ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কিছু সময় by শেখ হাসিনা
২৫ বৈশাখ, ১৪১৭। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম, রাস্তায় রাস্তায় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চানখারপুল হয়ে আমার গাড়ি কারাগারের প্রধান ফটকে পৌঁছাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এই এলাকায় ঘরে ঘরে গিয়েছি। ১৯৫৪ সাল থেকে আমরা ঢাকায় বসবাস শুরু করি। তখন থেকেই এই রাস্তায় যাতায়াত আমাদের এক রকম নিয়মিতই ছিল বলা যায়।
১৯৫৪ সালে আব্বা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। তারপর হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় শাসন চালু হলে এবং ৯২(ক) ধারা দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। আব্বা বন্দী হলেন। সঙ্গে আরও অনেক মন্ত্রী, এমপি। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও তখন বন্দী হন।
সেই থেকেই জেলখানায় আব্বার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতাম আমি, কামাল ও ছোট্ট জামাল। আমরা মায়ের হাত ধরে আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আসতাম। মাসে দুবার দেখা করার সুযোগ পেতাম। এর আগেও আব্বা জেলে ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি বহুবার জেলে গেছেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল একটানা প্রায় তিন বছর জেলে কেটেছে তাঁর জীবন। তার পরও ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৭১ সালে বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সেই জেলখানায় যাচ্ছি। আমরা গেটে পৌঁছালাম। গেট খুলে দেওয়া হলো। গাড়ি ভেতরে নিয়ে গেল। আমার সঙ্গে গাড়িতে বেগম সাজেদা চৌধুরী ছিলেন। আমরা নামলাম। আইজি প্রিজন স্বাগত জানালেন। জেল সুপার, জেলারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা আপা ও স্বরাষ্ট্রসচিব এবং অন্য সবাই আছেন।
আমার বারবার রেহানার কথা মনে পড়ছিল। ওকে সঙ্গে নিয়েই আমার আসার কথা। জেলখানায় দুই বোন একসঙ্গে আসব, এটাই ছিল আমার চিন্তা। কিন্তু আজ রেহানাকে ছেড়ে এসে ভীষণ মন খারাপ লাগছে। যেখানে গাড়িটা থেমেছে, এই রাস্তা দিয়ে আব্বা হেঁটে আসতেন জেলগেটে। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার দিকে। আজ আমি সেই রাস্তায়।
গার্ড অব অনার হলো। আমাদের সেই জায়গায় যেটা দেওয়ানি বলে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একটি বেদি করা হয়েছে, সেই বেদিতে ফুল দিলাম। শামিম শিকদারের নির্মাণ করা ভাস্কর্য এখানে একটা স্তম্ভের ওপর স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টা স্তম্ভের মাঝে মধ্যের স্তম্ভে ভাস্কর্যটা রাখা। বাকিগুলো জলের ফোয়ারা, পানি নামছে বিরাট জলাধারে, টলটলে পানি।
আমগাছটা ঘিরে বেদি করা হয়েছে। যে গাছে হলুদ পাখিরা এসে বসত। অগণিত কণ্ঠের কলকাকলিতে একাকিত্বের ভার লাঘব করত এসব পাখি। নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী ছিল ওরা। আমরা গেলাম সেই ঘরটা দেখতে। টিনের চাল দেওয়া ঘর। ছোট্ট খুপরি জানালা। পাশেই উঁচু দেয়াল। বাতাস আপন মনে আসতে চাইলেও ওই দেয়াল বাধা হয়ে দাঁড়াত। একটা চৌকি আছে, লম্বা ও আড়ে অত্যন্ত ছোট। আব্বা ছয় ফুট লম্বা মানুষ হয়ে কীভাবে ওই ছোট চৌকিতে দিনের পর দিন ঘুমিয়েছেন, ভাবতে অবাক লাগে। একখানা ছোট্ট টেবিল, সঙ্গে কাঠের একখানা চেয়ার। ছোট ছোট হাঁড়ি-কড়াই। চায়ের একটা কাপ। সামান্য কয়েকটা জিনিস রাখা আছে। পাশের দেয়ালে লেখা অজুখানা। সেখানে গিয়ে দেখলাম, একটা গর্ত, ওটা পায়খানা। পাশে একটুখানি জায়গা অজু করার জন্য। সেখান থেকে কিছু দূরে একটা গোসলখানা। একটা চৌবাচ্চা আছে পানি ভরে রাখার জন্য। তার পরই পাকের ঘর। একটা তোলা মাটির চুলা, লাকড়ি দিয়েই রান্না করা হতো। সেখানে গিয়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই ঘরে একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হয়েছে আব্বাকে। ভাবতেও পারি না। আব্বার নিজের হাতে লাগানো সফেদাগাছটা অনেক বড় হয়ে গেছে। বুড়ো হয়ে গেছে গাছটা। কামিনী ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। এখনো আছে গাছটা। ফুলে ফুলে ভরে যায় আর ফুল ঝরায় এই গাছটা। সুগন্ধে ভরে ওঠে সমস্ত এলাকা।
