পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন? by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান সংশোধনের বিশেষ কমিটির চূড়ান্ত খসড়া দেশের রাজনৈতিক আকাশকে দ্রুতগতিতে সাংঘর্ষিক রাজনীতির কালো ছায়ায় আবৃত করছে। মাত্র কয়েক দিন আগে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট যেভাবে নির্বাচনের ভরাডুবি মেনে নিয়েছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে সেই মানসিক উত্তরণের জন্য আমাদের আরও অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে—অন্তত রাজনৈতিক দলগুলোর আচার-আচরণ থেকে তা-ই মনে হয়। বর্তমান দলীয় শাসনের অধীনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ একাধিক নির্বাচনে বিরোধী দল বিজয়ী হলেও শুধু দলীয় সরকারের অধীনে কিংবা কোনো সত্যিকারের নিরপেক্ষ পদ্ধতির অধীনে নির্বাচনে পরাজয় যে বিরোধী দল মেনে নেবে না, তা বলাই বাহুল্য। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে আস্থাহীনতার যে প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল, সেই আস্থাহীনতা তো হ্রাস পায়ইনি বরং সময়ের সঙ্গে আরও জোরালো হচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচন কী ব্যবস্থায় করা হবে, তা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনেই পরাজিত দল নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেয় না, সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে পরাজয় মেনে নেওয়ার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পরাজিত দল থেকে আশা করা বাহুল্য মাত্র। তাই সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক সাংঘর্ষিক পরিণতি এড়ানোর জন্য, দেশকে অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং আগামী নির্বাচনপদ্ধতি সরকার ও বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য চিন্তাভাবনা করা উচিত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সূচনায় এটা নিয়ে যতটা গবেষণা, চিন্তাভাবনা করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। এর ফলে প্রতিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অন্তত পরাজিত দলের নানা আপত্তি। বিরোধী দল বরাবরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিশেষ করে, এর প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে সরকারি দলের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারছে না। অবশ্য মতৈক্যে পৌঁছানোর কারণও নেই। সরকারি দল ইচ্ছা করলে প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, সেই সিদ্ধান্তটি যতটা প্রভাবিত করতে পারে, বিরোধী দল তা করতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের নিয়মে সরকারি ও বিরোধী দলের আধিপত্যের ব্যবধান যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ এই মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে সরকারি ও বিরোধী দলের সমান অংশগ্রহণই বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। উভয় দলের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিতকারী ও স্বচ্ছ একটি পদ্ধতির বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো।
প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সম্মতিসূচক স্বাক্ষরসহ ব্যক্তিদের তালিকা সরকারি ও বিরোধী দল তৈরি করবে। এই উভয় তালিকায় যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নাম থাকবে, তাঁদের মধ্য থেকে প্রধান উপদেষ্টা করলে কোনো দলেরই আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ, নামটি তাদের তালিকা থেকেই এসেছে। এ রকম তালিকা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা জাতীয় টেলিভিশনে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন। তালিকায় উপস্থিত নামের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য তালিকা দুটি পেনড্রাইভের মাধ্যমে কম্পিউটারে ইনপুট করা যেতে পারে।
নামের বানান বিভ্রাট কিংবা অসংগতি এড়ানোর জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রকে ব্যবহার করা যেতে পারে। টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগের স্বচ্ছতা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে কোনো দলের অসম্মতি জ্ঞাপন করাও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। যেহেতু কেবল উভয় তালিকায় আছে, এমন ব্যক্তিকেই প্রধান উপদেষ্টা করা হবে, জাতীয় টেলিভিশনে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কালক্ষেপণ যাতে করতে না হয়, তার জন্য কেবল যথাসম্ভব দলনিরপেক্ষ ব্যক্তির নামই উভয় দলের তালিকায় স্থান পাবে।
