ইস্রাফিল আলমের কবজায় অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় by সোলায়মান তুষার
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অতীশ দীপঙ্কর
বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়েছে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য টক শো কাঁপানো ইস্রাফিল
আলমের বাহিনী। সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ও তার স্ত্রী
এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা।
দখলদারিত্ব পাকাপোক্ত করতে
জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও পরিবর্তন করা হয়েছে। গঠন করা
হয়েছে আরেকটি ট্রাস্টি বোর্ড। সাবেক প্রেসিডেন্টের স্ত্রী অধ্যাপক আনোয়ারা
বেগম ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ও উদ্যোক্তা এবং ট্রাস্টি বোর্ডের
চেয়ারম্যান। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অন্যতম
সদস্য। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে বিতাড়িত করা
হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইস্রাফিল আলম এমপি এখন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের
চেয়ারম্যান। এছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অন্য সদস্যরাও সরকার সমর্থক। আর
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন আবুল হোসেন শিকদার। জাল ও ভুয়া
সার্টিফিকেট দিয়ে তিনি চাকরি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইস্রাফিল আলম কিভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন তা জানতে
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাকে শোকজ করেছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান
অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী মানবজমিনকে জানিয়েছেন, অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমই
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। বিষয়টি নিয়ে অপর পক্ষকে বারবার সতর্ক করেছি।
সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে। অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম
মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ইস্রাফিল আলমের নেতৃত্বে তার বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল
করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে লুটপাট। তাকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
তার ছেলেকেও লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন আনোয়ারা বেগম। তবে ইস্রাফিল
আলম এমপি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইস্রাফিল আলম
কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এজন্য তিনি
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন
জয়েন্ট স্টক কোম্পানির।
ইস্রাফিল আলম যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করেন: ২০১১ সালের ১৮ই মে ইস্রাফিল আলম এমপিকে বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেন চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। ওই বছরের ২৫শে মে ইস্রাফিল আলম এমপি আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে এ সম্পর্কিত একটি চিঠিও দেন ইস্রাফিল। সদস্য হওয়ার পর থেকে তিনি কৌশলের আশ্রয় নেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নানা সময় অসুস্থ থাকায় অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে থাকতে হয়। সে সুযোগটি নেন ইস্রাফিল আলম ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদার। ২০১১ সালের ২৪শে জুলাই বোর্ড অব ট্রাস্টির একটি বিশেষ সভা হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদার। ওই বৈঠকেই ইস্রাফিল আলম এমপিকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। অথচ ওই বৈঠক সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। তাকে অন্ধকারে রেখেই বৈঠকটি করা হয় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। এরপর থেকে ইস্রাফিল আলম বিশ্ববিদ্যালয় দখলের পাঁয়তারা শুরু করেন। ২০১২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ থেকে একই নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন করেন। যার নম্বর এস-১১৫৩৮। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেয়া হয় “ATISH DIPANKAR BIGGAYAN O PROJOKTI BISHAWBIDDALAY TRUST”
অথচ কাগজপত্রে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৪ সালে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ থেকে ‘অতীশ দীপঙ্কর ফাউন্ডেশনের’ নামে রেজিস্ট্রেশন নেন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি অতীশ দীপঙ্কর ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছিল। যার রেজি. নং এস-৪০৮৫(১৮৭)/০৪ (জয়েন্ট স্টক কো.)। পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর আলোকে ২০১১ সালের ২৭শে জুন গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ট্রাস্ট দলিল সম্পন্ন করা হয়। যার নম্বর-৮৬৮১। নতুন আইন অনুযায়ী ২০১২ সালের ১৩ই জুলাই ATISH DIPANKAR UNIVERSITY OF SCIENCE & TECHNOLOGY TRUST-এর নামে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে আবার রেজিস্ট্রেশন নেন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। যার নম্বর এস-৪০৮৫ । ড. আনোয়ারা বেগম হন ওই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তাতে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য করা হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি, ইস্রাফিল আলম এমপি, ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ, মোবারক হোসেন, ফজলুর রহমান, তাহেরুল ইসলাম পাটোয়ারী, আবদুল জব্বার মিয়া, সাবেক প্রেসিডেন্টের ছেলে ইমতিয়াজ আহমেদ, আরিফুল বারী মজুমদার, এবিএম রাশেদুল হাসান, ড. সিরাজুল হক চৌধুরী ও কামরুজ্জামানকে। সাবেক প্রেসিডেন্টে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদের অসুস্থতার কারণে নানা সময় অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে দেশের বাইরে থাকতে হয়। এ সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ড. আবুল হোসেন শিকদারের সহযোগিতায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইস্রাফিল আলম ও ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ২০১১ সালের ১৮ই অক্টোবর ১৬৪৩৮ নম্বর ক্রমিকে ১ঠ-৬২ নং বোর্ড অব ট্রাস্টিজ দলিল এবং ২০১১ সালের ১লা নভেম্বর ১৩৮৪৫ নং ক্রমিকে সংশোধিত বোর্ড অব ট্রাস্টিজ দলিল সম্পন্ন করেন। তাতে মূল ক্যাম্পাস উল্লেখ করা হয়েছে ০৫ দারুস সালাম রোড, সেকশন-০১ মিরপুর। অথচ মূল ক্যাম্পাস অবস্থিত বাড়ী নং-৮৩, রোড নং-০৪, ব্লক-বি, বনানী ঢাকা-১২১৩-তে।
ইস্রাফিলকে ইউজিসির শোকজ: ইস্রাফিল আলম এমপিকে শোকজ করেছে ইউজিসি। ২০১২ সালের ১২ই জুলাই ওই শোকজ করা হয়। অবৈধ প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৮ই অক্টোবর মিরপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ইস্রাফিল আলম এমপিকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়। এছাড়া তাতে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম, আমিন আহমেদ ও মোবারক হোসেনকে সদস্য দেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের মতামত নেয়া হয়নি এবং কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তাদের মতামত ছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন করা হয়। ইউজিসির শোকজ নোটিশে বলা হয়, ইস্রাফিল আলম এমপিকে চেয়ারম্যান করে যে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন করা হয়েছে তা বাতিল বলে গণ্য করা যেতে পারে। ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) শামসুল আলম স্বাক্ষরিত শোকজ নোটিশে বলা হয়, কমিশন মনে করে যে, ড. আনোয়ারা বেগম কর্তৃক গঠিত বোর্ড অব ট্রাস্টিজই অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার বৈধ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে ৫ কার্য দিবসের মধ্যে ইস্রাফিল আলম এমপির বস্তুনিষ্ঠ মতামত জানাতে বলা হয়। ১৯শে জুলাই ইস্রাফিল আলম এমপি একটি মনগড়া জবাব দেন।
সাবেক রেলমন্ত্রীর চিঠি: ২০১২ সালের ১৩ই আগস্ট জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মেসের রেজিস্টার বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। চিঠির শেষ দিকে তিনি লিখেছেন, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৪ সাল থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে। সংরক্ষিত রেকর্ড যাচাই করে ATISH DIPANKAR BIGGAYAN O PROJOKTI BISHAWBID-DALAY TRUST নামে নিবন্ধনের আবেদনটি বাতিল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আপনাকে অনুরোধ করেছে। উল্লেখ্য, ইস্রাফিল আলম এমপি প্রতারণার মাধ্যমে এ নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিবন্ধন নিয়েছেন।
বিতর্কিতরা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য: ইস্রাফিল আলম এমপির নেতৃত্বে বিতর্কিত ব্যক্তিরা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে আছেন। ১৩ জন সদস্যের মধ্যে ৪ জনই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। আর ভিসি ও তার ২ ছেলে রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডে। এরা হলেন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি লিয়াকত শিকদার, মহানগরের সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ হেমায়েত হোসেন, সাবেক সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন অপু ও সাবেক সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ার কবির। অন্যরা হলেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদার, ঢাবি’র লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, তাহেরুল ইসলাম পাটোয়ারী, এবিএম রাশেদুল হাসান, ঢাবি’র সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহীন খান, বর্তমান ভিসির ছেলে ফিরোজ মোহাম্মদ হোসেন, মনজুর মোর্শেদ হোসেন ও জোনায়েদ আহমেদ।
টাকার ভাগ-বাটেয়ারা: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আয়কৃত সব অর্থই ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নিয়ম অনুযায়ী একটি টাকাও কারও পকেটে যাওয়ার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা সম্মানিভাতা দেয়া হয় বলে জানা গেছে। পকেট ভারী করতে খোলা হয়েছে অবৈধ ক্যাম্পাস। অবৈধ ক্যাম্পাস খুলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তথাকথিত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর ৬ (১০) ও ১৩ (২) ধারা অনুযায়ী কোন শাখা ক্যাম্পাস থাকতে পারবে না। অথচ অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও ধানমন্ডি, উত্তরা, পান্থপথ, পল্টন ও মিরপুরে অবৈধভাবে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। যার একটিরও অনুমোদন নেই। সূত্র জানিয়েছে, এসব ক্যাম্পাসে শিক্ষার নামে মূলত সার্টিফিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি বারবার এসব ক্যাম্পাস বন্ধের জন্য নোটিশ দিলেও কোন কাজে আসছে না। সর্বশেষ চলতি বছরের ২১শে জানুয়ারি এসব অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধ করতে ইউজিসি চিঠি দেয়।
জাল সার্টিফিকেটধারী ভিসি: অভিযোগ রয়েছে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদারের বেশির ভাগ সার্টিফিকেটই জাল ও ভুয়া। তার অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডির সার্টিফিকেট জাল ও ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে তদন্তে। প্রো-ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেলেও বর্তমানে আবুল হোসেন শিকদার ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে জীবন বৃত্তান্ত জমা দিয়েছিলেন তার বেশির ভাগই ভুয়া ও বানোয়াট। ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদানের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আতফুল হাই শিবলী, পরিচালক সামছুল আলম ও সহকারী পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা। এ কমিটি তার সনদগুলো যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের সত্যতা পান। তারা ২০১২ সালের ১৪ই মার্চ তদন্ত রিপোর্টে জমা দেন। বর্তমান প্রো-ভিসি ২০০৬ সালে ভারতের রাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের কথা উল্লেখ করলেও তদন্ত পর্যন্ত সনদপত্র পাননি। এছাড়া ২০০৮ সালে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ ক্যাম্পাস থেকে তিনি আরেকটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিরই কোন সনদ নেই। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। তিনি ২০০৭ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করলেও বলেছেন, ২০০৬ সালের কথা। অথচ ২০০৬ সালে তিনি একটি পিএইচডি করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি কিভাবে এমবিএ ও পিএইচডি করলেন? তিনি ২০০৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়’র বাংলাদেশ ক্যাম্পাস থেকে এমপিএইচ ডিগ্রি অর্জনের কথা উল্লেখ করেন, অথচ তা অর্জন করেন ২০০৯ সালে। এটিও বাংলাদেশে অনুমোদিত নয়। ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অর্জনের কথা উল্লেখ করলেও ঢাবি’র রেকর্ডবুকে দেখা যায় তিনি ১৯৮০ সালে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২৭তম স্থান অর্জন করেন। একইভাবে মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান উল্লেখ করলেও তিনি ৩০তম স্থান পেয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এভাবে প্রতিটি সনদের বিপরীতে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। মিথ্যা তথ্য দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় প্রো-ভিসিকে কেন চাকরিচ্যুত করা হবে না তা জানতে চেয়ে শোকজ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত বছরের ১৬ই অক্টোবর ওই শোকজ করা হয়। সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত ভিসি আবুল হোসেন শিকদার বলেন, এ সংক্রান্ত বক্তব্য আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় দখলের অভিযোগ সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের লাখ লাখ টাকা দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত তাদের কিছু সুবিধা দেয়া হয়। টাকা ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম বলেন, ইস্রাফিল আলমের নেতৃত্বে জোরপূর্বক ইউনিভার্সিটি দখল করা হয়েছে। অথচ ইউনিভার্সিটি আমি প্রতিষ্ঠা করেছি। আমিই এর উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, আমাকে ইউনিভার্সিটির কোন প্রোগ্রামে বা অনুষ্ঠানেও দাওয়াত দেয়া হয় না। আমার ছেলে একবার ইউনিভার্সিটিতে গেলে তাকেও লাঞ্চিত করা হয়। ইউনিভার্সিটির কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত ভিসির সার্টিফিকেট সম্পর্কে তিনি বলেন, তার সব কাগজপত্রই ভুয়া। এ বিষয়ে ইস্রাফিল আলম এমপি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড গঠন বৈধ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। তিনি বলেন, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দখলের বিষয়টি সঠিক নয়। ট্রাস্টি বোর্ডে অন্য সদস্যরাও আছেন। এখানে আমি চেয়ারম্যান মাত্র। সঠিক প্রক্রিয়াতেই তাকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে বলে তিনি জানান। আনোয়ারা বেগমের অভিযোগের বিষয়ে ইস্রাফিল আলম বলেন, তিনি তার অভিযোগের পক্ষে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বলেন, অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকেই আমরা স্বীকার করে নিয়েছি। তিনিই অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তার অনুপস্থিতিতে আরেকটা ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা শোকজ করেছি। তিনি বলেন, শুধু ট্রাস্টি বোর্ডই নয়, কিছু অবৈধ শাখাও খোলা হয়েছে। যার অনুমোদন ইউজিসি দেয়নি। অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, বিষয়টি মীমাংসার জন্য আমরা দুই পক্ষকেই বলেছি। তারা সমাধানে আসতে না পারলে আমরা বিষয়টি চ্যান্সেলরের কাছে পাঠিয়ে দেবো।
ইস্রাফিল আলম যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করেন: ২০১১ সালের ১৮ই মে ইস্রাফিল আলম এমপিকে বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেন চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। ওই বছরের ২৫শে মে ইস্রাফিল আলম এমপি আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হন। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে এ সম্পর্কিত একটি চিঠিও দেন ইস্রাফিল। সদস্য হওয়ার পর থেকে তিনি কৌশলের আশ্রয় নেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নানা সময় অসুস্থ থাকায় অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে থাকতে হয়। সে সুযোগটি নেন ইস্রাফিল আলম ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদার। ২০১১ সালের ২৪শে জুলাই বোর্ড অব ট্রাস্টির একটি বিশেষ সভা হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদার। ওই বৈঠকেই ইস্রাফিল আলম এমপিকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। অথচ ওই বৈঠক সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। তাকে অন্ধকারে রেখেই বৈঠকটি করা হয় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। এরপর থেকে ইস্রাফিল আলম বিশ্ববিদ্যালয় দখলের পাঁয়তারা শুরু করেন। ২০১২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ থেকে একই নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন করেন। যার নম্বর এস-১১৫৩৮। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেয়া হয় “ATISH DIPANKAR BIGGAYAN O PROJOKTI BISHAWBIDDALAY TRUST”
অথচ কাগজপত্রে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৪ সালে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ থেকে ‘অতীশ দীপঙ্কর ফাউন্ডেশনের’ নামে রেজিস্ট্রেশন নেন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি অতীশ দীপঙ্কর ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছিল। যার রেজি. নং এস-৪০৮৫(১৮৭)/০৪ (জয়েন্ট স্টক কো.)। পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর আলোকে ২০১১ সালের ২৭শে জুন গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ট্রাস্ট দলিল সম্পন্ন করা হয়। যার নম্বর-৮৬৮১। নতুন আইন অনুযায়ী ২০১২ সালের ১৩ই জুলাই ATISH DIPANKAR UNIVERSITY OF SCIENCE & TECHNOLOGY TRUST-এর নামে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে আবার রেজিস্ট্রেশন নেন অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। যার নম্বর এস-৪০৮৫ । ড. আনোয়ারা বেগম হন ওই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তাতে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য করা হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি, ইস্রাফিল আলম এমপি, ব্যবসায়ী আমিন আহমেদ, মোবারক হোসেন, ফজলুর রহমান, তাহেরুল ইসলাম পাটোয়ারী, আবদুল জব্বার মিয়া, সাবেক প্রেসিডেন্টের ছেলে ইমতিয়াজ আহমেদ, আরিফুল বারী মজুমদার, এবিএম রাশেদুল হাসান, ড. সিরাজুল হক চৌধুরী ও কামরুজ্জামানকে। সাবেক প্রেসিডেন্টে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদের অসুস্থতার কারণে নানা সময় অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকে দেশের বাইরে থাকতে হয়। এ সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ড. আবুল হোসেন শিকদারের সহযোগিতায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইস্রাফিল আলম ও ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ২০১১ সালের ১৮ই অক্টোবর ১৬৪৩৮ নম্বর ক্রমিকে ১ঠ-৬২ নং বোর্ড অব ট্রাস্টিজ দলিল এবং ২০১১ সালের ১লা নভেম্বর ১৩৮৪৫ নং ক্রমিকে সংশোধিত বোর্ড অব ট্রাস্টিজ দলিল সম্পন্ন করেন। তাতে মূল ক্যাম্পাস উল্লেখ করা হয়েছে ০৫ দারুস সালাম রোড, সেকশন-০১ মিরপুর। অথচ মূল ক্যাম্পাস অবস্থিত বাড়ী নং-৮৩, রোড নং-০৪, ব্লক-বি, বনানী ঢাকা-১২১৩-তে।
ইস্রাফিলকে ইউজিসির শোকজ: ইস্রাফিল আলম এমপিকে শোকজ করেছে ইউজিসি। ২০১২ সালের ১২ই জুলাই ওই শোকজ করা হয়। অবৈধ প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৮ই অক্টোবর মিরপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ইস্রাফিল আলম এমপিকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়। এছাড়া তাতে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম, আমিন আহমেদ ও মোবারক হোসেনকে সদস্য দেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের মতামত নেয়া হয়নি এবং কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তাদের মতামত ছাড়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন করা হয়। ইউজিসির শোকজ নোটিশে বলা হয়, ইস্রাফিল আলম এমপিকে চেয়ারম্যান করে যে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন করা হয়েছে তা বাতিল বলে গণ্য করা যেতে পারে। ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) শামসুল আলম স্বাক্ষরিত শোকজ নোটিশে বলা হয়, কমিশন মনে করে যে, ড. আনোয়ারা বেগম কর্তৃক গঠিত বোর্ড অব ট্রাস্টিজই অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার বৈধ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে ৫ কার্য দিবসের মধ্যে ইস্রাফিল আলম এমপির বস্তুনিষ্ঠ মতামত জানাতে বলা হয়। ১৯শে জুলাই ইস্রাফিল আলম এমপি একটি মনগড়া জবাব দেন।
সাবেক রেলমন্ত্রীর চিঠি: ২০১২ সালের ১৩ই আগস্ট জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মেসের রেজিস্টার বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। চিঠির শেষ দিকে তিনি লিখেছেন, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৪ সাল থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে। সংরক্ষিত রেকর্ড যাচাই করে ATISH DIPANKAR BIGGAYAN O PROJOKTI BISHAWBID-DALAY TRUST নামে নিবন্ধনের আবেদনটি বাতিল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আপনাকে অনুরোধ করেছে। উল্লেখ্য, ইস্রাফিল আলম এমপি প্রতারণার মাধ্যমে এ নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিবন্ধন নিয়েছেন।
বিতর্কিতরা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য: ইস্রাফিল আলম এমপির নেতৃত্বে বিতর্কিত ব্যক্তিরা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে আছেন। ১৩ জন সদস্যের মধ্যে ৪ জনই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। আর ভিসি ও তার ২ ছেলে রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডে। এরা হলেন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি লিয়াকত শিকদার, মহানগরের সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ হেমায়েত হোসেন, সাবেক সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন অপু ও সাবেক সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ার কবির। অন্যরা হলেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদার, ঢাবি’র লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, তাহেরুল ইসলাম পাটোয়ারী, এবিএম রাশেদুল হাসান, ঢাবি’র সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহীন খান, বর্তমান ভিসির ছেলে ফিরোজ মোহাম্মদ হোসেন, মনজুর মোর্শেদ হোসেন ও জোনায়েদ আহমেদ।
টাকার ভাগ-বাটেয়ারা: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আয়কৃত সব অর্থই ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নিয়ম অনুযায়ী একটি টাকাও কারও পকেটে যাওয়ার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা সম্মানিভাতা দেয়া হয় বলে জানা গেছে। পকেট ভারী করতে খোলা হয়েছে অবৈধ ক্যাম্পাস। অবৈধ ক্যাম্পাস খুলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তথাকথিত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর ৬ (১০) ও ১৩ (২) ধারা অনুযায়ী কোন শাখা ক্যাম্পাস থাকতে পারবে না। অথচ অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও ধানমন্ডি, উত্তরা, পান্থপথ, পল্টন ও মিরপুরে অবৈধভাবে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। যার একটিরও অনুমোদন নেই। সূত্র জানিয়েছে, এসব ক্যাম্পাসে শিক্ষার নামে মূলত সার্টিফিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি বারবার এসব ক্যাম্পাস বন্ধের জন্য নোটিশ দিলেও কোন কাজে আসছে না। সর্বশেষ চলতি বছরের ২১শে জানুয়ারি এসব অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধ করতে ইউজিসি চিঠি দেয়।
জাল সার্টিফিকেটধারী ভিসি: অভিযোগ রয়েছে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত ভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন শিকদারের বেশির ভাগ সার্টিফিকেটই জাল ও ভুয়া। তার অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডির সার্টিফিকেট জাল ও ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে তদন্তে। প্রো-ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেলেও বর্তমানে আবুল হোসেন শিকদার ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে জীবন বৃত্তান্ত জমা দিয়েছিলেন তার বেশির ভাগই ভুয়া ও বানোয়াট। ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদানের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আতফুল হাই শিবলী, পরিচালক সামছুল আলম ও সহকারী পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা। এ কমিটি তার সনদগুলো যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের সত্যতা পান। তারা ২০১২ সালের ১৪ই মার্চ তদন্ত রিপোর্টে জমা দেন। বর্তমান প্রো-ভিসি ২০০৬ সালে ভারতের রাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের কথা উল্লেখ করলেও তদন্ত পর্যন্ত সনদপত্র পাননি। এছাড়া ২০০৮ সালে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ ক্যাম্পাস থেকে তিনি আরেকটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিরই কোন সনদ নেই। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। তিনি ২০০৭ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করলেও বলেছেন, ২০০৬ সালের কথা। অথচ ২০০৬ সালে তিনি একটি পিএইচডি করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি কিভাবে এমবিএ ও পিএইচডি করলেন? তিনি ২০০৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়’র বাংলাদেশ ক্যাম্পাস থেকে এমপিএইচ ডিগ্রি অর্জনের কথা উল্লেখ করেন, অথচ তা অর্জন করেন ২০০৯ সালে। এটিও বাংলাদেশে অনুমোদিত নয়। ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অর্জনের কথা উল্লেখ করলেও ঢাবি’র রেকর্ডবুকে দেখা যায় তিনি ১৯৮০ সালে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২৭তম স্থান অর্জন করেন। একইভাবে মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান উল্লেখ করলেও তিনি ৩০তম স্থান পেয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এভাবে প্রতিটি সনদের বিপরীতে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। মিথ্যা তথ্য দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় প্রো-ভিসিকে কেন চাকরিচ্যুত করা হবে না তা জানতে চেয়ে শোকজ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত বছরের ১৬ই অক্টোবর ওই শোকজ করা হয়। সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত ভিসি আবুল হোসেন শিকদার বলেন, এ সংক্রান্ত বক্তব্য আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় দখলের অভিযোগ সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের লাখ লাখ টাকা দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত তাদের কিছু সুবিধা দেয়া হয়। টাকা ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম বলেন, ইস্রাফিল আলমের নেতৃত্বে জোরপূর্বক ইউনিভার্সিটি দখল করা হয়েছে। অথচ ইউনিভার্সিটি আমি প্রতিষ্ঠা করেছি। আমিই এর উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, আমাকে ইউনিভার্সিটির কোন প্রোগ্রামে বা অনুষ্ঠানেও দাওয়াত দেয়া হয় না। আমার ছেলে একবার ইউনিভার্সিটিতে গেলে তাকেও লাঞ্চিত করা হয়। ইউনিভার্সিটির কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত ভিসির সার্টিফিকেট সম্পর্কে তিনি বলেন, তার সব কাগজপত্রই ভুয়া। এ বিষয়ে ইস্রাফিল আলম এমপি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড গঠন বৈধ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। তিনি বলেন, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দখলের বিষয়টি সঠিক নয়। ট্রাস্টি বোর্ডে অন্য সদস্যরাও আছেন। এখানে আমি চেয়ারম্যান মাত্র। সঠিক প্রক্রিয়াতেই তাকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে বলে তিনি জানান। আনোয়ারা বেগমের অভিযোগের বিষয়ে ইস্রাফিল আলম বলেন, তিনি তার অভিযোগের পক্ষে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বলেন, অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমকেই আমরা স্বীকার করে নিয়েছি। তিনিই অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তার অনুপস্থিতিতে আরেকটা ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা শোকজ করেছি। তিনি বলেন, শুধু ট্রাস্টি বোর্ডই নয়, কিছু অবৈধ শাখাও খোলা হয়েছে। যার অনুমোদন ইউজিসি দেয়নি। অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, বিষয়টি মীমাংসার জন্য আমরা দুই পক্ষকেই বলেছি। তারা সমাধানে আসতে না পারলে আমরা বিষয়টি চ্যান্সেলরের কাছে পাঠিয়ে দেবো।
No comments