টর কমান্ডার লে.কর্ণেল মাকসুদুল আলম জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে দুর্গত এলাকায় বিজিবির একটি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর থেকে আরেকটি মেডিক্যাল টিম চাওয়া হয়েছে।
মাকসুদুল জানান, বিভিন্নস্থানে নিরাপত্তা এবং সহায়তার জন্য বিজিবি’র মোট নয়টি পেট্রোল দেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী জানান, আখাউড়ায় ৫ জন ও সদরে ১৪ জনসহ মোট ১৯ জন মারা গেছে।
সদর হাসাপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা.আবু সাঈদ জানান, ‘সদর হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে আসা আহত রোগীদের মধ্যে মোট ৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ডলি রানী দে ও লাভলী আক্তারে পরিচয় জানা গেলেও বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
সদর হাসপাতালে ৩০ বছরের অজ্ঞাত এক পুরুষের লাশ পড়ে রয়েছে হাসপাতালে পড়ে রয়েছে বলেও জানান, সাঈদ।
আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তা ডা.মো.শাহাআলম জানান,স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সুমা আক্তার (১০) এবং জয়নাল মিয়া (৩২) রয়েছেন। তারা দুজন সদর উপজেলার জারুলতলা গ্রামের বাসীন্ধা। অন্য তিনজনের লাশ পরিবারের লোকজন নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি তাদের পরিচয় তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
ঝড়ে প্রাণহানির ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক নূর মোহাম্মদ মজুমদার জানিয়েছেন, ‘এ পর্যন্ত ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। আহতদের ৬০ জনকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
বাকিদের স্থানীয় বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। আহত কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
ইতিমধ্যে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, ১ বান্ডেল টিন এবং ২০ কেজি চাল দেওয়ার ঘোষনা দেওয়া হয়েছে।, যোগ করেন নূর মোহাম্মদ।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন চাকমা টর্নেডোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। তিনি, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছি। হিসেব না করে ক্ষয়ক্ষতি পরিমান বলা যাবে না।’
অন্যদিকে টর্নেডোর কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট রেলপথে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় রেললাইনের ওপর গাছ পড়ে থাকার এই দুই রুটে রেলযোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়।
আখাউড়া জংশনের লোকোশেড ইনচার্জ মো.মহসিন ভূইয়া জানান,সদর উপজেলার ভাতশালা রেলওয়ে স্টেশনে গাছ পড়ে থাকায় টর্নেডোর পর থেকেই স্টেশনটি বন্ধ রয়েছে।
রাত সাড়ে আটটার দিকে রেললাইনকে চলাচল উপযুক্ত করার কাজ শুরু হয়। পরে রাত ১০টায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এদিকে বাহ্মণবাড়িয়া জেলা সুপার গিয়াসউদ্দিন জানান, ‘কারাগারের পশ্চিম পাশের দেয়ালটি ভেঙে ১ জন কারারক্ষী নিহত ও অপরজন আহত হয়েছে। তবে এতে কারাগারের কোনো কয়েদির হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দেয়াল ভেঙে পড়ার পরপর কারাকর্তৃপক্ষ কারা সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি করে।
তবে কোনো কয়েদি পালিয়েছে কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি গিয়াসউদ্দিন।
No comments