১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি-সনদ ছয় দফা দেওয়ার অপরাধে আব্বা গ্রেপ্তার হন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল তাঁকে। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। নিঃসঙ্গ এই কারাগারে বই পড়া, বাগান করাই ছিল তাঁর একমাত্র অবসর। গান শোনার জন্য একটা টেপরেকর্ডারের আবেদন করেও পাননি। তাঁকে মানসিক নির্যাতন করাই ছিল আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের উদ্দেশ্য। বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি জেলখানা থেকেই পুনরায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় আব্বাকে। এরপর ১৯ জুলাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। মামলা শুরু হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস আমরা জানতেই পারিনি আব্বা কোথায় আছেন, কেমন আছেন।
একটা দেশের মানুষের জন্য একজন মানুষ কতখানি কষ্ট করতে পারেন, কীভাবে জীবন বিপন্ন করতে পারেন, দিনের পর দিন যাতনা ভোগ করেও মানসিক শক্তি সবল রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারেন, তা এখানে এলেই বোঝা যায়। বাংলার মানুষকে গভীরভাবে তিনি ভালোবাসতেন। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। দরিদ্র মানুষের কষ্ট তিনি সইতে পারতেন না। তাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে বাংলার মানুষের মুক্তি কীভাবে দেবেন, সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র স্বপ্ন। দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসাই তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। এত কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতাও তিনি পান দেশের জনগণের ভাগ্য ফেরানোর লক্ষ্যে।
যখনই জেলখানায় গিয়েছি আব্বার সঙ্গে দেখা করতে, তখনই ফেরার সময় কষ্ট যেন বেড়ে যেত। তখন জামাল ছোট ছিল, আব্বাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাইত না। এরপর রেহানা যখন আসত, একই অবস্থা হতো; কিছুতেই আসতে চাইত না। আমি ও কামাল বড় ছিলাম বলে কষ্টটা বাইরে ছোটদের মতো প্রকাশ করতে পারতাম না। সবার বাবা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়, দোকানে নিয়ে যায়, গল্প করে, খেলা করে; আর আমরা শুধুই বঞ্চিত হয়েছি বাবার স্নেহ-আদর-ভালোবাসার সান্নিধ্য থেকে। ছোট্ট রাসেল জেলখানায় গেলে কিছুতেই আব্বাকে ফেলে বাসায় আসবে না। আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় যাবে। আব্বা ওকে বোঝাতেন, ‘এটা আমার বাসা, আমি থাকি। তুমি মায়ের সঙ্গে তোমার বাসায় যাও।’ কিন্তু ছোট্ট রাসেল কি তা শুনত; জেদ ধরত, কান্নাকাটি করত। বাসায় এসে বারবার মাকে জিজ্ঞেস করত, আব্বা কোথায়? মা বলতেন, এই তো আমি তোমার আব্বা। আমাকে তুমি আব্বা বলে ডাকো।
আমরা এখান থেকে গেলাম জাতীয় চার নেতাকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, সেই জায়গায়। সেখানে হেঁটেই গেলাম। আব্বার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান—এই চারজনকে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে কারাগারে বন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে ঢুকে হত্যা করার ঘটনা সভ্য জগতে বোধ হয় এই প্রথম। বাইরে থেকে অস্ত্রধারীরা ঢুকে একের পর এক হত্যা করে এই চার নেতাকে। এখানে বেদিতে ফুল দিলাম। চারটা স্তম্ভে চারজনের ভাস্কর্য করা হয়েছে। পানির ফোয়ারার ভেতরে এই ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হয়েছে। এখনো গরাদে বুলেটের চিহ্ন রয়ে গেছে। দেয়ালের গায়ে যে বুলেটের চিহ্ন ছিল, তা মেরামত করা হয়েছিল বহু আগেই। সেই চিহ্ন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাজউদ্দীন সাহেবের দুই মেয়ে রিমি ও মিমি, মনসুর আলী সাহেবের ছেলে মো. নাসিম এবং কামরুজ্জামান সাহেবের ছেলে রাজশাহীর বর্তমান মেয়র লিটন উপস্থিত ছিল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবেই তাঁরা স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। প্রতিটি সংগ্রামে অংশ নিয়ে জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেছেন। এই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টা ঘাতকের দল মেনে নিতে পারেনি; যে কারণে পরিকল্পিতভাবে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে আর ৩ নভেম্বর জেলখানায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দালালরা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এই জিঘাংসা চরিতার্থ করে। জাতি চিরদিন এই খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণা করে যাবে।
সেখান থেকে ফেরার পথে মহিলা ওয়ার্ডে গেলাম। সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, দীপ্তি আমার সঙ্গে ছিলেন। অনেকেই এই কারাগারে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। তাঁদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যেসব কারারক্ষী সাবজেলে আমার ডিউটি করেছে, তাদের সঙ্গেও দেখা হলো। সেখান থেকে গেটে এলাম। যে কামরায় বসতে দিল, এই কামরায় আব্বার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল।
১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর আমার আক্দ হয় ড. এম এ ওয়াজেদের সঙ্গে। কয়েক দিন পর ইন্টারভিউর অনুমতি পেলে মা আমাকে ও ড. ওয়াজেদকে এখানে নিয়ে আসেন। জেলখানার ফুল দিয়ে আব্বা দুটি মালা তৈরি করেন, বিয়ের প্রথম ফুলের মালা আব্বার হাত থেকে পেলাম। আব্বা মালা পরিয়ে কন্যা সম্প্রদান করেন এই কামরায়। সেই জায়গায় আজ এসে বসলাম।
এক হাজার বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে, সেই ঘোষণা দিলাম। বের হওয়ার পথে দেখতে গেলাম অন্য একটি কামরা। সেখানে সব সময় আব্বার সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশের কামরায় পেলাম সেই টেবিলটা। গোল গোল পায়া দেওয়া একটা টেবিল। এখনো আছে। আমরা ছোটবেলায় ওই টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসতাম। জামাল খুব ছোট ছিল, ওই টেবিলের ওপরই বসিয়ে দিলে খেলা করত। এরপর রেহানা এল আমার মায়ের কোলজুড়ে। রেহানাও খেলা করেছে ওই টেবিলে। কারণ আব্বা তো বারবারই জেলে বন্দী হয়েছেন। এরপর ছোট্ট রাসেল এল আমার মায়ের কোলে। আমাদের সবার আদরের ছোট্ট রাসেলও ওই টেবিলে বসে খেলা করেছে। পেছনে টিনের শেড দেওয়া বারান্দা এখনো ওই রকমই আছে। আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন আব্বা আসবেন। কারণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো। জেলগেটে আসার পর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। অনুমতি এলে ভেতরে গিয়ে বসতাম। আমাদের ভেতরে বসিয়ে তারপর আব্বাকে আনতে যেত। মাত্র আধঘণ্টার জন্য দেখা পেতাম। এর বেশি অনুমতি ছিল না। মা ফ্লাক্সে করে চা বানিয়ে নিয়ে যেতেন, সঙ্গে কিছু নাশতা। আমরা যেখানে বসতাম, সেখানেও গোয়েন্দা সংস্থার দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন। কী কথা হয় না-হয়, বোধ হয় তা ওপরে জানানোর কাজই তাঁদের ছিল।
বিকেল পাঁচটা থেকে প্রায় পৌনে সাতটা পর্যন্ত কারাগারে ছিলাম। সব বন্দীর জন্য বড় খানা দেওয়ার নির্দেশও দিয়ে এলাম। এখানে এসে বারবার এ কথাই মনে হচ্ছিল, আব্বা বাংলার মানুষকে এত ভালোবাসতেন। নিজের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, চাওয়া-পাওয়া সব বিসর্জন দিয়ে এই দুঃসহ কষ্টকে আলিঙ্গন করেছেন শুধু একটাই কারণে, তা হলো বাংলার মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা। নিজের জীবনের কথা একবারও ভাবেননি। আমার মা ছায়ার মতো সারা জীবন তাঁকে অনুসরণ করে গেছেন, কোনো চাওয়া-পাওয়া তাঁর ছিল না। স্বামীকে কতটুকু পেয়েছেন? বছরের পর বছর তো তাঁর জেলে কেটেছে আর বাইরে থাকলে আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। ঘর-সংসার, ছেলেমেয়ে—সব দায়িত্ব আমার মা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেন, যেন স্বামী তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন।
আমার দাদা-দাদির কথা খুব মনে পড়ছে। তাঁরাও এই কারাগারে এসে বন্দী সন্তানকে দেখে গেছেন। আমার আব্বা খুবই সৌভাগ্যবান ছিলেন যে এমন পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। রত্নগর্ভা আমার দাদি; আব্বার প্রতিটি কাজে সহায়তা করেছেন, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন, আর্থিক সহায়তা করেছেন। ছেলে দেশের ও দশের জন্য কাজ করছেন। বাংলার গরিব মানুষের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন—এই গর্ব তাঁদের ছিল। কখনো আমার দাদা-দাদি আব্বার কাজে বাধা দেননি বরং উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। এমন বাবা-মা না হলে, তাঁদের দোয়া না থাকলে মানুষ কি এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে? পারে না। এই দেশের স্বাধীনতার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য গোটা পরিবারকেই আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তবেই না আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি।
আজ স্বাধীনতা সবাই ভোগ করছে, কিন্তু এর পেছনে কত মানুষের কত ত্যাগ, কত কষ্ট, কত সাধনা, তা কি কেউ মনে রাখে?
গণভবন
শেখ হাসিনা: প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
১৯৫৪ সালে আব্বা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন। তারপর হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় শাসন চালু হলে এবং ৯২(ক) ধারা দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে। আব্বা বন্দী হলেন। সঙ্গে আরও অনেক মন্ত্রী, এমপি। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও তখন বন্দী হন।
সেই থেকেই জেলখানায় আব্বার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতাম আমি, কামাল ও ছোট্ট জামাল। আমরা মায়ের হাত ধরে আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আসতাম। মাসে দুবার দেখা করার সুযোগ পেতাম। এর আগেও আব্বা জেলে ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি বহুবার জেলে গেছেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল একটানা প্রায় তিন বছর জেলে কেটেছে তাঁর জীবন। তার পরও ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৭১ সালে বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সেই জেলখানায় যাচ্ছি। আমরা গেটে পৌঁছালাম। গেট খুলে দেওয়া হলো। গাড়ি ভেতরে নিয়ে গেল। আমার সঙ্গে গাড়িতে বেগম সাজেদা চৌধুরী ছিলেন। আমরা নামলাম। আইজি প্রিজন স্বাগত জানালেন। জেল সুপার, জেলারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা আপা ও স্বরাষ্ট্রসচিব এবং অন্য সবাই আছেন।
আমার বারবার রেহানার কথা মনে পড়ছিল। ওকে সঙ্গে নিয়েই আমার আসার কথা। জেলখানায় দুই বোন একসঙ্গে আসব, এটাই ছিল আমার চিন্তা। কিন্তু আজ রেহানাকে ছেড়ে এসে ভীষণ মন খারাপ লাগছে। যেখানে গাড়িটা থেমেছে, এই রাস্তা দিয়ে আব্বা হেঁটে আসতেন জেলগেটে। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম রাস্তার দিকে। আজ আমি সেই রাস্তায়।
গার্ড অব অনার হলো। আমাদের সেই জায়গায় যেটা দেওয়ানি বলে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একটি বেদি করা হয়েছে, সেই বেদিতে ফুল দিলাম। শামিম শিকদারের নির্মাণ করা ভাস্কর্য এখানে একটা স্তম্ভের ওপর স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টা স্তম্ভের মাঝে মধ্যের স্তম্ভে ভাস্কর্যটা রাখা। বাকিগুলো জলের ফোয়ারা, পানি নামছে বিরাট জলাধারে, টলটলে পানি।
আমগাছটা ঘিরে বেদি করা হয়েছে। যে গাছে হলুদ পাখিরা এসে বসত। অগণিত কণ্ঠের কলকাকলিতে একাকিত্বের ভার লাঘব করত এসব পাখি। নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী ছিল ওরা। আমরা গেলাম সেই ঘরটা দেখতে। টিনের চাল দেওয়া ঘর। ছোট্ট খুপরি জানালা। পাশেই উঁচু দেয়াল। বাতাস আপন মনে আসতে চাইলেও ওই দেয়াল বাধা হয়ে দাঁড়াত। একটা চৌকি আছে, লম্বা ও আড়ে অত্যন্ত ছোট। আব্বা ছয় ফুট লম্বা মানুষ হয়ে কীভাবে ওই ছোট চৌকিতে দিনের পর দিন ঘুমিয়েছেন, ভাবতে অবাক লাগে। একখানা ছোট্ট টেবিল, সঙ্গে কাঠের একখানা চেয়ার। ছোট ছোট হাঁড়ি-কড়াই। চায়ের একটা কাপ। সামান্য কয়েকটা জিনিস রাখা আছে। পাশের দেয়ালে লেখা অজুখানা। সেখানে গিয়ে দেখলাম, একটা গর্ত, ওটা পায়খানা। পাশে একটুখানি জায়গা অজু করার জন্য। সেখান থেকে কিছু দূরে একটা গোসলখানা। একটা চৌবাচ্চা আছে পানি ভরে রাখার জন্য। তার পরই পাকের ঘর। একটা তোলা মাটির চুলা, লাকড়ি দিয়েই রান্না করা হতো। সেখানে গিয়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই ঘরে একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে কাটাতে হয়েছে আব্বাকে। ভাবতেও পারি না। আব্বার নিজের হাতে লাগানো সফেদাগাছটা অনেক বড় হয়ে গেছে। বুড়ো হয়ে গেছে গাছটা। কামিনী ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। এখনো আছে গাছটা। ফুলে ফুলে ভরে যায় আর ফুল ঝরায় এই গাছটা। সুগন্ধে ভরে ওঠে সমস্ত এলাকা।
১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি-সনদ ছয় দফা দেওয়ার অপরাধে আব্বা গ্রেপ্তার হন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল তাঁকে। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। নিঃসঙ্গ এই কারাগারে বই পড়া, বাগান করাই ছিল তাঁর একমাত্র অবসর। গান শোনার জন্য একটা টেপরেকর্ডারের আবেদন করেও পাননি। তাঁকে মানসিক নির্যাতন করাই ছিল আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের উদ্দেশ্য। বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি জেলখানা থেকেই পুনরায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় আব্বাকে। এরপর ১৯ জুলাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। মামলা শুরু হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস আমরা জানতেই পারিনি আব্বা কোথায় আছেন, কেমন আছেন।
একটা দেশের মানুষের জন্য একজন মানুষ কতখানি কষ্ট করতে পারেন, কীভাবে জীবন বিপন্ন করতে পারেন, দিনের পর দিন যাতনা ভোগ করেও মানসিক শক্তি সবল রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারেন, তা এখানে এলেই বোঝা যায়। বাংলার মানুষকে গভীরভাবে তিনি ভালোবাসতেন। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। দরিদ্র মানুষের কষ্ট তিনি সইতে পারতেন না। তাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে বাংলার মানুষের মুক্তি কীভাবে দেবেন, সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র স্বপ্ন। দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসাই তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। এত কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতাও তিনি পান দেশের জনগণের ভাগ্য ফেরানোর লক্ষ্যে।
যখনই জেলখানায় গিয়েছি আব্বার সঙ্গে দেখা করতে, তখনই ফেরার সময় কষ্ট যেন বেড়ে যেত। তখন জামাল ছোট ছিল, আব্বাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাইত না। এরপর রেহানা যখন আসত, একই অবস্থা হতো; কিছুতেই আসতে চাইত না। আমি ও কামাল বড় ছিলাম বলে কষ্টটা বাইরে ছোটদের মতো প্রকাশ করতে পারতাম না। সবার বাবা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায়, দোকানে নিয়ে যায়, গল্প করে, খেলা করে; আর আমরা শুধুই বঞ্চিত হয়েছি বাবার স্নেহ-আদর-ভালোবাসার সান্নিধ্য থেকে। ছোট্ট রাসেল জেলখানায় গেলে কিছুতেই আব্বাকে ফেলে বাসায় আসবে না। আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় যাবে। আব্বা ওকে বোঝাতেন, ‘এটা আমার বাসা, আমি থাকি। তুমি মায়ের সঙ্গে তোমার বাসায় যাও।’ কিন্তু ছোট্ট রাসেল কি তা শুনত; জেদ ধরত, কান্নাকাটি করত। বাসায় এসে বারবার মাকে জিজ্ঞেস করত, আব্বা কোথায়? মা বলতেন, এই তো আমি তোমার আব্বা। আমাকে তুমি আব্বা বলে ডাকো।
আমরা এখান থেকে গেলাম জাতীয় চার নেতাকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, সেই জায়গায়। সেখানে হেঁটেই গেলাম। আব্বার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান—এই চারজনকে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে কারাগারে বন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে ঢুকে হত্যা করার ঘটনা সভ্য জগতে বোধ হয় এই প্রথম। বাইরে থেকে অস্ত্রধারীরা ঢুকে একের পর এক হত্যা করে এই চার নেতাকে। এখানে বেদিতে ফুল দিলাম। চারটা স্তম্ভে চারজনের ভাস্কর্য করা হয়েছে। পানির ফোয়ারার ভেতরে এই ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হয়েছে। এখনো গরাদে বুলেটের চিহ্ন রয়ে গেছে। দেয়ালের গায়ে যে বুলেটের চিহ্ন ছিল, তা মেরামত করা হয়েছিল বহু আগেই। সেই চিহ্ন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাজউদ্দীন সাহেবের দুই মেয়ে রিমি ও মিমি, মনসুর আলী সাহেবের ছেলে মো. নাসিম এবং কামরুজ্জামান সাহেবের ছেলে রাজশাহীর বর্তমান মেয়র লিটন উপস্থিত ছিল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবেই তাঁরা স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। প্রতিটি সংগ্রামে অংশ নিয়ে জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছেন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেছেন। এই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টা ঘাতকের দল মেনে নিতে পারেনি; যে কারণে পরিকল্পিতভাবে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে আর ৩ নভেম্বর জেলখানায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দালালরা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এই জিঘাংসা চরিতার্থ করে। জাতি চিরদিন এই খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণা করে যাবে।
সেখান থেকে ফেরার পথে মহিলা ওয়ার্ডে গেলাম। সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, দীপ্তি আমার সঙ্গে ছিলেন। অনেকেই এই কারাগারে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। তাঁদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যেসব কারারক্ষী সাবজেলে আমার ডিউটি করেছে, তাদের সঙ্গেও দেখা হলো। সেখান থেকে গেটে এলাম। যে কামরায় বসতে দিল, এই কামরায় আব্বার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল।
১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর আমার আক্দ হয় ড. এম এ ওয়াজেদের সঙ্গে। কয়েক দিন পর ইন্টারভিউর অনুমতি পেলে মা আমাকে ও ড. ওয়াজেদকে এখানে নিয়ে আসেন। জেলখানার ফুল দিয়ে আব্বা দুটি মালা তৈরি করেন, বিয়ের প্রথম ফুলের মালা আব্বার হাত থেকে পেলাম। আব্বা মালা পরিয়ে কন্যা সম্প্রদান করেন এই কামরায়। সেই জায়গায় আজ এসে বসলাম।
এক হাজার বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে, সেই ঘোষণা দিলাম। বের হওয়ার পথে দেখতে গেলাম অন্য একটি কামরা। সেখানে সব সময় আব্বার সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশের কামরায় পেলাম সেই টেবিলটা। গোল গোল পায়া দেওয়া একটা টেবিল। এখনো আছে। আমরা ছোটবেলায় ওই টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসতাম। জামাল খুব ছোট ছিল, ওই টেবিলের ওপরই বসিয়ে দিলে খেলা করত। এরপর রেহানা এল আমার মায়ের কোলজুড়ে। রেহানাও খেলা করেছে ওই টেবিলে। কারণ আব্বা তো বারবারই জেলে বন্দী হয়েছেন। এরপর ছোট্ট রাসেল এল আমার মায়ের কোলে। আমাদের সবার আদরের ছোট্ট রাসেলও ওই টেবিলে বসে খেলা করেছে। পেছনে টিনের শেড দেওয়া বারান্দা এখনো ওই রকমই আছে। আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন আব্বা আসবেন। কারণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো। জেলগেটে আসার পর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। অনুমতি এলে ভেতরে গিয়ে বসতাম। আমাদের ভেতরে বসিয়ে তারপর আব্বাকে আনতে যেত। মাত্র আধঘণ্টার জন্য দেখা পেতাম। এর বেশি অনুমতি ছিল না। মা ফ্লাক্সে করে চা বানিয়ে নিয়ে যেতেন, সঙ্গে কিছু নাশতা। আমরা যেখানে বসতাম, সেখানেও গোয়েন্দা সংস্থার দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন। কী কথা হয় না-হয়, বোধ হয় তা ওপরে জানানোর কাজই তাঁদের ছিল।
বিকেল পাঁচটা থেকে প্রায় পৌনে সাতটা পর্যন্ত কারাগারে ছিলাম। সব বন্দীর জন্য বড় খানা দেওয়ার নির্দেশও দিয়ে এলাম। এখানে এসে বারবার এ কথাই মনে হচ্ছিল, আব্বা বাংলার মানুষকে এত ভালোবাসতেন। নিজের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, চাওয়া-পাওয়া সব বিসর্জন দিয়ে এই দুঃসহ কষ্টকে আলিঙ্গন করেছেন শুধু একটাই কারণে, তা হলো বাংলার মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা। নিজের জীবনের কথা একবারও ভাবেননি। আমার মা ছায়ার মতো সারা জীবন তাঁকে অনুসরণ করে গেছেন, কোনো চাওয়া-পাওয়া তাঁর ছিল না। স্বামীকে কতটুকু পেয়েছেন? বছরের পর বছর তো তাঁর জেলে কেটেছে আর বাইরে থাকলে আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। ঘর-সংসার, ছেলেমেয়ে—সব দায়িত্ব আমার মা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেন, যেন স্বামী তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন।
আমার দাদা-দাদির কথা খুব মনে পড়ছে। তাঁরাও এই কারাগারে এসে বন্দী সন্তানকে দেখে গেছেন। আমার আব্বা খুবই সৌভাগ্যবান ছিলেন যে এমন পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। রত্নগর্ভা আমার দাদি; আব্বার প্রতিটি কাজে সহায়তা করেছেন, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন, আর্থিক সহায়তা করেছেন। ছেলে দেশের ও দশের জন্য কাজ করছেন। বাংলার গরিব মানুষের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন—এই গর্ব তাঁদের ছিল। কখনো আমার দাদা-দাদি আব্বার কাজে বাধা দেননি বরং উৎসাহ দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন। এমন বাবা-মা না হলে, তাঁদের দোয়া না থাকলে মানুষ কি এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে? পারে না। এই দেশের স্বাধীনতার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য গোটা পরিবারকেই আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তবেই না আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি।
আজ স্বাধীনতা সবাই ভোগ করছে, কিন্তু এর পেছনে কত মানুষের কত ত্যাগ, কত কষ্ট, কত সাধনা, তা কি কেউ মনে রাখে?
গণভবন
শেখ হাসিনা: প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
No comments