ধরা যাক, প্রথমে উভয় তালিকায় প্রথম ১০ জনের মধ্যে মিল খোঁজা যেতে পারে। এ রকম একাধিক মিল থাকলে যে নামের জন্য তালিকায় ক্রমিক সংখ্যার যোগফল সবচেয়ে কম (এটা উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে), তাকে বাছাই করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে টাই হলে উভয় তালিকায় ক্রমিক সংখ্যার ব্যবধান যে ক্ষেত্রে কম, তাকে গ্রহণ করা যেতে পারে। এর পরও টাই থাকলে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে একটি মুদ্রা টসের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথম ১০ জনের তালিকায় মিল না হলে প্রথম ২০ জন, না হলে প্রথম ৩০ জনের মধ্যে এই মিল খোঁজা যেতে পারে, যতক্ষণ না মিল পাওয়া যায়। এ রকম একটি অ্যালগরিজমের যাবতীয় প্যারামিটার (প্রথম কত জনের তালিকা থেকে মিল খুঁজতে হবে ইত্যাদি) উভয় দলের সম্মতি নিয়েই নির্ধারণ করা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির সামান্য ব্যবহার থাকলেও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী বর্তমান সরকার প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের এই পদ্ধতিতে জনগণের সঙ্গে সাফল্য ভাগ করে নিতে পারে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সূচনায় এটা নিয়ে যতটা গবেষণা, চিন্তাভাবনা করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। এর ফলে প্রতিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অন্তত পরাজিত দলের নানা আপত্তি। বিরোধী দল বরাবরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিশেষ করে, এর প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে সরকারি দলের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারছে না। অবশ্য মতৈক্যে পৌঁছানোর কারণও নেই। সরকারি দল ইচ্ছা করলে প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, সেই সিদ্ধান্তটি যতটা প্রভাবিত করতে পারে, বিরোধী দল তা করতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের নিয়মে সরকারি ও বিরোধী দলের আধিপত্যের ব্যবধান যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ এই মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে সরকারি ও বিরোধী দলের সমান অংশগ্রহণই বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। উভয় দলের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিতকারী ও স্বচ্ছ একটি পদ্ধতির বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো।
প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সম্মতিসূচক স্বাক্ষরসহ ব্যক্তিদের তালিকা সরকারি ও বিরোধী দল তৈরি করবে। এই উভয় তালিকায় যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নাম থাকবে, তাঁদের মধ্য থেকে প্রধান উপদেষ্টা করলে কোনো দলেরই আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ, নামটি তাদের তালিকা থেকেই এসেছে। এ রকম তালিকা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা জাতীয় টেলিভিশনে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন। তালিকায় উপস্থিত নামের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য তালিকা দুটি পেনড্রাইভের মাধ্যমে কম্পিউটারে ইনপুট করা যেতে পারে।
নামের বানান বিভ্রাট কিংবা অসংগতি এড়ানোর জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রকে ব্যবহার করা যেতে পারে। টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগের স্বচ্ছতা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে কোনো দলের অসম্মতি জ্ঞাপন করাও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। যেহেতু কেবল উভয় তালিকায় আছে, এমন ব্যক্তিকেই প্রধান উপদেষ্টা করা হবে, জাতীয় টেলিভিশনে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কালক্ষেপণ যাতে করতে না হয়, তার জন্য কেবল যথাসম্ভব দলনিরপেক্ষ ব্যক্তির নামই উভয় দলের তালিকায় স্থান পাবে।
ধরা যাক, প্রথমে উভয় তালিকায় প্রথম ১০ জনের মধ্যে মিল খোঁজা যেতে পারে। এ রকম একাধিক মিল থাকলে যে নামের জন্য তালিকায় ক্রমিক সংখ্যার যোগফল সবচেয়ে কম (এটা উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে), তাকে বাছাই করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে টাই হলে উভয় তালিকায় ক্রমিক সংখ্যার ব্যবধান যে ক্ষেত্রে কম, তাকে গ্রহণ করা যেতে পারে। এর পরও টাই থাকলে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে একটি মুদ্রা টসের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথম ১০ জনের তালিকায় মিল না হলে প্রথম ২০ জন, না হলে প্রথম ৩০ জনের মধ্যে এই মিল খোঁজা যেতে পারে, যতক্ষণ না মিল পাওয়া যায়। এ রকম একটি অ্যালগরিজমের যাবতীয় প্যারামিটার (প্রথম কত জনের তালিকা থেকে মিল খুঁজতে হবে ইত্যাদি) উভয় দলের সম্মতি নিয়েই নির্ধারণ করা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির সামান্য ব্যবহার থাকলেও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী বর্তমান সরকার প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের এই পদ্ধতিতে জনগণের সঙ্গে সাফল্য ভাগ করে নিতে পারে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments